‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন’… 

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 25 May 2022, 06:40 AM
Updated : 25 May 2022, 06:40 AM

বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো। শুরু থেকেই তার কবিতা পাঠকের প্রাণে নবজাগরণের উদ্দীপনা তৈরি করেছিল। অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সামাজিক অবিচার ও শোষণ-নির্যাতন-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তাকে সহজেই অন্যদের থেকে আলাদা করেছিল। দ্রোহ, প্রেম, দেশাত্মবোধ, অসাম্প্রদায়িক আধুনিক মননের অপূর্ব সংমিশ্রণে নজর কেড়েছিলেন নজরুল। মূলত বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও কাজী নজরুল ইসলাম অনেক প্রেমের কবিতাও লিখেছেন। প্রেম-বিরহ নিয়ে নজরুলের এমন সব কালজয়ী গান আছে যা শুনলে এখনো মানুষ আপ্লুত না হয়ে পারে না। গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ লিখেছেন, তবে তুলনামূলক কম। কিন্তু সেগুলো পাঠক নন্দিত হয়েছে।

বাংলা ১৩০৬ সনের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। সোনার চামচ মুখে নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেননি। তার ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। কবিতা গান অন্য সব রচনার জন্য তিনি খ্যাতি অর্জন করলেও আজীবন তাকে আসলে দুঃখের সঙ্গেই বসবাস করতে হয়েছে, দুঃখ জয়ের সংগ্রাম করতে হয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য রুটির দোকানে যেমন বালকবেলায়ই কাজ করতে হয়েছে, তেমনি কম বয়সে সৈনিক জীবনও বেছে নিতে হয়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে না পারলেও জীবনযোদ্ধা নজরুল ইসলাম সাহিত্যে সমর্পিত হয়ে আলো ছড়িয়েছেন চারদিকে।

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যখন প্রবল হয়ে উঠছিল, তখন বাংলা সাহিত্যে সাহসের ঝড় তুলে উন্নত শির এই কবির আবির্ভাব মানুষকে প্রতিবাদী হতে বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। স্বাধীনতা, সাম্য চিন্তা এবং সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে জাগরণের এক নতুন হাওয়া তৈরি করতে কাজী নজরুল ইসলামের রচনাসমূহ বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।

কবির মৃত্যু হয়েছে ঢাকায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ছয় বছরের মাথায়, বাংলা ১৩৮৩ সনের ১২ ভাদ্র। মসজিদের পাশে তাকে কবর দেওয়ার কথা তার একটি কবিতায় আছে। তাই তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়েছে, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের অতি উৎসাহী তৎপরতায়। এ থেকে কারো মনে হতে পারে যে, নজরুল বুঝি খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন অথবা তার সাহিত্যের মূল উপজীব্য বুঝি ছিল ইসলাম ধর্ম।

কাজী নজরুল মোটেও কোনো ধর্ম-সম্প্রদায়, জাতিগোষ্ঠীর কবি ছিলেন না। এটা সত্য যে, তিনি হামদ, না'ত, গজলসহ অনেক ইসলামী সংগীত রচনা করেছেন, তার লেখায় আরবি-ফারসি শব্দও প্রচুর ব্যবহার করেছেন। আবার তিনি শ্যামা সংগীত, ভজন, কীর্তনও লিখেছেন। হিন্দুদের দেব-দেবী তার লেখায় স্থান পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন উদার ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার একজন মানুষ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চায় তার আগ্রহ দেখা যায়নি। তিনি বিয়ে করেছিলেন হিন্দু নারী প্রমিলা দেবীকে। সন্তানদের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী অনিরুদ্ধ ইসলাম এবং কাজী সব্যসাচী ইসলাম।

ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে নয়, তিনি মানুষকে দেখতেন মানুষ হিসেবে। তিনি লিখেছেন: নদীর পাশ দিয়ে চলতে যখন দেখি একটি লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ প্রশ্ন ভাবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান, একজন মানুষ ডুবছে এইটেই… সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে… মন বলে আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি।

তিনি লিখেছেন: হিন্দু না মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কাণ্ডারি বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।

যারা হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়িতে জাতের মান নির্ধারণ করেন তাদের তিনি 'বেকুব' বলে তিরস্কার করেছেন। ধর্মাচরণ নিয়ে তাকে বিদ্রুপ-গঞ্জনা কম সহ্য করতে হয়নি। আক্ষেপ করে তিনি বলেছেন: "কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মেলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে, আমার গাঁটছাড়ার বাঁধন কাটতে বেগ পেতে হবে না। কেননা একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে আছে ছুরি। বর্তমানে সাহিত্য নিয়ে ধূলোবালি, এত ধোঁয়া, এত কোলাহল উঠছে যে ওর মাঝে সামান্য দীপবর্তিকা নিয়ে পথ খুঁজতে গেলে আমার বাতিও নিভবে, আমিও মরব।"

নজরুল ৭৭ বছরের জীবন পেয়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে ৩৫ বছরই ছিলেন জীবন্মৃত। তিনি তার একটি কবিতায় লিখেছেন: 'তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না, সারাদিনমান কোলাহল করি কারো ধ্যান ভাঙিব না।… নিশ্চল-নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ'।

এ যেন জীবনদ্রষ্টা কবির জ্যোতিষীর মতো নিজের সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী। কবি তো আসলে ভবিষ্যৎদ্রষ্টাই হন। ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৭৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিশ্চল না হলেও নিশ্চুপ ছিলেন ঠিকই।

কাজী নজরুল ইসলাম– বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল, লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন মাত্র ২২ বছর। এই অল্প সময়ে তিনি সাহিত্যের সব শাখায় তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। লেখালেখি ছাড়া পত্রিকা সম্পাদনা এবং রাজনীতিতেও আগ্রহী ছিলেন। একবার তিনি নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন। শিল্পের জন্য শিল্প– এই নীতির পক্ষে তিনি ছিলেন না। তার সব অঙ্গীকার ছিল জীবনকেন্দ্রিক। নজরুলের জীবন ছিল একদিকে ছন্নছাড়া, অন্যদিকে ধূমকেতুর মতো। বেঁচে থাকার জন্য জীবনে তাকে কত কি-না করতে হয়েছে।

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে 'বিদ্রোহী' কবিতা লিখে তিনি প্রথম সাড়া ফেলেন। তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। রচনার সময়কাল ধরলে গত বছর 'বিদ্রোহী'র শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। শত বছর পরেও পাঠককে সমান চনমনে করে তোলে এই কবিতা।

'বিদ্রোহী' কবিতায় তিনি যেমন ভৃগু ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে চেয়েছেন, তেমনি খোদার আসন আরশ ছেদিয়া ওঠার কথাও বলেছেন। অন্যায়-অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতার পাশাপাশি তিনি অনেক প্রেমের কবিতা-গানও লিখেছেন। তার অনেক গান এখনও প্রেমিক-প্রেমিকাদের মুখে মুখে ফেরে। নজরুলের লেখা ও আঙ্গুল বালার কণ্ঠে গীত 'ভুলি কেমনে আজও যে মনে বেদনা সনে রহিল আঁকা' এই গান শুনলে কার মন না আনচান করে! নারীর রূপ ও সজ্জা নিয়ে তার গান তুলনাহীন। 'হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল/ এনে দে এনে দে/ নইলে বাঁধবো না চুল' অথবা 'সুর্মা-পরা আঁখি হানে আসমানে/ জ্যোৎস্না আসে নীল আকাশে তার টানে' এমন আরও অনেক গানে কবি প্রিয়দর্শিনীর রূপ ও সজ্জার মন কাড়া বর্ণনা দিয়েছেন।

সেজন্যই এটা বলা যায় যে দ্রোহ আর প্রেম তার কাছে অভিন্ন ছিল। তিনি লিখেছেন: 'মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হতে রণতূর্য'। তাকে সাম্য ও মানবতার কবিও বলা হয়। কারণ তার কলম থেকেই বেরিয়েছে: 'গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান'।

অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে নজরুলের কলম ছিল ক্ষুরধার। তার অবস্থান ছিল সুন্দরের পক্ষে। তিনি লিখেছেন: 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান/ নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি/ সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি'।

তার কলম থেকেই বেরিয়েছে: 'মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ/ এক সে আকাশ মায়ের কোলে/ যেন রবি শশী দোলে/ এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।'

আবার সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সমান সোচ্চার। লিখেছেন: 'দেখিনু সেদিন রেলে/ কুলি বলে এক বাবুসাব তারে টেনে দিল নিচে ফেলে/ চোখ ফেটে এলো জল/ এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?'

নজরুলের সময়ে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপও কিছু কম হয়নি। তাকে তুচ্ছ করার জন্য 'বালক প্রতিভা' বলা হয়েছে। অর্থাৎ তার পরিণতি আসেনি। কিন্তু যারা এসব করেছে তারা সমাজে প্রভাবকের স্থান পাননি, কেউবা হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে, নজরুল আছেন উজ্জ্বল– দেদীপ্যমান।

বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমর্থন ও অকাতর স্নেহ পেয়েছেন নজরুল। নজরুল সম্পাদিত পত্রিকা 'ধূমকেতু'র জন্য আশীর্বাণীতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন:

আয় চলে আয় রে ধূমকেতু

আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু

দুর্দিনের এই দুর্গশিরে

উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।

অলক্ষণের তিলক রেখা

রাতের ভালে হোক না লেখা

জাগিয়ে দেবে চমক মেরে

আছে যারা অর্ধ চেতন।

ধূমকেতু'তে প্রকাশিত কবিতার জন্য নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কারাগারে রাজবন্দীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল টানা ৪০ দিন অনশন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের দৃঢ়তাকে সমর্থন জানিয়ে লেখেন: "আদর্শবাদীকে আদর্শ ত্যাগ করতে বলা তাকে হত্যা করারই সামিল। অনশনে যদি কাজীর মৃত্যু ঘটে তা হলেও তার অন্তরে সত্য আদর্শ চিরদিন মহিমাময় হয়ে থাকবে।" শেষ পর্যন্ত স্নেহভাজন নজরুলের অনশনে বিচলিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে টেলিগ্রাম করেন: Give up hunger strike. Our literature claims you. কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ নজরুলকে এই টেলিগ্রাম না দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন।

১৯৪১ সালে এক সাহিত্য সভায় নজরুল বলেছিলেন: "যদি আর বাঁশি না বাজে-আমি কবি বলে বলছি না-আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি-আমায় ক্ষমা করবেন-আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি-আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম, সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।"

তিনি লিখেছেন:

আমি চির তরে চলে যাব

তবু আমারে দিব না ভুলিতে…

হ্যাঁ, বাঙালির পক্ষে তাকে ভোলা সম্ভব হবে না কোনো দিন। তিনি বেঁচে থাকবেন তার কালজয়ী সব রচনার মধ্যে। সবচেয়ে বড় কথা সাম্য ও মৈত্রীর পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা থাকবে প্রশ্নাতীত।

নজরুলের আরেকটি গানের অংশবিশেষ:

'আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন

খুঁজি তারে আমি আপনায়

আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি

আমার পিয়াসী বাসনায়…

আমারই রচিত কাননে বসিয়া

পরানু পিয়ারে মালিকা রচিয়া

সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া

আপনারি গলে দোলে হায়'…

সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে খণ্ডিত নজরুল চর্চা পরিহার করা জরুরি। যার 'চির উন্নত শির' বিশ্ব ছাড়ায়ে' উঠেছিল তাকে সম্পূর্ণভাবে খুঁজে নিতে না পারার অক্ষমতা আমরা কী দূর করতে পারব না কোনো কালেই?

কবির জন্মজয়ন্তীতে তার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।