নারীরা ঘরে বসে থাকবে না

যতীন সরকার
Published : 20 April 2013, 04:51 PM
Updated : 20 April 2013, 04:51 PM

দেশে এখন যে খুবই সংকট চলছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সে সঙ্গে সংকট উত্তরণের সম্ভাবনাও যে খুব স্পষ্ট হয়ে এসছে তাতেও সন্দেহের অবকাশ নেই। সংকট এলেই তো সংকট উত্তরণের প্রশ্ন আসে। আজকে স্বাধীনতার চারটি দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও যখন দেখছি যে, স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলো প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না বরং দেশটিকে পাকিস্তানায়নের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে– তখন আমাদের তরুণ প্রজন্ম শাহবাগে যে উত্থান ঘটালেন, সেই উত্থান তো স্বাধীনতার শক্তি, বাংলাদেশের ঘুমিয়ে পড়া শক্তির উত্থান।

উনিশ শতকের চিন্তাবিদ ওয়েন্ডেল ফিলিপস বলেছেন 'ইটারনাল ভিজিলেন্স ইজ দ্য প্রাইস অব লিবার্টি'- 'সদা সতর্কতাই স্বাধীনতার মূল্য'। কিন্তু আমরা সেই স্বাধীনতার মুল্য দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই জাগরণটা এতদিনে হলেও ঘটেছে, এটাই তো সম্ভাবনার বিরাট একটি প্রত্যয় আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে। এখন কথা হচ্ছে যে, যুদ্ধে যদি নামি, তা সেটি আদর্শগত যুদ্ধই হোক কী অস্ত্র দিয়েই হোক– মাঠে নামলে আমি একাই যুদ্ধ করব, আর আমার শত্রুপক্ষ একেবারে বসে বসে আঙুল চুষবে তা তো নয়। কাজেই আমাদের শত্রুপক্ষ স্বাভাবিকভাবে তাদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য সামনে নেমে এসেছে। এবার দেশের জনগণ বিচার করবেন কোন শক্তির পক্ষে তারা থাকবেন।

আজকে ধর্ম নিয়ে কথা উঠেছে, আস্তিক-নাস্তিকের প্রসঙ্গ এসেছে– এসব কথা যে হচ্ছে, আমি মনে করি তাতে ভালোই হয়েছে। এই অর্থে ভালো হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা থেকে শুরু করে নজরুলের খণ্ডায়ন এবং বাংলা ভাষার বানান সংহারের নামে পাকিস্তান আমলে আমাদের শত্রুপক্ষ এমন কিছু কাজ করেছিল যা বাঙালিদের ক্ষুব্ধ করেছিল। তা বলেই তো আমরা সেদিন জাগ্রত হয়েছিলাম। যদি তারা এমনটি না করত তাহলে রবীন্দ্রনাথকে আমরা এমন করে পেতাম না, নজরুলের খণ্ডায়ন রোধ করতে পারতাম না। আর বাংলার সংস্কৃতিকে যথার্থ স্থানে স্থাপন করতে তো পারতামই না।

এবারও যখন আমাদের শত্রুপক্ষ তাদের হেফাজত করার জন্য ১৩ দফা দিয়েছে– আমার মনে হয়েএটা দিয়ে ওরা ভালোই করেছে। আমাদের মধ্যে যে চেতনার জাগরণ ঘটিয়েছে এটি অসাধারণ অসাধারণ অসাধারণ!

এখন সবচেয়ে বড় জাগরণটি ঘটেছে নারীর ক্ষেত্রে। নারী সাংবাদিকের ওপর আক্রমণ হযেছে, সে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য, তাকে প্রতিরোধের জন্য সমস্ত নারী সংগঠন রাস্তায় নেমে এসেছে। আমি তো দেখেছি সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়, এমনকি থানা বা ইউনিয়ন পর্যাযেও মেহনতি নারীরা, আজকে যে নারীরা দেশের অর্থনীতি সচল করে রেখেছে–- তারা গৃহবন্দী না থেকে বিদেশ থেকে দেশের জন্য টাকা নিয়ে আসছে– গার্মেন্টস শিল্পকে যথার্থ একটি উৎপাদনের কাঠামোতে পরিণত করেছে– সেই নারীরা ঘরে বসে থাকবে? থাকবে না। বরং শত্রুপক্ষের এই যে উস্কানি এটা আমাদের জন্য ভালোই হয়েছে। এভাবেই আমি বিষয়টি দেখি।

আজকে কথা উঠছে, কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা যাবে না। খুবই সত্য কথা। কারও ধর্মানুভুতিতে আঘাত করা মানবিক চেতনার মধ্যে পড়ে না। এটা কোনোভাবেই মানবাধিকার নয়। কিন্তু ধর্মানুভুতিতে আঘাত কীভাবে লাগে, ধর্মই বা আসলে কী– সে বিষয়গুলো সম্পর্কে আজকে সামনাসামনি অনেক কথা বলা হচ্ছে– এসব নিয়ে আলোচনা উঠে এসছে। আমি মনে করি, এই আলোচনার মধ্য দিয়ে এ দেশে প্রকৃত মানবধর্মের প্রতিষ্ঠা ঘটবে। সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী শক্তির অবসান ঘটবেই।

তবে আরেকটি বিষয়ে আমাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য বলব। এটি কিন্তু আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল, তা হচ্ছে না। বরং এখনও কিছু কিছু বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও চিন্তাবিদ যে কথা বলছেন, সেটা সামগ্রিকভাবে আমাদের এই গণজাগরণের মধ্যে এসে যায়নি। সেটি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা। আমাদের সমাজে যা কিছু পশ্চাদপদ ঘটনা ঘটছে তার পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের ছোবল। যে সাম্রাজ্যবাদ একাত্তরে বঙ্গোপসাগরে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল- সেই সাম্রাজ্যবাদের সপ্তম নৌবহরের বর্তমান প্রধান স্কট বাংলাদেশ সফর করেছেন। আর এরাই তো বাংলোদেশে মার্কিন নানা ষড়যন্ত্র চালাচ্ছেন। এটার মধ্যে আামি একমাত্র দেখেছি সিপিবি ও বাসদ একটি বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। এ বিষয়ে তারা যথার্থভাবেই বলেছে যে, যদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সম্পর্কে আমরা সচেতন না হই– যদি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনাকে সমগ্র আন্দোলনের মধ্যে যুক্ত করতে না পারি- তাহলে দেশের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যাবে।

আমি বলব, যদি আমাদের এ জাগরণকে আমরা এভাবে এগিয়ে নিতে পারি তবে কোনো অপশক্তিই আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।