একটি রাজনৈতিক দলের মূলধারার দল হয়ে ওঠার জন্য আবশ্যকীয় দুটি শর্ত রয়েছে। এর একটি হচ্ছে ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব; আর অপরটি, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলন, সংগ্রাম পরিচালনা করতে পারবার সক্ষমতা।
Published : 22 Apr 2025, 07:00 PM
জুলাই গণআন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রদের নেতৃত্বে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল। ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল গঠিত হলেও এনসিপি ছাড়া আর কোনো দলকে নিয়ে জনমনে তেমন কোনো আগ্রহ তৈরি হয়নি।
এনসিপি নিয়ে আগ্রহের মূল কারণ, জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নিয়ে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও পাচ্ছে— রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এমন একটি ধারণার শক্তিশালী উপস্থিতি। এনসিপির নেতারা বিভিন্ন সময় ‘নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ এবং ‘দায় ও দরদের’ জায়গা থেকে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন। এনসিপির নেতারা জোর দিয়ে এটাও বলছেন, তারা যে রাজনীতি করবেন— সেটা হবে পুরোনো বন্দোবস্ত যে রাজনীতির জন্ম দিয়েছে তার থেকে গুণগতভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং নতুন ধারার।
এসব কিছুর ফলে জন্মলগ্ন থেকেই জনগণ, সিভিল সোসাইটি ও অন্যান্য দলের মধ্যে এনসিপিকে নিয়ে একটা কৌতূহল এবং পর্যবেক্ষণের জায়গা তৈরি হয়েছে। সবাই এটা বুঝতে চাচ্ছে, বাংলাদেশে বিদ্যমান দল, মতাদর্শ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং চর্চার বাইরে গিয়ে জাতির সামনে তারা নতুন কী তত্ত্ব এবং চর্চা উপস্থাপনা করতে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক ছোট রাজনৈতিক দল নানা সময়ে চমক সৃষ্টিকারী বক্তব্য এবং স্লোগান নিয়ে হাজির হলেও জনমানসে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়নি। এর কারণ এনসিপির মতো এদের কোনোটাই রাষ্ট্র এবং রাজনীতির কেন্দ্রে অবস্থানকারী দল হিসেবে জনমানসে প্রতিভাত হয়নি।
নিকট অতীতে জাতীয় পার্টিও রাষ্ট্র এবং রাজনীতির কেন্দ্রে অবস্থানকারী দল ছিল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করলেও জাতীয় পার্টি কখনোই মূলধারা হয়ে উঠতে পারেনি। এখন প্রশ্ন হলো, নতুন বন্দোবস্তের কথা বলা এনসিপি কি মূল ধারা বা আদৌ কোনো ধারা হয়ে উঠতে পারবে?
মোটা দাগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চারটি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত বাঙালি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারা দুটিই সম্মুখসারিতে রয়েছে। অন্য দুটি ধারার একটি হলো ধর্মভিত্তিক, বিশেষ করে ইসলামবাদী; অন্যটি মার্কসবাদী বা বামপন্থী। বাংলাদেশের সমস্ত দল এ চারটি ধারার কোনো একটিকে ধারণ করেই গড়ে উঠেছে।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও সিপিবি হচ্ছে এ চারটি ধারার প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান দল। প্রধানতম দুটি ধারার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মূল রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের জনপরিমণ্ডলের সমস্ত রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং চর্চা মধ্য সত্তরের দশক থেকে এ দুটি দলকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে।
ধর্মভিত্তিক ও বামপন্থী দলগুলোসহ অন্যান্য দলগুলো হয় এই দুটি দলের সমর্থনে বা বিরোধিতায়, তাদের সঙ্গে জোট গঠন বা জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে, অথবা তাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত হয়ে বা তার প্রতিধারণা তৈরি করে নিজেদের বিকশিত ও বিবর্তিত করেছে। ভিন্ন ধারার হলেও গুণগতভাবে ধর্মভিত্তিক ও বামপন্থী দলগুলো স্বাধীন ধারা হিসেবে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। তাত্ত্বিক এবং চর্চাগত, দু-ভাবেই তারা জাতীয়তাবাদী ধারার ওপর নির্ভরশীল থেকেছে।
এ চারটি ধারার তিনটি গড়ে উঠেছে একাত্তর পূর্ব সময়ে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারা— যেটা সর্বস্তরের জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, কোনো দেশে একটি ধারা জনপ্রিয় হবার পেছনে মূল কী নিয়ামক কাজ করে? কেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারা অন্যতম মূলধারা হয়ে উঠতে পারল, ইসলামবাদ বা বামপন্থা সেটা পারল না কেন?
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারা মূলধারা হয়ে উঠবার পেছনে জাতীয় রাজনীতির নানাবিধ নিয়ামক এবং প্রেক্ষাপট থাকলেও যে বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তা হলো— এ ধারার জন্মদাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব এবং আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা— যেটা পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে আর কোনো নেতা অর্জন করতে পারেননি।
জিয়ার নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ বিএনপি গঠিত হয়; তার প্রতি তৎকালীন অন্যতম প্রধান দল মওলানা ভাসানীর অনুসারী ন্যাপের পূর্ণ সমর্থন ছিল। এ ধারাবাহিকতায় কিছু সময় পরে পুরো দলকে বিলুপ্ত করে ন্যাপ বিএনপিতে বিলীন হয়ে যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন বাম এবং ডানপন্থী দল থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী বিএনপিতে যোগ দেয়। এসব কিছু শুরু থেকেই বিএনপিকে একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গঠিত আর কোনো রাজনৈতিক দল অন্য দলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে এত ব্যাপক সমর্থন পায়নি। কোনো প্রধান দলও নিজেদের বিলুপ্ত করে এভাবে অন্য দলে যোগ দেয়নি।
জিয়াউর রহমানের মডেল অনুসরণ করে পরবর্তীকালে জেনারেল এরশাদ দল গঠনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে ওই মাত্রায় সাড়া না পাবার ফলে তার গঠিত জাতীয় পার্টি অন্যতম প্রধান দল হতে পারেনি। এছাড়া তাত্ত্বিক বা ধারণাগতভাবেও কোনো রাজনৈতিক চিন্তার জন্ম তিনি দিতে পারেননি।
জিয়া পরবর্তী এরশাদের আমলে এবং বর্তমান সময়ে ধারাবাহিকভাবে একটানা আঠারো বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপি কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে, নানা দমন-পীড়নের মাঝেও একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে রয়েছে। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে পারবার সক্ষমতা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং এর প্রধান ধারক বিএনপিকে গুরুত্বপূর্ণ দল হিসেবে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক রেখেছে।
একই কথা কমবেশি বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা জনপ্রিয়তা অর্জন করবার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে সংগ্রামের নানা ধারাবাহিকতায় এ ধারার প্রতিনিধিত্বকারী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিতে পারবার সক্ষমতা; এবং নানা কালপর্বে একাধিক ক্যারিশমেটিক নেতার এ দলকে নেতৃত্ব দেওয়া— এ ধারাকে সঞ্জীবিত রেখেছে।
এর বিপরীতে, ধর্মভিত্তিক এবং বামপন্থী ধারা দুটি বিভিন্ন সময়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেলেও, এই ধারাগুলো থেকে কোনো ক্যারিশমেটিক নেতা উঠে না আসায় তাদের প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো জাতির বৃহৎ অংশকে কোনো আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। এ না পারবার ব্যর্থতা তাদেরকে যেমন মূলধারা করেনি, তেমনি এ ধারা দুটির অনুসারী কোনো দলও প্রধানতম দল হয়ে ওঠেনি।
দেখা গেছে শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর যে কোনো দেশে একটি দলের প্রধানতম দল হয়ে উঠবার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব। দলের আগে গণমানুষ প্রথম ভরসার জায়গা খোঁজে ওই দলকে নেতৃত্বদানকারী নেতার ওপর। ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের কারণেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাপ প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে পেরেছিল; কিন্তু অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের ন্যাপ তা পারেনি।
ভারতে মহাত্মা গান্ধী ও জওহারলাল নেহেরুর নেতৃত্বের কারণে কংগ্রেস এবং পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মাধ্যমে মুসলিম লীগ প্রভাবশালী দলে পরিণত হয়েছিল; যার ধারাবাহিকতা দল দুটি এখনো বজায় রাখতে পেরেছে। দেশে দেশে এ ধরনের নানা উদাহারণ রয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, একটি দলকে মূলধারা হবার জন্য আবশ্যকীয় দুটি শর্ত রয়েছে। এর একটি হচ্ছে ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব; আর অপরটি হচ্ছে, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলন, সংগ্রাম পরিচালনা করতে পারবার সক্ষমতা।
এনসিপির কয়েকজন নেতা দল গঠন করবার পূর্বে বিভিন্ন মিডিয়াতে জানিয়েছিলেন তারা তুরস্কের এরদোয়ান, পাকিস্তানের ইমরান খান এবং ভারতের কেজরিওয়ালের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছেন এটা বোঝার জন্য যে, কীভাবে তারা তাদের দলকে নিজেদের দেশে জনপ্রিয় করেছেন। এই তিনটি প্রেক্ষাপটেও যে বিষয়টা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে তা হলো— ক্যারিশমেটিক বা পপুলিস্ট নেতৃত্বে দল পরিচালনা— যেটা তাদের দলকে দ্রুত জনপ্রিয় করতে সাহায্য করেছে।
এনসিপির ক্ষেত্রে একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে, ছাত্র নেতৃত্ব হাসিনা সরকারের পতনে মূল ভূমিকা পালন করলেও যৌথ নেতৃত্বের ফলে কোনো একক জনপ্রিয় নেতা ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসেনি। এ ক্ষেত্রে তারা যদি সফলতা পায়, তাহলে এটি এতদিন ধরে চলে আসা বিশ্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সফল হবার ক্ষেত্রে যে সমীকরণ দেখা গেছে, সেখানে নতুন মাত্রা যোগ করবে। দল গঠন বিষয়ক নতুন ডিসকোর্সের জন্ম দেবে। (চলবে)