ভ্রমণপ্রিয় কয়েকজন দুরন্ত কিশোর সুন্দরবনে ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে। পথ খুঁজতে খুঁজতে গহনবনে নিজেরাও একসময় হারিয়ে যায়।
Published : 18 Apr 2025, 01:05 AM
ওসি সাহেব ও ডিউটি অফিসার সব গোছগাছ শেষ করে রওয়ানা দেওয়ার প্রস্তুতি নেন। দলের অন্যান্য সদস্যরা সবাই গাড়িতে উঠে বসেছেন। ওসি সাহেব উঠে বসলেই গাড়ি দুটো ছেড়ে দেওয়া হবে। তিনি যাওয়ার আগে শেষবারের মতো- চার কিশোরের অভিভাবকদের সাথে কিছু কথা বলে নিচ্ছেন।
এসময় শরণখোলা থানার কন্ট্রোল রুমের টেলিফোনটা বেজে ওঠে। একজন কনস্টেবল দৌড়ে এসে ওসি সাহেবকে কিছু বলতেই তিনি দ্রুত আবার থানার ভেতরে প্রবেশ করেন। ওসি সাহেবের পাতলা হাঁটার পদক্ষেপ দেখে- জরুরি কোনো ফোন মনে করে ডিউটি অফিসারও গাড়ি থেকে নেমে ওসি সাহেবের পেছন পেছন কন্ট্রোল রুমে প্রবেশ করেন। ৯৯৯ জরুরি পরিষেবার কন্ট্রোল রুম থেকে ফোন এসেছে। তারা কিশোরদের উদ্ধার বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেসব জানতে চেয়েছেন। এবং তাদের পক্ষ থেকে দুটি তথ্য জানিয়েছেন।
প্রথম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে- কিশোর পর্যটকের দলটি যে নম্বর থেকে কল করেছিল, জিপিএস ট্র্যাকিং-এর মাধ্যমে সে নম্বরটির অবস্থান পাওয়া গিয়েছে। এক ঘণ্টা আগে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কাছাকাছি নেটওয়ার্কে যুক্ত ছিল নম্বরটি। কিন্তু চিন্তার ব্যাপার হলো, গত প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সে নম্বরটিকে আর নেটওয়ার্কে পাওয়া যাচ্ছে না।
আর দ্বিতীয় তথ্যটি হচ্ছে- ৯৯৯ থেকে শরণখোলা নৌ-পুলিশকেও চার কিশোরের হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে জানানো হয়েছে। অতি দ্রুত তাদের উদ্ধারে শরণখোলা থানা পুলিশকে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে।
প্রথম তথ্যটিতে শরণখোলা থানার ওসি সাহেবের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চারটি তাজা প্রাণ নিয়ে তার আশঙ্কা এবার রীতিমতো আতঙ্কে পরিণত হয়। সুন্দরবনের সবচেয়ে সুন্দর প্রাণীটির হিংস্র ও ভয়াল রূপ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চাঁদপাই রেঞ্জে ইদানিং তাদের আনাগোনা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে বলে গত কদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে।
ওসি সাহেব এসব কথা কিশোরদের অভিভাবকদেরও জানিয়ে যাওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন। সংক্ষেপে সব জানিয়ে সবাই দ্রুত রওনা হন।
ঘন বনের বড় বড় আকাশছোঁয়া গাছের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট গাছের ঝোপ-জঙ্গল মাড়িয়ে, প্যাঁচিয়ে, আঁচড় খেয়ে চার বন্ধু হাঁটতে থাকে। আর সুন্দরবন তার সৌন্দর্য ছাপিয়ে এক ভয়ঙ্কর রূপ এই কিশোরদলের সামনে ধীরে ধীরে খুলতে থাকে। পথ হারানো ছাড়া আরও কী কী বিপদ তাদের সামনে অপেক্ষা করছে, তা এখনো তাদের ধারণায় নেই। গড়িয়ে যেতে থাকা সময়, গোপন সেসব বিপদ নিয়ে কখন-কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে তারা তা জানে না এবং ভাবতে পারে না। তাই তারা হাঁটছে। বিপদের ভাবনাহীন হাঁটা, হেঁটে চলেছে।
৯৯৯ নম্বরে সাহায্য চেয়েও কিশোরদল ঠিক ভরসা করতে পারেনি। এই গভীর বনে তাদেরকে কে-কীভাবে সাহায্য করতে পারে, তারা তা ভাবতে বা অনুমান করতে পারেনি। তাই নিজেদের পথ, নিজেরাই খোঁজার চেষ্টা করে। নিজেদের উপর বিশ্বাস রেখে, হারিয়ে ফেলা পথ খুঁজতে তারা পথহীন পথে হাঁটতে শুরু করে। অথবা বলা যায় এই গহন ঘন বন থেকে বের হতে পথহীন জঙ্গলে তারা পথ তৈরি করতে হাঁটা শুরু করে।
বড় বড় গাছগুলো উপরে গিয়ে নিজেদের ডালপালা দিয়ে একজন আরেকজনের সাথে গলাগলি করে জড়িয়ে আছে। আর তাদের পাতারা জোটবদ্ধ হয়ে আকাশকে ঢেকে রেখেছে। দিনের বেলায় সূর্যের আলো এবং রাতের বেলায় চাঁদের আলোর জন্য সবাই মিলে জারি করেছে সংরক্ষিত এলাকায় ‘প্রবেশ নিষেধ’ নামের নিষেধাজ্ঞা। যদিও মেঘের গুরুগম্ভীর গুড়ুম গুড়ুম শব্দ শুনে কিশোরদল বুঝতে পারে, আকাশে আজ চাঁদ নেই। ঘন মেঘের আড়ালে চাঁদ আরও আগেই ঢাকা পড়েছে।
তবে বিভিন্ন পাখি ও প্রাণীর সম্মিলিত কিচিরমিচির ও হই-হল্লায় সুন্দরবন তখনও জেগে আছে। রাত কতটা গভীর হলে এই বন ঘুমায় তারা তা জানে না। কিন্তু এই কিচিরমিচির ও হই-হল্লার মাঝেও পরিচিত অনেক শব্দ না থাকায়, চারপাশের পরিবেশে কেমন আশ্চর্যজনক এক নীরবতা। এত প্রাণের মাঝেও কেমন এক প্রাণহীন নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে বলে তাদের কারও কারও মনে হতে থাকে। মানুষের চলাচল ছাড়া, কোলাহল ছাড়া এখানকার জীবন যেন ঠিক মুখরিত নয়। উপভোগ্য নয়।
মোবাইলের আলোটুকুর বাইরে জমে থাকা ছোপ ছোপ অন্ধকারে চার কিশোর পথ খুঁজে ফিরে। কিন্তু পথের কোনো চিহ্ন নেই, চলাচলের রেখা নেই। সড়সড় শব্দে ছোট খাট প্রাণীদের সরে যাওয়া ছাড়া আর কেউ তাদের পথ ছাড়ে না। ঘুড়ির ওড়ানোর সময় নাটাই আর সুতো মাঝে মাঝে এমন প্যাঁচ লাগে। যতই প্যাঁচ খোলার চেষ্টা করা হয় ততই প্যাঁচ আরও লাগতে থাকে। প্যাঁচ লাগতে থাকে আর বাড়তে থাকে, প্যাঁচ আর খোলে না। শেষ পর্যন্ত যদিও প্যাঁচ খোলা যায়, সুতোটা আর আস্ত থাকে না। কেটে বা ছিঁড়ে ফেলতে হয়। জোড়া দিয়ে তাও সুতোর প্যাঁচের একটা সমাধান বা ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু বনের ভেতর পথ হারিয়ে, পথ খুঁজে পাওয়ার কোনো সমাধানই করা যাচ্ছে না। পথ খুঁজতে গিয়ে যেন আরও হারিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোনো কূল কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না।
ক্লান্ত শরীরে এবং ভারি হয়ে আসা পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো মনে মনে আওড়ায় ইমরান। এতক্ষণ সবাইকে সান্ত্বনা ও অনুপ্রেরণা দিয়ে হেঁটে চলা ইমরানও এবার যেন ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। ‘একদিনে এত পথ হাঁটিনি কখনো, আমি আর হাঁটতে পারবো না’, ইমরানের কাঁধে হাত রেখে কথাটা বলে আদনান। আদনানের কথায় ও কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে ইমরানের ভাবনায় ছেদ পড়ে। চমকিত হয়ে সে ধাতস্থ হয়। কাঁধে রাখা আদনানের হাতটাকে নিজের হাতের মুঠোয় নিতে নিতে তার মনে হয়- এই পথ খোঁজায় তার সাথে আরও তিন বন্ধু আছে। সে একা নয়। সবাই মিলে চিন্তা ও চেষ্টা করলে একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই।
‘এই তোরা কেউ এইবার একটু ব্যাগটা নে। এই ব্যাগ নিয়া আমি আর হাঁটতে পারবো না’, বলতে বলতে কাঁধ থেকে ব্যাগটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মিঠু। আসলেই- ‘এ বড় অন্যায় হয়ে গেছে’ এমন চেহারায় একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। জিসানের ধরে রাখা মোবাইলের আলোতে একজনের চোখে আরেকজনের সে চেহারা ধরা পড়ে। কিন্তু তাদের সে চেহারায় একটা দ্বিধাও স্পষ্ট হয়, ‘কে কাঁধে নেবে ব্যাগটা!’
এসময় জিসানের মোবাইলটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা অপরিচিত নম্বরটা এক পলক দেখতেই একটা রিং হয়ে কলটা কেটে যায়। তবে কলটা কেটে গেলেও সবার মুখচ্ছবি মুহূর্তেই উজ্জ্বল আভায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। চিরচেনা জগৎ থেকে কেউ একজন তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে, এই কল-রিং তারই ইঙ্গিত। ‘নিরাশ হওয়া চলবে না, নিরুদ্যম হওয়া যাবে না’, সবার মনের কোণে কথাগুলো দোল খায়।
জিসান মোবাইলটা নিয়ে ছোট একটা গাছে ওঠে রিং আসা নম্বরে ডায়াল করতে থাকে। নম্বরটা ব্যস্ত পাওয়া গেলে ভাবে- কলার নিশ্চয়ই তাকে বারবার কল করার চেষ্টা করছে। সে ডায়াল করায় ক্ষান্ত দিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে। নেটওয়ার্কের একটি দুটি দাগ স্ক্রিনের এক কোনায় একটু পরপর ভেসে উঠেই আবার ডুবে যায়। তারপরও জিসান আরাধ্য নম্বরটি অথবা পরিচিত অন্য কোনো নাম বা নম্বর ভেসে উঠার প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে থাকে। বাকি তিনজনও, গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে মোবাইলের রিংটোন বা জিসানের হ্যালো হ্যালো শোনার অপেক্ষায় থাকে। অপেক্ষায় থেকে থেকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে নেটওয়ার্ক আসছে? কল আসছে? তোর কল যায় ওই নম্বরে’? সব প্রশ্নের একই উত্তর হয়, ‘না’। সাথে এটাও বলে জিসান, ‘আমি কয়েকবার ডায়াল করেছি, নম্বরটা ব্যস্ত দেখাচ্ছে’।
চলবে...