স্থানীয়ভাবে এটি ‘দ্য আগুমাতসা ফলস’ নামেও পরিচিত, পশ্চিম আফ্রিকার সর্বোচ্চ জলপ্রপাত।
Published : 17 Apr 2025, 02:03 AM
কখনও কখনও প্রকৃতি নিঃশব্দে আহ্বান জানায়— আত্মাকে শুদ্ধ করতে, মনকে জাগিয়ে তুলতে, আর জীবনকে নতুন করে ছুঁয়ে দেখতে। সেই নিঃশব্দ ডাকে সাড়া দিয়েই আমরা রওনা হলাম ঘানার বুকে লুকিয়ে থাকা এক বিস্ময়ের খোঁজে— উইলি জলপ্রপাত।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ঘানার ভোল্টা অঞ্চলের হোহই মিউনিসিপ্যালটিতে অবস্থিত উইলি জলপ্রপাত, যা স্থানীয়ভাবে ‘দ্য আগুমাতসা ফলস’ নামেও পরিচিত, পশ্চিম আফ্রিকার সর্বোচ্চ জলপ্রপাত। এটি গড়া হয়েছে ‘আগুমাতসা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি’র ভেতরে। প্রায় ৮০ মিটার উচ্চতা থেকে অবিরাম জলধারা নেমে আসে দুটি ধাপে— ‘লোয়ার ফল’ ও ‘আপার ফল’।
বছরের গরম ও শুকনো মৌসুম— ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল— এ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। আমরা ঠিক করলাম মার্চ মাসের শেষদিকে যাওয়ার, যখন বৃষ্টির ছোঁয়া প্রকৃতিকে আরও সজীব করে তোলে।
ভোরের আলো ফুটতেই পাঁচজন সঙ্গী ও দুঃসাহসী গাড়িচালক মাইকেলকে নিয়ে রওনা হলাম রাজধানী আক্রা থেকে উইলির পথে। দূরত্ব প্রায় ২১৫ কিলোমিটার। সময় লাগে গড়ে ৫–৬ ঘণ্টা, রাস্তাঘাট বেশ ভালো, তবে কিছু অংশ খানাখন্দে ভরা।
যাত্রাপথে হঠাৎ চোখে পড়লো রাস্তার ধারে শত শত বেবুন! বাচ্চা, বয়স্ক, পুরুষ— সব ধরণের বেবুন রাস্তার দু’পাশে চলাফেরা করছে অবাধে। মাইকেলের কাছ থেকে জানতে পারলাম, এই পাহাড়ি এলাকা ঘানা সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে একধরনের নিরাপদ অভয়ারণ্য— বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে বানর ও বেবুনদের জন্য সংরক্ষিত।
পাঁচ ঘণ্টার ড্রাইভ শেষে পৌঁছলাম ‘ওয়াটারফল লজ’ নামে একটি ছিমছাম রিসোর্টে। এটি পরিচালনা করেন এক জার্মান দম্পতি। বাঁশ, কাঠ আর পাথরের ছোঁয়ায় তৈরি বাংলোগুলো পাহাড়ি পরিবেশের সঙ্গে দারুণভাবে মিশে গেছে। ঘরের জানালা খুললেই দেখা মেলে সবুজে মোড়ানো পাহাড় আর অদূরে ঝর্ণার শব্দ। দুপুরের খাবারে ছিল তাজা তেলাপিয়া মাছ, স্থানীয় কেঙ্কি (ফারমেন্টেড কর্ন ডো) আর মশলাদার পাম স্যুপ। বিশ্রামের পর বিকেলেই বেরিয়ে পড়লাম লোয়ার জলপ্রপাতের পথে।
প্রায় চল্লিশ মিনিট হাঁটার পর পাথুরে পথ আর সবুজে মোড়া গাছগাছালির ফাঁক গলে পৌঁছলাম লোয়ার ফল-এ। দূর থেকেই ঝর্ণার গর্জন কানে বাজছিল, যেন এক প্রাচীন ডাকে সাড়া দিচ্ছি। পাথরের ফাঁক দিয়ে নামতেই চোখে পড়ে বিশাল জলধারা— অত্যন্ত উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহ যেন আছড়ে পড়ছে মাটির বুকে। নিচের দিকে গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক এক পুল— স্বচ্ছ, ঠান্ডা, প্রাণবন্ত। এখানে আরেক অনন্য আকর্ষণ হাজার হাজার ‘ফ্রুট ব্যাট’ বা বাদুরের ঝাঁক। দিনের বেলা গাছের ডালে ঝুলে থাকে তারা, অদ্ভুত এক শব্দ তুলে— যা ঝর্ণার আওয়াজের সঙ্গে মিলে তৈরি করে এক রহস্যময় সংগীত।
পরদিন ভোরে আমরা রওনা দিলাম আপার জলপ্রপাতের দিকে। স্থানীয় গাইড কোয়ামি বারবার সাবধান করলেন— এই পথ সহজ নয়, ৪–৫ ঘণ্টার ট্রেক, দরকার ধৈর্য আর মনোবল। প্রথমে খানিকটা সমতল, তারপরই শুরু সেই খাড়া, বন্ধুর পাহাড়ি পথ। হাতে বাঁশের লাঠিটা যেন হয়ে উঠেছিল অন্ধের যষ্টি। পাথর, শিকড়, কর্দমাক্ত পথ, ঝরনা পেরিয়ে ক্রমে উঠতে থাকি আমরা।
প্রায় দুই ঘণ্টা টানা হাঁটার পর চোখের সামনে খুলে গেল সেই স্বপ্নের দৃশ্য— উইলির আপার ফল। পাহাড়ের গা বেয়ে পড়ছে হিমশীতল জল, আশপাশে কেউ নেই, শুধু আমরা আর প্রকৃতি। ঝাঁপিয়ে পড়লাম জলে— প্রথমে অবাক, তারপর স্বস্তি, শেষে মোহ। মনে হলো জীবনানন্দ দাশের পঙক্তিই যেন এ অনুভূতির ভাষা: “শরীর এলায়ে আসে এই খানে ফলন্ত ধানের মতো করে... চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এই খানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান”।
এই আপার ফল থেকে একটি ধারা নেমে গেছে নিচের লোয়ার ফলে। আর পাহাড়ের ওপারে দেখা যায় টোগোর পাহাড়ি এলাকা— দুই দেশের সীমান্তে প্রকৃতির এক মহামঞ্চ!
নেমে আসার পথ ছিল ভিজে, পিচ্ছিল, তবে এবারে প্রস্তুত ছিলাম। প্রায় দুই ঘণ্টায় পৌঁছালাম সমতলে। পথে এক নির্জন কোণে দেখা হলো এক কোকো চাষীর সঙ্গে। চারপাশে কোকো গাছে ঝুলে থাকা উজ্জ্বল হলুদ ফল দেখে কৌতূহলে চোখ আটকে গেল। তিনি আমাদের হাতে তুলে দিলেন দুটো কোকো ফল। খোলা হলে ভেতরে দেখা গেল সাদা আঠালো সজ্জায় ঢাকা বীজ— যা শুকিয়ে, ভেজে, রূপ নেয় বিশ্বখ্যাত চকলেটে। সেই কোকো ফলের ঘ্রাণ আর স্বাদ আজও মনে লেগে আছে।
উইলি ওয়াটার ফল কেবল একটি পর্যটনস্থল নয়, বরং এটি একটি অভিজ্ঞতা— যেখানে প্রকৃতি, মানুষ ও মন একসূত্রে গাঁথা। এখানে প্রতিটি জলের ধারা, বাদুরের শব্দ ও পাহাড়ের ঢাল যেন একেকটি কাব্যের স্তবক। ভ্রমণ শেষে মনে হলো, প্রকৃতি মাঝে মাঝে আমাদের ডেকে নেয় নিজের কোলে, আমাদের ক্লান্ত আত্মাকে একটু শীতল প্রশ্রয় দিতে। উইলির জলে ভেসে ছিল শুধু শরীর নয়—ভেসে গিয়েছিল একঘেয়েমি, ভেসে উঠেছিল নতুন জীবনবোধ।