গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 10 Jan 2014, 05:26 PM
Updated : 10 Jan 2014, 05:26 PM

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের দিন বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইন সংবাদপত্রে "বিপদে 'মোরা' না যেন করি ভয়" শিরোনামের একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করি। সেখানে আমি লিখেছিলাম,

"বর্তমান বিশ্বে শুভ পরিবর্তনের যে দোলাচল আমরা লক্ষ্য করছি, তাতে প্রয়োজনে সীমিত সময়ের জন্য হলেও 'গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের' কথা আমাদের গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করতে হবে"।

লিখেছিলাম,

"এ নির্বাচনের পর কেমন সরকার, কেমন মন্ত্রিসভা আমরা চাই, কী আমাদের প্রত্যাশা হবে তাদের কাছে, জেগে ওঠা নতুন প্রজন্মের করণীয় কী হবে– সে সম্পর্কে আরও বলার ইচ্ছা রাখি পরবর্তী নিবন্ধে।''

ইতোমধ্যে দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, নির্বাচিত সংসদগণ শপথ নিয়েছেন এবং আগামী ১২ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। এই প্রেক্ষাপটে 'গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব' শিরোনামের লেখাটির আয়োজন।

'গণতন্ত্র' শব্দটি শুনতে আমাদের সবার খুব ভালো লাগে। শব্দে সীমাবদ্ধ না থেকে নাগরিক জীবনে, সমাজ ব্যবস্থায়, সরকার ও রাষ্ট্র প্রশাসনে গণতন্ত্র পরিব্যাপ্ত হোক, এটা আমরা সবাই চাই– মনেপ্রাণে কামনা করি।

অপরদিকে 'একনায়কত্ব' শব্দটি শুনতে ভালো লাগে না, কোথাও একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক, তেমন একটা ব্যবস্থার অধীনে আমরা থাকি– তা প্রত্যাশা করি না। বিষয়টি নিয়ে ভাবা যাক।

'গণতন্ত্র' ও 'একনায়কত্ব' কী পরষ্পরবিচ্ছিন্ন দুটো বিষয়? বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন রূপে যে গণতন্ত্র রয়েছে, সেখানে কি একনায়কত্ব নেই?

আমেরিকান গণতন্ত্রের উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। সে দেশে স্থানীয় সরকার, বিচার ব্যবস্থা এবং প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োজন হয় এমন সব নানা প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক বিধি-বিধান অনুশীলন হয়। জনগণ তার সুফলও ভোগ করে।

সরকার, যার মধ্যে প্রেসিডেন্ট, সিনেট এবং কংগ্রেস রয়েছে সেখানে গণতান্ত্রিক বিধি-বিধান অনুশীলন হলেও, শাসকদলের ভাষায় 'আমেরিকা ও তার জনগণের স্বার্থে' দেশের অভ্যন্তরে, ('হোমল্যান্ড সিকিউরিটি') এবং পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে চরম একনায়কত্ব তারা খোলাখুলি প্রর্দশন করে (ইরাক আক্রমণ ও সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি, পাকিস্তানের ভূখণ্ডে এসে লাদেনকে হত্যা করা, বিদেশি ভূখণ্ডে গুয়ানতানামো কারাগারে বন্দিদের আটকে রাখা ইত্যাদি)।

গণতন্ত্র এবং একনায়কত্বের এমনি পাশাপাশি অবস্থান আমরা দেখব গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ডে, ইউরোপে এবং সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারতে। মোট কথা, আমরা মেনে নিই বা না নিই, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও একনায়কত্বের স্থান রয়েছে।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল প্রশ্নটি অবশ্য অন্য জায়গায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অটুট রেখে, তার বিধি-বিধান মেনে, অশুভ শক্তির উপর একনায়কত্ব চালানো সম্ভব কিনা। আমি মনে করি সম্ভব; কারণ অশুভ শক্তির প্রতি কঠোরতা এবং সাধারণ জনগণের উপর কোমলতার সাযুজ্য যখন ঘটে, তখন তার সুফল পায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।

গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের' রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কী, কী হবে এই ব্যবস্থায়, কারা তা বাস্তবায়ন করবে– এসব বিষয়ে এখন বলব–

বাস্তব প্রয়োজনে স্বাধীন বাংলাদেশে 'গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের' প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোভাবটি কী ছিল? দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের সুশীল সমাজ সে অনুসন্ধান কখনও করেনি। তার মূল কারণ হল তারা জনবিচ্ছিন্ন, পরোপজীবী এবং দেশ ও জনগণের জন্য ক্ষতিকর।

স্বাধীনতার ঊষালগ্নে 'গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের' দাবিটি ছিল প্রবল। একটি 'বিপ্লবী জাতীয় সরকার' অভিধায় সে প্রত্যাশা প্রকাশিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এমন সকল দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তির সমন্বয়ে এমন একটি বিপ্লবী সরকার একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করবে, এটাই ছিল সে সময়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক চেতনার ঘনীভূত রূপ।

সে রাজনৈতিক কর্তব্য বঙ্গবন্ধু সম্পাদন করতে চেয়েছিলেন বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে, ১৯৭৪ সালের শেষে। কিন্তু তার উপযুক্ত সময় ছিল মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে, ১৯৭২ সালে।

ইতোমধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোর সকল স্তরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের একনিষ্ঠ অনুসারী অপশক্তি জায়গা করে নিয়েছে। তাই আমরা দেখি বঙ্গবন্ধু যখন বাকশালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, ৬০টি জেলায় (আহমেদ, ২০০৪) নিয়োগকৃত গভর্নরদের ক্ষমতায়িত করতে যাচ্ছিলেন, তখনই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে। আমাদের হারাতে হয় জাতির জনককে সপরিবারে।

সে সব হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় জাতীয় চার নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য বীর সেনানীকে হত্যা করা হয়। দীর্ঘ একুশ বছর ধরে বাংলাদেশ শাসন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী জিয়া-এরশাদ-খালেদা চক্র।

আজকে আওয়ামী লীগ করেন না কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবেন (যেমন ড. সলিমুল্লাহ খান) তারাও বলছেন যে বাংলাদেশের সহিংসতার মূলে রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া। গত নির্বাচনের পূর্ব থেকেই জামায়াত পরিষ্কারভাবেই গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়েছে এবং সে অনুযায়ী হত্যা, সংখ্যালঘুদের উপর পরিকল্পিত আক্রমণসহ নানা ধংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।

এ কাজে তাদের আদর্শিক, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক সহায়তা দিচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ৬ জানুয়ারি, ২০১৩ নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায় যে বেগম জিয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে তিনি পারবেন না, সময় হলে দেখা যাবে।

অন্যদিকে তাঁর পুত্র তারেক জিয়া– যিনি হাওয়া ভবন প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্র এবং জনগণের বিরুদ্ধে চরম একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আকণ্ঠ দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং আর কখনও রাজনীতিতে অংশ নেবেন না এমন মুচলেকা দিয়ে ব্রিটেনে পাড়ি দিয়েছিলেন, তিনিও খোলাখুলি লাদেন স্টাইলে জামায়াত-বিএনপি সৃষ্ট সন্ত্রাস, হত্যা এবং ধংসযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিদেশ থেকে। অস্বীকার করছেন বাহাত্তরের সংবিধানের চেতনা। বলেছেন সেই সংবিধানে নাকি বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি।

৪ জানুয়ারি, ২০১৩ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত সভায় অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেছেন,

"জামায়াতে ইসলামীর অধীনে এখন ১২৫টি জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। ইসলামী ব্যাংক-বিমাসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে এদের অর্থের জোগান দেওয়া হয়। এসব দিয়ে জামায়াত গৃহযুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে।"

সে সভাতে ড. জাফর ইকবাল বলেছেন,

"সমাধান আছে। গাইবান্ধার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি তা দেখিয়ে দিয়েছে। সমাধানটা হচ্ছে, জামায়াত-ই-ইসলামীকে পরিত্যাগ কর, আমরা একত্র হব, কারণ আমরা মানুষের জন্য রাজনীতি করি […]"।

তবে দুঃখজনক সত্যটি হচ্ছে এই যে, জামায়াত এবং জঙ্গিদের পরিত্যাগ করে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণের উপর্যুপরি আহবান বেগম খালেদা জিয়া প্রত্যাখ্যান করেছেন। দশম সংসদীয় নির্বাচন যে কারণে বিএনপি বর্জন করেছে, তার পেছনে কোনো 'নৈতিকতা' নেই।

বিএনপি এবারের নির্বাচনে যোগদান করেনি। কারণ তাদের প্রধান শরিক জামায়াত-ই-ইসলামীকে রক্ষা করতেই তারা এই নির্বাচন বয়কট করেছে। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের এই সিদ্ধান্তে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ গত ৫ বছরে বিএনপি বহুবার বর্তমান সরকারের অধীনে ইলেকশন কমিশনের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন করেছে, অনেকগুলোতে জয়লাভও করেছে।

তাই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিয়াল্লিশ বছর পর যখন বিএনপি-জামায়াত এবং জঙ্গি গোষ্ঠী বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ১৯৭১-এর মতো হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং ধংসযজ্ঞ চালাচ্ছে এবং দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তখন সাধারণ মানুষ আপন স্বার্থেই ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পরপর যা চেয়েছিল, তাই আজ দাবি করবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষের মোর্চার কাছে।

আর সেই দাবিটি হল সীমিত সময়ের জন্য হলেও (১১ তম সংসদীয় নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত) 'গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব' প্রতিষ্ঠা। 'গণতান্ত্রিক একনায়কত্বে'– গণতন্ত্রের সকল সুযোগ ও অধিকার থাকবে জনগণের জন্য এবং একনায়কত্ব আরোপিত হবে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত এবং তাদের সহযোগী সকল শক্তির বিরুদ্ধে।

গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের সরকার সামনের দিনগুলোতে জামায়াত ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অবশ্যম্ভাবী গৃহযুদ্ধের সময় নেতৃত্ব দিবে। এই একনায়কত্ব কায়েম ছাড়া সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি সম্ভব হবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষের সকল শক্তির ব্যাপক ঐক্য গড়ে তুলে জামায়াত-বিএনপি চালিত গৃহযুদ্ধে লিপ্ত শত্রুদের মোকাবেলা করাই হবে 'গণতান্ত্রিক একনায়কত্বে'র প্রধান কাজ।

গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব পরিচালনা করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এবং ১৪ দলীয় রাজনৈতিক ঐক্য। সে অনুযায়ী মন্ত্রিসভাও গঠন করতে হবে। গৃহযুদ্ধে লিপ্ত জামায়াত-বিএনপিকে মোকাবেলা করা ছাড়াও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধপন্থী গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে–

১) জামায়াত-ই-ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে জামায়াত ও তার সকল সহযোগী সংগঠনকে 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে ঘোষণা করতে হবে এবং জামায়াতের সকল অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে।

২) অবিলম্বে জামায়াতের আক্রমণে আক্রান্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে চলতি সন্ত্রাস এবং হত্যাযজ্ঞের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ এর অধীনে জামায়াতের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিনা, তা দ্রুত পর্যালোচনা করতে হবে। এমনকি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে (আইসিসি) মামলা দায়ের করা যায় কিনা, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে হবে।

৩) গত ৫ বছরে সরকারে থেকে যারা দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছে, যাদের নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা নেই, তাদের নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া যাবে না। তাছাড়া দলীয় পর্যায়ে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৪) অনলাইন এবং অন্যান্য মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে লড়ে যাওয়া নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ এবং কর্মপদ্ধতি সমন্বয় করতে হবে। জামায়াতি প্রোপাগাণ্ডা মোকাবেলায় তাদের যত রকমের সাহায্য-সহযোগিতা-নিরাপত্তা প্রয়োজন, তা দিতে হবে।

৫) রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সংযোগকারী হাইওয়েসমূহকে নির্বিঘ্ন রাখার জন্য সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা। এ ক্ষেত্রে হাইওয়েতে চলাচলকারী জনগণ, পরিবহণ মালিক-শ্রমিক-ব্যবসায়ীদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য একনায়কত্ব প্রয়োগ হবে গৃহযুদ্ধে লিপ্তদের বিরুদ্ধে।

৬) রাষ্ট্র প্রশাসনের (প্রতিরক্ষা ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ) সকল শাখাকে জামায়াত-জঙ্গিমুক্ত করার দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে একনায়কত্ব আরোপ হবে তাদের উপর।

৭) শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের রূপটি হবে– একদিকে শিক্ষার্থী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার, শিক্ষাদান ও তা গ্রহণের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। এজন্য অবিলম্বে জেনারেল জিয়াউর রহমান আরোপিত অধ্যাদেশ– যাতে বলা হয়েছে, সকল রাজনৈতিক দলের একটি ছাত্র সংগঠন থাকবে– তা বাতিল করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র সংগঠনের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বন্ধে তা প্রভূত সাহায্য করবে।

দেশে গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং ভবিষ্যত নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যে কোনো সংগঠনের তৎপরতা নিষিদ্ধ করতে হবে। এদের এবং যে কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রমের (ছাত্র বা শিক্ষক উভয়ের তরফ থেকে) বিরুদ্ধে একনায়কত্ব আরোপ করতে হবে।

সদ্য বিগত সরকারের আমলে সংসদে গৃহীত শিক্ষানীতির কিছু মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের গ্ণজাগরণ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতির স্বপক্ষে যে চেতনার সৃষ্টি হয়েছে, তাকে ধারণ করবে পরিবর্তিত শিক্ষানীতি। সোনার বাংলা গড়তে হলে আমাদের চাই একটি সমন্বিত শিক্ষাকার্যক্রম, যাতে সমাজে বৈষম্য, বিভেদ এবং পশ্চাদপদতার বদলে সাম্য, ঐক্য এবং অগ্রসরতা নিশ্চিত হয়।

৮) বাংলাদেশের বিপন্ন পরিবেশ রক্ষায় গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব কার্যকর ভূমিকা রাখবে। শুধুমাত্র মানুষ নয়, পানি, উদ্ভিদ, পাখি, প্রাণিকুলসহ সকল প্রজাতির প্রকৃতিগত অধিকার (মানবকুলের গণতান্ত্রিক অধিকার) নিশ্চিত করার স্বার্থেই একনায়কত্ব কঠোরভাবে আরোপ হবে ভূমিদস্যু, বৃক্ষকর্তনকারী (জামায়াত-বিএনপি দ্বারা গত কয়েক মাসে সারাদেশে হাজার হাজার বৃক্ষ কর্তন করা হয়েছে) এবং পরিবেশ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে।

৯) আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে শক্তিশালী এবং বিস্তৃত করতে হবে। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত সাজা প্রদান ও তা কার্যকর করতে হবে।

সর্বোপরি, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠাই হবে গণতান্ত্রিক একনায়কত্বকালীন সরকারের মূখ্য কাজ।

গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের সময় কি জরুরি অবস্থা জারির প্রয়োজন আছে? অনেকেই এটা জারির পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন। গৃহযুদ্ধকালীন সময়ে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। আমেরিকান সিভিল ওয়ারের সময় কেমন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল?

সিভিল ওয়ার চলাকালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন 'অল রেবেলস এন্ড ইনসারজেন্ট্‌স, দেয়ার এইডার্‌স, এন্ড এবেটার্‌স্‌'-দের মোকাবেলা করার জন্য, সীমিত সময়ের জন্য 'রিট অব হেবিয়াস করপাস' স্থগিত করেছিলেন মার্কিন সংবিধানের আলোকেই।

বাংলাদেশে কেউ কেউ মতামত দিয়েছেন, জরুরি অবস্থা জারি করলে একটি স্বৈরাচারী শাসনের সূত্রপাত ঘটতে পারে। আমি তা মনে করি না। জরুরি অবস্থা জারি যে সকল ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ব্যাকরণের বাইরে অবস্থান করে তা কিন্তু নয়। জরুরি অবস্থার অপপ্রয়োগ করলে নিশ্চয়ই তা গণতান্ত্রিক ব্যাকরণের বাইরেই পড়বে।

তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে জামায়াত বিএনপির ছত্রছায়ায় থেকে এবং তার সহযোগিতা নিয়ে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে এবং তা চালিয়েও যাচ্ছে। আজ এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে প্রচলিত আইন, পুলিশ ও প্রশাসন বর্তমান পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে।

তাই যদি ১৪ দলের সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধপন্থী গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের সরকার সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে, তা অগণতান্ত্রিক হবে না। বিশেষ পরিস্থিতির জন্যই জরুরি অবস্থার বিধান যেমন পৃথিবীর অসংখ্য গণতান্ত্রিক সংবিধানে আছে, তেমনি বাংলাদেশের সংবিধানেও আছে।

তাই আমাদের সংবিধানের আলোকেই জামায়েত ও সহযোগী শক্তি কর্তৃক যুদ্ধের হুমকি এবং অভন্তরীণ গোলযোগের কারণে ১৪১/এ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সীমিত সময়ের জন্য দেশে জরুরি অবস্থা জারি করার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন।

অনুচ্ছেদ ১৪১/সি-এর ক্ষমতাবলে জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময়ে ফান্ডামেন্টাল রাইটস আরোপ করার অধিকার স্থগিত থাকবে। এর ফলে গৃহযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কারাগারে প্রেরণ করা যাবে এবং কোর্টে তাদের বিচারের সম্মুখীন করা সম্ভব হবে।

বিএনপি এবং তার সভাপতি বেগম খালেদা জিয়াকে স্থির করতে হবে, তারা জামায়াত এবং জঙ্গিদের সঙ্গ ত্যাগ করে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শামিল থাকবেন কিনা। সরকারের সঙ্গে একটি অর্থপূর্ণ সমঝোতায় আসবেন কিনা। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বেগম খালেদা জিয়া ব্যর্থ হলে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার নেতৃত্ব মেনে দেশবিরোধী গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যাবেন নাকি তাদের ত্যাগ করে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নেবেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং অন্যান্য বামপন্থী দলগুলোকেও তাদের দোটানা ঝেড়ে ফেলে গণতান্ত্রিক একনায়কত্বে সামিল হতে হবে। গণতন্ত্রের ফাঁকা বুলি আওড়িয়ে তারা যথেষ্ট জনবিচ্ছিন্ন হয়েছেন। মনে রাখতে হবে, এনজিও স্টাইলে দল পরিচালনা করে এবং বর্তমান সমাজের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে কারাগারে না গিয়ে প্রগতিশীল আন্দোলনের বুলি আওড়ালে সাধারণ মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে না। সময়ের প্রয়োজনে বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে তারা ব্যর্থ হলে তা ঐতিহাসিক ভুল বলেই বিবেচিত হবে। সময় এবং সুযোগ কিন্তু তাদের জন্য অপেক্ষা করবে না।

আজকে প্রধান দ্বন্দ্বটি কোনটি? আমাদের সমাজের প্রধান দ্বন্দ্ব হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধপন্থী অসাম্প্রদায়িক শক্তি বনাম যুদ্ধাপরাধী-মৌলবাদী-রাজাকার শক্তির দ্বন্দ্ব। গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম করে যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে চিরতরে পরাজিত করি, তাহলেই এই দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটবে।

ড. মো. আনোয়ার হোসেন: উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।