আমাদের স্বীকার করতে হবে— ক্ষমতা সব সময়ই মানুষকে বদলায়। কাজেই শাসকের সদিচ্ছা নয়, দরকার একটি প্রতিষ্ঠাননির্ভর, নিয়মতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
Published : 21 Apr 2025, 05:28 PM
বাংলাদেশের রাজনীতি এক দীর্ঘকালের জটিলতা ও পুনরাবৃত্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে এগিয়েছে। ১৯৭১ সালে একটি রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেওয়ার পর এই দেশটি অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন আর অনেক রক্তপাতের ইতিহাস বহন করে চলেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাই— স্বপ্নগুলো অনেকটাই ঝাপসা হয়ে গেছে, আর অর্জনগুলো আংশিক বা ক্ষণস্থায়ী। এই পরিস্থিতির মধ্যেই হঠাৎ একদিন দেশের রাজনৈতিক আকাশে বিদ্যুতের মতো চমক দেখিয়েছিল একদল ছাত্র। ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে তারা যে অভ্যুত্থান ঘটায়, তা সাহস, আবেগ, যুক্তি এবং ঐক্যের এক ব্যতিক্রমী প্রকাশ।
এই অভ্যুত্থান ছিল সংগঠিত রাজনৈতিক দলের ছায়ামুক্ত। এর কেন্দ্র ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মেস, ক্যাম্পাস আর সোশ্যাল মিডিয়ার গোপন গ্রুপ। কোনো নির্দিষ্ট ব্যানার নয়, বরং অসংখ্য হাত একসঙ্গে প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেছিল— বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে। এটি ছিল একটি নতুন রাজনীতির চিহ্ন, যেখানে নেতৃত্ব নয়, সম্মিলিত চেতনা কথা বলে; যেখানে পরিকল্পনা নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্ততা জেগে ওঠে প্রতিবাদে।
ছাত্রদের এই অভ্যুত্থান একদিনে হয়নি। এর পেছনে বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা বঞ্চনা, অবিচার আর প্রতারণার ইতিহাস। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পক্ষপাতমূলক নিয়োগ, হল দখল, ছাত্র রাজনীতির নামে সহিংসতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ— এসব তরুণদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছিল। তার ওপর চাকরির বাজারে দুর্নীতি, বৈষম্য আর মতপ্রকাশের অধিকার হরণ তাদের আর চুপ থাকতে দেয়নি।
এই আন্দোলনের শক্তি ছিল এর ভাষা। তারা যে ভাষায় কথা বলেছিল, তা ছিল অমায়িক, যুক্তিনিষ্ঠ, অথচ দৃঢ়। তারা বলেছিল, ‘আমরা কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবি না; আমরা চাই নতুন নীতি, নতুন কাঠামো।’ এটি ছিল রাজনৈতিক আখ্যানের গতানুগতিক ভাষার বিপরীতে এক অন্তর্মুখী বিপ্লব। মিছিলের ব্যানারে লেখা ছিল, ‘জনগণের ভয় পাওয়াই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা’— এমন কথা শুধু সাহস নয়, গভীর চিন্তারও প্রকাশ।
শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, এমনকি অনেক ছোট শহরের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়েও এই আন্দোলনের ঢেউ পৌঁছে যায়। ছাত্র-ছাত্রীরা একে অপরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে থাকে, ভয় উপেক্ষা করে রাস্তায় দাঁড়ায়। তারা গাইতে শুরু করে নতুন গান, লিখতে শুরু করে নতুন কবিতা, যা পরিণত হয় এক প্রকার সাংস্কৃতিক জাগরণে। এই সময়ের প্রতিটি পোস্টার, দেয়ালচিত্র, ফেইসবুক পোস্ট আর ইউটিউব ভিডিও এক নতুন ইতিহাসের ছবি আঁকে।
এই আন্দোলনের অন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এর অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র। এখানে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র নয়, মাদ্রাসার ছাত্র, ভোকেশনাল শিক্ষার্থী, এমনকি শ্রমজীবী তরুণরাও অংশ নিয়েছিল। এই বৈচিত্র্যই ছিল এর শক্তি। তারা কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ নয়, বরং একটি মানবিক রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে মাঠে নামে। তারা বলেছিল, ‘আমরা চাই রাষ্ট্র আমাদের পাশে দাঁড়াক, আমাদের ঘাড়ে নয়’।
ওই সময় দেশের অনেক প্রবীণ নাগরিক ও বুদ্ধিজীবী এই তরুণদের উৎসাহ দিয়েছিলেন। কেউ সরাসরি রাস্তায় আসেননি, কিন্তু লিখেছেন, আলোচনা করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, এই প্রজন্মের কণ্ঠে তারা আবার ১৯৬৯ কিংবা নব্বইয়ের স্মৃতি খুঁজে পান। তবে তার চেয়েও বড় কথা ছিল সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। ফুটপাতের দোকানদার থেকে শুরু করে গ্রামের কৃষক পর্যন্ত অনেকেই বলেছিলেন— ‘এই ছেলেমেয়েগুলো ঠিক কথা বলছে।’
এই পর্বে আমরা দেখেছি একটি ছাত্র অভ্যুত্থান কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং একটি জাতির নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রচেষ্টা। তারা শাসনের পরিবর্তে সেবার ভাষা চেয়েছিল, ভয়ের পরিবর্তে মানবিকতার ভাষা। এই অভ্যুত্থান এক নতুন সকাল এনেছিল, দেশের রাজনীতির জলাবদ্ধতা ভাঙার জন্য এক প্রবল ঢেউ তুলেছিল।
শাসনের মুখোশ ও পুরনো ধারার প্রত্যাবর্তন
আদর্শিক পরিবর্তনের ডাক দিয়ে যে আন্দোলনের শুরু, তা যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিণত হয়, তখনই প্রকৃত পরীক্ষা শুরু হয়। বাংলাদেশের ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, শাসনের চেয়ারে বসার পর অনেক উচ্চারণ, অনেক শপথ, অনেক প্রতিজ্ঞাই ধীরে ধীরে মুছে যায় অথবা রূপান্তরিত হয়। জুলাই-অগাস্টের ছাত্র গণঅভ্যুত্থান এমন এক ধারা শুরু করেছিল যা বহুদিন পর রাজনৈতিক মঞ্চে মানুষের প্রত্যাশাকে উসকে দিয়েছিল। রাজনীতি যে আবার আদর্শ, স্বপ্ন ও নাগরিক সাহসের দিকে ফিরতে পারে— এই ধারণা কিছুদিনের জন্য হলেও অনেকের মনে আলো জ্বালিয়েছিল। কিন্তু মাত্র আট-সাড়ে আট মাসের ব্যবধানে মানুষ দেখতে পাচ্ছে, ওই স্বপ্ন আবারও ক্লান্ত হয়ে এসেছে। ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর প্রতিশ্রুতি উচ্চারিত হলেও রাষ্ট্র পরিচালনার ধরন, আমলাতন্ত্র-নির্ভরতা, দলীয়করণের ঔদ্ধত্য, ক্ষমতার বলয় এবং সর্বোপরি লোভ ও লাভের পুরনো প্রবণতাগুলো আবার দৃশ্যমান।
এখন অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন, আসলে কি শুধু নেতৃত্ব পাল্টানোই যথেষ্ট ছিল? নাকি পাল্টাতে হতো কাঠামোগত ব্যবস্থা, চিন্তার রূপরেখা এবং প্রতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি? নতুন নেতৃত্ব পুরনো সুবিধাবাদীদের হাতে পড়ছেন, আর মাঠের কর্মীরা হতাশ হচ্ছেন। ফলে সাধারণ মানুষ যেটুকু আশাবাদী হয়েছিল, ওই বিশ্বাসে চিড় ধরছে। কেউ কেউ বলছেন, পরিবর্তনের নামে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস হয়েছে, কিন্তু শাসনের ধরন অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। এই দ্বিচারিতাই মানুষকে ক্রমশ নিস্পৃহ করে তুলছে। আর একবার ধোঁকা খাওয়ার পর সাধারণ মানুষ আর আন্দোলনের পথে ফিরতে চায় না, বরং নিরাপদ দূরত্বে থেকে দেখে— ‘কে কার ঘরে গেল, কে কতটা পেল।’
এই সময়েই প্রয়োজন ছিল গণশক্তিকে সঙ্গে নিয়ে একটি অন্তর্গত সংস্কারমুখী কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, যে পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা, বিচারিক স্বাধীনতা এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতার প্রশ্নকে প্রাধান্য দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই প্রশ্নগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে অস্থিরতা এড়ানোর যুক্তিতে— যা বহুবার ক্ষমতাবানদের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, বিরোধী রাজনীতির যে অংশটি আগে গণতন্ত্রের কথা বলত, তার বড় অংশ এখন আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জাল বুনে ‘পরবর্তী শাসকগোষ্ঠী’ হয়ে ওঠার অপার প্রতীক্ষায় রয়েছে। ফলে ক্ষমতালোভ এবং রাজনৈতিক সুবিধাবাদ দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে মানুষের আশা ও স্বপ্নকে বিভ্রান্ত করছে।
এই প্রেক্ষাপটে কিছু অশুভ লক্ষণও ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ভিন্নমত বা বিশ্লেষণধর্মী কণ্ঠস্বরকে ‘অস্থিতিশীলতা’র দোহাই দিয়ে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে, প্রশ্ন করা হলে তাকে 'পুরনো শিবিরের' লোক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এই চর্চা একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পক্ষে বিপজ্জনক। মনে রাখা দরকার, সত্যিকারের গণতন্ত্রে ভিন্নমত হুমকি নয় বরং তা পথ দেখায়।
অন্যদিকে, বিশ্বজুড়ে রাজনীতির প্রবণতাগুলোতেও একটি বিপজ্জনক মোড় স্পষ্ট হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কিছু অংশে নতুন ধরনের ফ্যাসিবাদ উঠে আসছে, যেখানে অতি-জাতীয়তাবাদ আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ভাঙার চেষ্টা চলছে। ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদদের তৎপরতা এবং কথিত ‘গভীর রাষ্ট্র’ বিরোধিতা আসলে এক নতুন কর্তৃত্ববাদী শাসনের কৌশল, যেখানে তথ্যকে অস্ত্র বানিয়ে বাস্তবকে আড়াল করা হয়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোও আন্তর্জাতিক প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। কাজেই আমাদের দেশে শাসনের ধরন যদি জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও নাগরিক অংশগ্রহণের ভিত্তিতে না গড়ে ওঠে, তবে ভবিষ্যতের রাজনীতি আরও বিপজ্জনক চেহারা নিতে পারে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার মধ্যমণিতে জনগণকে স্থান দেওয়া, রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে নৈতিকতাবোধ পুনরুজ্জীবন করা এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গঠনে একটি স্পষ্ট, বাস্তবভিত্তিক ও মানবিক রূপরেখা তৈরি করা। জুলাই অভ্যুত্থানের অর্জন যে সাহস ও আদর্শিক আহ্বান, তাকে যদি রাজনৈতিক স্বার্থের বলিতে চড়ানো হয়, তবে তা কেবল এই সময়েরই ক্ষতি নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও বিশ্বাস হারানো হবে।
নতুন বাংলাদেশের সন্ধানে— সম্ভবের রাজনীতি ও জনআস্থার পুনর্গঠন
শাসনের পুনরাবৃত্তি, ক্ষমতার আবর্ত, আদর্শহীন আত্মবিস্মৃতি এবং মানুষের প্রত্যাশার ভাঙন— এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসা কি আদৌ সম্ভব? এমন প্রশ্ন আজ অনেকেই উচ্চারণ করছেন এবং কেউ কেউ হয়তো বিরক্তি বা হতাশা থেকেই এ প্রশ্ন তুলে ফেলছেন। কিন্তু ইতিহাস বলে, সমাজ এবং রাজনীতি কখনো স্থির থাকে না। নিরবতা, বিক্ষোভ, আন্দোলন— সবই প্রবহমান এবং তার ভেতরেই আবার জন্ম নেয় নতুন সম্ভাবনা।
জুলাই-অগাস্টের ছাত্র অভ্যুত্থান হয়তো আজ স্তিমিত, কিন্তু তা নিছক একটি ঘটনা নয়; বরং একটি চেতনার বীজ। ওই চেতনা এখন যদি কাঠামোগত সংস্কার, নৈতিক নেতৃত্ব ও সর্বজনীন অংশগ্রহণের দিকে না এগোয়, তবে আগামী দিনের রাজনীতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠবে। নতুন বাংলাদেশের ডাক তখন শুধুই স্লোগান হয়ে থাকবে, কার্যত পুরনো ক্ষমতা কাঠামোর পুনর্নির্মাণে ব্যবহৃত একটি মোড়ক।
সমাজের ভেতরকার বৈষম্য, বৈচিত্র্য ও ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। এসব নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে— আলোচনায়, বিশ্লেষণে এবং প্রয়োজনে নতুন বিকল্প নির্মাণে। এই অবস্থায় দায়িত্ব কিন্তু এককভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নয়, নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী মহল, তরুণ সমাজ ও গণমাধ্যম— সবার।
প্রথমত, নতুন বাংলাদেশ মানে কেবল সরকারের পরিবর্তন নয়; বরং একটি নতুন শাসনচর্চা। যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে জবাবদিহিতা থাকবে। মন্ত্রী নয়, আমলা নয়— প্রধান হবে নীতি ও জনগণ। শাসক ও শাসিতের দূরত্ব নয়, বরং পরস্পরের অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই অংশীদারত্ব রাজনৈতিক কর্মসূচির চেয়েও বড়— এটি একটি সামাজিক চুক্তি, যেখানে প্রতিশ্রুতি থাকবে দীর্ঘমেয়াদি এবং সুফলভোগী হবে কেবল একটি গোষ্ঠী নয় বরং সর্বসাধারণ।
দ্বিতীয়ত, রাজনীতিকে ফের আনতে হবে তরুণদের কাছে। যে তরুণরা ‘নেতার ছবি ছাড়া পোস্টার ছাপায় না’— তাদের ঘাড়ে ভর দিয়ে আবার আদর্শের কথা বলা যায় না। একটি জনকেন্দ্রিক ও নৈতিক রাজনীতি গড়ে তুলতে হলে নেতৃত্বের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, সংস্কৃতি এবং সাহসিকতার পরিসর থেকে। তার মানে রাজনীতিকে ‘দাগী অপরাধী’দের মঞ্চ থেকে বের করে আনতে হবে ‘নতুন মানুষ’ তৈরির ল্যাবরেটরিতে।
তৃতীয়ত, দমন নয়, অংশগ্রহণই গণতন্ত্রের ভিত্তি। ভিন্নমতকে শত্রু নয়, সহযাত্রী ভাবার মানসিকতা তৈরি না হলে মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ পুনর্গঠিত হবে না। একদিকে স্বাধীন গণমাধ্যম, অন্যদিকে কার্যকর স্থানীয় সরকার— এই দুই ভিত্তির ওপরই দাঁড়াবে অংশগ্রহণমূলক বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আজ গণমাধ্যম একদিকে করপোরেট পুঁজি ও রাজনৈতিক আনুগত্যের ছায়ায় পরিচালিত, অন্যদিকে স্থানীয় সরকার নীতিগতভাবে পঙ্গু।
চতুর্থত, আমরা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে চোখ না রাখলে বাস্তববাদী রাজনৈতিক চিত্র আঁকা সম্ভব নয়। আজকের বিশ্বে কর্তৃত্ববাদী শাসনের নতুন নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে এবং এর এক চরম উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতি। ট্রাম্পপন্থী এক শ্রেণি কৌশলে তথ্য বিকৃতি, উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা তৈরি করে গণতন্ত্রকে গিলে খাচ্ছে। এ এক ফ্যাসিবাদের নতুন মুখ— যা সরাসরি ট্যাঙ্ক-তোপ নিয়ে আসে না, বরং আসে আইন, গণমাধ্যম এবং কথার ফাঁদে। বাংলাদেশের রাজনীতি যদি জনগণের শক্তিকে না ভিত্তি করে, তবে এই রূপান্তরের প্রতিধ্বনি এখানেও আসতে পারে। তাই সময় থাকতে সাবধান হওয়া জরুরি।
শেষত, আমাদের স্বীকার করতে হবে— ক্ষমতা সব সময়ই মানুষকে বদলায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধ যদি শক্তিশালী হয়, তবে ব্যক্তির সীমাবদ্ধতাও রোধ করা যায়। কাজেই শাসকের সদিচ্ছা নয়, দরকার একটি প্রতিষ্ঠাননির্ভর, নিয়মতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক সংস্কৃতি। তাহলেই নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন কেবল স্লোগানে আটকে থাকবে না।
আজ যারা সাহস করে প্রশ্ন করছেন, কষ্ট করে আন্দোলন করছেন, যন্ত্রণা নিয়ে নীরব থাকছেন— তাদের কেউ হারিয়ে যাবে না। ইতিহাসে তারা ফিরে আসে— আরও বড় প্রশ্ন, আরও বিস্তৃত আহ্বান নিয়ে। শাসকেরা তাই যদি সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হন, তবে অন্তত প্রশ্নের মুখোমুখি হোন, উত্তর না পারলেও প্রশ্নকে বরণ করুন। তা না হলে যাদের হাতে স্বাধীনতার পুষ্পচিহ্ন তুলে দেওয়া হয়েছিল, তারাই একদিন বিস্মৃত শাসকদের ফুলেল বিদায় জানিয়ে বলবে— তোমরা এসে ছুঁয়েছিলে আমাদের স্বপ্ন, কিন্তু রক্ষা করতে পারোনি।