প্রয়োজন গাণিতিক হিসেবনিকেশ বিবেচনায় নেওয়া

আবু সাইয়ীদ
Published : 21 April 2021, 07:54 PM
Updated : 21 April 2021, 07:54 PM

গত ১৪ এপ্রিল ২০২১ থেকে সরকারী ভাষায় সর্বাত্মক বা কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে যা চলার কথা ছিল ২১ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়েছে, এখন চলবে ২৮ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের হার যেভাবে বাড়ছিল তাতে লকডাউনের আর বিকল্প কিছু ছিল না এবং সংক্রমণের হার কিছুটা কমলেও এখনো লকডাউনের প্রত্যাহারের সময় আসেনি, বরং বলা চলে লকডাউন লকডাউন ২৮ মের পরেও, আরও তিন-চার সপ্তাহ চলা উচিত। বিশেষ করে যখন ঢিলেঢালাভাবে কঠোর লকডাউন পালিত হচ্ছে, যথার্থ লকডাউন পালিত হলে অর্থাৎ কলকারখানা বন্ধ থাকলে, রাস্তায় লোকজনের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে লোকজনের চলাফেরা প্রায় শূন্যের কোঠায় আনতে পারলে ১৫ দিনে যে সুবিধে পাওয়া যেত, বর্তমান লকডাউনের ধরণে ৪৫ দিনেও তা পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। কর্মের সাথে ফলাফল নির্ভর করে, এ বিষয়ে গণিত কিছু নিয়মকানুন মেনে চলে- গোঁজামিল দিয়ে গাণিতিক হিসেব মেলানো যায় না।  

জীবিকার কারণে, ব্যবসাবাণিজ্য তথা অর্থনীতির চাকা সচল রাখায় ২৮ এপ্রিলের পরে লকডাউনের মেয়াদ আর বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে না, এমনটা ধরে নেওয়া যায়। কারণ বাংলাদেশের ব্যবসাবাণিজ্যের একটি বড় অংশ অনেকটাই ঈদ নির্ভর। ঈদ পর্যন্ত লকডাউন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো বাস্তবতা বাংলাদেশের নাই। 

যদি ২৮ এপ্রিলের পর থেকে ঈদ পর্যন্ত আর লকডাউন না থাকে, যদি শুরু হয় অবাধ বাণিজ্য এবং চলাচল– তার ভয়াবহ প্রভাব পড়বে করোনা সংক্রমণের উপর- এটা অনেকটাই অনুমিত। মার্চ মাসে কিছু জাতীয়, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কর্মকাণ্ড করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। ঈদ এবং ঈদ প্রাক্কালীন কর্মকাণ্ডও করোনার সংক্রমণ অনেকটা বাড়িয়ে দেবে এটাই স্বাভাবিক। তাই এ বিষয়টা সরকারকে এখনই গভীর পর্যালোচনায় এনে, ২৮ এপ্রিলের পর থেকে ঈদ পর্যন্ত বাংলাদেশে, বিশেষ করে শহর এলাকায় ব্যবসাবাণিজ্য এবং জনসাধারণের চলাচল কী প্রক্রিয়ায় চলবে, গাণিতিক হিসেবনিকেশের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

৩০ দিনের বিপণন কর্মকাণ্ড যদি ১৫ দিনে সম্পন্ন করতে হয়, যদি বাণিজ্যের পরিমাণ এবং ক্রেতার সংখ্যা প্রায় অভিন্ন থাকে তাহলে কর্মতৎপরতা বিবেচনায় ৩০ দিনের বিপণন কর্মকাণ্ড এবং ১৫ দিনের বিপণন কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিরাট ফারাক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা হিসেবে ৩০ দিনে অর্থাৎ ৩৬০ ঘণ্টায়, ধরে নেওয়া যায় আনুমানিক ৫০ লাখ মানুষ যে জনঘনত্ব তৈরি করবে ১৫ দিনে ১৮০ ঘণ্টায় জনঘনত্ব তার দ্বিগুণ হবে। অর্থনৈতিক দুরাবস্থা বা অন্য কোনও কারণে যদি বাজারঘাটে মানুষের উপস্থিতি ১৫-২৫ ভাগ কমও হয়, তারপরেও জনঘনত্বের পরিমাণ যা হবে তা করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য বিপদজনক। এরপরে প্রায়ই দেখা যায়, সরকার ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এমন ভুল সিদ্ধান্ত যদি এই ক্ষেত্রেও হয়, অর্থাৎ বিপণন সময় কমিয়ে দেয়, ধরা যাক সরকার ঘোষণা দিল ৬টার পরে মার্কেট বন্ধ থাকবে বা এমন কিছু, তাহলে শুধু বিপণন এলাকায় নয় পথেঘাটেও জনঘনত্বের পরিমাণ বেড়ে যাবে। আর জনঘনত্বের পরিমাণ যত বেশি, করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা তত বেশি। এরপরে যদি কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে তাহলে তো আর কোন কথাই নেই! হঠাৎ ঝড় বা হঠাৎ বৃষ্টি, কিছু কিছু স্থানে গাদাগাদি করে মানুষের নিরাপদ আশ্রয় নেওয়া- মানে করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেওয়া।    

৩৬০ ঘণ্টার কর্মযজ্ঞ যেহেতু ১৮০ ঘণ্টায় সারতে হবে এবং জনসমাবেশ যেন তীব্র আকার ধারণ না করে তাই সরকারকে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে।  এ সিদ্ধান্ত হতে হবে গাণিতিক হিসেবের উপর ভিত্তি করে। সরকার মাঝেমাঝেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তা বিবেচনায় আনলে বোঝা যায় সরকারের গাণিতিক বোঝাপড়ার মধ্যেই নেই। 

কয়েকদিন আগে ব্যাংকের লেনদেনের সময়সূচি করা হলো সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। পরিণতিতে যা হবার তাই হলো ব্যাংকের ভেতরে বাইরে গাদাগাদি ভিড়। একটি আবদ্ধ ঘরে অনেকক্ষণের জন্য অপেক্ষা করতে হলো গ্রাহকদের। প্রতিটি মুহূর্তেই করোনা ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ ব্যাংকিং সময় সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত হলে এ ঝুঁকিতে পড়তে হতো না গ্রাহককে। যেহেতু ওই সময় একটি নিয়ম করা হয়েছে যে সন্ধ্যে ৬টার মধ্যে সবাইকে বাড়ি ফিরতে হবে, তাই হয়তো ব্যাংকে কর্মরত মানুষদের কথা বিবেচনায় নিয়ে ওই নিয়ম করা হয়েছি। কিন্তু ব্যাংকে কর্মরতদের ৬টার মধ্যে সবাইকে বাড়ি ফিরতে হবে- এই নিয়মের বাইরে রেখে, বিশেষ পরিবহন ব্যবস্থায় যদি বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে এ ঝুঁকি এড়ানো যেতো। 

ঈদ বিপণনের ৩৬০ ঘণ্টার কর্মযজ্ঞ ১৮০ ঘণ্টায় সারতে চাইলে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। তাই ১৫ দিনে ৩৬০ ঘণ্টার কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করতে হবে এবং পাশাপাশি পদক্ষেপ নিতে হবে বিপণন স্থানের পরিসরের বৃদ্ধি ঘটানোর। এ না হলে ঈদের কয়েকদিন আগে থেকে না হলেও ঈদের পরে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার আরও ভয়াবহ হবার সম্ভাবনা বেশি। 

বিপণনের সময় বৃদ্ধির একমাত্র উপায় হচ্ছে বিপণন কেন্দ্রসমূহের সময়সূচী বাড়িয়ে দেওয়া। বিপণন কেন্দ্রসমূহ ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা। বর্তমান বাস্তবতায় অনেকেই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। রোজার মাসে সেহেরি পর্যন্ত বা সেহেরির পরেই কেনাকাটা করতে অনেকেরই কোন সমস্যা হবার কথা নয়। অনেক দেশেই সারা রাত বিপণন বিতান খোলা থাকে। ঢাকা শহরেও কিছু হোটেল, ফার্মেসি এবং চা-সিগারেটের দোকান সারা রাত খোলা থাকে। এর জন্য সরকারের দিক থেকে বাড়তি যে পদক্ষেপ নিতে হবে তা হলো রাত্রিকালীন নিরাপত্তা। রাতের বেলায় যেন কোন বিদ্যুৎ বিভ্রাট না হয় সেদিকে নজর রাখা। আর দোকান মালিকদের যা করতে হবে তা হলো কর্মচারীদের দিন এবং রাত, এই দুই শিফটে ভাগ করে দেয়া। পরিবহন ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। সাধারণত সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত গণপরিবহন চালু থাকে- এ সময়ে রাত ১২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্তও কিছু পরিবহন চালু রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। 

আরেকটি বিষয়ে সরকারকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে তা হলো শুধু ছোটবড় রেস্টুরেন্ট নয়, রাস্তার ধারের ছোটছোট চায়ের দোকানেও কেউ যেন কোন আহার গ্রহণ এবং চা পান করতে পারে না। মাস্ক না খুলে কোন খাবার গ্রহণ বা চা পান করার সুযোগ নেই। যিনি বাইরে থাকবেন, বায়ু প্রবাহ না থাকলে তার ৬ ফুট দূরে যদি কেউ থাকেন তাহলে মাস্ক খুলতে পারবেন না। আর বায়ু প্রবাহ থাকলে কোন পরিস্থিতিতেই মাস্ক খোলা যাবে না। 

এমনটাই সবার জানা ছিল যে শীতে করোনার সংক্রমণের হার বেশি হবে এবং গরমে কমবে কিন্তু তা হচ্ছে না আমাদের দেশে মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত করোনা ভাইরাস অধিক সংক্রমিত হচ্ছে আমার পর্যবেক্ষণে এর মূলে রয়েছে বায়ু প্রবাহ চৈত্র মাস থেকে আমাদের দেশে বায়ু প্রবাহ শুরু হয় গরমের কারণে আমরা বৈদ্যুতিক পাখা এবং এসি ব্যবহার শুরু করি শীতে বায়ু প্রবাহ না থাকায় মিটারের মধ্যেই করোনা ভাইরাস মাটিতে পতিত হয় কিন্তু মার্চ মাস থেকে বায়ু প্রবাহ শুরু হওয়ার পর, ভাইরাস অনেকটা সময় বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে কখনো কখনো দমকা হাওয়ার কারণে মাটিতে পড়ে থাকা ভাইরাসও আবার বাতাসে ভাসতে থাকে বৈদ্যুতিক পাখা এবং এসি' বাতাসের কারণে ঘরের ভেতরেও করোনা ভাইরাস কিছুটা সময় ভেসে বেড়াতে পারে তাই আমার বিবেচনায় সময়ে আমরা সার্বক্ষিনিক মাস্ক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সংক্রমণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি তবে লকডাউন উৎকৃষ্ট পন্থা নিয়ে আমি  গত ৩১ মার্চ আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলামএর পরে দেখলাম 'করোনা ভাইরাস বায়ুবাহিত' বলে ল্যানসেট এ একটি গবেষণা প্রকাশ হয়েছে সুতরাং বায়ু প্রবাহকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে 

বিপণনের স্থানের সীমানা বৃদ্ধি ঘটানোটা খুবই জরুরী এতে বিভিন্ন স্থানে জনঘনত্ব অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবেঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে ফুটপাতে প্রচুর দোকান বসেএই দোকানগুলির ক্রেতা এবং পথচারীদের নিয়ে এক ধরনের মানব জটলা তৈরি হয়, যা করোনা সংক্রমণের জন্য বিপদজনক। এ ক্ষেত্রে ঈদের আগে ফুটপাতের সকল বিক্রেতাকে সরিয়ে নিয়ে আশেপাশের কোন স্কুল, কলেজ বা সরকারী অফিসের বেইজমেন্টে, যদি ফাঁকা থাকে, স্থানান্তরিত করা হবে যৌক্তিক।  

করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করে একে নির্মূল করার একমাত্র পথ পরিপূর্ণ লকডাউন, এর কোন বিকল্প নেই। লকডাউনের ধরন নির্ধারণ করবে কতটা সংক্রমণের হার কমানো সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশে যে ধরনের লকডাউন হচ্ছে তাতে সর্বোচ্চ ৬০ ভাগ সুবিধা পাওয়া যেতে পারে এর বেশি নয়। কারণ নামে কঠোর লকডাউন হলেও একে ঢিলাঢারা লকডাউনই বলা চলে। সংক্রামণের হার শূন্যে এনে একে চিরতরে বিদায় করা সম্ভব একমাত্র পূর্ণ লকডাউন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। 

এ ছাড়া ভবিষ্যৎ ভাইরাসের ছোবল থেকে বাঁচতে আমাদের বিবিধ পদক্ষেপ নিতে হবে- এ নিয়ে আমি গত বছর ৩টি লেখা লিখেছিলাম। বিশ্ববাসীর কাছে খোলা চিঠি, বিশ্ববাসীর কাছে খোলা চিঠি-২, বিশ্ববাসীর কাছে খোলা চিঠি-৩ লেখা তিনটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে এ ছাপা হয়েছিল। এ লেখা ৩টির প্রয়োজনীয়তা এখনও শেষ হয়ে যায়নি, তাই লেখা ৩টি পড়ার অনুরোধ করবো।  

দুর্ভাগ্য যে দু-তিনটি দেশ বাদে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের সরকার করোনা মোকাবেলায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি। মনে হচ্ছে না যে তারা কখনোই গাণিতিক হিসেবনিকেশ করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং ভবিষ্যতেও গ্রহণ করতে পারবে। এরা মেনেই নিয়েছে এবং সেইমত প্রচারপ্রপাগাণ্ডাও চালাচ্ছে যে দীর্ঘদিন আমাদের করোনা নিয়েও বাঁচতে হবে। 

জীবন জীবিকাবর্তমান সময়ে শব্দ দুটি বহুল উচ্চারিত রাষ্ট্রগুলো দায় নিতে না পেরে, যথাযথ ভূমিকা পালন করতে না পেরেজীবিকার কথা বলে এবং অতীত মহামারীর ফিরিস্তি গেয়ে করোনাকে দীর্ঘমেয়াদী করলো। ভাইরাস সংক্রমণে অনেকের জীবন গেল- সাথে অনিশ্চিত করা হলো কোটি শিশুর ভবিষ্যৎভাবা হলো না এবং বিবেচনায় নেওয়া হলো না তাদের শিক্ষা জীবনকে কেউ ভাবছে না শিশুরা কেমন আছে? ভাবা হচ্ছে না শিশুসহ আপামর জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা।