অবশ্যই সে পরিত্রাণকর্তার নাম ‘শেখ হাসিনা’

সুভাষ সিংহ রায়
Published : 18 May 2013, 02:01 PM
Updated : 18 May 2013, 02:01 PM

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'সভ্যতার সংকট'-এ লিখেছিলেন, ''আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্রলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই।''

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সত্যিই আমাদের লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আর্বজনা দূর করার জন্য টুঙ্গিপাড়া নামক এক অজপাড়াগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়াণের পর দেশের গণতন্ত্র ছিল সামরিকজান্তার পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপে। সবাই আশা করত ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন জান্তাকে বিদায় নিতে হবে।

কিন্তু কোন বাংলাদেশকে পেছনে ত্যাগ করে যাবে মানুষ? কে হবেন পরিত্রাণকর্তা? নেতাজি সুভাষ বসু বলতেন,''আদর্শকে ষোলআনা পাইতে হইলে নিজের ষোলআনা দেওয়া চাই''।

সে ষোলআনা দেওয়ার মতো মানসিকতা সচরাচর মানুষের মধ্যে থাকে না। অবশ্যই শেখ হাসিনা দেশের মানুষকে ষোলআনা দেওয়ার জন্য বত্রিশ বছর আগের এক ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ইতিহাসের এক জটিল সময়ে তাঁকে জাতির পরিত্রাণকর্তার দায়িত্ব নিতে হয়।

বাংলাদেশে তখন প্রয়াত জিয়াউর রহমান প্রবল প্রতাপশালী শাসক। তার ভয়ে কথা কেউ বলতে চান না। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফিরে এলেন। তাঁর সেই আসাটি না হলে আজও জান্তার ক্ষমতার মদমত্ততা বা আত্মম্ভরিতার অবসান হত না। আর এভাবেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নির্মীয়মান ইতিহাসে শেখ হাসিনা নিজের জায়গা করে নিয়েছেন।

ইতিহাসে অনেক বাঁক থাকে, চোরাগোপ্তা পথ থাকে, অনিদিষ্ট আর অলক্ষ্য অনেক উপাদানে জড়িয়ে থাকে এর অনির্ধারিত গতিপথ। শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বত্রিশ বছর অতিক্রমের পর প্রশ্ন থেকে যায়, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন কি? তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার প্রথমক্ষণ থেকে জানতেন সংকটকালে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় 'ভরসার অভাব'। তাই দেশের মানুষের মধ্যে অবিরাম সে ভরসার পরিবেশ তিনি সৃষ্টি করে চলেছেন। সন্ত্রাস আর হিংসার উৎসভূমি তাঁর কখনওই অজানা ছিল না; থাকার কথাও নয়। তবু তিনি হয়ে উঠেছেস সবার ভরসাস্থল। তাই তো শহীদ নূর হোসেন বুকে-পিঠে লিখে ফেলতে পেরেছিল, 'গণতন্ত্র মুক্তি পাক; স্বৈরাচার নিপাত যাক'। গফরগাঁওয়ের গরিব রিকসাওয়ালা হাসমত আলি শেখ হাসিনার জন্য জমি কিনে রেখে যান। ভরসা না হয়ে উঠলেই কি!

১৯৮১ সালের ১৮ মে দৈনিক ইত্তেফাকে লেখা হয়েছিল, "দীর্ঘ ছ বছর বিদেশে অবস্থানের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠকন্যা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সতরই মে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে বরণ করে নেন তাদের নেত্রীকে। মধ্যাহ্ন থেকে লক্ষাধিক মানুষ কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করবে। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে বিমানবন্দরে কোনো নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।''

ওই সময়কার সরকারি পত্রিকা 'দৈনিক বাংলা' ১৮ মে, ১৯৮১ শেখ হাসিনার বিমানবন্দর সংবর্ধনা সংবাদে উল্লেখ করেছিল, ''ঐ দিন কালবোশেখী ঝড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ৬৫ মাইল। এবং এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে লাখো মানুষ শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য রাস্তায় ছিল।''

এভাবে লাখো মানুষের ভালোবাসা নিয়ে দেশে ফিরে এসেই তিনি গণতন্ত্রের জন্য আজীবন সংগ্রামের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। প্রথম থেকেই তিনি বিশ্বাস করেছেন, মানবসম্পদের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রসারের স্বীকৃতির পর মানবসম্পদের চিন্তাধারা অতিক্রম করে যেতে হবে। তাঁর বিশ্বাস, এ প্রসারতা হবে আরও ব্যাপক, কোনোমতেই পরিপ্রেক্ষিতের দৃষ্টিকোণের বিকল্প হিসেবে নয়। কখনও কখনও আরও উন্নততর ভাবনার মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করেছে। হোঁচটও খেয়েছেন কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েননি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো আগের সিদ্বান্ত পরে নিয়েছেন; আবার অনেক পরের সিদ্ধান্ত আগে নিয়ে ফেলেছেন। বিকল্প পথের চিন্তা তিনি সবসময় করে রাখেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঝুঁকিও নেন। দায়িত্বের আন্তঃনির্ভরতায় তাঁর অগাধ বিশ্বাস এবং আস্থা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।

শেখ হাসিনা বোধহয় একমাত্র নেতা যিনি জীবনবোধের কথা বলতে গিয়ে অকপটে নিজেকে মেলে ধরেছেন। সত্যিই অবাক হতে হয়। কোনো বাঁধাধরা তত্ত্বে তিনি নিজেকে আটকে রাখেননি। খোলামনে খোলাচোখে শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে সবকিছু যাচাই করে দেখেছেন। আর সে সঙ্গে পুরানোকে ছাড়িয়ে নতুনের দিকে বাড়িয়েছেন হাত।

বিশেষত বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশ কাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়বে বা কীভাবে এগিয়ে যাবে তা একমাত্র তিনিই বুঝেছেন। তাঁর পারদর্শিতায় দেশের সাধারণ মানুষের অগ্রগতি হয়েছে। তিনি সাধারণ মানুষের ভালোবাসাও তাই পেয়েছেন। কিন্তু সমাজের বিজ্ঞজনরা সবসময় তাঁকে স্বীকৃতি দেননি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিমুহূর্তে ঝুঁকির মধ্যে থাকা শেখ হাসিনার কদর অনেক খ্যাতিমানের কাছে নেই।

এখানেই একটি কৌতূহলোদ্দীপক দ্বান্দ্বিকতা দৃশ্যমান হয়। উদারনৈতিকতার যে ধারা যে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সূচনা করতে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার মূল্যায়ন আমরা কজন করেছি? ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চের সামরিক শাসনের দুদিন পর স্বাধীনতা দিবসে একমাত্র শেখ হাসিনাই সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। সেদিন খুব দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ''বাংলাদেশে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবই করব''।

তাঁর পক্ষের লোক বলে যারা নিজেদের দাবি করেন তারাও নতুন প্রজন্মের সামনে তাঁকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেন না। সামনাসামনি শেখ হাসিনা অন্তপ্রাণদের দ্বারা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু এদের সবসময় দূরে রাখতে পারেননি।

রাজনীতির প্রথম দিন থেকে তাঁর মনে হয়েছিল, আন্তর্জাতিক দিক থেকে বিশ্বশান্তি আজকের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যে সব বিরাট সমস্যা ও বিরোধে আমরা জর্জরিত তাদের সমাধানচেষ্টাই সবচেয়ে জরুরি। জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, বিরামহীন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের আবহাওয়া সৃজন- এসবই তাঁর গভীর ভালোবাসার ফসল। পাঠক একটু ভেবে দেখবেন নিরপেক্ষভাবে, কথাগুলো কি শেখ হাসিনার পক্ষে বাড়িয়ে বলা কিনা।

সাড়ে তিনবছর সরকারের প্রধান থাকার পরও বিশ্বখ্যাত জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপের মতে, শেখ হাসিনা এখনও ৭৭ শতাংশ বাংলাদেশির সর্মথনপ্রাপ্ত। ১৯৩৫ সালে জর্জ গ্যালাপ এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৩৬ সালে এটি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগাম বার্তা দিয়েছিল। গ্যালাপের জরিপের ফলাফল মেনে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী অ্যালফ্রেড লেনডনকে পরাজিত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কথাটা এ জন্যই বলা যে, এ প্রতিষ্ঠানের জরিপের মূল্য অনেক।

আজ দেশে-বিদেশে রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার প্রাধান্যের কথা বলেন ও লিখেন। তিনি সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু, সব রাজনৈতিক আন্দোলন ও তৎপরতা, প্রশংসা-নিন্দার লক্ষ্য এবং উপলক্ষ্য। বাংলাদেশে একটা প্রচলিত ধারণা, এ দেশে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে থাকলে জনগণের জন্য তাদের করণীয় খুব একটা থাকে না। অথচ ক্ষমতায় কিংবা ক্ষমতার বাইরে যেখানেই থাকুন না কেন শেখ হাসিনা সবসময়ই জনগণের কথা বলেছেন, কাজ করেছেন তাদের জন্য।

অতীতে পিতার বৃহৎ পরিপেক্ষণিকায় আমরা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি। সেখানে তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে বিরাটস্বরুপে আবির্ভূত হয়েছেন। তারপর আর কেউ কালের সে পরিপেক্ষণিকায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। শেখ হাসিনা এদিক দিয়ে পিতার দিকে অগ্রসরমান এবং সুদৃঢ়। অপরিসীম তাঁর ধৈর্য্য এবং বীরত্ব তাঁর বিরাট। তিনি নিকটবর্ত্তী বর্তমানের প্রত্যক্ষগোচর, এখানে বড়র সঙ্গে ছোট, মূল্যবানের সঙ্গে অকিঞ্চিৎকর জড়িত হয়ে থাকে।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি জরুরি কথা মনে পড়ল। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগের দিন পত্রিকায় আরেকটি সংবাদ ছিল ''শেখ হাসিনার আগমন প্রতিরোধ কমিটি তাদের কর্মসূচি আপাতত স্থগিত করেছে''। এ কমিটির কুশীলব এবং উত্তরসূরীরা কিন্তু এখনও সক্রিয়।

অনেক বিজ্ঞজনের জানা নেই যে, ১৯৮১ সালের ৫ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় বক্স আইটেমে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে তিনি বলেছিলেন, জীবনের ঝুঁকি আছে এটা জেনেই তিনি বাংলাদেশে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার বিপক্ষের অনেকেও বলেন যে, তিনি পলিটিক্সের আত্মপ্রবঞ্চনা ও পরবঞ্চনার পঙ্কিল আবর্ত্তের মধ্যে নিজেকে কখনও হারিয়ে ফেলেননি। সত্য যেখানে বিপদজনক সেখানে সত্যকে তিনি ভয় করেননি, মিথ্যে যেখানে সুবিধাজনক সেখানে তিনি সহায় করেননি মিথ্যেকে।

আধুনিককালের চলমান পটের ওপর তিনি নিত্যকালের চিত্র রেখে যাচ্ছেন।

সুভাষ সিংহ রায় : রাজনৈতিক বিশ্লেষক।