তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রার্থনা

মুহম্মদ জাফর ইকবালমুহম্মদ জাফর ইকবাল
Published : 12 Jan 2014, 05:07 PM
Updated : 12 Jan 2014, 05:07 PM

খুব সহজে আমার মন খারাপ হয় না। কিন্তু গত কয়েকদিন থেকে আমার খুব মনখারাপ। যারা এক নজর পত্রিকার দিকে তাকাবে কিংবা টেলিভিশনে খবর শুনবে তাদেরও মন খারাপ হয়ে যাবে। শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে এই দেশে মানুষের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভয়ে আতংকে জীবন বাঁচাবার জন্যে এই মানুষগুলো নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে। বাড়ির মেয়েদের বাড়ি থেকে সরিয়ে দিচ্ছে।

১৯৭১ সালে হিন্দু মুসলমান সবাই আক্রান্ত হয়েছিল। মুসলমান হলে কখনও কখনও হয়েতো মানুষ বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু হিন্দু হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে কেউ কখনও প্রাণে বেঁচে ফিরে আসেনি। ১৯৭১ সালে আমরা গ্রামে লুকিয়ে আছি, তখন দেখেছি একজন হিন্দু মা তার শিশুসন্তানকে বুকে চেপে ধরে স্বামীর পিছু পিছু ছুটে যাচ্ছেন, তাদের চোখ-মুখের সেই উদভ্রান্ত অসহায় দৃষ্টি আমি কখনও ভুলতে পারব না।

তেতাল্লিশ বছর পর এই বাংলাদেশে এখনও একজন অসহায় হিন্দু মা তার সন্তানকে বুকে চেপে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে ছুটে যাচ্ছেন। তার মানে যে দেশকে নিয়ে আমরা এত গর্ব করি সেই দেশটি আসলে তেতাল্লিশ বছরে এক ইঞ্চিও সামনে অগ্রসর হয়নি। এর চাইতে বড় দুঃখ, লজ্জা আর অপমান কী হতে পারে?

আমি মাঝে মাঝে কল্পনা করি আমি যদি এই দেশে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হতাম তাহলে আমার কেমন লাগত। আমি জানি তাহলে গভীর হতাশায় আমার বুক ভেঙে যেত। আমি কোনো দোষ করিনি, কিন্তু শুধুমাত্র একটি হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছি বলে আমার উপর যে নৃশংস অত্যাচার করা হচ্ছে তার জন্যে আমার বুকে যেটুকু ক্ষোভ জন্ম নিত তার চাইতে শতগুণ বেশি অভিমান হত আমার চারপাশের নির্লিপ্ত মানুষজনকে দেখে। কেউ কোনো কথা বলছে না, নিরবে এক ধরনের করুণা নিয়ে আমাকে দেখছে।

সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ হত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। প্রতিবার নির্বাচনের পর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় হবার পর, রায় কার্যকর হবার পর আমাদের উপর হামলা করা হবে। বিএনপি-জামাত হামলা করবে, আওয়ামী লীগ বা বাম দলগুলো সেটা ঘটতে দেবে। খুব বেশি হলে, নিরাপদ দূরত্ব থেকে প্রতিবাদ করবে। কিন্তু বুক আগলে কেউ রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না।

এই দেশে আমি যদি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হতাম তাহলে নিশ্চয়ই আমার বার বার মনে হত আমি এই দেশের মানুষ, কিন্তু এই দেশটি আমাকে রক্ষা করছে না। আমি নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করে বলতাম– ''তুমি কেন আমকে এমন একটি দেশে জন্ম দিয়েছ যেই দেশ আমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেয় না? এই দেশে আমাকে প্রতি মূহুর্ত আতংকে থাকতে হয়?'' কিন্তু আমি হিন্দু ধর্মাবলম্বী নই; তাই প্রকৃতপক্ষে তাদের বুকের ভেতর যে গভীর দুঃখ, ক্ষোভ, হতাশা আর অভিমান পুঞ্জিভূত হয়ে আছে আমি সেটা কোনোদিন অনুভব করতে পারব না।

আমাদের প্রিয় দেশটি নিয়ে আমাদের কত কল্পনা, কত স্বপ্ন। আমরা আশা করে আছি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করবে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাবে, একদিন দেশটা মাথা তুলে দাঁড়াবে। আমরা এর মাঝে সেগুলো এই দেশে শুরু হতে দেখেছি। কিন্তু এই মূহুর্তে আমার কাছে সবকিছু অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে। যদি আমরা একজন মানুষকে শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার জন্যে এই দেশে নিরাপত্তা দিতে না পারি তাহলে এই দেশটি কাদের জন্যে?

আমার মনে হয়, এই দেশ নিয়ে আমাদের যত কল্পনা, যত স্বপ্ন, যত পরিকল্পনা সবকিছু পেছনে সরিয়ে সবার আগে আমাদের এখন একটি মাত্র লক্ষ্য টেনে নিয়ে আসতে হবে। সেই লক্ষ্যটি হচ্ছে, এই দেশে একটি হিন্দু শিশু যেন নিশ্চিন্ত নিরাপত্তায় তার মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে পারে। গভীর রাতে ধর্মান্ধ মানুষের উম্মত্ত চিৎকারে তাদের যেন জেগে উঠতে না হয়। আগুনের লেলিহান শিখায় আপনজনের আতংকিত মুখ দেখতে না হয়। একজন হিন্দু কিশোরীকে যেন তার বাবার রক্তশূন্য মুখের দিকে তাকিয়ে থরথর কাঁপতে কাঁপতে বলতে না হয়– "এখন কী হবে বাবা?"

আমরা পদ্মা সেতু চাই না, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চাই না, যানজটমুক্ত বাংলাদেশ চাই না, শতকরা একশভাগ নিরক্ষর চাই না, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ চাই না। শুধুমাত্র হিন্দু এবং অন্যসব ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা চাই যেন তারাও ঠিক আমাদের মতো এই দেশটিকে তাদের নিজেদের ভালোবাসার দেশ বলে ভাবতে পারে। তীব্র অভিমানে তাদের বুক ভেঙে যেন আর কোনোদিন খান খান হয়ে না যায়।

আমি কার কাছে এটি চাইব জানি না, তাই তরুণ প্রজন্মের কাছে চাইছি। তোমরা আমাদেরকে একটি নূতন বাংলাদেশ উপহার দাও। যে বাংলাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প চিরদিনের জন্যে মুছে দেওয়া হবে। আমি জানি তোমরা পারবে।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।