হিন্দুত্ববাদী ভারত

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 1 June 2019, 10:54 AM
Updated : 1 June 2019, 10:54 AM

হিন্দু এবং মুসলমান প্রধান রাষ্ট্রগুলিতে রাজনীতিতে ধর্ম চমৎকারভাবে ব্যবহার করতে পারলে যে আশাতীত সাফল্য অর্জন করা যায়, ভারতের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর অভাবনীয় বিজয় আবার তা প্রমাণ করল। এ বিজয় মোদীর ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের কারণে বলা হলেও, তাঁর ক্যারিশমা এ জায়গাটিতেই যে, তিনি জানেন কি করে ধর্মকে "ম্যজিকের" মত ব্যবহার করতে হয়। আর একে ম্যজিকের মত ব্যবহার করতে জানলে, চরম প্রতিকূল পরিবেশেও যে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া যায়, তাই আরেকবার দক্ষতার সাথে দেখিয়ে দিলেন মোদী।

মোদীর এ বিজয় মূলতঃ হিন্দুত্ব ও হিন্দু রাষ্ট্রের চেতনার জয়; যদিও সেক্যুলারিজম হল ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতি। বিজেপির ধারাবাহিক এ  বিজয় সেক্যুলার নীতি বা চিন্তাধারার প্রতি ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অনাস্থারই প্রতিফলন। বাংলাদেশেও জনগণের একটি বড় অংশ সেক্যুলার নীতিকে রাষ্ট্রের জন্য উপযোগী মনে করেন না। "ইসলামপন্থার" রাজনীতি যারা করেন তারা আবার সেক্যুলার মতবাদকে নাস্তিকতার সাথে এক করে দেখেন। দুটোর মাঝে মৌলিক পার্থক্য তারা দেখতে পান না অথবা চান না।

এবারের নির্বাচনের ক্ষেত্র কট্টর হিন্দু জাতীয়াতাবাদী বিজেপির পক্ষে ছিল না বলেই সবার কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল। নানা কারণে জনগণের স্বপ্ন ভঙ্গ হচ্ছিল।গুজরাট দাঙ্গার "নায়ক" মোদী যখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০১৪ সালে ২৮২ আসন নিয়ে ক্ষমতাসীন হন, তখন অনেকে এটা ভেবেছিলেন, গুজরাটের "উন্নয়নের চমক" তিনি সারা ভারতবর্ষে দেখাবেন। তিনিও ভারতবাসীকে নির্বাচনী প্রচারে এমন ধারণা দিয়েছিলেন যে, দেশকে তিনি উন্নয়নের অন্য মাত্রায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু, যে স্বপ্ন তিনি দেশবাসীকে দেখিয়েছিলেন, প্রথম পাঁচ বছরের শাসন শেষে তার অনেকটাই তিনি পূরণ করতে পারেননি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনে হয়েছিল, জনগণের বড় অংশটাই বোধহয় মোদীর উপরে হতাশ।

জনগণের একটা বড় অংশ হতাশ যে ছিল তার লক্ষণ দেখা গেল বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে। বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ রাজ্যে বিজেপির ভরাডুবি ঘটল। অনেকে ভাবতে শুরু করলেন, কংগ্রেস বোধহয় আবার ক্ষমতায় আসছে। আর না ভাবারই বা কি কারণ ছিল। মোদীর শাসন ১৯৭০ সালের পর সবচেয়ে বেশি বেকারের জন্ম দিয়েছে দেশটিতে।

শিক্ষিত তরুণদের মাঝে সারা ভারতেই চাকরির অভাব নিয়ে প্রচণ্ড হাহাকার। নকশালবাড়ী আন্দোলনের সময় পশ্চিম বাংলায় চাকরি যেমন দুস্প্রাপ্য হয়ে উঠেছিল, অনেকটা যেন তারই প্রতিচ্ছবি মোদীর শাসনে ভারতবাসী দেখতে পেল। শুরুতে মোদী কিছুটা আশার সঞ্চার করলেও খারাপ ঋণ সামাল দিতে নতুন দেউলিয়া আইনের মতো কিছু শক্ত সংস্কারের পদক্ষেপ নেয়ায় ব্যাংকিং খাতে যথেষ্ট চাপ তৈরি হয়। দুর্নীতি রোধে পাঁচশ এবং এক হাজার রুপির নোট নিষিদ্ধ করা ছিল অনেকটা অর্বাচীনের মত সিদ্ধান্ত, যা অর্থনীতিকে বড় ধাক্কা দেয়। এসবসহ নানাবিধ কারণে প্রবৃদ্ধির হার নেমে যেয়ে অর্থনীতিতে স্থবিরতা আসে।

নতুন চাকরি তৈরির পথ অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে পাঁচ বছরে প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশ সামাজিক উন্নয়নের সব সূচককেই ভারতকে পিছনে ফেলে দেয়। ভারতে যখন জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ক্রমশই নিম্নমুখী, বাংলাদেশে তখন তা (বর্তমানে) ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবার মত অবস্থায়। এর ফলে, দেশটি আগামী কয়েক বছরে মাথাপিছু আয়ে ছাড়িয়ে যাবে ভারতকে। এসব কিছুই দলমত নির্বিশেষে ভারতের জনগণের বড় একটি অংশকে হতাশ করে।

ভারতের "সাহায্যে" স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ মাথা পিছু আয়, জীবন মান উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে ভারতকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবে– এসব সেখানে অনেকের পক্ষেই মানসিকভাবে মেনে নেয়া কঠিন। পাঁচ বছর আগে যেখানে তারা ভেবেছিল মোদী ক্রমান্বয়ে জনগণের জীবনমানকে পাশ্চাত্যের ষ্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে যাবেন, সেখানে ভারত যখন বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে যেতে থাকে, তখন হতাশা আসাটাই স্বাভাবিক।

বিজেপির পাঁচ বছরের শাসনে কৃষকদের কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। এ সময় হাজার হাজার কৃষক আত্মহত্যা করে। ভারতে দীর্ঘদিন ধরেই বঞ্চনার শিকার কৃষকরা আত্মহত্যা করছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যমতে, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সময়কালে ভারতে আত্মহত্যা করেছে ৩,২১,৪০৭ জন কৃষক। গবেষকদের মতে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে আরো বেশি হবে।

আত্মহত্যার প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়গুলিতে ঊর্ধমুখী দেখে মোদী সরকার ২০১৬ সাল থেকে কৃষকদের বাৎসরিক আত্মহত্যার সংখ্যা প্রকাশ থেকে বিরত রয়েছে। তবে, বর্তমানে গড় আত্মহত্যার সংখ্যা বছরে ১৬ হাজারের উপরে হবে বলে মনে করা হয়। কৃষকদের অবস্থা ক্রমশই সঙ্গীন হবার ফলে মোদীর বিরুদ্ধে মুম্বাইসহ বিভিন্ন শহরে স্মরণাতীত কালের বিশাল বিশাল কৃষক সমাবেশ এবং বিক্ষোভ হয়।

তবে, মোদী তাঁর প্রথম শাসনামলে জোর দেন খোলা স্থানে প্রাতঃকৃত্য করবার হার কমিয়ে আনবার উপর। এ বিষয়ে তিনি সফলতাও পেয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনগোষ্ঠী যে দেশটিতে খোলা জায়গায় প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করে, সেটি হল ভারত। মোদীর শৌচাগার নির্মাণ আন্দোলনের ফলে দেশটিতে খোলা স্থানে প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করা জনগোষ্ঠী সরকারী হিসাবে এখন ৫ শতাংশ দাবী করা হয়। যদিও বেসরকারী হিসাবে তা কমপক্ষে এখনো ১৫ শতাংশ বা ২০ কোটি হবে বলে মনে করা হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, সেক্যুলার নেহেরু থেকে হিন্দুত্ববাদী মোদী, সব সরকারের আমলেই সরকারী বা বেসরকারী যে খাতকেই প্রাধান্য দেয়া হোক না কেন, জাত, পাত, বর্ণ প্রথায় বিভক্ত ভারতে উন্নয়নের মূল অভিগমনটা উপর থেকে তৃণমূলে। ফলে, যে দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার কৃষক আত্মহত্যা করছে, এখনো ২০ কোটির মত মানুষের শৌচাগার ব্যবহারের মত সঙ্গতি নেই, পাশ্চাত্যের মানদণ্ডে বিপুল সংখ্যক মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করেন, সে দেশে ২০১৮ সালে ঘোষিত সামরিক বাজেট ৫৪ বিলিয়ন ডলার।

দেশের ধনীক শ্রেণী নিজ দেশের শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ না করে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করেন বিভিন্ন মার্কিন এবং বৃটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নিজেদের নামে হল, ভবন বা চেয়ার করতে। অর্থাৎ, ভারতের বিপুল সংখ্যক দলিত সম্প্রদায় এবং আদিবাসীদেরকে উন্নয়নের ধারায় আনতে, রাষ্ট্র এবং বাক্তি, এ দুই পর্যায় থেকেই রয়েছে প্রবল অনীহা। উন্নয়নের মূল লক্ষ্যটা সেখানে উচ্চ এবং মধ্যবিত্তকে ঘিরে।

উত্তর ভারতের উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীই বিজেপির মূল সমর্থন ভিত্তি, যাদের বড় অংশ হল বর্ণ হিন্দু। এরা সনাতন ধর্মকে যেভাবে বোঝেন, তার সাথে যোজন যোজন ফারাক রয়েছে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর হিন্দু সম্প্রদায়ের, এমনকি পশ্চিম বাংলারও।

দক্ষিণের রাজ্যের ধর্ম এবং বর্ণ নির্বিশেষে অধিকাংশ জনগোষ্ঠী মনে করেন,তারা উত্তরের ব্রাহ্মণ্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। তাদের কাছে বিজেপি মূলত এ ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতিরই প্রতিনিধি। ফলে, দক্ষিণ ভারতে বিজেপি বা কোন ধরণের হিন্দুত্ববাদী দল শিকড় গাড়তে পারেনি। এবারের নির্বাচনের ফলাফলেও সেটা দেখা গেছে। তবে, হিন্দুত্ববাদের উত্থানে সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় নিপতিত হয়েছে ভারতের দরিদ্র মুসলমান এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়।

জনসংখ্যার প্রায় পনের শতাংশ মুসলমান নিয়ে আজকে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ। এ মুসলমানদের বড় একটা অংশ হতদরিদ্র এবং দরিদ্র। এ দরিদ্রতার পিছনে সরকারী এবং সামাজিক নীতির পাশাপাশি মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মূল ধারা থেকে নিজেদের বিছিন্ন রাখতে চাওয়ার প্রবণতাও দায়ী।

এ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকেই মোদীর পাঁচ বছরের শাসনামলে বিজেপি এবং তার সহযোগী হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আর এস এস, শিবসেনা ইত্যাদি দ্বারা নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছে। মোদীর গরু সংরক্ষণ নীতির ফলে বহু মুসলমান শুধু শারীরিকভাবে নিপীড়ন নয়, হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হয়েছেন। অনেক সেক্যুলার ভারতীয় মনে করেন, মোদীর আমলে মানুষের চেয়ে পশুর (গরুর) উচ্চ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার নজির আধুনিক বিশ্বে আর কোন রাষ্ট্রে নাই।

ভারতের মুসলমানরা শ্রেণী নির্বিশেষে সব সময়ই সেক্যুলার রাজনৈতিক দলকে ভোট দিয়ে এসেছে। রাজনৈতিক দল যত বেশি সেক্যুলার, তত বেশি তারা নিরাপদ বোধ করেছে। যদিও বাস্তবতা হল সেক্যুলার দলগুলি অনেক ক্ষেত্রেই নানাবিধ কারণে মুসলমানসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। তারপরেও, হিন্দুত্ববাদীদের থেকে সেক্যুলারদের শাসনে তাঁরা নিজেদেরকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে নিরাপদ বোধ করে এসেছেন।

লোকসভা নির্বাচনে মুসলমানরা যেমন সাধারণত কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে থাকেন, তেমনি রাজ্যের নির্বাচনগুলিতে যে সমস্ত জায়গায় কংগ্রেসের চেয়েও অধিক সেক্যুলার বাম ফ্রন্টের প্রাধান্য রয়েছে, সেখানে তারা তাদেরকে ভোট দেন।

একটি নির্বাচনে ১৫ শতাংশ ভোট অনেক বড় ব্যাপার। এর সাথে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রায় ২.৫ শতাংশ ভোটও যে বিজেপির বাক্সে যাবে না, এ বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত ছিল। গত পাঁচ বছরে ধর্মান্তকরণের অভিযোগ তুলে বিভিন্ন জায়গায় যাজকদের উপর এবং চার্চে হামলা করেছে হিন্দুত্ববাদীরা।

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি নারী সমাজের আর্থ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়নে মোদী সরকার সফল তো হনই নাই, বরং খুব ব্যাপক মাত্রায় না হলেও, নানা হিন্দুত্ববাদীর কাছ থেকে নারীদেরকে সেই পুরানো সময়ে ফিরে যেতে বলা হয়েছে— যে সময়টাকে নারীরা বিভিন্ন প্রগতিশীল মানুষের প্রচেষ্টার পাশাপাশি স্বাধীন ভারতে সেক্যুলার দল এবং নারীবাদীদের সম্মিলিত প্রয়াসের ফলে পিছনে ফেলে এসেছেন।

বিজেপির পাঁচ বছরের শাসনে নারীদের উপরে সহিংসতা, যৌন নিপীড়নের মাত্রা বেড়েছে। হিন্দুত্ববাদ নামিয়ে আনতে পারেনি ধর্ষণের হার। সংখ্যার বিচারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পরেই সবচেয়ে বেশি নারী ধর্ষিত হয় ভারতে।

ধর্মের বাতাবরণ নারীকে সুরক্ষা দিতে তো পারেইনি, বরং কোনো কোনো হিন্দুত্ববাদীকে নারী-পুরুষের সমনাধিকার, বিধবা বিবাহের বিরোধীতা করাসহ প্রকাশ্যে সহমরণের জয় গান গাইতে দেখা গেছে। অর্থাৎ, "রাম রাজ্য" স্থাপনের নামে ভারতকে অনেক হিন্দুত্ববাদী যেন ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান সেই অন্ধকার যুগে, যে যুগে নারীর মানবিক সত্ত্বাকেই স্বীকার করা হত না।

এতসব ব্যর্থতার সাথে নির্বাচনের কিছু পূর্বে মোদী সরকার পাকিস্তানে অর্বাচীনের মত বিমান হামলা চালিয়ে দেশকে এক বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি দাঁড় করান। এত ব্যর্থতা নিয়ে সাধারণত কোন দল পুনঃনির্বাচিত হয় না। সবাই তাই ভেবেছিলেন, বিজয়ী হলেও বিজেপির নির্বাচনী ফল গতবারের চেয়ে খারাপ হবে। কিন্তু, সমস্ত জল্পনা কল্পনাকে ভুল প্রমাণ করে দলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসন নিয়ে বিজেপি এককভাবে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে।

নির্বাচনে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী চেতনা, হিন্দু রাষ্ট্র, হিন্দু জাতীয়াতাবাদের শ্লোগান এক নিমিষে ম্যাজিকের মত সব সমস্যার সমাধান হিসাবে ধর্মীয়ভাবে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর সামনে হাজির হয়েছে। তারাও দলে দলে ভোট দিয়ে বিপুলভাবে বিজয়ী করে মোদীকে আবার ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছে।

এ বিজয়ের জন্য বিশ্লেষকরা নানা সেক্যুলার দলের কি দুর্বলতা, ভুলভ্রান্তি ছিল এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। কিন্তু, অত্যন্ত বাস্তব যে বিষয়টা অনেকে এড়িয়ে যাচ্ছেন সেটা হল, দীর্ঘ সেক্যুলার শাসন জনগণের মনোজগত থেকে হিন্দুত্বের চেতনা দূর করতে পারেনি। তাই তাদের সামনে যখন সেক্যুলারিজমের বিপরীতে হিন্দুত্ববাদী দল উপস্থিত হয়েছে, তারা তার সাথে নিজেদের একাত্মতা বোধ করেছেন।

মনোজগতে সচেতন বা অবচেতনভাবে হিন্দুত্ববাদী চেতনার প্রবল লালন না থাকলে লাল কৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে রাম মন্দির নির্মাণের জন্য ১৯৯০ সালের রথযাত্রায় এত বিপুল সাড়া পড়ত না। বস্তুত, এ রথযাত্রার মধ্য দিয়েই পরাক্রমশালী দল হিসাবে বিজেপি আবির্ভূত হয়। এরপর আর তাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সেদিনের সে রথযাত্রার অন্যতম সদস্য ছিলেন তৎকালীন তরুণ নেতা, নরেন্দ্র মোদী।

এখানে উল্লেখ্য যে, দীর্ঘ সেক্যুলার শাসন যেমন একদিকে হিন্দুত্ববাদের চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছে; তেমনি, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সেক্যুলার রাষ্ট্র তুরস্কে উত্থান ঘটিয়েছে "ইসলামপন্থার" রাজনীতির। ভারতে হিন্দুত্ববাদী চেতনার আইকন আজকে যেমন নরেন্দ্র মোদী, তুরস্কে তেমনি রেচেপ তাইয়্যেব এরদোগান।

সেক্যুলার এবং তুলনামূলক বিচারে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবেশকে মোদীর বিজেপি এবং এরদোগানের এ কে পার্টী (Justice and Development Party) কাজে লাগিয়েছে চরমপন্থার ধারার রাজনীতিকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য। দুটো দলই নিজেদের আসল পরিচয় গোপন করে ক্যামোফ্লাজের আশ্রয় নিয়েছে। অর্থাৎ, নিজেদের দলের সাথে ধর্মীয় পরিচয় যুক্ত করেনি।

বাংলাদেশে জামায়েতের অনেকেই আজকে ভারত এবং তুরস্কের মডেল অনুসারে দল থেকে ধর্মীয় পরিচয় বিযুক্ত করে রাজনীতির মাঠে পুনরায় সক্রিয় হতে চাইছেন। এ ক্যামোফ্লাজের অংশ হিসাবেই বিজেপি এবার নির্বাচনে ছয় জন মুসলমান প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে— যাদের সবাই অবশ্য পরাজিত হয়েছেন।তেমনি, জামায়াতের এ অংশটিও মনে করছে, সব ধর্মের অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত করেই নতুন দলের যাত্রা শুরু করা উচিৎ।

ভারতে বিজেপির বিজয় বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর জন্য সুখবর।  এতে, তাত্ত্বিকভাবে তাদের রাজনীতির যৌক্তিকতা আরো জোরালোভাবে তারা উপস্থাপন করতে পারবেন। ভারতের উদাহারণ দিয়ে সেক্যুলার মতবাদ যে ব্যর্থ, এ কথা আরো জোরেসোরে তারা প্রচার করবেন।হিন্দুত্ববাদের বিপরীতে "ইসলামপন্থার" রাজনীতি যে কতটা জরুরী, সেটা তাঁরা তুলে ধরবার প্রয়াস পাবেন।

যে হিন্দুত্ববাদ দীর্ঘ সময় ভারতের রাজনীতিতে প্রান্তিক অবস্থানে ছিল তাই আজকে মূলধারা। এক সময় ভারতকে মনে করা হত নেহেরুর স্বপ্নের ফসল। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী হলেও, ভারত কখনোই গান্ধীর দেখানো পথে চলেনি। ভারত দীর্ঘদিন পরিচালিত হয়েছে নেহেরুর সেক্যুলারিজম এবং সমাজতন্ত্রের পথ ধরে– অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতি পরিচলনা করে জাতীয় পুঁজিবাদী শ্রেণীর বিকাশের পরিবেশ তৈরি করে। ইন্দিরা গান্ধী উত্তর কংগ্রেস, নেহেরুর চিন্তার বিপরীতে গিয়ে বাজার অর্থনীতির পথে দেশকে নিয়ে যায়। আর বিজেপি বাজার অর্থনীতির সাথে যোগ করে হিন্দুত্ববাদের।

এ অর্থে আজকের ভারত কোন অর্থেই গান্ধী বা নেহেরু ভারত নয়। আজকের ভারত হচ্ছে বিনায়ক দামোদর সাভারকার আর ড. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির ভারত। বৃটিশ আমলে মুসলিম লীগের রাজনীতির বিপরীতে চন্দ্রনাথ বসুর হিন্দুত্ববাদের ধারণা সাভারকার প্রথম সারা ভারতে তুলে ধরেন— যে ধারণার মূলমন্ত্র হচ্ছে সম্মিলিত হিন্দু পরিচয়ই হল ভারতের একমাত্র সত্ত্বা বা পরিচয়। অর্থাৎ,"ইসলামপন্থী" এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা যেমন মনে করেন, তাদের নিজেদের রাষ্ট্র বিশ্বে পরিচিত হবে মুসলিম পরিচয়ে, সাভারকারও মনে করতেন, ভারত বিশ্বে পরিচিত হবে হিন্দু পরিচয়ে।

উপমহাদেশে এতদিন পর্যন্ত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের জনগণের একটা বড় অংশের মুসলিম জাতীয়াতাবাদী চেতনার প্রতি দুর্বলতা রয়েছে বলে মনে করা হত। অপরদিকে, ভারতের জনগণের বড় অংশটি রাজনৈতিকভাবে সেক্যুলার বলে ধরে নেয়া হত। কিন্তু, নব্বই পরবর্তী সময় থেকে এ ধারায় দ্রুত পরিবর্তন আসতে থাকে যার সূত্রপাত এক অর্থে হয়েছিল ১৯৮৪ সালের নির্বাচন থেকে, যে নির্বাচনে বিজেপি প্রথমবার দুটো আসন পেয়েছিল। খুব অদ্ভুত শোনালেও বাস্তবতা হল ভারতের জনগণের বড় অংশটি আজ পাকিস্তান বা বাংলাদেশের অনেকের মত সেক্যুলার পরিচয় ছেড়ে দিয়ে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইছেন।

তবে, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের রাজনীতি ভারতে টেকসই হবে কিনা তার পুরোটা নির্ভর করছে এ জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে মোদী সরকার জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পারবেন কিনা তার উপর। ভারতের মত রাষ্ট্রে যেখানে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, সেখানে সেক্যুলার দলগুলোর নিয়মতান্ত্রিকভাবেই নির্বাচনের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবার সুযোগ রয়েছে।

ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের শ্লোগান দিলেও বিজেপি বা অন্য সনাতন ধর্ম নির্ভর দলগুলো ভারতের সংবিধানের পরিবর্তন ঘটিয়ে দেশটির রাষ্ট্র ধর্ম হিন্দু করবার দাবী তোলেনি। ধর্মীয় শ্লোক বা বাণী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেনি। নারীদের অবদমনকে মাথায় রেখে ব্যাপক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়নি, যে ধরণের উদ্যোগ মুজাহেদিন ও তালেবান আমলে আফগানিস্থান এবং শিয়াপন্থী "ইসলামী বিপ্লবের" পর  ইরানে দেখা গিয়েছে।

আর সবচেয়ে বড় কথা হল,ভারতের নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের মত কখনোই তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়নি। ফলে, চারদিকে বিজেপি, শিবসেনার জয় জয়কার অবস্থাতেও অল ইন্ডিয়া মজলিস ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের মত "ইসালাম ভিত্তিক" দল ২ টি এবং ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিমলীগ ৩ টি আসন পেয়েছে। এরাও বিজেপির মত সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে।

এ সাম্প্রদায়িক বিভাজন বিজেপির রাজনীতির বড় অস্ত্র। তবে বিভাজনের বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কোথাও জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। বর্তমান ভারতই হচ্ছে তার বড় উদাহরণ। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি ক্রমশই ভারতের অর্থনীতিকে যেমন স্থবির করে দিচ্ছে, তেমনি সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ভারত পিছিয়ে পড়ছে, পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশ থেকেও। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভারতের সেক্যুলার দলগুলি যে আবার রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসবে, এটা বলাই বাহুল্য।