‘মুক্ত আর্টস’-এর আয়োজনে এটি ছিল ব্রিটেন-বাংলা ঐতিহ্য উৎসবের তৃতীয় আসর।
Published : 23 Apr 2025, 12:15 AM
যুক্তরাজ্যের লন্ডনে থেমস নদীর তীরে হয়ে গেল সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ধামাইল সংগীত ও নৃত্যের সাংস্কৃতিক আয়োজন।
শনিবার পপলার ইউনিয়নের একটি মিলনায়তনে ‘মুক্ত আর্টস’-এর আয়োজনে এটি ছিল ব্রিটেন-বাংলা ঐতিহ্য উৎসবের তৃতীয় আসর।
উৎসবের সূচনা করেন ‘মুক্ত আর্টসের’ সভাপতি সত্যব্রত দাস স্বপন। সংগঠনের কার্যক্রম ও বছরব্যাপী পরিকল্পনা তুলে ধরেন সংস্থার সৃজন পরিচালক অসীম চক্রবর্তী।
এবারের পরিষদীয় আলোচনার বিষয় ছিল ‘বরাক উপত্যকার সমাজ পরিবর্তন এবং নারী স্বাধীনতায় ধামাইল নৃত্য গীতের ভূমিকা’। এতে অংশ নেন কার্ডিফ সিটি কাউন্সিলের কাউন্সিলর ও মানবাধিকারকর্মী জেসমিন চৌধুরী, লেখক ও সাংবাদিক নজমুল আলবাব এবং মাইক্রোসফট ইউকে-র বিপণন পরিচালক সুপ্রিয়া দেব পুরকায়স্থ।
উৎসবে ধামাইল গান শোনায় শিশু-কিশোররা। স্নিগ্ধা রায়, রূপকথা দত্ত, বিন্থি দাস, বৃন্দা দাস ও ঈষা দাস সংগীত পরিবেশন করেন। নৃত্যে অংশ নেন বিরোজা দে, শ্রিয়া গোস্বামী, আরুষি চক্রবর্তী, শতাক্ষী দেব, রুদ্রনীল দেব ও আনুষা দাস।
পরের পর্বে ‘সুরালয়’ শিল্পীরা পরিবেশন করেন সমবেত ধামাইল। এতে অংশ নেন রঞ্জিতা সেন, জয়শ্রী পুরকায়স্থ, প্রিয়াঙ্কা ঘোষ, অল্পনা পাল, সুপ্রিয়া দেব পুরকায়স্থ ও শুভাঙ্গী দাম।
সন্ধ্যার মূল পর্ব ছিল ‘ধামাইল কথা’—এক গীতি-আলেখ্য, রচনা ও নির্দেশনায় অসীম চক্রবর্তী। বাচিক শিল্পী দীপ রায়ের কণ্ঠে গল্পসূত্রে এগিয়ে চলে ধামাইলের ঐতিহাসিক ধারা। তুলে ধরা হয় চণ্ডীদাস, রাধারমণ দত্ত, প্রতাপ রঞ্জন, উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী ও ঠুমরির ঐতিহ্য।
অমিত দে’র কণ্ঠে বন্দনা সংগীত ‘প্রথম বন্দনা যে করি’ দিয়ে শুরু হয়ে ভোররাত পর্যন্ত চলে বাঁশি, জলের গান ও কৃষ্ণরূপের আবেশ। গৌরী চৌধুরী শোনান ‘বাঁশি রে পরানের বাঁশি’।
তারপরের আয়োজনে ছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত ও ধামাইলের সম্মিলন। ভ্রমর সংবাদ পর্বে পরিবেশন করা হয় গৌরী চৌধুরীর ‘ভ্রমর কৈয়ো গিয়া’ ও অমিত দে’র কণ্ঠে বড়ে গোলাম আলীর ‘আয়ে না বালাম’ গান। কোকিল সংবাদ পর্বে আসে লাবনী বড়ুয়ার গলায় ক্বারী আমির উদ্দিনের ‘কুহু স্বরে মনের আগুন’ গান ও পাঁচপাড়া ধামাইল। পপিকরের কণ্ঠে ‘চন্দ্রা দাও গো বিদায়’ ও অপর্ণা ভৌমিকের কোরাসে সঙ্গত আয়োজনকে দেয় অন্যমাত্রা।
পুরো পরিবেশনায় ধামাইল সংগীতের সঙ্গে মৌসুমী সামন্তের নির্দেশনায় ও সুপ্রিয়া দেব পুরকায়স্থের তত্ত্বাবধানে নৃত্য পরিবেশন করেন সুস্মিতা ভট্টাচার্য, কনিকা গোস্বামী, বাপ্পী দাম, সোমা গঙ্গা রায়, সুমা দে, রূপনা রানী দাস ও মুন্নি চক্রবর্তী। বাদ্যযন্ত্রে ছিলেন হিরণ্ময় গোস্বামী (মৃদঙ্গ), তৌকি (রিদম) ও ময়ুখজিৎ চক্রবর্তী (বাঁশি)।
পরিবেশনার সমাপ্তি ঘটে ‘যুগল মিলন হইলো গো’ গানের মধ্য দিয়ে—রাধা-কৃষ্ণের মিলন সংগীতের তালে দর্শকরাও যেন হয়ে উঠেন ধামাইল শিল্পী।
‘মুক্ত আর্টস’-এর সভাপতি সত্যব্রত দাস স্বপন বলেন, “এটি আমাদের তৃতীয় হেরিটেজ ফেস্টিভ্যাল। আগের উৎসবগুলোয় আমরা উদযাপন করেছি ভাটিয়ালি ও বাংলা কীর্তন। এবার ধামাইলকে কেন্দ্র করে আমাদের এই আয়োজন।”
তিনি জানান, এবছরের আয়োজনে নির্মিত হচ্ছে ১৫টি ভিডিওচিত্র, একটি তথ্যচিত্র ও একটি বই। এসবে ধামাইলের ইতিহাস, বিকাশ, পরিবেশনারীতি ও ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ স্থান পাবে। গবেষণায় যুক্ত থাকছেন বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের লোকগবেষকরা।
চিত্রশিল্পী মৌনিমুক্তা চক্রবর্তীর চিত্রকর্মকে কেন্দ্র করে নির্মিত একটি তথ্যচিত্রেও ধামাইল সংগীত ও নৃত্যের নান্দনিকতা তুলে ধরা হবে। ‘ন্যাশনাল লটারি হেরিটেজ ফান্ড’-এর সহায়তায় আয়োজনের প্রতিটি পর্ব নথিবদ্ধ ও সংরক্ষিত হবে টাওয়ার হ্যামলেটস লোকাল হিস্টোরি অ্যান্ড আর্কাইভ মিউজিয়ামে।
পাশাপাশি প্রকাশিত বইটি সংযুক্ত করা হবে লন্ডনের আইডিয়া স্টোর লাইব্রেরির সংগ্রহে—যাতে আগামী প্রজন্মও এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় অংশ নিতে পারে।