আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ‘ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্ব’

এ বি এম খায়রুল হক
Published : 10 Oct 2021, 01:36 AM
Updated : 10 Oct 2021, 01:36 AM

গ্রিক দার্শনিকরা, বিশেষ করে অ্যারিস্টোটল, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে একটি রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের প্রয়ােজনীয়তা উল্লেখ করে তাদের পৃথক ও স্বাধীন দায়িত্ব কর্তব্যের কথা উল্লেখ করেন। মধ্যযুগে হবস, জন লক এবং ইংলিশ চ্যানেলের দুই পাশের দার্শনিকরা এমন এক আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করতেন যেখানে রাজা বা রাজতন্ত্রের কোনাে ছেদ ঘটে না (The King is dead, long live the King)। অর্থাৎ শাসনযন্ত্রের পরম্পরা সবসময় বজায় থাকবে। পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করবে, রাজকর্মচারীরা সেই আইন অনুসারে রাজকার্য পরিচালনা করবেন। আইনের ব্যত্যয় হলে বিচারকরা সে আদেশ-নির্দেশ বাতিল করতে পারবেন। এ তিনটি অঙ্গের দায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যে যদি বিভাজন না থাকে, এক অঙ্গ অন্য অঙ্গের কাজে হস্তক্ষেপ করে তাহলে রাজ্যের প্রজারা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারে, যার প্রতিশ্রুতি রাজা তার রাজ্যাভিষেকে দিয়েছিলেন। এই চিন্তা থেকেই জন লক ১৬৯০ সালে তার সেকেন্ড ট্রিটিজ অব সিভিল গভর্নমেন্টে লিখলেন:

It may be too great a temptation to human frailty, apt to grasp at power, for the same persons who have the power of making laws, to have also in their hands the power to execute them, whereby they may exempt themselves from obedience to the laws they make, and suit the law, both in its making and execution, to their own private advantage.

(কেইসেস অ্যান্ড ম্যাটেরিয়ালস অন কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ল, মাইকেল অ্যালেন এবং ব্রায়ান থম্পসন, পৃষ্ঠা-৩০) 

এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৪৮ সালে ফরাসি চিন্তাবিদ ব্যারন দ্য মন্তেস্কিউ তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'এল এসপি দে লোয়া'-তে আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ- রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অঙ্গ বা বিভাগের উল্লেখ করেন। তিনি এই বিভাগগুলোর বর্ণনা করতে গিয়ে বিখ্যাত 'দ্য প্রিন্সিপাল সেপারেশন অব পাওয়ারস' বা 'ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্ব' নিয়ে আলোচনা করেন। এই গ্রন্থ ১৭৫০ সালে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়।

মন্তেস্কিউ মনে করতেন রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গগুলির মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন না থাকলে সাধারণ মানুষের মুক্তি বাধাগ্রস্ত হবে। এমনকি ন্যায় বিচার সুদূর পরাহত হবে। তিনি তার গ্রন্থে বললেন-

When the Legislative Power is united with the Executive Power in the same person or body of magistrates, there is no liberty because it is to be feared that the same Monarch or the same Senate will make tyrannical laws in order to execute them tyrannically. There is no liberty if the Judicial Power is not separated from the Legislative Power and from the Executive Power. If it were joined with the Legislative Power, the power over the life and liberty of citizens would be arbitrary, because the Judge would be the Legislator. If it were joined to the Executive Power, the Judge would have the strength of an oppressor. All would be lost if the same man, or the same body of chief citizens, or the nobility, or the people, exercised these three powers, that of making laws, that of executing public decisions, and that of judging the crimes or the disputes of private persons.

(কেইসেস অ্যান্ড ম্যাটেরিয়ালস অন কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ল, মাইকেল অ্যালেন এবং ব্রায়ান থম্পসন, পৃষ্ঠা-৩০-৩১ থেকে উদ্ধৃত)।

ইংল্যান্ডের দার্শনিক ও রাজনীতি শাস্ত্রের পণ্ডিতদের কাছে এই 'ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্ব' সমাদৃত হলেও তদানিন্তন রাজনীতিবিদদের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণযােগ্য হয়নি। যদিও মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের শেষভাগ থেকে ধীরে ধীরে এ তত্ত্ব প্রভাব বিস্তার আরম্ভ করে।

তবে ১৮ শতকে আমেরিকায় 'ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্ব' যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। এমনকি ১৭৮১ সালে ইংরেজ সেনাপতি লর্ড কর্নওয়ালিশ আত্মসমর্পন করলে যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক অবস্থান নিয়ে যখন ১৩টি কলােনির বোদ্ধারা বিভিন্ন পত্রিকায় নানান অভিমত প্রকাশ করছেন, তখন 'ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্ব' তাদের আলােচনায় ছিল। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত অ্যালেকজান্ডার হ্যামিল্টন, জন জে জেস এবং জেমস ম্যাডিসনের বক্তব্য থেকে তত্ত্বটির গ্রহণযােগ্যতা প্রতীয়মান। পরবর্তীতে যদিও এ তত্ত্ব স্পষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে কথিত না হলেও ১৮০৩ সালে বিখ্যাত মােকদ্দমা 'মারবারি বনাম ম্যাডিসন' মামলায় বিভাজন তত্ত্ব প্রধান বিচারপতি জন মার্শাল রায়ে গ্রহণ করেন। অনেক পরে হলেও ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এ দেশগুলির সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় পরােক্ষভাবে 'বিভাজন তত্ত্ব' গ্রহণ হয়। তবে সুযােগ পেলেই এ তত্ত্ব রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ-ভঙ্গ করতে দ্বিধা করে না।

যেহেতু 'বিভাজন তত্ত্বে'র যথাযথ প্রয়ােগ ব্যতিরেকে প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন কার্যকারণ সঠিকভাবে পরিচালনা সম্ভব নয়, মানুষের অধিকার রক্ষাও ক্ষুণ্ণ হয়, এমনকি ন্যায়বিচার তথা আইনের শাসনও ব্যহত হতে পারে, সেহেতু এ তত্ত্ব নিয়ে কিছুটা আলােচনা করা হলাে।

উপরােক্ত আলােচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সাথে আইনের শাসন প্রক্রিয়া শুধু অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িতই নয়, বরঞ্চ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক।

আইন সভা বা সংসদ সম্বন্ধে বলতে গেলে প্রথমেই 'ওয়েস্টমিনিস্টার পার্লামেন্ট' এর কথা চলে আসে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজার পরেই এই প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ ।

১০৬৬ সালে নরমান বিজয়ের আগে ইংল্যান্ডে 'বিজ্ঞ' জনের সভা হতাে। নরমান বিজয়ের পর রাজাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য 'বিজ্ঞজনে'র সভার বদলে Curia Regis (কিংস কোর্ট)  সৃষ্টি করা হয়। ১২৭৫ সালে রাজা প্রথম এডওয়ার্ড ওয়েস্টমিস্টারে একটি প্রথম জেনারেল পার্লামেন্ট আহ্বান করেন এবং স্ট্যাচু অব ওয়েস্টমিনিস্টার স্বাক্ষর হয়। প্রথম এডওয়ার্ড ১২৯৫ সালে পুনরায় একটি পার্লামেন্ট আহ্বান করেন। ওই পার্লামেন্টে ব্যারন, নাইটস, বার্গেস (তৎকালীন ব্রিটেনে পূর্ণ নাগরিক অধিকারসম্পন্ন নগরবাসী) এবং ধর্মযাজরা যােগ দেন। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম জাতীয় পার্লামেন্ট। বর্তমান পার্লামেন্টের এইভাবে সূচনা।

'কুইন-ইন-পার্লামেন্ট' স্বার্বভৌম বা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এটি যেকোনও আইন প্রণয়ন করতে ক্ষমতাবান। ডাইসির ভাষায়- এই পার্লামেন্ট একজন পুরুষকে নারী বা একজন নারীকে পুরুষে রূপান্তর করা ব্যতিরেকে সব কিছুই করতে সক্ষম।

স্যার আই্ভর জেনিংস তার 'কেবিনেট গভর্নমেন্ট' গ্রন্থে পার্লামেন্ট সম্বন্ধে ইংল্যান্ডবাসীদের অনুভূতি এইভাবে প্রকাশ করেন:

The constitutional authorities… exercised law-making functions and the people has acquiesced in their exercise. Revolution has … produced, instead, the recognition of a rule that Parliament can legislate as it pleases and that what Parliament enacts is law ..

তাত্ত্বিকভাবে পার্লামেন্ট যে কোনও আইন প্রণয়ন করতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেও ম্যাগনা কার্টা, পিটিশন অব রাইট, বিল অব রাইটস পরিপন্থি কোনাে আইন পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণয়নের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, করলেও দেশের জনগণ তার মােকাবেলা করবে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত চিন্তাবিদ লেসলি স্টিফেন ১৮৮২ সালে লিখিত 'দ্য সায়েন্স অব এথিকস' গ্রন্থে পার্লামেন্টের আইন প্রণয়নের স্বাধীনতা সম্পর্কে বলেন:

It is, of course, omnipotent in the sense that it can make whatever laws it pleases, … But from the scientific point of view the power of the legislature is, of course, strictly limited. It is limited, .. because the legislature is the product of a certain social condition, and determined by whatever determines the society; and… because the power of imposing laws is dependent upon the instinct of subordination, which is itself limited. (Cret-309)

এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ১৯৭২ সালে আমি তখন লন্ডনে। যুক্তরাজ্য ইউরােপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে যাচ্ছে। চারদিকে সবাই ভীষণ উৎসাহী। হাজার বছরের পাউন্ড, শিলিং, পেন্স, ফারদিং এর জায়গায় নতুন মুদ্রা চালু হলাে, ওজনেও পাউন্ডের বদলে কিলােগ্রাম এলাে। সবার মনে যেন এক উৎসবের আনন্দ। পার্লামেন্ট ইউরােপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার লক্ষে আইন প্রণয়ন করলাে। ৪৪ বছর পরে যুক্তরাজ্যের অধিবাসীরা আবার গণভােট করে ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে রায় দিল। পার্লামেন্টও দেশের লােকদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার পক্ষে আবার আইন প্রণয়ন করলাে। এতেই বােঝা যায় যে দেশের লােকেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে পার্লামেন্ট কতখানি গুরুত্ব দেয়, মূল্য দেয়। এটাই 'Representative Government' বা প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ও গণতন্ত্রের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ১৯৭২ সাল ও ২০১৭ সালের দুই আইনই দেশের মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন, সেহেতু এই দুই বিপরীতমুখী ক্ষেত্রেই পার্লামেন্ট আইনের শাসনের পরিচয় দিয়েছে।

তবে এমন ঘটনাও আছে যেখানে পার্লামেন্ট যে কনভেনশন মেনে চলে সেটির পরিপন্থি পদক্ষেপ নিয়েছে।

১৭৬০ এর দশকে আমেরিকার কলােনি থেকে বেশি কর আদায়ের জন্য ওয়েস্টমিস্টার পার্লামেন্ট বেশ কয়েকটি আইন পাস করে। ওই আইনগুলো 'ফাইভ ইনটলারেবল অ্যাক্টস' নামে কুখ্যাত। কলােনিগুলোর পক্ষে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন লন্ডনে বিভিন্ন সাংসদ বা মেম্বার অব পার্লামেন্টকে বােঝানোর বৃথাই চেষ্টা করলেন যে- যেহেতু কলােনি থেকে কোনও প্রতিনিধি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নির্বাচিত হওয়ার সুযােগ নেই এবং যেহেতু ব্রিটিশ সরকার 'প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার তত্ত্ব' অনুসরণ করে, সেহেতু ওই তত্ত্ব অনুসারে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কলােনিগুলোর অধিবাসীদের ওপর কোনরূপ কর আরােপ করতে পারে না। কিন্তু বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের কোনাে আবেদন-নিবেদন-যুক্তি পার্লামেন্টের কোনাে সদস্য পাত্তাই দিল না। তার ফলে যা হলাে তা ইতিহাস। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার নিজেদের কনভেনশন নিজেরাই ভঙ্গ করে আইনের শাসন এর ব্যত্যয় ঘটিয়েছিল।

আদালত কর্তৃক পার্লামেন্ট বা সংসদ প্রণীত কোন আইনে হস্তক্ষেপ করার সুযােগ খুবই সীমিত। সাধারণভাবে ইংল্যান্ডের কোনাে আদালত সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না, তবে প্রণীত আইনটি ব্যাখ্যা করতে পারে এবং সেই ব্যাখ্যা সকলের উপর বাধ্যকর। তাছাড়া, আইন প্রণয়নে কুইন-ইন-পার্লামেন্ট এর বিভিন্ন ধাপ ও কার্যপ্রণালী রয়েছে। আইন প্রণয়নে যদি কার্যপ্রণালী সঠিকভাবে অনুসরণ করা না হয়, তবে আদালত আইনটিকে অবৈধ ঘােষণা করতে পারে। ন্যায় বিচারের স্বার্থে আদালত এও ঘােষণা করতে পারে যে, পার্লামেন্ট যে উদ্দেশ্য নিয়ে আইনটি প্রণয়ন করেছিল সে উদ্দেশ্য (Intents and objects) অনুসারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে এইচ ডাব্লিউ আর ওয়েড তার 'অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ল' গ্রন্থের ৪১৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন:

The Courts may presume the Parliament, when it grants powers, intends them to be exercised in a right and proper way. Since Parliament is very unlikely to make provision to the contrary, this allows considerable scope for the Courts to devise a set of canons of fair administrative procedure, suitable to the needs of the time.

তবে যদি এমন হয় যে পার্লামেন্টের প্রণীত আইন এমনই অযৌক্তিক ও অসঙ্গত যা ব্যাখ্যা করা কঠিন সেক্ষেত্রে আদালত কী করতে পারে? ১৬০০ সালে ড. বোরহাম মােকদ্দমায় 'কোর্ট অব কমন প্লিজ' আদালতের প্রধান বিচারপতি স্যার এডওয়ার্ড কোক বলেন:

When an Act of Parliament is against right and reason or repugnant or impossible to be performed, the common law will control it and adjudge that Act to be void.

(হোয়াট নেক্সট ইন দ্য ল, লর্ড ডেনিং, ৩১৯ পৃষ্ঠা হতে উদ্ধৃত)

কোক এর মতাদর্শ সমকালীন আর একজন বিচারক সমর্থন করেন। Day vs Savage মােকদ্দমায় প্রধান বিচারপতি হোবার্ট বলেন:

.. even an Act of Parliament made against natural equity, as to make a man judge in his own case is void itself, for jura natural sunt immutabilia and they are leges lagumes. 

(অ্যাডিমিনিস্ট্রেটিভ ল, এইচ ডাব্লিউ আর ওয়েড, ১৯৮২ সালের সংস্করণের ৪১৮ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত)।

তবে ১৬৮৮ সালে ব্রিটেনের রাজা জেমসকে রক্তপাতহীনভাবে মহান বিপ্লবের করে সরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে আইন প্রণয়নে পার্লামেন্ট এর সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আদালত কর্তৃক এইরূপ ক্ষমতা স্বীকৃতও বটে, সেক্ষেত্রে ১৭ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রদত্ত উপরােক্ত রায় দুইটির গ্রহণযােগ্যতা সন্দেহাতীত নয়। বরঞ্চ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়নের এই ক্ষমতা সর্বজনস্বীকৃত। বিল অব রাইটস এর নবম অনুচ্ছেদ নিম্নরূপ:

Proceedings in Parliament ought not to be impeached or questioned in any court or place out of Parliament i

এই শতাব্দিতেও পার্লামেন্ট এবং সর্বোচ্চ আদালতের ক্ষমতার সীমানা সম্বন্ধে প্রশ্ন পরােক্ষভাবে হলেও যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখে  (on the application of Miller and another) Respondents Vs. Secretary of State for Exiting the European Union … Appellant, [2017] UKSC5 মােকদ্দমায় উঠে আসে।

ওই মােকদ্দমায় আদালতের সম্মুখে প্রশ্ন ছিল- ইউরােপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে আসার জন্য যুক্তরাজ্যের নিজস্ব আইন অনুসারে পদক্ষেপ নিতে পারবে কিনা? নির্দিষ্ট বিচার্য বিষয় ছিল:

Whether a formal notice of withdrawal can lawfully be given by ministers without prior legislation passed in both Houses of Parliament and assented to by HM The Queen.

এই মােকদ্দমায় প্রধান রায় দেন ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট লর্ড নিওবার্গার। তার রায়ের ৩য় দফায় পার্লামেন্ট ও আদালতের ক্ষমতার সীমানা সম্বন্ধে এইভাবে আলােকপাত করেন:

It is worth emphasising that nobody has suggested that this is an inappropriate issue for the courts to determine. It is also worth emphasising that this case has nothing to do with issues such as the wisdom of the decision to withdraw from the European Union, the terms of withdrawal, the timetable or arrangements for withdrawal, or the details of any future relationship with the European Union. Those are all political issues which are matters for ministers and Parliament to resolve. They are not issues which are appropriate for resolution by judges, whose duty is to decide issues of law which are brought before them by individuals and entities exercising their rights of access to the courts in a democratic society.

রায়ের পরবর্তী পর্যায়ে মােকদ্দমার বিচার্য বিষয় নির্ধারণ করতে গিয়ে লর্ড নিওবার্গার বলেন:

.. as we have concluded, ministers cannot give Notice by the exercise of prerogative powers, only legislation which is embodied in a statute will do….

Thus, the referendum of 2016 did not change the law in a way which would allow ministers to withdraw the United Kingdom from the European Union without legislation.

এই রায় থেকে প্রতীয়মান হয় যে গণভােট (referendum) এর যথেষ্ট রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকলেও আইন প্রণয়ন ব্যতিরেকে যুক্তরাজ্য ইউরােপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। ২০১৭ সালের এই রায় যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত আইন প্রণয়নে পার্লামেন্টের 'সর্বময় ক্ষমতা' পুনরায় ঘােষণা করে।

বিচার ব্যবস্থার অবস্থানও রায়টি এইভাবে পুনর্ব্যক্ত করে:

Judges therefore are neither the parents nor the guardians of political conventions; they are merely observers. As such, they can recognize the operation of a political convention in the context of deciding a legal question… but they cannot give rulings on its operation or scope, because those matters are determined within the political world. ..

এই মােকদ্দমায় ব্যক্ত বিচার বিভাগের এই অবস্থান সকল দেশের সকল বিচারকদের জন্য শিক্ষণীয়।

এইবার একটি কল্পিত ঘটনা চিন্তা করা যাক। পার্লামেন্ট যদি সম্পূর্ণ বাস্তবতাবর্জিত আইন করে বসে, যা কোনওভাবেই বলবৎ করা সম্ভব নয়? এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের আদালত স্থবির থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু সাধারণ মানুষ, পার্লামেন্ট সদস্যরা  যাদের  প্রতিনিধিত্ব করেন, তারা নিজেরাই সমাধান করবে। এই সম্বন্ধে লেসলি স্টিফেন ১৮৮২ সালে কী চিন্তা করেছেন দেখা যাক:

If a legislature decided that all blue-eyed babies should be murdered, the preservation of blue-eyed babies would be illegal; but legislators must go mad before they could pass such a law, and subjects be idiotic before they could submit to it.

('দ্য সায়েন্স অব এথিকস' এর ১৩৭ পৃষ্ঠা হতে উদ্ধৃত)

পার্লামেন্ট আইন প্রণয়নে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেও এর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে লেসলি স্টিফেনের এই বক্তব্য অধ্যাপক ডাইসিও সমর্থন করেন:

The combined influence both of the external and of the internal limitation on legislative sovereignty is admirably stated in Leslie Stephen's Science of Ethics, whose chapter on 'Law and Custom? contains one of the best statements to be met with of the limits placed by the nature of things on the theoretical omnipotence of sovereign legislatures.

(ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য স্টাডি অব দ্য ল অব দ্য কনস্টিটিউশন, এ ভি ডাইসি, ৮১ পৃষ্ঠা, ইএলবিএস এডিশন. ১৯৬৮) 

আইন প্রণয়নে পার্লামেন্ট যত ক্ষমতাই থাকুক জনগণের অনুভূতি জনগণের কথাই আইনের শাসন, শেষ হাসিটা জনগণেরই। এ কারণেই হিলেয়ার বার্নেট তার 'কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ল' বইতে বলেছেন:

The law is not autonomous but rest on the support of those it governs. The law is the servant of the sense of rightness in the community, and whilst the rule of law places law above every individual irrespective of rank and situation-it remains, paradoxically, subject to the ultimate judgment of the people.

পার্লামেন্ট যে কীভাবে জনজীবনে প্রভাব ফেলে তার একটা উদাহরণ টানা যেতে পারে কোভিড-১৯ এর সময়ে যুক্তরাজ্যে সরকারের সংকট মােকাবেলার ধরন দেখে। সংকটের শুরুতেই ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনাভাইরাস অ্যাক্ট-২০২০ প্রণয়ন করা হয়। এরপর এই আইনেরই বিধান অনুসারে সরকার এক এক করে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া আরম্ভ করে। একেই বলে আইনের শাসন বা সরকারকে বলে গভর্নমেন্ট আন্ডার ল। কারণ যা কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সবই আইনের আওতায়।

লেসলি স্টিফেন উপরে বর্ণিত উদাহরণে পার্লামেন্ট যদি অযৌক্তিক কোনাে আইন প্রণয়ন করে তখন কী কর্তব্য সেটির ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট যদি জনগণের নিকট আগ্রহণযােগ্য কোনাে রায় প্রদান করে, তাহলে কী হবে? লেসলির ইঙ্গিত এখানেও কার্যকর বলে ধারণা করা যায়। যদি না অবশ্য সংসদ ওই রায় 'সুপারসিড' বা রহিত  করে আইন প্রণয়ন করে; যেমন, ভারতে Shah Banoo মােকদ্দমার ক্ষেত্রে ঘটেছিল।

আগের দুই পর্ব