সফলভাবে বাংলাদেশে শেষ হলো দ্বাদশ এশিয়া কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ২০১২। ক্রিকেট-পাগল দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান কতো উচুঁতে, যারা বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামকের পর্যায়ে আছেন, তারা জানেন।
ইতিহাস যারা লিখবেন, নিষ্পৃহ দৃষ্টিতে, তারা এই হতদরিদ্র দেশটির ক্রিকেট-অনুরাগের কথা যদি যথাযথ আবেগ আর নৈর্ব্যক্তিকভাবে না লেখেন, ইতিহাসবেত্তা হিসেবে এক সময়ে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন। ইতিহাস নাকি লেখা হয় ইতিহাস-সৃজনকালে ক্ষমতার বলয়ে গ্রহ-উপগ্রহতূল্য মানুষদের থাকা ইচ্ছা-অনিচ্ছায়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বাংলাদেশের অভিষেক ঘটে ২০০০ সালে, পূর্ণ সদস্য হিসেবে, বর্তমান ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি এবং অর্থবিত্তের নিরিখে সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ ভারতের বিরুদ্ধে। ঢাকা ঐতিহাসিক সেই প্রথম টেস্ট ম্যাচের আয়োজকের ভূমিকায় থেকে বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দেয়, মেহমানদারিতে দরিদ্র অথচ আভিজাত্য ও গৌরবে সমৃদ্ধ দেশটি সৌজন্যবোধের কোন শিখরে অবস্থান করে।
টেস্ট তো খেললো ২০০০ সালে। তারও আগে ১৯৭৯ সাল থেকে আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ সহযোগী দেশ হিসেবে অংশ নিয়ে টেস্ট খেলুড়ে দু'একটি দেশের তথাকথিত 'আভিজাত্যে' আঁচড় বসিয়ে দিয়েছে।
এ সব আজ ইতিহাসের বিষয়। অগ্রগামী যারা তাদের জন্য সব সময় ইতিহাসের বিবর্ণ পাতায় গৌরবের কাহিনী খুঁজে বেড়ানো কৌলীন্যের পরিচায়ক হয় না।
বাংলাদেশ শুধু খেলায় নয়, ইভেন্ট আয়োজনেও বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের আস্থা অর্জন করার কারণে বিশ্ব ক্রিকেট কাপের সহআয়োজক হওয়ার কিছুকাল পরেই এশিয়া একক আয়োজক হিসেবে একটি সফল আয়োজন শেষে এখন যখন আয়োজকের ধুলো হিতু হয়েছে, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেব মেলাতে বসা দরকার। সব আয়োজনের শেষে সবচেয়ে বড় কাজটি হলো স্টকটেকিং হিসাব নিকাশ মেলানো। কী ভুল করলাম, কী না করলেও হতো, তার হিসাব।
সত্যের প্রয়োজনে স্বীকার করি, বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের লালসবুজ পতাকাকে ইতিবাচক ইমেজে তুলে ধরার কৃতিত্ব বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের–দলটির পৌনঃপুনিক হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পরও। মাঝে মাঝে যখন হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো চমক দেখানো কৃতিত্ব দেখায় দলটি, ঝলমল করে ওঠে চিত্ত। যেমন একবার, গত বছর দ্বিপাক্ষিক এক সফরে নিউজিল্যান্ডকে ক্রিকেটের ভাষায়, 'ড্রাবিং'-দিয়ে হোয়াইট ওয়াশ করেছিলো। আর সেই উপলক্ষে কী আদেখলাপনাই না দেখতে হলো গোটা জাতিকে। এনাম খিলাতে গলা পর্যন্ত ডুবে গেলো বিজয়ী দলটির সদস্যদের। আমরা বিষম খেলাম ! একী হচ্ছে ! এর চেয়ে বড় অর্জন যদি ভবিষ্যতে দলটি উপহার দেয়, এবং নিয়মিত পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণের ফলে সেটাই প্রত্যাশিত, তখন আর তাদেরকে দেয়ার জন্য বাকি রইলো কী ? আমরা বলেছিলাম, শীতের শুরুতে সব শীতবস্ত্র পরে ফেললে, ভরা শীতে পরার জন্য বাকি থাকে কী! আরো বলেছিলাম, সময়ের উপযোগী কীর্তন অন্য সময়ে মধুর শোনাতে না-ও পারে।
যাক অতীতের সেই সব বিষয়, যাকে আমরা সহজেই বলতে পারি 'ভ্রান্তি বিলাস।'
বর্তমানে আমাদের ক্রিকেট সূর্যের গৌরবময় উজ্জ্বল অবস্থান মধ্যগগনে।
সদ্য সমাপ্ত এশিয়া কাপের এগারোতম সংস্করণে এশিয়ান ক্রিকেটের পরাশক্তিদের সঙ্গে লড়ে রানার আপ হয়েছে ন্যূনতমের চেয়ে এক রান বেশিতে। আহা, ২ রানের হারে কী হা হুতাশ আমাদের জাতীয় জীবনে, মিডিয়ায়, বাসে ট্রেনে, রাস্তাঘাটে এমন কি স্বামী-স্ত্রীর বিশ্রম্ভালাপে! যেন বড় হার হলেই ভালো হতো! একই তো বলে ক্রিকেট! সো কোজ, ইয়েট সো ফার ! কতো কাছে, কিন্তু কতো দূরে ! ভাবছি আহা যদি উল্টোটাই হতো, কী চমৎকারই না হতো, হতো প্রত্যাশিত ফলের মতোই। ভাগ্য সহায়ক ছিলোনা, তাই তো এমনটা হলোনা। এই যে পরাজয় বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের , তা শুধু গৌবরজনকই নয়, মহানও। আসলে হেরেও জিতেছে বাংলাদেশ। মানুষের হৃদয়মন জিতেছে। আর সবচেয়ে বড় জয়ী পক্ষটির নামঃ ক্রিকেট! এবং বাংলাদেশ এশিয়ান ক্রিকেটের দুই পরাশক্তি-ভারত ও শ্রীলংকাকে-যাদের রয়েছে বিশ্ব ক্রিকেট কাপ ও এশিয়া কাপ অর্জনের কৃতিত্ব-পেছনে ফেলে ফাইনালে লড়েছে আর এক পরাশক্তি-বিশ্বকাপ, এশিয়া কাপ, টি-২০ কাপ জয়ী পাকিস্তানকে ঘাম ছুটিয়ে তবেই জিততে দিয়েছে।
এখন বিশ্লেষন হচ্ছে নানারকম। ভিলেন বের করার চেষ্টা হচ্ছে। হিরো খোঁজা হচ্ছে আতিপাতি করে।
পূর্ণাঙ্গ একটি কাপ প্রতিযোগিতার আয়োজক দেশকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী উচ্ছ্বাসপূর্ণ প্রশংসার উত্তাপ উৎরে যাওয়ার আগেই ক্রিকেট বোর্ডকে পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে। সামনে, এ বছরেই আছে টি-২০ বিশ্ব ক্রিকেট কাপ। শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই-আসরে বাংলাদেশ যেন নিজেই নিজেকে অতিক্রম করে যেতে পারে আপন নিপুনতায়, তার জন্য প্রস্তুতি শুরু করতে হবে এখনই।
এখন খেলোয়াড়দের কিছুদিনের ছুটি। এরপর তাদেরকে নিয়ে শুরু হবে কোচ ও কোচিংস্টাকের প্রশিক্ষণ পর্ব। আমরা বারবার বলে আসছি, মনঃস্তাত্বিক দিকে দলটির ঘাটতি আছে। একজন দক্ষ মনঃস্তাত্বিক পারেন তাদের ভেতরকার 'সুপ্ত বাঘকে' জাগিয়ে দিতে। 'আমরা পারি, এবং আমরাই পারি', এই বিশ্বাস বোধের উদ্বোধন দলটির জন্য জরুরি।
আর কিছুদিন পর দলটিকে বিসিবির তরফে নাগরিক সম্বর্ধনা দেয়া যেতে পারে সাড়ম্বরে। সব দল মতের মানুষের সমাহারে সেই নাগরিক সম্বার্ধনা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আয়োজক করা হোক। পাঁচ তারা হোটেলের আভিজাত্যের দেয়ালের ঘেরাটোপে আবদ্ধ কোনো জায়গায় নয়।
আমন্ত্রণ জানানো হোক সকল দল মতের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে। যথাযথ মর্দাদায় জানানো হোক সেই আমন্ত্রণ।
খেলার সৌজন্য টিকেট বিতরণে যে অসৌজন্যের অভিযোগ বিসিবির বিরুদ্ধে শোনা যায়, তার যৌক্তিকতা কাজ করতে গেলে ভুল হয়' বলে যেন খোঁজা না হয়। অভিযোগ যদি সত্য হয় ফাইনালে বিরোধী দলের নেত্রীসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সমাজপতিদের আমন্ত্রণ জানালে বিসিবি-রই উদারতার পরিচয় পাওয়া যাবে। বিসিবি কোনো ব্যক্তির পকেটের সংস্থা নয়, কথাটা মনে রাখতে হবে।
ফখরুজ্জামান চৌধুরী:প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও কথাসাহিত্যিক।