মায়ার খেলা

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 8 July 2015, 05:29 AM
Updated : 8 July 2015, 05:29 AM

কবিরা ভবিষ্যতদ্রষ্টা এটা জানলেও মানার জন্য তো উদাহরণ চাই। সেই কবে রবীন্দ্রনাথ নৃত্যনাট্য লিখেছিলেন, 'মায়ার খেলা'। কৌশলী রবি ঠাকুর বলে যাননি এ মায়ার খেলা নানা কিসিমের হতে পারে। একদিন তা বঙ্গদেশের রাজনীতিতে দেখব আমরা।

একটা কথা একশ ভাগ সত্য যে, আওয়ামী লীগ যেমন বড় দল, তার চেহারা, আচরণও ব্যাপক। একদা আন্দোলনমুখী উজ্জ্বল এই দলের হাত ধরে স্বাধীনতা এলেও এর সে সব নেতাদের কেউ আর জীবিত নেই। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের রেখে যাওয়া স্মৃতি ও কর্মপ্রবাহের ওপর ভর করে চললেও দলে যেমন মোশতাক ছিলেন, এখনও আছেন। 'মায়ার খেলা' নামের সাম্প্রতিক সময়ের নাটকে আমরা সেটাই দেখছি। মায়া-পর্বের বিশ্লেষণ বা এর অযৌক্তিক ব্যাখাতীত ঘটনাবলী দেশের জন্য নতুন কিছু নয়। বরং আমরা দেখব কীভাবে এর বিস্তার আর কীভাবে তা শেকড় গেড়ে আমাদের সম্ভাবনা ধ্বংস করে।

বাংলাদেশে এখন দুটো বিষয়ে কথা বলা যায় না। একটা ধর্ম, আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ। ধর্ম নিয়ে একচুল এধার ওধার হলে জীবননাশ হবার আশঙ্কা। কেউ কোনো বিষয়ে বিশ্লেষণ বা মতামত প্রকাশ করলেই বিপদে পড়তে হয়। মানি, এটা স্পর্শকাতর ও বিশ্বাসের বিষয়। বিশ্বাসী মানুষজন আপন বিশ্বাসচ্যূতি আর পাপের ভয়ে এমন করেন। মুক্তিযুদ্ধের বেলায় দেখছি আরেক ধরনের ভয়। যেন 'ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না' জাতীয় ব্যাপার। এটাও কিন্তু ভয় থেকে এসেছে।

স্বীকার করছি না বটে, ক্রমাগত ফিকে হয়ে আসা চেতনা আর বদলে যাওয়া মানুষদের দেখে আমরা শঙ্কিত। যে যে ধর্মের যে সম্প্রদায়ের হোক না কেন, কোনো একটি জায়গায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে নিজের মতো করে দেখেন। তার বাইরে গেলেই ভয় আর আশঙ্কার কারণে সবাই কেমন যেন রগচটা হয়ে থাকেন। পান থেকে চুন খসলেই রাজাকার বানিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আমাদের দেশে একদা মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন আসলেই রাজাকার বানিয়ে ছেড়েছে, তেমনি জন্ম দিয়েছে মায়ার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন ইমেজ। বীর বিক্রম বা বীর বাহাদুররা পদবি আর খেতাবের জোরে চলেন। আপনি তো ধারেকাছেই ঘেঁষতে পারবেন না।

রাজনীতিতে দুধরনের মানুষ সক্রিয় ও সার্থক। এক দলের হাতিয়ার স্বাধীনতার চেতনা, আরেক দলের হাতে স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে মানুষ রাগিয়ে তোলার ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের অস্ত্র। মায়ারা প্রথম দলে। তারা একদা যুদ্ধ করলেও এখন রাস্তা পাহারা দেন। কী অদ্ভূত মিল! বাঘা সিদ্দিকী যেমন বঙ্গবীর হয়ে এখন রাস্তায় শুয়ে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশে ব্যস্ত, মায়াকেও দেখেছি বিএনপি ঠেকাতে লুঙ্গি পরে রাস্তায়।

এতে অসুবিধে ছিল না। দলের সবাইকে কোট-প্যান্ট পরে মওদুদের মতো ইফতারে আসবেন আর আন্দোলনের সময় লুকিয়ে থাকবেন এমন হতে হবে না। কিংবা সুরঞ্জিত বাবুর মতো পাঞ্জাবি-পাজামা পরে দলের হয়ে বড় বড় কথা বলবেন আর পদবিহীনতায় সন্তুষ্ট থেকে মোসাহেবি করবেন, রাজপথে থাকবেন না তেমনও নয়। কিন্তু মায়া বিরোধী দলকে ব্যর্থ করতে না পারলে চুড়ি পরার হুমকি দিলেন বটে, ঘরের ব্যর্থতা সামাল দিতে পারলেন না। সে দায় কি তিনি অস্বীকার করতে পারবেন?

এখন যে প্রশ্ন বা যে সমস্যা তিনি আরও প্রকট করে তুললেন তাতে তার চেয়েও দল আর সরকার পড়েছে বিপাকে। আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগ আর বিএনপি মানেই ব্যাপক বিনোদন। এদের মন্ত্রিত্ব বা পদবি যে কীভাবে নির্ধারণ করা হয় বোঝা মুশকিল। বিএনপি আমলে আমরা চুলে জেল দেওয়া, পুলিশ-মিলিটারিকে চোখ উঁচিয়ে নাক বাঁকিয়ে কথা বলে উত্তেজিত করার নাবালক বাদশা বাবরকে দেখেছি। পরিণতি কী সেটা তো এখন আর বলার মতো নয়।

তেমনই আমরা দেখলাম সেতু-নায়ক আবুল হোসেনকে। সরকারের ভালো-মন্দ সব ফেলে ক্রমাগত তিনি হয়ে উঠেছিলেন শিরোনাম। পদ্মার ঢেউ টাকার ঢেউ মিলে আবুল হোসেন চলে গিয়েছিলেন সাগরের ওপারে। তার নাম, তার বিষয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ভালো প্রভাব ফেলেছিল। সে এক ধুন্দুমার কাণ্ড। আজ আবুল হোসেন নেই। 'কোথাও কেউ নেই'এর মতো।

মায়া সাহেবের খুঁটি অবশ্য অনেক পোক্ত। সে কারণে তার বিষয়টি দলের জন্য, সরকারের জন্যও অনভিপ্রেত। কিন্তু এটাই এখন নিয়তি। আমাদের দেশের রাজনীতিতে মায়া-মমতার দিকটা এত বেশি যে, তাকে অবহেলা করা যাবে না। আবার এই মায়ার ফাঁদে বা মায়ার পাকে কে কী হারায় আর কী পায় সেটাও এখন দেখার বিষয়।

তবে আমরা দেখছি সরকারের অর্জন বা জাতির যে সম্ভাবনা তার অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়ছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দেশের এক ব্যাপক সুশীল অংশ সরব। যে কোনো কারণে হোক তারা বদলে যাওয়া বা বদলে দেওয়ার দলে। এদের সাইকোলজি বা মনস্তত্ব বোঝা মুশকিল। কখনও মনে হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার বেদনা, কখনও মনে হয় ধর্মীয় কারণ, কখনও-বা আওয়ামী লীগের ঔদ্বত্যের জন্য এদের এমন আচরণ মনে হলেও আসলে এরা কী চায় বোঝা মুশকিল!

আমি অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বুঝতে চেয়েছি। শেষ পর্যন্ত দেখলাম ওদের একটাই কথা, সব মানি, আওয়ামী লীগ মানি না। যার মানে, এই অনেক কারণে মেশানো এক ককটেল পানে বুঁদরা খেয়ে না-খেয়ে শেখ হাসিনা-বিরোধী। এমন মানুষের সংখ্যা কত আর তারা কী চায় সেটা নির্বাচনেই বোঝা যাবে। তবে এটুকু বলতে পারি যে, আওয়ামী লীগের জন্য সেটা সুখকর কিছু নয়। ফলে আত্মতুষ্টির জায়গা নেই। বাড়াবাড়িরও নয়। কিন্তু কেউ শোনে না ধর্মের কাহিনি। আওয়ামী লীগাররা তো নয়-ই। তারা যে কী বস্তু আর কী কী করতে পারেন সেটা কাছে না গেলে বোঝা মুশকিল।

মায়াকে আমরা জাতীয় পর্যায়ে দেখছি বটে, দেশে বিদেশে এই দলে হাজার হাজার মায়া ও তার ছায়া আছে। যাদের দিলে সাহস আর মনে ফূর্তির কমতি নেই। তারা কথায় এত শক্ত আর তেজী যে শুনলে ভয় লাগে। কিন্তু বিপদের কালে তাদের টিকি মেলা ভার। বিশেষত বিগত কয়েক বছরের কমর্কাণ্ড দেখলে সেটাই প্রমাণিত হয়ে যায়।

বিদেশে আওয়ামী লীগ এবং এর নেতারা নিজেদের ভূমিকা আর খবরদারিতে এত সন্তুষ্ট, জনগণের তোয়াক্কাই করে না। আশ্চর্যের বিষয়, এদের টার্গেট গ্রুপও ভিন্ন। জামায়াত-বিএনপির পরিবর্তে নিজেদের ভেতর দ্বন্দ্ব আর আমাদের ওপর চড়াও হবার ভেতরেই এদের সুখ-শান্তি। দেশেও তাই। মায়ার মতো পুরনো, ঝানু আর নির্ভরযোগ্য নেতারাও এখন আত্মবিধ্বংসী।

এর সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ বোঝা জরুরি। কেউ যদি মনে করেন, বিএনপি আওয়ামী লীগের কারণে পিছিয়ে পড়েছে, তবে ভুল করবেন। বিএনপি পিছিয়ে আছে নিজেদের কারণে। সে কারণের মূল বা উৎস হচ্ছে সময় ও প্রগতির সঙ্গে চলতে না-পারা। এখনকার প্রজন্ম বা মানুষজন অন্ধ নয়। কেউ কিছু বলে দিলে বা করলেই তারা 'জী জী' করে মেনে নেবে না। বলার সাহস বা মুরোদ না থাকলেও মনে মনে বুঝে নেবে।

বিএনপির ধরাটা সেখানে। বয়সী নেতারা নতুনদের তৈরি করেনি। নিজেরাও আপডেট থাকেনি। যে কারণে তারা মানুষের মনের ভাষা পড়তে ব্যর্থ। একদা গায়ের জোরে টাকার জোরে বা মানুষের অন্ধবিশ্বাসের জোরে পার পেয়ে গেলেও এখন তারা নিজেদের জালে আটকা পড়ে গেছেন। তাদের মুক্তি যে কোথায় নিজেরাও জানেন না।

আওয়ামী লীগেও সে দুর্গতির প্রতীক এসব নেতারা। শেখ হাসিনা দুয়েকজন নতুন মুখ আনলেও এখনো পুরনো নেতারাই দাবিয়ে বেড়াচ্ছেন। এরা অভিজ্ঞ নিঃসন্দেহে, পোড়খাওয়া প্রবীণ। কিন্তু যে আগুনে তারা পুড়েছিলেন সে আগুন আর আজকের দুনিয়া ও রাজনীতির আগুন এক নয়। নতুন আগুনে স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়-প্রীতি, গায়ের জোর আর অর্থের জোর সাময়িক। এটা যারা বোঝেন না তারাই ধীরে ধীরে মায়া হয়ে ওঠেন। একদা মুক্তিযোদ্ধা, একদা সৈনিক বীরদেরও অস্ত্রে শান দিয়ে যেতে হয়। না হলে মরচে পড়ে। মরচেপড়া অস্ত্রে শত্রুবধ তো হয়ই না, উল্টো নিজের পায়ে বা সাথীর গায়ে আঁচড় কাটে।

আজকের সমস্যা তাই। বহুকাল আগে সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত আমাকে তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছিলেন। সংবাদ অফিসে আড্ডা শেষে তাঁর সঙ্গে রিকশায় যাচ্ছিলাম। দুঃখ করে বলছিলেন, সে সময় আওয়ামী লীগে নবীনদের অভাব নিয়ে তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ শীর্ষ নেতারাও ভালোভাবে নিতে পারেনি। তিনি লিখেছিলেন, আওয়ামী লীগে কি চল্লিশের বেশি বয়সী নেতা-কর্মীর বাইরে লোকজন নেই?

আর যায় কোথা। সে বছর আওয়ামী লীগ তাঁকে কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়নি। চিঠিও পাঠায়নি। অথচ এর পরপর আওয়ামী লীগের ভোট-বিপর্যয় আর মেয়র হানিফ ও অন্যান্যদের কৌশলী নেতৃত্বে নতুন মুখরাই সুদিন ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু এ দলটির সুদিন মানে প্রয়াত আহমদ ছফার সে বিখ্যাত উক্তি: 'জিতলে তারা একাই জেতে আর হারলে আমরা সবাই হেরে যাই।'

মায়া সমস্যার মায়াজাল থেকে বেরুতে হলে তাই স্বজনপ্রীতি আর সে বলয় থেকে বের হতে হবে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির জন্য কাজটা সহজ কিছু নয়। পারলে মঙ্গল, না পারলে জবাবও পেতে হবে। জবাব পেলেও তারা ভুলে যায়। আবার যখন বিপদে পড়ে তখন না-বোঝার ভান করে।

আওয়ামী লীগের বয়সী নেতারা যে কামের চাইতে আকাম বেশি করছেন আর তাতে দলের শেকড় আলগা হচ্ছে সেটা খালেদা জিয়ার কথাতেই স্পষ্ট। এ লেখা যখন লিখছি, খবরে দেখলাম, খালেদা জিয়া বলেছেন পুলিশ বোমা না ছুঁড়লে নাকি তাদের আন্দোলন থামত না। যার মানে, আন্দোলন থামিয়েছে পুলিশ। লীগের কর্মীবাহিনী বা নেতাদের কথা মুখেও আনেননি তিনি। এরপরও কি তারা বলবেন যে, তারা সার্থক?

আগেই বলেছি মায়ার দেশ, ভালোবাসার দেশ বাংলাদেশ। এখানে আসল মায়া নকল মায়া আর মায়ার কুহকজাল আছে। মানুষ তা বুঝতে পারছে। রাজনীতিই বুঝে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।