একটি দল ডান, বাম, না মধ্যপন্থী তা নির্ভর করে তার ঘোষিত রাজনৈতিক মতাদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং কর্মসূচির ওপর।
Published : 23 Apr 2025, 05:28 PM
পপুলিস্ট নেতৃত্বের অনুপস্থিতিই শুধু নয়, প্রতিষ্ঠাকালে বিএনপি যেমন অন্যান্য দল ও নেতৃবৃন্দের সমর্থন ও শুভদৃষ্টি পেয়েছিল, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তা পায়নি। এনসিপির শীর্ষ পদের অধিকাংশই হচ্ছে দেড় বছর আগে আখতার হোসেনের হাতে গড়া গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সাবেক নেতা-কর্মী। এর আহবায়ক নাহিদ ইসলাম ছিলেন ছাত্রশক্তির সদস্য সচিব আর আখতার হোসেন আহবায়ক।
ছাত্রশক্তির বাইরে যারা দলটির নানা স্তরে যুক্ত হয়েছেন তারা হলেন গণঅধিকার পরিষদ এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন থেকে বের হয়ে আসা কয়েকজন, ছাত্রশিবিরের সাবেক কিছু সদস্য এবং বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের প্রাক্তন কর্মী ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার নির্দলীয় ব্যক্তিবর্গ। ছাত্রলীগ ছেড়ে আসা দু-চার জনও নেতৃত্বের সম্মুখসারিতে রয়েছেন।
তবে ইতোমধ্যে গণঅধিকার পরিষদ থেকে আসা কয়েকজন ফিরে গেছেন তাদের পুরোনো দলে। আর শিবির থেকে আসা একটি উল্লখযোগ্য অংশ এনসিপিতে তাদের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি মনে করে আলাদা আরেকটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। অর্থাৎ, যাত্রাপথের শুরুতেই এনসিপিকে কিছুটা হোঁচট খেয়ে যাত্রা শুরু করতে হয়েছে।
শুধু দল গঠন নয়, এনসিপির যে রাজনৈতিক লক্ষ্য তার সঙ্গেও বিএনপি, সিপিবিসহ বড় দাগে যারা বাম, লিবারেল বা সেক্যুলার হিসেবে পরিচিত দলগুলোর ভিন্ন অবস্থান রয়েছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ-বিরোধী ধর্মভিত্তিক দলগুলো এনসিপির ঘোষিত লক্ষ্যের সঙ্গে কমবেশি সহমত পোষণ করেছে।
বিদ্যমান সংবিধান বাদ দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদ নির্বাচন, নতুন রাজনৈতিক ‘বন্দোবস্ত’ লক্ষ্য ধরে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা বা বাংলাদেশ ২.০ বিনির্মাণ এনসিপির আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য। তবে বিএনপি এ লক্ষ্যসমূহের সঙ্গে একমত না হলে শুধু ধর্মভিত্তিক ইসলামী দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এনসিপির পক্ষে বর্তমান বাস্তবতায় এ সমস্ত লক্ষ্য বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব।
এনসিপি তার ঘোষিত রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে চায় নিজেদের মধ্যপন্থী দল হিসেবে পরিচয় দিয়ে। কিন্তু আত্মপ্রকাশের পর এখন পর্যন্ত তাদের দলীয় দর্শন এবং আদর্শ কী হবে সেটা তারা ঘোষণা করতে পারেনি।
তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, শুধু কিছু রাজনৈতিক স্লোগান, রেটোরিক এবং আবেগের ওপর ভিত্তি করেই কি তারা একত্র হয়েছেন? কীসের ভিত্তিতে, তারা ঠিক কোন বিষয়টা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন, যেটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্পূর্ণ নতুন বা ভিন্ন?
রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং দর্শন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকবার ফলে মধ্যপন্থী দল বলতে তারা কী বুঝাচ্ছেন সেটি আপামর জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। একটি দল ডান, বাম, না মধ্যপন্থী তা নির্ভর করে তার ঘোষিত রাজনৈতিক মতাদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং কর্মসূচির ওপর। তবে এনসিপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ফেইসবুক পোস্ট বা টকশোতে দেওয়া বক্তব্য থেকে অনেকের কাছে যে বিষয়টা স্পষ্ট, তা হলো ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে তারা ইতিবাচকভাবে দেখছেন। এর ফলে তারা বক্তৃতা বা বিবৃতিতে অতিরিক্ত সতর্ক থাকছেন, যাতে মুসলিম সমর্থকদের বিরাগভাজন না হন।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং বিচারের দাবিতে দল গঠনের আগেই এনসিপির নেতাকর্মীরা সোচ্চার রয়েছেন। এনসিপির অনেক সমর্থকই আওয়ামী লীগের পর বামপন্থী রাজনীতি এবং সেক্যুলার মতাদর্শকে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর মনে করেন। তারা বামপন্থার সঙ্গে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি বা কলকাতাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির একটি মেলবন্ধন তৈরির চেষ্টা করছেন।
এ ধরনের মেলবন্ধন বা যোগসূত্র বের করবার জন্য যে ধরনের তাত্ত্বিক গবেষণামূলক কাজ দরকার তা তাদের কেউ এখন পর্যন্ত করেনি। ফলে এ ধরনের অবস্থান যারা নিয়েছেন, তারা মূলত ফেইসবুককেন্দ্রিক পোস্টের ওপরই নির্ভর করছেন। এর ফলে এনসিপির কারও কারও মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সরলীকৃত দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। হয়তো এ কারণেই এনসিপির একজন প্রভাবশালী নেতার তৎপরতায় দলটি গঠিত হবার পূর্বেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিপিবি, বাসদ এমনকি এলডিপিকে নিষিদ্ধ করবার জন্য হাইকোর্টে রিট করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন— যদিও এ দলগুলো সব সময়েই হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে নানাভাবে তাদের জায়গা থেকে সোচ্চার থেকেছে। তারা সবাই ২০১৪ এবং ২০২৪-এর নির্বাচন বর্জন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির সঙ্গে একই সমান্তরালে অবস্থান করেছে।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের ১৪ দলীয় জোটে রয়েছে তিনটি বামপন্থী দল— ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল ও কমিউনিস্ট কেন্দ্র। এর বাইরে জাসদ নিজেদের বামপন্থী দল হিসেবে দাবি করলেও অন্য বামপন্থী দলগুলো আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আসা এ দলটিকে বামপন্থী দল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ।
এ তিনটির বাইরে সব বামপন্থী দল ২০০৯ সাল থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকলেও এনসিপিভুক্ত একটি বড় অংশের প্রবণতা হচ্ছে সব বামপন্থী দলগুলো হাসিনাপন্থী এবং ওই সূত্র ধরে ভারতপন্থী— এ ধরনের একটা ব্র্যাকেটে ফেলবার চেষ্টা।
এসব কিছুর ফলে যে বিষয়টা সচেতন জনমানসের চোখে ধরা পড়ছে তা হলো, হাসিনা উত্তর রাজনীতির পরিমণ্ডলে বামপন্থী রাজনীতির যে উপস্থিতি, সেটা জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দুর্বল এবং উপেক্ষণীয় হলেও— এনসিপি সংশ্লিষ্ট একটা উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে তা তাদের ভিশন অনুযায়ী বাংলাদেশ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক।
আওয়ামী লীগের জোটে থাকা তিনটি বামপন্থী দলের পাশাপাশি, ইসলামবাদীদের একটি অংশও হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সহযোগিতা করেছিল। ইতিহাসে দেখা যায়, বৈধতার সংকট দেখা দিলে অথবা সহজে জনপ্রিয়তা অর্জন, পপুলিস্ট রাজনীতি বা অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা সংহত করার প্রয়োজনে শাসকরা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করেন। উদাহরণস্বরূপ, জেনারেল এরশাদ অবৈধ ক্ষমতা বৈধ করতে এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন।
শেখ হাসিনাও তার ক্ষমতা ধরে রাখবার জন্য ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে সক্রিয় একটি অংশকে নানা সুযোগ-সুবিধা দেবার নীতি গ্রহণ করে এ ধারার রাজনীতি বিকাশের নানা ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। বিনিময়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে যুক্তদের বড় একটি অংশ হাসিনাকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভা করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কওমী জননী;’ অর্থাৎ, ‘জাতির জননী’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
শেখ হাসিনা মনে করেছিলেন, তার দল এবং বেসামরিক-সামরিক প্রশাসনের পাশাপাশি ইসলামপন্থীদের এ সমর্থন তার শাসনকে একটা শক্ত ভিত্তি দেবে। পাশাপাশি, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভূমিকা পালন করবে।
উদার, বাম বা সেক্যুলার গণতান্ত্রিক ধারার কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন যাতে দাঁড়াতে না পারে এ বিষয়ে হাসিনা এবং তার দল খুব সচেতন ছিল। কেননা, এ ধরনের আন্দোলন গড়ে উঠলে, তা তাদের রাজনৈতিক ভিত্তিকেই তাত্ত্বিকভাবে চ্যালেঞ্জ করে বসবে; যার পরিণতিতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। এ ধারার রাজনীতির কোনো ধরনের বিকাশ যাতে না ঘটে, তার জন্য ইসলামবাদের রাজনীতি, ও তার আদর্শিক এবং সংস্কৃতির একটা শক্তিশালী উপস্থিতি— তার শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এবং ‘বৈধতা’ দেয়ার জন্য তিনি প্রয়োজন মনে করেছেন।
ইসলামবাদীদের যে অংশ হাসিনার সঙ্গে সহযোগিতা করেনি, তাদের দমনের নীতি অবলম্বন করা হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে, বিএনপি রাজনৈতিক ও আইনি সহযোগিতাসহ এই অংশের পাশে দৃঢ়ভাবে ছিল। হাসিনার শাসনামলে ইসলামবাদী রাজনীতির এই দ্বিবিধ রূপকে বিবেচনায় না নিয়ে, এনসিপির একটি অংশ সব ইসলামবাদীকে মজলুম এবং বামপন্থীদের জালেমের সহযোগী হিসেবে সরলীকৃত লেন্সে দেখতে চায়।
নারী-পুরুষ সমানাধিকার বা জেন্ডার জাস্টিসের প্রশ্নে এনসিপির অবস্থান অস্পষ্ট। এই দোদুল্যমানতার কারণ, তারা একদিকে সমানাধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থেকে দূরে সরতে চায় না, অন্যদিকে জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিপুল নারী সমাজের সমর্থনও হারাতে চায় না।
রাজনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সব কয়টি ইসলামী দল একটা বিষয়ে একমত যে, তারা নারী-পুরুষের সমনাধিকারের বিষয়টি পশ্চিমাজাত এবং ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অপরদিকে, জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে, বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো নারী-পুরুষ সমতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি। তারা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে এমন রাষ্ট্র চায়, যা সব ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করে সমানাধিকার নিশ্চিত করবে।
বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্রকাঠামোর আকাঙ্ক্ষাই ব্যাপকভাবে নারী সমাজকে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসতে উৎসাহিত করেছিল। তাদের কাছে মনে হয়েছিল, নারীর ওপর সামাজিক নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদের পাশে না থেকে আওয়ামী লীগ সরকার পুরুষতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে; ক্ষেত্রবিশেষে সেটা করছে ধর্মীয় বাতাবরণে।
নারী অধিকার কর্মীদের যে বিষয়টা বিস্মিত করছে তা হলো, তারুণ্যমণ্ডিত দল হবার পরও এনসিপি নারী অধিকারের প্রশ্নে, নারীর ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়াচ্ছে না। তাদের অনেকের ধারণা, এনসিপির সঙ্গে যুক্ত নেতারা যদি শুরু থেকেই এ বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিতেন, তাহলে নারী নিপীড়নের এত ঘটনা ঘটত না।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান এনসিপির নেতাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর এমন এক উচ্চ আসনে বসিয়েছে, যেখান থেকে তারা ভূমিকা নিলে অনেক অনভিপ্রেত ঘটনা এড়ানো যেত বা এখনো এড়ানো সম্ভব। বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপি বা অন্য দলের পক্ষে এমন ভূমিকা নেওয়া সম্ভব নয়।
এনসিপি নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে অনীহার কারণে শুধু নারীদের প্রতিই সহিংস আচরণ নয়, ঘটেছে একের পর এক মাজার আক্রমণের ঘটনা— যা অনেক মুসলমানের ধর্মীয় চেতনাকে চরমভাবে আঘাত করেছে। মাজার জিয়ারত না করলেও, মাজার ও কবরকে ঘিরে বিভিন্ন মাজহাব নিরিখে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানের মধ্যে শ্রদ্ধা ও ভয় মিশ্রিত ধর্মীয় অনুভূতি রয়েছে, যা এই অঞ্চলে ইসলামের আগমন ও প্রচারের কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত।