দুর্যোগ-উত্তর জাপান

ফখরুজ্জামান চৌধুরী
Published : 10 March 2012, 04:12 PM
Updated : 10 March 2012, 04:12 PM

দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেলো। দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলো মার্চের ১১ তারিখ। ২০১১ সালের মার্চের শুক্রবার এই দিনে রৌদ্রালোকিত মধ্য দুপুরে হঠাৎ করেই কেঁপে উঠলো টোকিয়ো মহানগরীসহ জাপানের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ন এলাকা। রিকটার স্কেলে নয় ডিগ্রি মাত্রায় প্রলয়ংকরী এই ভূকম্পনের ফলে মুহূর্তের মধ্যে তছনছ হয়ে যায় জনপদের পর জনপদ। তহোকু ভূমিকম্পের সাথী হয়ে একশ তেত্রিশ ফুট উঁচু ঢেউ নিয়ে সুনামি যখন আঘাত করলো কিছু পরে, ধ্বংসের শিঙ্গাধ্বনির তীব্রতা বেড়ে গেলো কয়েক গুণ, যদিও জাপানিরা জিশিন অর্থাৎ ভূমিকম্পের জন্য বলা যায় তৈরিই থাকে। দেশটির অবস্থান ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে।

গত বছরের আগে সবচেয়ে দুঃসহ ভূমিকম্প জাপানকে বিধ্বস্ত করে ১৯৯৫ সালের ১৭ জানুয়ারি (মঙ্গলবার)। হানশিন ভূকম্প বা কোবে ভূকম্পন নামে পরিচিত এই ৬.৮ মাত্রার কম্পনে, যার স্থায়ীত্ব ছিলো ২০ সেকেন্ড, বন্দর নগরী কোবে এবং পাশ্ববর্তী হিয়োগো প্রিফেকচারের বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তপে পরিণত হয়। ভোরের আলো ফোটার আগে (সকাল ৫-৪৬ মি:) ঘুমন্ত জনপদে আঘাত হেনেছিলো সেই ভূমিকম্প। প্রাণ হারান ৬৪৩৪ জন, যার মধ্যে কোবে নগরীতেই মৃত্যের সংখ্যা ছিলো ৪৬০০ জন। তবে বিশ শতকের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প, যার ফলে জাপানের প্রাচীন রাজধানী নগরী কিয়োটোসহ মূল জাপানি দ্বীপ হনসুর বিশাল এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়, কান্তো তোহোকু নামে পরিচিত সেই ভূমিকম্প অনুভূত হয় ১৯২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর।

২০১১ সালে ১১ মার্চের ভূমিকম্পের আগে এটিই ছিলো জাপানের সবচেয়ে ধ্বংসকরী ভূমিকম্প। জাপানিরা বুঝে ভূমিকম্পের ভ্রকুটির নিচেই তাদের বসবাস করতে হবে। বাড়িঘর, কলকারখানা, বিশাল ইমারত, স্থাপনা জাপানে তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে ভূমিকম্প-ঝুঁকির কথা বিশেষ বিবেচনায় রেখে। জাপানে বিভিন্ন সময়ে অবস্থানকালে হঠাৎ করেই ভূমিকম্পনে ছ'তলা দালানের সর্বোচ্চ তলার ফ্ল্যাটে কম্পন অনুভব করেছি, ভবনটি বাতাসে সুপারি গাছ যে ভাবে কাত হয় মৃদু, তেমনি হচ্ছে। বড় কন্যা ও তার পরিবারের সবাইকে জাপানে অবস্থান করার কারণে ভূমিকম্পের ব্যাপারে দেখেছি মোটামুটি নিরুদ্বেগ থাকতে। কিন্তু গত বছরের ভূমিকম্পের পর তাদের আস্থার প্রাচীরে চিঁড় ঘরে। হেথা নয় হেথা নয়…. এমন চিন্তায় নয়, পূর্ব পরিকল্পিত জাপান-ত্যাগের বিষয়টি তাদের জন্য ত্বরান্বিত হয় তোহোকু ভূমিকম্পের কারণে।

ভয়াবহ সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ যারা প্রত্যক্ষ করেন নি, তাদের পক্ষে এর তীব্রতা কল্পনা করা সম্ভব নয়, সম্ভব নয় বোঝার। কী হবে তার পরবর্তী মানসিক প্রতিক্রিয়া! নাতিদীর্ঘ আকারের জাপানি মানুষগুলিকে খুব কমই দেখা যায় কোনো বিষয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে। কোটরাগত চোখের নিচে থাকে না কোন রকম আবেগের প্রকাশ।

ভূমিকম্প-সুনামি পরবর্তী সপ্তাহে ফুকুওকার নাকামুরা গাকুয়েন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপিকা মারি কাইগো জবাবি ই-মেইলে লিখেছিলেনঃ চোখের নিমেষে বদলে গেলো চিরচেনা দৃশ্যপট। জানিনা, কতোদিনে দ্বীপ-রাষ্ট্রটি এই ক্ষতি সামলে উঠতে পারবে!

কোনো রকম উচ্ছ্বাস নেই। হা হুতাশ নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথাও বোধ করি তিনি বলেছিলেন ঘটনার তীব্রতা তখন পর্যন্ত ভুলতে না পারার কারণে। পরবর্তী কালে আর কোনো ই-ইমেইলে মারি কাইগোকে হাহুতাশ করতে শুনিনি।

টোকিয়ো থেকে ভূকম্পনের অভিজ্ঞতার কথা তানিরা পরবর্তী কালে জানাতে গিয়ে যখন শুধু বলে, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি তখন বুঝতে পারি, কিছুটা হলেও এমন এক ভূমিকম্পের পরও দালানকোটা দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব একমাত্র জাপানেই। ক্ষতি যা হয়েছে, করেছে সুনামি। উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকা লন্ডভন্ড হয়েছে।

ভূমিকম্পের পর স্বাভাবিকভাবেই সেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের কার্যপরিধি সংকুচিত হবে। ব্যতিক্রম হয়নি জাপানেও। বিদ্যুত, পানি সরবরাহে টান পড়লো। জাপানিরা নিজে থেকেই পরিমিত বিদ্যুৎ-পানি ব্যবহার করলেন। খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি মোকাবেলায় নিজেরাই দোকান থেকে ন্যুনতম জিনিসপত্র কিনেছেন। নীরবে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কিনেছেন। কোনো হৈ চৈ নেই।

বড় মেয়ে তানিরা ও তার স্বামী শওকত দু'জনেই ঢাকা ডেন্টাল থেকে বিডিএস ডিগ্রিধারী। জাপান সরকারের মনোবোশু বৃত্তি নিয়ে ফুকুওকার কিউশু ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট করে টোকিয়ো মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল ইউনিভার্সিটিতে পোস্টাগ্রাজুয়েট গবেষণার ফেলো হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তাদেরকে জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো।

জাপানিদের সঙ্গে এক যুগ মেলামেশা করার কারণে কিনা জানিনা, ভূমিকম্পের কথা বলতে গিয়ে তাদের দু'জনকে কোনো রকম বাহুল্য কথা বলতে শুনিনি। শুধু বললো এই সময়ে জাপানিরা বিদেশিদের কাছ থেকে একটা জিনিসই মুধু আশা করে: সহমর্মিতা। কোনো বৈষয়িক, বস্তুগত সাহায্য নয়। তোমাদের পাশে আছি তোমাদের এই দুঃসময়ে, শুধু এটুকু আশ্বাস, -যা পুরোমাত্রায় প্রশংসনীয়ভাবে সেই সময়ে দেখিয়েছিলেন জাপান-প্রবাসী বাংলাদেশীরা তাদের কষ্টার্জিত রোজগারের টাকা দিয়ে গড়ে তোলা জাপান-সহায়ক দুর্যোগ ত্রাণ তহবিলের মাধ্যমে। একজন প্রবাসী হোটেল ব্যবসায়ী তাঁর হোটেল উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন দুর্যোগকবলিত জাপানিদের বিনামূল্যে অবস্থানের জন্য। জাপান সরকার এবং জাপানের জনগণ বাংলাদেশের মানুষদের এইসব ঘটনায় কৃতজ্ঞ বোধ করেছেন।

অন্যদিকে সরকারি পর্যায়ে দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয় টোকিয়োতে বাংলাদেশ দূতাবাস বন্ধ করে দূতাবাসের লোকজনকে অন্যত্র নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে। দূতাবাসে কর্মরত অনুর্ধ ২০ জন বাংলাদেশী কর্মকর্তা/কর্মচারীর প্রাণ রক্ষা করার প্রয়োজনে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, বোধ করি। কিন্তু এর তাৎপর্য বিবেচনায় আনা হয়নি। হ্রস্বদৃষ্টিতে গৃহীত এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছেন জাপান প্রবাসী হাজার হাজার মানুষ, একমাত্র টোকিয়োতেই যার সংখ্যা দশ হাজারের ঊর্ধ্বে। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ছিলো প্রত্যাশিত। জাপান সরকারও বিষয়টিকে দুর্যোগ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা হিসেবে মেনে নিতে পারেনি।

বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও পুরানো পরীক্ষিত বন্ধুদেশসমূহের অন্যতম জাপান, এই তথ্য শুধু কুটনীতিক পর্যায়ে স্বীকৃত নয়, সাধারণ পর্যায়েও অনুভূত।

স্বস্তির বিষয়, দূতাবাস বন্ধের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তটি কার্যকর হয়নি।

॥২॥
ভূমিকম্প পরবর্তী জাপানের সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখা দেয় ফুকুশিমা দাইচি পারমানবিক চুল্লির বৈকল্য ও তেজষ্ক্রিয়তার বিকিরণ। এই ক্ষেত্রে জাপানি পারমানবিক কর্মসূচির পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচিত হয়। সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। যার কারণে বিপদে যুক্তরাষ্ট্রকে কাছে পাওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংশয় ছিলো না। জাপানের পারমানবিক কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের জ্ঞানের বাইরে ছিলো, এমন ধারণা করা বাতুলতা।

দুর্যোগ পরবর্তী জাপানের ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপারে কোনো কোনো মহলে তেমন সংশয় ছিলো তবে কতো সময় লাগবে তা নিয়ে দু:শ্চিন্তা ছিলো যেমন জাপানে তেমনি বহির্বিশ্বেও।

যারা জাপানকে দেখেছেন কাছে থেকে তারা কিন্তু নি:সংশয় ছিলেন তার ঘুরে দাড়ানোর বিষয়ে। হিরোশিমা-নাগাসাকির ধ্বংসস্তুপের ওপর আজকের জাপানকে দেখে কর্মনিপুন এক জাতির প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা না রেখে পারা যায় না।

নয় মাত্রার ভূমিকম্প আর ১৩৩ ফুট জলোচ্ছ্বাসের পর এক বছর কেটে গেছে। এখন আর জাপানের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। আছে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিরান জনপদে এক ধরণের গা-ছম ছম করা নীরবতা। প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়কে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাওতো কান বর্ণনা করেছিলেন দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজয়ের পর জাপানের জন্য সবচেয়ে বিপর্যয় হিসেবে।

জাপানের এই ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি নিহিত আছে এর মানুষ, প্রতিষ্ঠান ও পরাজয় না মানা দৃঢ়চিত্ত জাতীয় বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। হারি-কিরির মতো আত্মবিধ্বংসী প্রথা, কামাকাজের মতো আত্মত্যাগী বৈমানিকের অস্তিত্ব একমাত্র জাপানেই সম্ভব।

তবে জাপানের সামনে রয়েছে এমন এক সমস্যা যার কারণে একদিন এই সমৃদ্ধ দেশটিকে বিপদে পড়তে হতে পারে।

জাপানিদের বয়স যতো বাড়ছে, বিপদের মাত্রাও বাড়ছে ততো। জাপানের জনসংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমে যাচ্ছে। জাপানের প্রাপ্তবয়স্করা অতিদ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছেন। সেই তুলনায় নারী প্রতি জাপানি শিশুর জন্মহার মাত্র ১.৩৯ ভাগ, যা যে কোন নিরিখে উদ্বেগজনকভাবে কম।

সরকারি এক জরিপে জানা যায় ২০৬০ সালের মধ্যে জাপানের বর্তমান জনসংখ্যা ১২৮ মিলিযন নেমে আসবে এক তৃতীয়াংশে। আর প্রতি দশজনের মধ্যে চারজনের বয়স হবে পয়ষট্টি বছরের বেশি। জনসংখ্যার মানচিত্রে কী বিপরীত অবস্থানে আছে আমাদের প্রিয় স্বদেশ, বাংলাদেশ!

ফখরুজ্জামান চৌধুরী: প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও কথাসাহিত্যিক।