আইনের শাসন: প্রেক্ষিত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ

এ বি এম খায়রুল হক
Published : 10 Oct 2021, 11:56 PM
Updated : 10 Oct 2021, 11:56 PM

আইনের শাসন বা due process of law কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণয়নকারী সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সেটি নিয়ে আলোচ নার মধ্য দিয়েই এ পর্বটি শুরু করা যাক। প্রথমেই বলা প্রয়ােজন যুক্তরাষ্ট্র একটি লিখিত সংবিধান দ্বারা পরিচালিত। এ সংবিধানই পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। চার মাস আলাপ-আলােচনার পর জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে ১৭ সেপ্টেম্বর ১৭৮৭ তারিখে ১৩টি কলােনির প্রতিনিধিরা কলােনির সকল জনগণের পক্ষে সংবিধানে স্বাক্ষর করেন।

এ কারণেই বলা যায় যে কলােনিগুলাের জনগণই সংবিধানের স্রষ্টা। এ প্রসঙ্গে দুইশ বছর ব্গে থমাস পেইনের বক্তব্য প্রণিধানযােগ্য:

A Constitution is not the act of government, but of a people consituting a government, and a government without constituion is power without right….. A constitution is a thing antecedent to a government; and a government is only the creature of a consitution. (1792)

(কনস্টিটিউশন অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ল, হিলারি বারনেট জি, চতুর্থ সংস্করণ, ২০০২)

একইভাবে Yick Wo Vs. Peter Heter Hopkins (১৮৮৫) মােকদ্দমায় যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে বিচারপতি স্ট্যানলি ম্যাথিউস রাষ্ট্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করেন:

When we consider the nature and the theory of our institution of government, the principles upon which they are supposed to rest and review the history of their development, we are constrained to conclude that they do not mean to leave room for the play and action of purely personal and arbitary power. Sovereignty itself is, of course, not subject to law, for it is the author and source of law; but in our system, while sovereign powers are delegated to the agencies of government, sovereignty itself remains with the people, by whom and for whom all government exists and acts.

যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে মােট ৭টি অনুচ্ছেদ (Article)। প্রথম ১০টি সংশােধনী আমেরিকান 'বিল অব রাইটস'  নামে পরিচিত। পরবর্তীতে আরও ১৭টি সংশােধনী সংবিধানে সংযুক্ত হয়।

সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদ (Article 1) কংগ্রেসকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছে। নবম ধারায় নিম্নলিখিত ঘােষণা প্রদান করেঃ

.. The privilege of the writ of habeas corpus shall not be suspended, unless when in cases of rebellion or invasion the public safety may require it. No bill of attainder or ex post facto law shall be passed.

দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ (Article II) যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা সৃষ্টি করে। তৃতীয় অনুচ্ছেদ (Article III) সুপ্রিম কোর্টসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ সৃষ্টি করে। চতুর্থ অনুচ্ছেদ (Article IV) এর ৪র্থ ধারা ঘােষণা করে যে, যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ষষ্ঠ অনুচ্ছেদ (Article VI) সংবিধান ও সংবিধানের আওতায় প্রণীত আইনের শ্রেষ্ঠত্ব ঘােষণা করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে 'Rule of Law' শব্দগুলাে না থাকলেও এর পঞ্চম সংশােধনী (Amendment V) ও চতুর্দশ সংশােধনী (Amendment XIV)-তে 'due process of law' শব্দগুলো রয়েছে। 'due process of law' অর্থ যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া বলেই মনে হয়। তবে 'Rule of Law' বা 'আইনের শাসন' শব্দগুলোর প্রয়ােগ বা ব্যাপ্তি অনেক ব্যাপক। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে স্পষ্ট করে 'Separation of powers' বা ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্বের কথা বলা না হলেও রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ পৃথক পৃথক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে বিধায় 'Founding fathers' বা সংবিধান প্রণেতারা ক্ষমতার বিভাজন গ্রহণ করেছেন বলেই সুপ্রিম কোর্ট মনে করে এবং সকলেই বিভাজন তত্ত্ব অনুসরণও করে।

এবার আইনের শাসনের আলােকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান আলােচনা করা যাক। ১৭৮৭ সালে চার মাস আলাপ আলােচনার পর ১৭ সেপ্টেম্বর ১৭৮৭ তারিখে ১৩টি কলােনির প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রণীত সংবিধান গ্রহণ করেন। ১৭৮৯ সালে সংবিধানটি কলােনিগুলো অনুমােদন করে। সংবিধান আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেসের ওপর আরােপ করে। কংগ্রেসের দুইটি কক্ষ, সিনেট ও হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ। যদি সিনেট ও হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ কর্তৃক প্রণীত আইনে রাষ্ট্রপতি ভেটো দেন তবে তা আইন হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না। আবার দুইটি আইন সভার একটি যদি আইন প্রণয়ন করে, সে আইনে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর প্রদান করলেও তা আইন হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না। এটি এক বিবেচনায় আইনের শাসন।

আবার উপরের তিন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রণীত আইন যদি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলেও আদালত ওই আইন 'Ultra Vires to the Constitution' মর্মে বাতিল করবে।

এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল Marbury Vs. Madison নামে এক বিখ্যাত মামলায়। কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত ১৭৮৯ সালের 'জুডিশিয়ারি অ্যাক্ট' আদালতের 'Original jurisdiction' (মামলার প্রথমবার শুনানি) যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টকে অর্পণ করে। বাদী মারবারি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তার নিয়ােগপত্রটি পাঠাতে বিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডিশনের ওপর 'Mandamus' নির্দেশনা প্রার্থনা করে জুডিশিয়ারির বিধান অনুসারে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে এক মােকদ্দমা দায়ের করেন। 

(*এখানে পাঠকদের সুবিধার জন্য বলে রাখা ভালো- 'Mandamus' হলো নিম্ন আদালত বা সরকারী কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পাদনের জন্য বাধ্য করতে বা নির্দেশ দেওয়ার জন্য উচ্চ আদালত কর্তৃক জারি করা আদেশ।)

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ৩য় অনুচ্ছেদের ২য় ধারা অনুযায়ী, কেবল বিভিন্ন রাজ্যগুলোর মধ্যে মামলা বা নাগরিকদের সঙ্গে রাজ্যের মামলা এবং বিদেশি রাষ্ট্রদূতের করা মােকদ্দমায় সরাসরি শুনানির জন্য দেশটির সুপ্রিম কোর্টের 'Original jurisdiction' ক্ষমতা ছিল। অন্য সবক্ষেত্রে সংবিধান শুধু আপিল শুনানি করার ক্ষমতা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টকে ।

প্রধান বিচারপতি জন মার্শাল তাঁর রায়ে মারবারি কর্তৃক আনীত মােকদ্দমা শুধু খারিজই করেননি, যেহেতু জুডিশিয়ারি আইনের সংশ্লিষ্ট বিধানটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, তাই আইনের ইতিহাসে সর্বপ্রথম 'জুডিশিয়াল রিভিউ' তত্ত্বের অবতারণা করেন। সে আর এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তবে আইনের শাসনের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়?

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সংবিধানের আওতায় যে কোনাে আইন প্রণয়নে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। কিন্তু এক্ষেত্রে কংগ্রেসের প্রণীত আইন প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। যেহেতু সংবিধান কংগ্রেসসহ সকল প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে, সেহেতু কংগ্রেস সংবিধান বহির্ভুত বা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনাে আইন প্রণয়ন করতে পারে না। করলেও তা আইনের শাসন এর ব্যত্যয় হবে কারণ সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন, কংগ্রেস প্রণীত আইন, সংবিধানের অধীনস্ত। এই যুক্তিতে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত আইন বাতিল করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে।

আইনের শাসনের আরও একটি দিক হচ্ছে সংবিধানের অনুশাসন অনুসারে আইন প্রণয়নের সঠিক ব্যবহার। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ফেডারেল সরকার ও স্টেট সরকার কোন কোন ধরনের আইন প্রণয়ন করতে পারবে- তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। স্টেট সরকারের জন্য নির্দিষ্ট ধরনের আইন যদি কংগ্রেস প্রণয়ন করে কিংবা ফেডারেল সরকারের জন্য নির্দিষ্ট ধরনের আইন যদি স্টেট আইন সভা প্রণয়ন করে তবে সুপ্রিম কোর্ট সেই আইনগুলাে বাতিল করে দিতে পারবে।

প্রণীত কোনাে আইন সংবিধান বা প্রথম দশটি সংশােধনী (amendments), যা 'আমেরিকান বিল অব রাইটস' নামে বিখ্যাত, তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় বা আইন যদি ভুল আইনসভা কর্তৃক প্রণীত হয় এবং তা যদি সঠিক কার্যপ্রণালী অনুসারে আদালতের নজরে আনা হয়, তবে আদালত তর্কিত আইনটিকে আইনের শাসন পরিপন্থি বিধায় অবৈধ ঘােষণা করতে পারবে।

এবার আইনের শাসন এর পটভূমিকায় বাংলাদেশের সংবিধানের আলােচনা।

বাংলাদেশ ৩০ লাখ শহীদদের আত্মত্যাগ ও ৪ লাখ মা-বােনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে স্বাধীনতা লাভ করে। ৪ নভেম্বর ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশের সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ তারিখে এই সংবিধান বলবৎ হয়। এর ১৫৩টি অনুচ্ছেদ। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে স্বাধীনতার ঘােষণা হতে সংবিধান বলবৎ পর্যন্ত ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানগুলি সন্নিবেশিত হয়েছে।

সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় প্যারাগ্রাফে 'আইনের শাসন' এর অঙ্গীকার রয়েছে। প্রথম অনুচ্ছেদ বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘােষণা করেছে। সপ্তম অনুচ্ছেদ সংবিধানের প্রাধান্য ঘােষণা করেছে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ঘােষণা করেছে; তৃতীয় ভাগ সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের বিধান করেছে। এই ভাগের ২৬ অনুচ্ছেদ মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্য আইন বাতিল বলে ঘােষণা করেছে। ষষ্ঠ ভাগ সুপ্রিম কোর্টসহ একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ স্থাপন করেছে। সপ্তম ভাগ একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন স্থাপন করেছে।

আইন ও আইনের শাসন প্রক্রিয়া উপযুক্ত প্রতিটি ভাগের প্রতিটি অনুচ্ছেদে প্রস্ফুটিত হয়ে রয়েছে। তবে সংবিধান ও আইনের বইতে আইন ও আইনের শাসন এর কথা লিপিবদ্ধ থাকা এক জিনিস, আর ওই সকল মহান বিধান রাষ্ট্রের বাস্তব প্রক্রিয়ায় প্রতিফলিত হওয়া সম্পূর্ণ আরেক ব্যাপার।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট  রাষ্ট্রপতিকে হত্যা ও অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা হয়। ২০ অগাস্ট সামরিক শাসন জারী ইত্যাদি সবই সংবিধান ভঙ্গ করে করা হয়েছিলা, এই সকল ঘটনা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা, আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি, মহান সংবিধান এবং সংবিধানে ব্যক্ত সকল বিধান থাকা সত্ত্বেও এই রাষ্ট্রদ্রোহিতা ঘটেছিল।

এখানেই শেষ নয়। দেশের রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারের প্রায় সবাইকে যারা হত্যা করলাে তাদেরকে যেন বিচারের সম্মুখীন হতে না হয়, সেজন্য তদানিন্তন শাসকরা ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ তারিখে এক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (Ord. No. I of 1975) জারির মধ্য দিয়ে তথাকথিত আইন করে আইনের শাসনের পথ বন্ধ করে। এই রাষ্ট্র ছিল তখন একটি টোটালাটারিয়ান বা স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে আইনের শাসন কথাটিই ছিল এক নিদারুণ রশিকতা।

১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর দিবাগত গভীর রাতে কিছু সংখ্যক সশস্ত্র ব্যক্তি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে উপস্থিত হয়ে কারাগারের প্রধান ফটক ও অন্যান্য ফটক খােলার হুকুম দেয়। উল্লেখ্য যে রাতে কোনও অবস্থাতেই ফটক খােলা যায় না, অধিকন্তু তাদের কাছে ফটক খােলার কোন লিখিত অনুমতিপত্রও ছিল না। কারাগার-কর্তৃপক্ষ প্রথমে ফটক খুলতে অস্বীকার করলেও, পরে বঙ্গভবন থেকে (তাদের বক্তব্য অনুসারে) নির্দেশ পেয়ে তারা সশস্ত্র ব্যক্তিদের দাবি মতো ফটক খুলে দেয়। তৎপর তারা বাংলাদেশের চার প্রথিতযশা নেতাকে খুন করে চলে যায়।

দুর্ভাগ্যজনক এই কারণে যে মৌখিক নির্দেশ, তা যারই হােক না, কারাগার কর্তৃপক্ষ তা মানতে একেবারেই বাধ্য ছিলেন না। তারা বরঞ্চ যথাযথ কর্তৃপক্ষের লিখিত নির্দেশ ব্যতিরেকে ফটক খুলতে পারেন না। তা সত্ত্বেও আইনভঙ্গ করে তারা ফটক খােলেন। এভাবেই তারা আইনের শাসন ভঙ্গ করেন। ফলে জাতি চারজন নেতা হারান এবং দেশ আবারও কলঙ্কিত হয়।

তিন ব্যক্তি সংবিধান ভঙ্গ করে পর পর দেশের রাষ্ট্রপতি হলেন। প্রথমদিকে এক পুতুল সংসদ ছিল। দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি সেই সংসদও বাতিল করলেন। তৃতীয় রাষ্ট্রপতি এক হ্যাঁ-না ভােটের মাধ্যমে নিজের গদি পাকাপােক্ত করলেন। সেই সময় সংবিধান ভঙ্গ ও আইন ভঙ্গ ও আইনের শাসন ভঙ্গের প্রতিযােগিতা চলছিল। ব্যাপারটা চূড়ান্ত পর্যায়ে গেল ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল যখন নূতন নির্বাচিত সংসদ অধিবেশনের প্রথম কয়েক মিনিটের মধ্যেই ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সকল অবৈধ রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কার্যকলাপের বৈধতা পঞ্চম সংশােধনী আইনের মারফত দেওয়া হলো। এরপর তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এক ঘােষণায় পরদিন ৭ এপ্রিল তারিখে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করেন।

সংসদ সংবিধানের আওতায় সংবিধানে ব্যক্ত কার্যাবলী করতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেও অবৈধ রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কার্যের বৈধতা দিতে পারে না। যা অবৈধ তা অবৈধই থাকবে।

একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলাে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। তদানীন্তন সেনাপ্রধান সংবিধান ভঙ্গ করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন, সামরিক শাসন জারি করেন। চার বছর ধরে সামরিক শাসন চালু থাকে। সামরিক আদালত প্রাণদণ্ড পর্যন্ত দেয়। সামরিক শাসন চার বছর চলার পর তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন হলাে। আবারও জনগণকে ধােকা দিয়ে সংবিধানের সপ্তম সংশােধনীর মাধ্যমে চার বছরের অবৈধ কার্যকলাপের বৈধতা প্রদান করা হলাে। এইভাবেই স্বৈরশাসন তাদের আজ্ঞাবহ সংসদকে দিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের সাথে এবং দেশের সংবিধানের সাথে প্রতারণা করলাে ।

আইনের শাসন এর কথা শুধু সংবিধানের পাতায় লেখা থাকলেই হয় না। মুক্তির কথা, স্বাধীনতার বাণী, আইনের শাসন জনগণের আত্মায় যতক্ষণ না গ্রোথিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনাে সংবিধানই তাদেরকে অধিকার হাতে উঠিয়ে দেবে না, সংবিধানে আইনের শাসনের কথা লেখাই থাকবে তাদেরকে ন্যায় বিচার দেবে না। আইনের শাসন কিভাবে সমুন্নত রাখা যায় সে সম্বন্ধে এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাউজ অব লর্ডসের সাবেক বিচারপতি লর্ড থমাস বিংহাম বলেন:

The judges are not, of course, the only guardians of the rule of law, perhaps not even the most important. Parliamentray and public opinion, informed by the media, should be alert to detect and scrutinize any infringement.

('দ্য রুল অব ল', লর্ড থমাস বিংহাম, পৃষ্ঠা-২২ )

যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিভাজন সংবিধান অনুসারে মেনে চলা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানেও প্রতিটি প্রধান অঙ্গের দায়িত্ব-কর্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ন্যায় পৃথক পৃথকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং একই প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্ব সংবিধানের অংশ করা হয়েছে। তারপরেও আমরা দেখেছি ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত মহান সংসদ বাংলাদেশেও যেকোনও টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্রের ন্যায় (যেমন নাজি জার্মানিতে রাইখস্ট্যাগ হিটলারের বা চিলির ন্যাশনাল কংগ্রেস পিনােসের আজ্ঞাবহ হয়েছিল) সংসদ স্বৈরশাসকদের আজ্ঞাবহ ছিল।

লেসলি স্টিফেন ও হিলারি বারনেট কর্তৃক বক্তব্য অনুযায়ী, সবদেশের জনগণকেই তাদের অধিকার রক্ষার্থে 'Eternal vigilant' বা 'চির সজাগ' থাকতে হয়।

রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গ ও ইহার ক্ষমতাকে কিভাবে আইনের শাসন এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় বা আদৌ রাখা যায় কিনা তা সংক্ষেপে আলােচনা করা দরকার।

এদিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অনেকটাই পরিষ্কার। তারা যুক্তরাজ্যের শাসনতান্ত্রিক 'Dichotomy' (বৈপরীত্য) এর অনিশ্চয়তা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্ব এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে কংগ্রেসকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক রাখতে সক্ষম হয়।

নির্বাহী বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ও তার নিয়ােগকৃত সেক্রেটারি অব স্টেট ও অন্য সেক্রেটারি দ্বারা পরিচালিত হয়। বিচার বিভাগের দায়িত্বে অ্যাটর্নি জেনারেল থাকেন। নির্বাহী বিভাগের সাথে সিনেট বা হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ এর কোনাে সম্পর্ক নেই। বিচার বিভাগও সম্পূর্ণ পৃথক।

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট সেক্রেটারি দ্বারা নিয়ােগপ্রাপ্ত। যদি কোনাে কর্মকর্তা সংবিধান, বিল অব রাইটস বা অন্য কোনাে আইন ভঙ্গ বা মানবাধিকার ভঙ্গের অভিযােগে অভিযুক্ত হন, সে যেই হোন না কেন, তার বিরুদ্ধে ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন। ক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতে মােকদ্দমা দায়ের করতে পারেন, এমনকি তার নির্বাচনী এলাকার জনপ্রতিনিধি বা রিপ্রেজেনটেটিভকে চিঠি দিয়ে অভিযােগ জানাতে পারেন। হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস এর হাউজ কমিটিগুলো অত্যন্ত ক্ষমতাশীল। যে কোনও ব্যক্তিকে কমিটি ডেকে পাঠিয়ে পরীক্ষা করতে পারে, এরপর তাকে বিচারের সম্মুখীন করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের মত বাংলাদেশের লিখিত সংবিধান থাকলেও, ক্ষমতা পরিচালনার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের শাসন ব্যবস্থার সাথে মিল রয়েছে। মােটা দাগে যুক্তরাজ্যে নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে কেবিনেট। কেবিনেটের প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য রয়েছে একজন করে মন্ত্রী। মন্ত্রীরা একদিকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য,, অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী প্রধান। প্রত্যেক মন্ত্রী তাদের নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী কেবিনেটের সার্বিক দায়িত্বে থাকলেও প্রত্যেক মন্ত্রী তার মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত সকল বিভাগের কাজের জন্য বা কোনাে ব্যর্থতার জন্য হাউজ অব কমন্স এর কাছে দায়বদ্ধ। একেই বলে 'Ministerial Responsibility'। এটিই যুক্তরাজ্যের শাসন ব্যবস্থার সৌষ্ঠব।  এই পদ্ধতিতেই অর্থাৎ হাউজ অব কমন্সের কাছে দায়বদ্ধতার মধ্য দিয়েই সেখানে আইনের শাসন নিশ্চিত করা হয়।

সরকারের যে কোনও কাজের জন্য সার্বিকভাবে কেবিনেট এবং প্রতিটি মন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের কাজের জন্য বা গৃহীত পদক্ষেপের জন্য হাউজ অব কমন্সে সংসদ সদস্যদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, কৈফিয়ত দিতে হয়। প্রশ্নোত্তর পর্বে সাংসদরা প্রশ্নে প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীকে বিপর্যস্ত করে ফেললেও উপায় থাকে না। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমর্থনে ইরাকে যুক্তরাজ্য সেনাবাহিনী পাঠালে প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে হাউজ অব কমন্সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে সাংসদদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এই কয়েক বছর আগে হাউজের সম্মুখে ব্রেক্সিট চুক্তির সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারায় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে-কে অশ্রুসিক্ত অবস্থায় পদত্যাগ করতে হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকেও ব্রেক্সিট চুক্তির জন্য হাউজে প্রশ্নবানে রীতিমত জর্জরিত হতে হয়েছিল। তাকে ২০২০ সালের মার্চ মাসে এবং এর পরে বিভিন্ন সময়ে কোভিড সংক্রমণ রােধে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বারবার হাউজে প্রশ্নোত্তরের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমনকি নিজের বাসভবনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মাধ্যমে দেশবাসীকে কোভিড-১৯ সম্বন্ধে তথ্য জানাচ্ছেন। এটাকেই বলে সরকারের জবাবদিহিতা।

১৯৭৩ বা ১৯৭৪ সালের ঘটনা। যুক্তরাজ্যের একজন মন্ত্রী একটা অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছেন। সেখানে মন্ত্রীকে দামী একটি ফুলদানি উপহার দেয়া হলাে। পরে প্রকাশ পেল, যে সংস্থার পক্ষ হতে ওই উপহার দেয়া হয়েছিল তারা একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের কিছু কাজও তারা করেন। ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা তাদের কাজের কোনাে খবরই মন্ত্রীর জানা ছিল না, কিন্তু তবুও তিনি সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। একেই বলে আইনের শাসন।

যুক্তরাজ্যে ও বাংলাদেশের সরকারী কর্মকর্তারা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরিতে প্রবেশ করেন এবং সাধারণভাবে অবসর নেওয়ার বয়স পর্যন্ত চাকরি করেন। যদিও দুই দেশেই মন্ত্রীরা পরিবর্তন হন। তবে যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা শুধু সরকারের জন্যই বিশুদ্ধ ও নির্মোহভাবে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করেন, কোন রাজনৈতিক দল সরকারে আছে তা কখনােই তাদের মাথাব্যথার কারণ হয় না। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের সরকারী কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও একই মাপকাঠি প্রযােজ্য হওয়ার কথা।

যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে সরকারী কর্মচারীদের আইন ভঙ্গ করা বা আইনকে 'টুইস্ট' করার প্রবণতা কম। তারা যে খুব সাধুমন্ত তা নয়, তবে তারা জানেন যে ধরা পড়লে তাদের ক্যারিয়ার বা পেশাগত জীবন শেষ। তাছাড়া, ওই দেশে কোনাে সরকারি কর্মচারী কোনাে অপরাধমূলক কাজ করলে এবং ধরা পড়লে যে কোনাে সাধারণ অপরাধীর মতােই তাদের বিচার হয়। কোনাে ক্ষমা নেই। এ জন্যই ওই দুই দেশের সরকারকে বলা হয় 'গভর্নমেন্ট আনডার ল'। যত বড় কর্মকর্তাই হােন, আইনের শাসন বা due process of law এর মধ্য দিয়েই তাকে যেতে হবে, যেমন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিচারক সিরিকা তদানীন্তন রাষ্ট্রপতিকে হােয়াইট হাউজের কথােপকথনের টেইপ আদালতে জমা দেবার হুকুম করেছিলেন।

যে সব দেশে রাজনৈতিক প্রভুকে খুশি রাখার জন্য সরকারি কর্মকর্তারা আইনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন, তারা হয়তাে নিজেদের অজান্তেই দেশকে টোটালাটারিয়ান বা স্বৈরশাসনের দিকে নিয়ে যায়, এভাবেই আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটে।

তবে সরকারি কর্মচারীদেরকে খুব বেশি আইনের নিগড়ে বেঁধে রাখলে তাদের পক্ষে কাজ করা মুশকিল হয়। কারণ সরকারি কাজে কারও কারও সিদ্ধান্ত নিতেই হয় এবং সব সিদ্ধান্ত সব সময় সঠিক নাও হতে পারে, সেক্ষেত্রে তাদের সরাসরি দায়ী করলে তারাও কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে চাইবেন না। ফলে সরকারেরই কাজের ক্ষতি হবে। কাজেই তাদের বিবেচনা অনুসারে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে, কিছুটা বিধি বিধানের আওতায় রাখতে হবে, কিছুটা মনিটরিং বা তদারকির মধ্যে রাখতে হবে, কিছুটা বিশ্বাসও করতে হবে, না হলে সরকারই স্থবির হয়ে যাবে, তবে কোনটা কতটুকু তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীই আত্মবিবেচনায় ঠিক করবেন। এখানে কোনাে 'রুল অব থাম্ব' নেই।

আগের তিন পর্ব