বিশ্ববাসীর কাছে খোলা চিঠি- ০২

আবু সাইয়ীদ
Published : 24 May 2020, 02:34 PM
Updated : 24 May 2020, 02:34 PM

প্রিয় বিশ্ববাসী,

সম্প্রতি "বিশ্ববাসীর কাছে খোলা চিঠি" শিরোনামে জনৈক বিশ্ববাসীর একটি চিঠি আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। চিঠিটি আমি মনোযোগ সহকারে পাঠ করেছি। পত্রদাতা ছোট একটি চিঠিতে অনেক বিষয়ে দৃষ্টি দিয়েছেন। যে কারণে অনেক কিছুই হয়তো এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি বিস্তারিত আলোচনা হলে হয়তো অস্পষ্ট বিষয়গুলি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। করোনাভাইরাসের এ সময়ে অনেক বিষয়েই আলোচনা হচ্ছে, বিতর্ক হচ্ছে অনেক বিষয় নিয়েই – লকডাউন বনাম হার্ড ইমিউনিটি, শিথিল লকডাউন বনাম কঠোর লকডাউন, জীবন বনাম জীবিকা ইত্যাদি। বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনায় যুক্ত হচ্ছেন না, এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েতই কম।

শিথিল-কঠোর যাই হোক, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সুইডেন ব্যতিত বিশ্বের সকল দেশ শেষ পর্যন্ত লকডাউনের পথ বেছে নিয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সুইডেন হার্ড ইমিউনিটির পথ অবলম্বন করেছে যুক্তরাজ্য প্রথমে হার্ড ইমিউনিটির কথা ভাবলেও পরে এখান থেকে সরে এসেছে এবং তা অনেকটা বাধ্য হয়েই। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশ সিদ্ধান্ত নিয়ে হার্ড-ইমিউনিটির দিকে না গেলেও প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল হার্ড-ইমিউনিটির দিকেই। ভারতে হার্ড-ইমিউনিটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে করোনাভাইরাসকে যেভাবে মোকাবেলা করা হচ্ছে, তাতে এমনও হতে পারে হার্ড-ইমিউনিটি শেষ ভরসা, অনানুষ্ঠানিকভাবে এমন চিন্তাও কর্তৃপক্ষের মাথায় থাকতে পারে।

এবার একটু আলোচনা করা যাক হার্ড-ইমিউনিটি নিয়ে। হার্ড-ইমিউনিটি বলতে কী বোঝায় এবং কী ধরনের ফলাফল দেয়। হার্ড (Herd) শব্দের অর্থ হল জনগোষ্ঠী এবং ইমিউনিটির অর্থ হল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। সমাজের বেশির ভাগ মানুষের শরীরে যখন কোনও বিশেষ জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়, অর্থাৎ অল্প কিছু মানুষ বাদে বেশিরভাগ মানুষই কোনো নির্দিষ্ট রোগ প্রতিরোধী হয়ে যায়, তখন তার সুবিধে অন্য মানুষেরা পেতে শুরু করেন তাকেই বলে হার্ড ইমিউনিটি। ধরা যাক, কোনো অঞ্চলে ১০ লাখ মানুষ আছেন, এরমধ্যে ৮ লাখ মানুষ কোনও নির্দিষ্ট ভাইরাসজনিত রোগের ভ্যাকসিন নিয়ে নিয়ে প্রতিরোধী হয়েছেন, তাহলে বাকি ২ লাখ অপ্রতিরোধী লোকও সেই নির্দিষ্ট ভাইরাস থেকে আক্রান্ত হবার কম ঝুঁকিতে থাকবে অর্থাৎ ১০ লাখের এই জনগোষ্ঠী এই ভাইরাস প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জন করবে। একইভাবে জীবাণু সংক্রমণের মাধ্যমেও হার্ড ইমিউনিটি গড়ে ওঠে যখন মানবদেহ কোনো জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়, তখন মানবদেহ সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং সেই জীবাণুকে চিনে রাখে। ফলে, পরবর্তীকালে সেই জীবাণু দ্বারা আবার আক্রান্ত হলে, দেহ তার বিরুদ্ধে দ্রুত এবং কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে ধরা যাক, কোনো অঞ্চলে ১০ লাখ মানুষ আছেন, এর মধ্যে ৮ লাখ মানুষ জীবাণু আক্রান্ত হয়ে প্রতিরোধী হয়েছেন, তাহলে বাকি ২ লাখ অপ্রতিরোধী লোকও সেই নির্দিষ্ট ভাইরাস থেকে আক্রান্ত হবার কম ঝুঁকিতে থাকবে। একটি অঞ্চলের কিছু শতাংশ মানুষ  ভ্যাকসিন না নিয়ে এবং সংক্রমিত না হয়েও অর্থাৎ ইমিউনড না হয়েও সংক্রমণের হাত থেকে বেঁচে যাবেন।  অর্থাৎ, একের থেকে অন্যের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের শৃঙ্খল ভেঙে যাবে। এই অঞ্চলে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠবে

এখন প্রশ্ন হল, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে কি হবে না। করোনাভাইরাসের যেহেতু এখনো ভ্যাকসিন নেই, তাই এক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি হতে হলে, তা হতে হবে সংক্রমণের পথ ধরেই। অর্থাৎ কোটি কোটি মানুষকে সংক্রমিত করেই তৈরি করতে হবে হার্ড ইউমিনিটি। প্রাথমিকভাবে অত্যন্ত সংক্রামক রোগ হামের ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি পেতে হলে ৯০% মানুষকে আক্রান্ত হতে হবে। তবে যখন কোনো রোগ সূচকীয় হারে সংক্রমিত হতে থাকে তখন যদি মোট জনসংখ্যার অর্ধেকও প্রতিরোধী হয়ে যায়, তাহলে মহামারী আর সেই হারে ছড়াতে পারে না। জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার হারের সাথেও রয়েছে হার্ড ইমিউনিটির সম্পর্ক। জীবাণু ছড়ানোর হারকে R0 (Reproduction number), দ্বারা প্রকাশ করা হয়। করোনাভাইরাসের R0 ২ থেকে ২.৫ এর মধ্যে, এমনটাই এখন পর্যন্ত ধারণা। অর্থাৎ একজন আক্রান্ত মানুষ দুজনের মাঝে এটি ছড়াতে পারেন। ১, ২, ৪, ৮, ১৬, ৩২, ৬৪ … এই হারে ছড়াতে থাকবে। তবে কোনো অঞ্চলের অর্ধেক লোক যদি প্রতিরোধী হয়ে যায়, তাহলে একজন মানুষ একজনেই ছড়াবে। অর্থাৎ ছড়ানোর হার অনেক কমে যাবে।  ১, ১, ১, ১, ১, ১, ১, ১ …  তার মানে যত বেশি মানুষ প্রতিরোধী হয়ে উঠবে সংক্রমণের হার তত কমে আসবে এবং একসময় শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। ধারণা করা হচ্ছে যে, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে হার্ড ইউমিনিটি অর্জনের জন্য মোট জনসংখ্যার ৬০% মানুষকে আক্রান্ত হতে হবে। অর্থাৎ যে দেশের জনসংখ্যা ১০ কোটি সেই দেশে ৬ কোটি মানুষকে করোনায় আক্রান্ত হতে হবে যেখানে এই রোগে অন্তত ১০ ভাগ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, মৃত্যুর হার ৫ ভাগ, সেখানে হার্ড ইউমিনিটির জন্য সংক্রমণকে বেছে নেয়া কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা অবশ্যই  বিশেষভাবে ভাবতে হবে   

ভাবতে হবে, এখনও এই বিষয়ে বিজ্ঞানীরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি যে যারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন তারা ঠিক কতটুকু প্রতিরোধী হচ্ছেন বা আদৌ প্রতিরোধী হচ্ছেন কি না! কেননা বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদেরও পুনরায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। এছাড়া  গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ফ্লু জাতীয় ভাইরাসে মিউটেশন হয়ে নিয়মিত নতুন নতুন প্রকরণের সৃষ্টি হয়। কেউ একজন একটি প্রকরণ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে প্রতিরোধী হলেও পরবর্তীতে যদি অন্য কোনো প্রকরণ দিয়ে সংক্রমিত হয়, তাহলে প্রথম ক্ষেত্রে যে ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে সেটি দ্বিতীয়টির বেলায় কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলবে না। সুতরাং ফ্লু জাতীয় ভাইরাসের ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটির মধ্য দিয়ে কোনো কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাবে কি না তা নিশ্চিত হয়ে বলার সুযোগ নেই। তাই মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলে দেয়ার কৌশল কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। 

প্রথমে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য হার্ড ইমিউনিটির পথে হাঁটার কথা ভাবলেও সরে এসেছে এবং তা বাস্তবতার কারণেই। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটির কথা বলে সমালোচিত হয়েছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি নিজেও আক্রান্ত হন। আবার রাশিয়া, ব্রাজিল করোনাকে পাত্তা দিচ্ছে কি দিচ্ছে না, তা বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু পরিণাম তাদের ভয়াবহ হয়েছে। লকডাউন না করে হার্ড ইউমিনিটির পথে হাঁটা একমাত্র দেশ সুইডেন। হার্ড ইউমিনিটির দিকে গিয়ে সুইডেন কি সফল হল না কি ব্যর্থ হল তা বলার সময় এখনো আসেনি, তবে এ নিয়ে রয়েছে বিশ্বব্যাপী পর্যালোচনা  

সিদ্ধান্ত নিয়েই হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করার পথে হাঁটছে সুইডেন। অফিস-আদালত থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল, বিনোদন কেন্দ্র খোলা রয়েছে। কারণ সুইডেনের চাওয়া, মানুষে মানুষে মেলামেশা হোক। রোগ ছড়িয়ে পড়ুক সুস্থ-সবল-তরতাজা মানুষের মধ্যে। সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে শুধু কেয়ার হোমের চারপাশে, যেখানে বয়স্ক মানুষেরা থাকেন। বিশেষ সাবধানতা নেয়া হয়েছে রুগ্ণ ও প্রতিরোধক্ষমতা কম এমন মানুষদের জন্যও। দেশটির মহামারি বিষয়ক প্রধান বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেস টেগনেলের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীরা এই কৌশলের প্রবর্তক এবং সরকারিভাবে এটি বাস্তবায়নের পক্ষে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে সুইডেনের সকল ভাইরোলজিস্ট এখনও এই কৌশল নিয়ে পুরোপুরি আশ্বস্ত নন- ভাইরোলজিস্টদের মধ্যে আছে দ্বিধাবিভক্তি।  

২০ মে ২০২০ পর্যন্ত সুইডেনে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ৩২১৭২ এবং ৩৮৭১ পাশের দেশ নরওয়ে এবং ডেনমার্কের চেয়ে সুইডেনে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। সুইডেন যেহেতু হার্ড ইমিউনিটি'র দিকে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই এই দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল, কতজন আক্রান্ত হলে সুইডেন হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছাবে? এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে কত দিনে হার্ড ইউমিনিটি অর্জন করা সম্ভব হবে এবং আদৌ হার্ড ইউমিনিটি অর্জন করা সম্ভব হবে কি না? এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য খুব বেশি সময় হয়তো অপেক্ষা করতে হবে না। 

তবে সুইডেনে লকডাউন ঘোষণা করা না হলেও কিছু নিয়ম যে মানা হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। গণপরিবহন ব্যবহারের হার যথেষ্ট পরিমাণে কমেছে, জনসংখ্যার একটা বড় অংশ ঘরে থেকে কাজ করছেন এবং জনসংখ্যার সিংহভাগই স্বেচ্ছায় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছেন অধিকাংশই ইস্টারের ছুটিতে কোথাও ভ্রমণ করেননি। আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে সুইডেনের জনসংখ্যা আনুমানিক এক কোটির সামান্য বেশি এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব ২৫ জন/স্কয়ার-কিলোমিটার যেখানের বাস্তবতাই পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে- সেখানে সুইডেন পুরোপুরি হার্ড ইমিউনিটির পক্ষে গেছে, এটি বলা মুশকিল

যদি কোনো দেশ হার্ড ইমিউনিটির পথে হাঁটে, সেই দেশের জন্য প্রথম জরুরি যে পদক্ষেপ, তা হল, প্রথমেই বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের আলাদা করে ফেলা দ্বিতীয় জরুরি পদক্ষেপ হল, যেহেতু বিপুল সংখ্যক লোক আক্রান্ত হবেন, যদি তা মূল জনগোষ্ঠীর পঞ্চাশ ভাগও হয় অর্থাৎ ১০ কোটি মানুষের দেশে ৫ কোটি মানুষ আক্রান্ত হন, এর  অন্তত ১০/১৫ ভাগ আক্রান্তের জন্য হাসপাতালে ভেন্টিলেটরসহ আইসিইউ বেড, সাধারণ বেড ইত্যাদি প্রস্তুত রাখা এখন কথা হচ্ছে, বর্তমানে অধিকাংশ দেশে যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে তাদের চিকিৎসা করতেই রাষ্ট্র হিমশিম খাচ্ছে- যখন এর কয়েকগুণ লোকের জন্য হাসপাতাল সেবার প্রয়োজন হবে তখন কীভাবে সামাল দেবে সেটাই বড় প্রশ্ন। সেই সাথে আক্রান্তের ৫ ভাগ মানুষের মৃত্যুঝুকি তো রয়েছেই। এ ছাড়া বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নয়, যে বিপুল সংখ্যক লোক কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হবেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ কর্ম ক্ষমতায় কোন প্রভাব পড়বে কি না? আমরা জানি, পোলিও রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাময়িক কিংবা স্থায়ীভাবে শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হন ও তার অঙ্গ অবশ বা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তবে করোনাভাইরাসে এমন বাহ্যিক ক্ষতির কোন লক্ষণ দেখা না গেলেও আভ্যন্তরীণ যে কোন ক্ষতি হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না 

সুইডেন ব্যতীত বিশ্বের সকল দেশ লকডাউনের পথে হাঁটছে লকডাউনের পথে হাঁটা, এখন পর্যন্ত জানা তথ্যের ভিত্তিতে অপেক্ষাকৃত সফল দেশসমূহ হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, শ্রীলঙ্কা, উরুগুয়ে, নেপাল ইত্যাদি। যদিও এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার সময় নয়। অনেক দেশেই ঘোষিত হয়েছে লকডাউন, তবে নিশ্চিত হওয়া মুশকিল যে কোন দেশে কতটা লকডাউন পালিত হচ্ছে। যদি আমরা লকডাউনকে এক ধরনের বন্দি অবস্থাই ধরে নেই, তাহলে সেই অর্থে লকডাউন পালিত হয়েছে বা হচ্ছে, এমন কতটা অঞ্চল পাওয়া যাবে তা বলা মুস্কিল। বিচ্ছিন্ন কিছু ভিডিও ফুটেজের মধ্যে উহানে কঠোর লকডাউনের একটি আভাস পাওয়া যায় কিন্তু অন্যকোন দেশ বা অঞ্চলে এমনটা হয়েছে তার চিত্র বা তথ্য সচারাচর চোখে পড়েনি। বরং অনেক অঞ্চলেই দেখা গেছে "যদি" এবং "জরুরী প্রয়োজন" এই শব্দ দুটির ফাঁকে যথাযথ লকডাউন পালিত না হওয়া। এ ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে যেমন ঢিলেঢালা ভাব ছিল বা আছে, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও রয়েছে না মানার এক ধরনের প্রবণতা অর্থাৎ লকডাউন মানে লকডাউন, এমনটা কম দেখা গিয়েছে।

সংক্রমিত হয়ে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলা, পদক্ষেপ হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ, বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন, কিন্তু ভ্যাকসিন সময় সাপেক্ষ- তাই যে পদক্ষেপটি করোনাভাইরাস প্রতিরোধের জন্য অবশিষ্ট থাকে, তা হল লকডাউন- এখন পর্যন্ত এর কোন বিকল্প নেই তা ভাবার যথেষ্ঠ যৌক্তিক কারণ রয়েছে। আর এক্ষেত্রে অবশ্যই হতে হবে পূর্ণ লকডাউন। আণুবীক্ষণিক করোনাভাইরাসকে আটকাতে গেলে লকডাউনের মধ্যে সামান্যতম ছিদ্রও রাখা যাবে না। একটি ছোট ছিদ্র লক্ষিন্দরকে সর্প দংশনের সুযোগ করে দিয়েছিল। অর্থহীন হয়ে পড়েছিল লোহায় নির্মিত বাসর ঘর।

আর সমস্যাটা এখানেই যে কীভাবে সম্ভব একটি নিছিদ্র লকডাউন বাস্তবায়ন করা? এর ব্যবস্থাপনাই বা কী হতে পারে? হার্ড ইমিউনিটিতে গেলে স্বাস্থ্য সেবার প্রস্তুতি গুরুত্বপূর্ণ, এ ছাড়া আর কোন জটিল পদক্ষেপ নেই কিন্তু লকডাউনে গেলে, যে বিশাল কর্মযজ্ঞ, লাখ-লাখ অথবা কোটি মানুষকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঘরের মধ্যে আটকে ফেলা, কাজটা যে সহজসাধ্য নয় তা বলাই বাহুল্য, কিন্তু অসম্ভব নয়। 

এক্ষেত্রে, বর্তমানে প্রায় সকল দেশেই বিদ্যমান এমন একটি ব্যবস্থাপনার দিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে, তা হল, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা। অনেক দেশেই একদিনে কয়েক লাখ বা কয়েক কোটি মানুষ ভোট দিয়ে থাকে। প্রতিটি নির্বাচনেই একটি কাঠামো এবং কর্ম পদ্ধতি মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করা হয়। কাঠামোর যে স্তর বিন্যাস, তার শীর্ষে রয়েছে নির্বাচন কমিশন এবং সর্বশেষ স্তরে রয়েছে ভোটকেন্দ্র। ধরা যাক ৬০ লাখ ভোটারের একটি শহরে ভোট কেন্দ্র ২ হাজারটি। তাহলে গড়ে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রের ভোটারের সংখ্যা হচ্ছে ৩ হাজার। নির্বাচন সম্পন্ন করার কর্ম পদ্ধতিতে যা হয়, তা হল, ভোটের মাধ্যম যাই হোক, ব্যালট পেপার অথবা ইভিএম মেশিন, তা কমিশন থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তার মাধ্যমে কেন্দ্রে পৌঁছানো হয়, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ এবং গণনা শেষে পেপার অথবা ইভিএম মেশিন রিটার্নিং কর্মকর্তার মাধ্যমে আবার কমিশনে পাঠানো   

এবার ধরে নেয়া যাক, একটি দেশে ২৮ দিনের একটি লকডাউন পরিচালিত হবে এবং এ জন্য জাতীয়ভাবে লকডাউন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হল, এই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তার পদবী হল প্রধান নিয়ন্ত্রক আলোচ্য শহরের জন্য একজন কর্মকর্তা দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন এবং পদবী হল মহানগর নিয়ন্ত্রক, সাথে থাকলেন আরও প্রয়জনীয় সংখ্যক বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা। পর্যায় ক্রমে একেকটি কেন্দ্রে, ১ জন কেন্দ্র সমন্বয়ক ৫ জন সহকারী সমন্বয়ক নিয়োগ দেয়া হল এই শহরের জন্য ২ হাজার ভোট কেন্দ্রে ২ হাজার লকডাউন কেন্দ্র স্থাপন করা হল। উল্লেখ্য, যে সীমানা ধরে একটি কেন্দ্র স্থাপিত হয় সেখানে ভোটারের বাইরে আরও কিছু মানুষ থাকে। ধরে নেয়া যায় একটি ভোট কেন্দ্রিক এলাকায় গড়ে ৫ হাজার মানুষের বসবাস। যদি প্রতিটি পরিবারে গড়ে ৪ জন করে সদস্য থাকেন, তাহলে একটি কেন্দ্রের আওতায় ১২৫০টি পরিবার থাকবে। একেক জন সহকারী সমন্বয়ককে ২৫০টি পরিবারের দায়িত্বপ্রাপ্ত করা হল নির্বাচনে যা হয়, ভোট কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার এবং সহকারী প্রিজাইটিং অফিসাররা অবস্থান করেন এবং ভোটাররা ভোট দিতে আসেন আর এক্ষেত্রে যা হবে, তা হল, মানুষ তার ঘরে অবস্থান করবেন, সহকারী সমন্বয়কেরা তাঁদের কাছে যাবেন।

কর্ম পদ্ধতি অনেকটা এই রকম- 

ধরে নেয়া যাক কোন এক মাসের ৬ তারিখে ঘোষণা করা হল যে ৮ মার্চ থেকে দেশব্যাপী বা অমুক অমুক শহরে লকডাউন। এই লকডাউনের বার্তাটি এমন যে, ঠিক কার্ফুতে যা হয়ে থাকে অর্থাৎ কোন ব্যক্তি তার বাড়ীর বাইরে বেরুতে পারবেন না। বের হলেই গ্রেপ্তার। এদিন সকাল ৮টা থেকে সহকারী কেন্দ্র সমন্বয়কগণ, তার একজন সহকারীসহ, তার আওতাধীন থাকা ২৫০ বাড়িতে পর্যায় ক্রমে যাবেন এবং তিনি সকল পরিবারকে একটি ফোন নম্বর দেবেন, যে ফোনটি ২৪ ঘণ্টার জন্য তার অথবা তার সহকারীর কাছে থাকবে। পাশাপাশি ওই পরিবারের ফোন নম্বরসহ অন্যান্য তথ্য লিপিবদ্ধ করে নেবেন এই বিষয়টি লিপিবদ্ধ করা অধিক জরুরী যে আগামী ২৮ দিনের খাদ্য সংস্থান কোন কোন পরিবারের রয়েছে ধরে নেয়া যায় যে এর মধ্যে কিছু পরিবার থাকবে, যাঁদের ২৮ দিনের খাদ্য সংস্থান করা আছে। কিছু পরিবার আছে যাঁদের সামান্য কিছু সবজি এবং ফল কিনলেই চলবে এবং তাঁদের অর্থের কোন সংকট নেই, কিছু পরিবারের ৩/৪ দিনের খাদ্য সংস্থান রয়েছে, হয়তো অনেক পরিবার পাওয়া যাবে যাঁদের কোনই খাদ্য সংস্থান নেই, ইত্যাদি সহকারী সমন্বয়কের এই সকল পরিবারকে যে বার্তা দেবেন, তা হল, আপনারা আপনাদের বাড়ির বাইরে যেতে পারবেন না, তাই আপনাদের যখন যা প্রয়োজন হবে, তা আমাদের জানালে আমরা সরবরাহ করব। যাঁদের সামর্থ আছে তারা সরবরাহকৃত পণ্যের বিনিময়ে টাকা প্রদান করবেন কিন্তু যাঁদের সামর্থ নেই তাদেরককে বিনামূল্যে চালডালসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহ করা হবে এবং এই সকল পরিবারের প্রতি সদস্য প্রতি সপ্তাহে কি পরিমাণ চালডালসহ অন্যান্য পণ্য পাবেন, তাও জেনে দেয়া হবে। যদি এমন কোন পরিবার পাওয়া যায়, যাঁদের এই মুহুর্ত থেকেই খাবারের কোন সংস্থান নেই, তাঁদেরকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে সংরক্ষিত পণ্য থেকে অন্তত ২ দিনের খাবার সরবরাহ করবে। এই সকল পরিবারকে আরও বার্তা দেবেন যে কেউ অসুস্থ বোধ করলে ডাক্তার অথবা হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করে দেবার সকল দায়িত্ব  এই কর্তৃপক্ষের। কেউ অসুস্থ বোধ করলে দ্রুত ফোন নম্বরে যোগাযোগ করবেন কিন্তু আপনারা বেরুতে পারবেন না। কোন পরিবার কর্তৃক ফোন বা লিখিত চাহিদাপত্র পাবার পর, কর্তৃপক্ষের সাড়া দেবার ক্ষেত্রে যে বাধ্যবাধকতা থাকবে তা হল, চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৩ ঘণ্টা এবং পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার অধিক সময় গ্রহণ করবেন না। এই ধরনের একটি লকডাউনের মধ্য দিয়ে যে আরেকটি সুবিধে পাওয়া যাবে, তা হল, শহরের একটি পূর্ণাংগ ডাটাবেইজ তৈরি হয়ে যাবে। যে সকল পরিবারকে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করা হবে, সেই সকল পরিবারের পেশাগত তথ্য এবং সরবরাহকৃত খাবারের অর্থমূল্য লিপিবদ্ধ করে রাখা হবে, কারণ প্রাথমিকভাবে সরকারী অর্থে খাবার সরবরাহ করা হলেও পরবর্তিতে এই সকল পরিবারের আয়ের মূল উৎস থেকে, যদি সুযোগ থাকে, সমন্বয় করা হবে। যেমন কোন এক পরিবারকে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করা হয়েছে, যে পরিবারের কর্তাব্যক্তি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন এবং সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে এই কর্তাব্যক্তির পাওনা রয়েছে- সেই পাওনা থেকে এই অর্থ সমন্বয় করা হবে। হয়তো অনেক বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমনটা সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ একটি শহরে দৈনন্দিন আয়ের যে ভাসমান মানুষ আছে তার সংখ্যা নেহায়াত কম নয়। তাঁদেরকে যা দেয়া হবে তা অনুদান হিসেবেই দেয়া হবে বলে ধরে নেয়াই হবে যৌক্তিক।  

এতগুলো পরিবারের সার্বিক দায়িত্ব নেয়া আপাত জটিল মনে হলেই একটি বড় পরিসরের চেইন-শপ এবং হোম ডেলিভারির চাইতে অধিক জটিল কিছু নয়। প্রয়োজন একনিষ্ঠতা এবং বিভিন্ন স্তর ও বিভাগে যথাযথ ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে সকল কর্মকার্তা-কর্মচারী বা স্বেচ্ছাসেবক লকডাউন নিয়ন্ত্রণের কাজে জড়িত থাকবেন, তাঁরা দায়িত্বপালনকালীন নিজ নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবেন। তাঁদের আবাসন, পরিবহনসহ সকল দৈনন্দিন দায়ভার কর্তৃপক্ষ বহন করবেন। ২৮ দিন পর লকডাউন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সকল কর্মকর্তাকর্মচারিরা প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গরোধে চলে যাবেন। যদি ২৮ দিন টানা ডিউটি করা এবং পরবর্তিতে আবার ১৪ দিনের সঙ্গরোধে থাকা, টানা ৪২ দিনের দায়িত্ব পালন যদি বাড়তি চাপের কারণ হয়, তাহলে ১৪ দিন পরে নতুন গ্রুপ কাজে যোগ দিতে পারেন।

২৮ দিন লকডাউনের পর যে ফলাফল আসবে বলে প্রত্যাশা করা যায়, তা হল, কিছু মানুষ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে থাকবেন, কিছু মানুষ সঙ্গরোধে থাকবেন এবং অবশিষ্টরা, অর্থাৎ যারা আক্রান্ত হবেন না, তাঁরা কর্মে ফিরে যেতে পারবেন। কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের যে গতিবিধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে এটি স্পষ্ট যে ঘনবসতি বড় শহরগুলোতে আক্রান্তের পরিমাণ যতটা তার চেয়ে অনেক কম ছোট শহরগুলিতে। গ্রাম পর্যায়ে আক্রান্তের পরিমাণ নগণ্য। তাই অনেক ছোট শহর এবং গ্রামীণ এলাকা, যদি কোন ব্যতিক্রম না থাকে, লকডাউনের আওতায় আনার প্রয়োজন নেই। তবে লকডাউন এলাকার মতই এই সকল এলাকাতেও ভোট কেন্দ্রসমূহে লকডাউন নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হবে। যদি কোন এলাকায় করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে তাহলে, পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে পরিবর্তিত হবে। আবার একই ভাবে ২৮ দিন লকডাউন পালনের পর সকল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে পরিবর্তিত হবে। এবং একটি সময় পর্যন্ত পর্বেক্ষণ অব্যাহত রাখতে হবে। হতে পারে তা দুই থেকে তিন মাস।          

সংক্রমণের মধ্য দিয়ে হার্ড ইমিউনিটি বলি, শিথিল অথবা হার্ড লকডাউনই বলি- কোনটা যৌক্তিক, কোনটা যৌক্তিক নয়, আর এর বাস্তবায়নে কাঠামো এবং পদ্ধতিগত রূপরেখা- এ চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেবার দায় এবং অধিকার, কোনটাই একজন সাধারণ নাগরিকের কর্মপরিধিভুক্ত নয়, এই নাগরিক বিশ্বের যে প্রান্তেই অবস্থান করুন না কেন– এ এক বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু অবশ্যই রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের সুস্পষ্টতাকে দেখতে পাওয়া, সুনিশ্চিত হওয়া এবং শঙ্কাহীন জীবন প্রত্যাশা করা, যে কোন বিশ্বনাগিরকের অধিকারভুক্ত। পরিতাপের বিষয় যে করোনা ভাইরাসের মত বৈশ্বিক সমস্যাকে বৈশ্বিকভাবে মোকাবেলার লক্ষ্যে সামান্যতম পদক্ষেপেরর দিকে তো নিয়ে যাওয়া তো হয়নি বরং প্রতিটি দেশের স্থানিক সমস্যা হিসেবে রেখে দিয়ে, স্থানীয় কর্মপন্থার মধ্যে দিয়ে একে মোকাবেলার চেষ্টা করা হয়েছে– যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং অনেকটা ঘোষণার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ করে রেখেছে- তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনার পরেও এমন অভিযোগে অভিযুক্ত করাই যায়। জিনোমগত বিশিষ্টের কারণে কেউ হয়তো স্থানিক পদক্ষেপকেই যৌক্তিক মনে করতে পারেন, কিন্তু করোনা ভাইরাসের জিনোমগত তারতম্য বিদ্যমান থাকলেও, গতিপ্রকৃতির মূল ধারা যদি বিবেচনায় আনা হয়, তবে অঞ্চল ভেদে এর বৈশিষ্ঠের কোন তারতম্য ঘটে না, অর্থাৎ একে প্রতিরোধের পদ্ধতি প্রায় একই থেকে যায়। ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের আগ পর্যন্ত এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণের দুটি পথই খোলা আছে, তা হল, সংক্রমণের মধ্য দিয়ে হার্ড ইমিউনিটি অথবা লকডাউন

মহামারি বিষয়ক প্রধান বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেস টেগনেলের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানীদের পরামর্শে সুইডেল হার্ড ইমিউনিটিতে গেছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউনের পদক্ষেপকে 'বিশাল ভুল' বলে মন্তব্য করেছেন স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মেডিসিনস স্ট্রাকচারাল বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের প্রধান ও রসায়নে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী মাইকেল লেভিট। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটির রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব পরিসংখ্যান, মহামারিতত্ত্ব এবং গবেষণা ডিজাইন বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ড. নুট উইটকাওস্কি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বে যে লকডাউন চলছে তাতে করোনাভাইরাসের মহামারির সময় আরো দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অধ্যাপক ড. নুট উইটকাওস্কি লকডাউন নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন- "'শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগের মহামারির ক্ষেত্রে সময় লাগে মাত্র দুই সপ্তাহ। দুই সপ্তাহেই তা শীর্ষে ওঠে এবং এরপরই শেষ হয়ে যায়।" 'শ্বাসযন্ত্রজনিত সব রোগের ক্ষেত্রে রোগকে থামানোর একমাত্র উপায় হলো হার্ড ইমিউনিটি। জনগণের ৮০ শতাংশ মানুষকেই এই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসতে দেওয়া উচিত, যাতে করে এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিকভাবেই মানুষের দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়।" "শিশুদের এই ভাইরাসে কিছুই হয় না।" ইত্যাদি

আন্দ্রেস টেগনেল, মাইকেল লেভিট এবং নুট উইটকাওস্কি প্রভৃতি বিশিষ্টজনের লকডাউনের বিপরীতে হার্ড ইমিউনিটির পক্ষাবলম্বন এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করছে, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন সাধারণ মানুষ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এমন কি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তেও সংশয় তৈরি করছে। বিচ্ছিন্ন পরষ্পরবিরোধী কোন বক্তব্য সব সময় স্বাভাবিক কর্ম প্রক্রিয়ায় বাঁধা তৈরি করে থাকে, এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। বিভিন্ন স্থানে হয়তো জীবিকা বা অর্থনৈতিক কারণে লকডাউন শিথিল হচ্ছে কিন্তু এর পেছনে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যও ভূমিকা রাখছে। বিজ্ঞানীরা যখন দ্বিধাবিভক্ত, তখন এর প্রভাব রাষ্ট্র ও সমাজে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই রয়েছে, গবেষণা এবং উদ্ভাবনে তো বটেই, সাধারণ বোঝাপড়াতেও এতটাই পিছিয়ে আছে যে, অগ্রসর দেশসমূহ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, অবশ্যই এক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা- এদের দিক নির্দেশনা এবং কর্মকাণ্ড অনুকরণ করা ছাড়া, এই সকল দেশের নিজস্ব নিজস্বচিন্তাভাবনাপ্রসূত কোন পদক্ষেপ নেয়ার সামর্থ্য নেই।  বিষয়টি যদি এমন হত যে, এটি নিরসনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষে সম্ভবও ছিল, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ভাইরোলজিস্ট এবং সংশ্লিষ্টদের  একটি সম্মেলন আহ্বান করে, এই বিতর্কটি বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা। যদি হার্ড ইমিউনিটির মধ্য দিয়ে করোনা ভাইরাসকে প্রতিহত করা যেত, সামান্য ক্ষতির মধ্য দিয়ে, তাহলে এর চেয়ে ভাল আর কিছুই হতে পারত না। আর হার্ড ইমিউনিটর পথ যদি আদৌ কোন সমাধানের পথ না হয়ে থাকে, তাহলে এই পথে হাঁটাকে নিরুৎসাহিত করা এবং বিচ্ছিন্ন বক্তব্য থেকে বিরত থাকতে সকলকে অনুরোধ করা। প্রয়োজনে এ বিষয়ে সম্মেলন থেকে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়তো এমন একটি বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আসতে পারতেন না, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেত নিঃসন্দেহে। বর্তমান বাস্তবতায় অবশ্যই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সকল রাষ্ট্রসমূহকে বিবেচনায় নিতে হবে যে বৈশ্বিক এই সমস্যা সমাধানে বৈশ্বিক সম্মিলিত পদক্ষেপের কোন বিকল্প নেই।  

ধন্যবাদান্তে,

জনৈক বিশ্বনাগরিক