গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ ও পনেরজন সম্পাদক

আবদুল মান্নান
Published : 28 Jan 2017, 02:57 AM
Updated : 22 May 2013, 05:12 PM

দৈনিক 'আমার দেশ' পত্রিকার বহুল আলোচিত সমালোচিত নিন্দিত আবার কারও কারও কাছে নন্দিত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, যিনি এখন কারাবন্দী, বাংলাদেশের পনেরজন প্রতিষ্ঠিত পেশাদার সম্পাদক তার মুক্তি দাবি করে সম্প্রতি এক বিবৃতি দিয়েছেন এবং সে বিবৃতি কেন্দ্র করে সুধীমহলে বেশ সমালোচনার ঝড় বইছে। এ পনের সম্পাদক শুধু দৈনিক 'আমার দেশ' সম্পাদকের মুক্তিই দাবি করেননি, একই সঙ্গে সরকার কর্তৃক সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া 'দিগন্ত' ও 'ইসলামিক টিভি' চ্যানেলও পুনরায় সম্প্রচার শুরু করতে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

দৈনিক 'আমার দেশ' পত্রিকা বিএনপির মুখপাত্র বলে পরিচিত হলেও এটি মূলত জামায়াতের মুখপত্র হিসেবেই কাজ করে। 'দিগন্ত' টিভি চ্যানেল বর্তমানে একাত্তরে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মালিকানাধীন জামায়াতের টিভি চ্যানেল। 'ইসলামিক টিভি' বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াত ভাই সাইদ ইস্কান্দর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। তার মৃত্যুর পর এটির মালিকানা তার পরিবারের কাছেই আছে বলে জানা যায়। তিনটি গণমাধ্যমই বন্ধ হয়েছে অথবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ৫ মে রাতে হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক ঢাকায় সংগঠিত ভয়াবহ তাণ্ডবলীলার প্রেক্ষাপটে। তথ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, এ বন্ধ সাময়িক।

বাংলাদেশে পত্রপত্রিকা বা টিভি চ্যানেল বন্ধ হওয়ার ঘটনা নতুন বিষয় নয়। প্রাক-বাংলাদেশ আমলে আইয়ুব খানের শাসনামলে 'দৈনিক ইত্তেফাক' বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। একাত্তরের ২৬ মার্চ রাতে 'দৈনিক ইত্তেফাক', 'দি পিপল', 'দৈনিক গণবাংলা' কামান দেগে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৫ সনে বাকশাল পদ্ধতির সরকার প্রবর্তিত হলে দেশের চারটি ছাড়া সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে 'একুশে টিভি' শুধু বন্ধই করে দেওয়া হয়নি তার যন্ত্রপাতিও খুলে নেওয়া হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সাকাচৌ পরিবারের মালিকনাধীন 'সিএসবি নিউজ' ও 'চ্যানেল ওয়ান' বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

এসব গণমাধ্যমের কোনো কোনোটি বন্ধ হয় রাজনৈতিক কারণে, আবার কোনোটি বন্ধ হয় চালু করা অথবা প্রকাশের পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে। সম্প্রতি দৈনিক 'আমার দেশ' এবং অন্য দুটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করার কারণ ছিল এ তিনটি গণমাধ্যম নিয়মিত অসত্য তথ্য প্রচার ও প্রকাশ করে পরিকল্পিতভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করছিল এবং দেশে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য জনগণকে চরম উস্কানি দিচ্ছিল।

স্বাধীন গণমাধ্যমকে বলা হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। একটি দেশের আইন পরিষদ, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে সে দেশের গণতন্ত্র সাধারনত বিপন্ন হয় না। আর এ চার স্তম্ভের যে কোনো একটি দুর্বল হলে বা নড়বড়ে হলে তখন সে দেশের গণতন্ত্র বিপদে পড়ে।

প্রত্যেকটি স্তম্ভের আবার নিজস্ব কিছু নীতিমালা আছে। সে নীতিমালা মেনে চলার প্রধান দায়িত্ব এ স্তম্ভগুলো যাদের হেফাজতে আছে তাদের। আবার যখন কেউ একটা পত্রিকা প্রকাশের অথবা টিভি চ্যানেল চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তাকে সরকারি কিছু আইনকানুনও মেনে চলতে হয়। এসবের ব্যাতয় ঘটলে এর দায়দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতার অর্থ এ নয় যে যা ইচ্ছা তা বলতে পারার বা লিখতে পারার লাইসেন্স পাওয়া। বিশ্বের কোনো দেশই তা অনুমোদন করে না। বাংলাদেশের সংবিধান তার নাগরিকদের সমাবেশ বা সংগঠন করার অধিকার দিয়েছে। এটি তার মৌলিক অধিকারের অংশ। তাই বলে কোনো একটি দল বা গোষ্ঠী যদি সমাবেশ ডেকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে অথবা তার অবাধ চলাচলে প্রতিবন্ধকতার কারণ হয় তাহলে সে সমাবেশ আইনের দৃষ্টিতে কখনও বৈধ হতে পারে না।

পাকিস্তান সাংবিধানিকভাবে একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র। সে দেশে মসজিদের মাইক নামাজের আজান দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতেও তাই। আমাদের দেশে মসজিদের মাইক ইদানিংকালে অনেক দাঙ্গা-হাঙ্গামার কাজে ব্যবহার তো হয়ই, আবার অনেক জায়গায় ইসলামি জলসার নামে গভীর রাত পর্যন্ত তা ব্যবহার করে যার কারণে এলাকার সাধারণ মানুষের শান্তির ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।

এখন তা বন্ধ করা হলে কেউ যদি বলে বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করা হয়েছে তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বাংলাদেশে হিজবুত তাহরির বা হুজি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কারণ তারা জনগণের নিরাপত্তার হুমকির কারণ হয়েছিল। বাংলাদেশের সংবিধান দেখিয়ে তারা বলতে পারে না যে সরকার তাদের সংগঠন করার সাংবিধানিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত খোলামেলা দেশেও ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের মতো (কেকেকে) চরম বর্ণবাদী সংগঠন নিষিদ্ধ। আশির দশকে একজন মার্কিনী সে দেশের পতাকার ডিজাইনে তার বাড়ির দরজার পাপোস বানিয়েছিল। পুলিশ তাকে এ অপরাধে গ্রেফতার করে। আদালতে সে বলে, একটি স্বাধীন দেশে তার বাড়ির দরজার পাপোস কীরকম হবে তা অন্য কেউ বলে দিতে পারে না। সে তার দেশের সংবিধানের দোহাই দেয়। আদালত তার রায়ে বলে, স্বাধীনতা নৈরাজ্যসৃষ্টির লাইসেন্স নয়। সে যাত্রায় তাকে মোটা অংকের জরিমানা গুণতে হয়।

জার্মানিতে নাৎসি পার্টি নামের কোনো সংগঠন করার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারে না। সে দেশে নাৎসি পার্টির দলীয় চিহ্ন ব্যবহার নিষিদ্ধ। তাই বলে কেউ বলে না জার্মানিতে বাকস্বাধীনতা অথবা সংগঠন করার স্বাধীনতা রূদ্ধ করা হয়েছে।

দৈনিক 'আমার দেশ' শুরুর দিকে আতাউস সামাদ বা আমানউল্লাহ কবিরের মতো পেশাদার সাংবাদিকদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হত। তখন পত্রিকাটি সাংবাদিকতার নূন্যতম নীতিমালা মেনে চলার চেষ্টা করত। কিন্তু যে মুহূর্তে সেটি তাদের হাত থেকে মাহমুদুর রহমানের মতো 'অপেশাদার' সাংবাদিকের হাতে গিয়ে পড়ল তখন তার অবস্থা হল একজন মুমূর্ষু রোগীর হাতুড়ে ডাক্তারের হাতে পড়ার সামিল।

মাহমুদুর রহমান পেশায় একজন প্রকৌশলী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ পাশ করেছেন। সালমান রহমানের বেক্সিমকোতে চাকরি করতেন। হলেন বেগম জিয়ার বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান, আর পরে জ্বালানি উপদেষ্টা। ২০০৬ সালের নির্বাচনের আগে উত্তরায় সাবেক ও কর্মরত কিছু আমলাকে নিয়ে নির্বাচনী ষড়যন্ত্র করতে গিয়ে মিডিয়ার হাতে ধরা পড়লেন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় বেগম জিয়ার একজন নির্বাচনী উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেছেন।

এরপর মাঝেমধ্যে দৈনিক 'আমার দেশ' পত্রিকায় কিছু মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। কয়েকটি চ্যানেলে রাতের টক শোতে তাকে দেখা যাওয়া শুরু হল। একদিন বনে গেলেন দৈনিক 'আমার দেশ' পত্রিকার সম্পাদক। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে দৈনিক 'আমার দেশ' সরাসরি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলে 'আমার দেশ' চাঁদে সাঈদীকে অবিস্কার করে। পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফ পরিবর্তনের একটি ছবি নিজ পত্রিকায় প্রকাশ করে নিচে লিখেন- 'সাঈদীর ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে কাবা শরিফের ইমামদের প্রতিবাদ মিছিল'।

এতে সারা দেশে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ অনেক প্রাণহানি ঘটে। দেশের বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। অনেক স্থানে মন্দির-প্যাগোডা ধ্বংস করা হয়। দৈনিক 'আামার দেশ' ছাড়াও এ কাজে উস্কানি দেয় 'দিগন্ত টিভি' চ্যানেল।

তবে 'দিগন্ত' টিভি 'ইসলামিক টিভি' চ্যনেলকে সঙ্গে নিয়ে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ভূমিকাটি পালন করে ঢাকায় হেফাজতি অভিযানের সময়। তারা দিনব্যাপী মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে সরাসরি হেফাজতি সমাবেশের অনুষ্ঠান ও বিভিন্নজনের উস্কানিমূলক সাক্ষাৎকার প্রচার করে। তাদের অনুষ্ঠান দেখে মনে হচ্ছিল রাত পোহালেই আল্লামা শফি পাশে অবস্থিত বঙ্গভবনে তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে প্রবেশ করবেন, আর জুনায়েদ বাবুনগরী গণভবন দখল করবেন!

যে পনেরজন সম্পাদক মাহবুবুর রহমানের মুক্তি অথবা চ্যানেল দুটি খুলে দিতে দাবি করে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন তারা কী সে অনুষ্ঠানগুলো দেখেছেন? দৈনিক 'আমার দেশ' কীরকমের অপসাংবাদিকতা করে তার বিস্তারিত তথ্য দিয়ে তো ইংরেজি দৈনিক 'ডেইলি স্টার' একাধিক রিপোর্টও করেছে। তারপরও অবাক হতে হয় বন্ধু মাহফুজ আনামও সে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন!

আমার এক সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধুকে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি কিছুটা আমতা আমতা করে বলেন, অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হোক। পত্রিকা বের না হলে অথবা টিভি চ্যানেল চালু না হলে তো অনেক সাংবাদিকের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। কেমন খোঁড়া যুক্তি! বলি, এখন হলমার্ক-কেলেঙ্কারির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের মুক্তি দিতে যদি এফবিসিসিআই একটি বিবৃতি নিয়ে হাজির হয় তাহলে আমাদের গণমাধ্যম সেটিকে কীভাবে গ্রহণ করবে? এ প্রশ্নের জবাব বন্ধুর কাছে নেই।

ইতোমধ্যে দেশের সুশীল সামাজ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পনেরজন সম্পাদকের বিবৃতির তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ ও সমালোচনা করেছেন। যে পনেরজন সম্পাদক এ বিবৃতিতে সই করেছেন তারা প্রত্যেকেই পেশাদার সম্পাদক এবং দেশের মানুষ তাদের যথেষ্ট সম্মান করে ও তারা আশা করে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের রক্ষক হিসেবে তারা তাদের দায়িত্বপালনে আরেকটু সচেতন হবেন।