গোলমেলে খাদ্য বাড়ায় রোগবালাইয়ের আশঙ্কা

কিউ আর ইসলাম
Published : 14 March 2013, 01:30 PM
Updated : 14 March 2013, 01:30 PM

হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর অধিবাসীদের উদ্ভাবিত খাদ্যাখাদ্যে এতই স্বাতন্ত্র্য ছিল যে খাদ্যের বৈশিষ্ট্য থেকে জাতীয়তা অথবা সাংস্কৃতিক পরিচয় পাওয়া যেত। কারণ এ সমস্ত খাদ্য সুস্থ শরীর এবং উদ্দীপনাময় জীবন যাপনের জন্য সকল উপাদান সরবরাহ করত। এই সমস্ত খাদ্য খেয়ে মানুষ বেঁচে থেকেছে এবং তাদের বংশ বিস্তার করেছে। আদিম যুগে মানুষ সব ধরনেরই খাবার খেত। এ নিয়ে কোন কুসংস্কার ছিলনা। ওই সব খাদ্য থেকে শরীরের ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের চাহিদা পূর্ণ হত। দেহ সবল ও নিরোগ রাখতে প্রয়োজনীয় উপাদান পাওয়া যেত। কালে কালে মানুষের অভিরুচি পরিবর্তনের ফলে খাদ্যের বাহ্যিক রূপের উপর গুরুত্ব বেড়েছে। বর্তমানে খাদ্যের গুণাগুণ থেকে স্বাদের কদর বেশী। প্রক্রিয়াজাত খাবার সহজলভ্য হয়েছে। এ ধরনের খাদ্য থেকে ভিটামিন ও খনিজ উপাদান পাওয়া না গেলেও শরীরের শক্তি চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। আমেরিকার বিশিষ্ট দন্ত চিকিৎসক ড: ওয়েস্টন প্রাইচ-এর মতে, আধুনিক সভ্য যুগের এই সংক্ষিপ্ত সময়ে মনুষ্য জাতির দেহে অস্থি ও দাঁতের উল্লেখযোগ্য অবক্ষয় পরিলক্ষিত হয়েছে। পৃথিবীতে মানুষ আগমনের পর থেকে এ পর্যন্ত কোন কালে এ রকম ঘটেনি। বিশেষ করে ঐতিহ্যগত খাদ্যের স্থান আধুনিক, পরিশোধিত ও প্রক্রিয়াজাত উপকরণ থেকে তৈরি খাদ্য সামগ্রী দখল করে নিয়েছে। যে সব সমাজে বা গোত্রে দৈনন্দিন খাদ্য অপরিবর্তিত বা আগের মতই থেকে গেছে তাদের বেশীর ভাগ এই অবক্ষয় থেকে মুক্ত আছেন।

প্রাচীন আমলে বিশ্বের এক এক এলাকায় এমনকি সমাজেও খাদ্যের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও মূল বিষয়ে একটা মিল ছিল। সুস্বাস্থ বজায় রেখে কর্মঠ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য বা খাদ্য তৈরির উপকরণের সবগুলোই বসতির আশেপাশেই ছিল। আমাদের দেশের কথাই বলা যেতে পারে। কয়েক দশক আগেও অধিকাংশ গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা পূরণ হত স্থানীয় উৎপাদিত সামগ্রী থেকে। শুধু লবণের জন্য অন্যত্র থেকে সরবরাহের উপর নির্ভর করতে হত। নিজ জমিতে উৎপাদিত বা মজুরি দিয়ে ক্রয় করা স্থানীয় চাল থেকে শর্করা জাতীয় খাদ্য উপাদানের চাহিদা মেটানো হত। নিজ গ্রামের নদী, বিল, খাল বা পুকুরের মাছ থেকে আমিষের চাহিদা পূরণ হত। কলমী, হেলেঞ্চা, সজনে, কাটানুটি, কচু শাক কেনার প্রয়োজন হত না। বসত বাড়ী সংলগ্ন উঁচু জমিতে শিম,লাউ, বরবটি, মুলা, করলার বীজ বুনে দেয়া হত। বসত বাড়ীর উঠানের কোনায় মুরগীর খুপরী থাকত। কারও বাড়ীতে ছিল গরুর গোয়াল। তবে ডিম, দুধ ও গোশত খাওয়ার সুযোগ কম হত। আম, জাম, পেয়ারা, বরই গাছ বাড়ীর চারদিকে অফসলী উঁচু জমিতে বা জঙ্গলে ছিল। এ সমস্ত গাছের ফল বিক্রি হত না বা কেনার মত সামর্থ্য ছিলনা। কেনার প্রয়োজনও হত না। গাছের মালিকের পরিবারে সদস্যরা নিজেরাই খেত। তবে আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশীদের না দিয়ে নয়। ছোট ছেলেমেয়েরা যে কোন গাছ থেকে যখন খুশি যে ভাবেই হোক না কেন পেড়ে খেতে দোষ ছিল না। প্রতিদিনই পরিপক্ক ও টাটকা ফল খাওয়া পড়ত। এখন এ সব গ্রামের বাসিন্দারা বিদেশী খাদ্য কিনে খাচ্ছে। চীপস, বিস্কুট, আপেল, পানীয় সরাসরি বিদেশ থেকে আমদানি আর না হয় আমদানিকৃত উপকরণ থেকে তৈরি। এমন কি মাছও বিদেশী – থাই পাঙ্গাস, পুটি ও কই, গ্রাস কার্প, মিররকার্প ইত্যাদি।

সারা দেশেই খাবারের ধরণ বদলে গেছে। উপকরণ, রন্ধন পদ্ধতি, আকৃতি, স্বাদ– সবকিছুই। নাস্তায় চিড়ামুড়ির বদলে সিঙ্গাড়া, বার্গার, পোটাটো ফিঙ্গারস, নড্যুলস ইত্যাদি। সাদা ভাতের বদলে ফ্রায়েড রাইস। সেই সাথে থাই স্যুপ ও ফ্রায়েড চিকেন। এ সমস্ত খাবার খেতে দোষ কী? এগুলো চর্বিতে ভরা। ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের ঘাটতি থাকে। শরীরের চাহিদা বা প্রয়োজনের তুলনায় স্নেহ জাতীয় উপাদানের পরিমাণ বেশী। পুষ্টি বা খাদ্যমানের দিক থেকে এগুলো নিকৃষ্ট। অথচ এ সমস্ত খাবারই খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। পরিমাণেও বেশী খাওয়া হচ্ছে। ফলে দেহ স্থুল হয়ে পড়ছে। স্থুলতার জন্য নানা রকমের রোগ আক্রমণ করছে। সম্প্রতি আমেরিকা ও বৃটেনে স্থুলতা থেকে রক্ষার জন্য ওই সমস্ত দেশের নাগরিকদের নির্দিষ্ট কিছু খাবার গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যের পরিবর্তন এখন খুবই স্পষ্ট। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ থেকে দেখা যায় যে বিগত ৫০ বছরে জনপ্রতি গড়ে দৈন্কি খাদ্য গ্রহণের পরিমণ শতকরা ১৩ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ষাট দশকের প্রথম দিকে এই পরিমাণ ছিল ৮৮৬ গ্রাম। যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৯৫-৯৬ সালে ৯১৪ গ্রাম, ২০০৫ সালে ৯৪৮ গ্রাম এবং ২০১০ সালে ১,০০০ গ্রামে পৌঁছেছে। এই সময়ের মধ্যে ভাত ও রুটি খাওয়ার পরিমাণ ৮২ গ্রাম কমে এলেও প্রাণিজ খাদ্য যেমন ডিম, দুধ, মাছ খাওয়া ৫৩ গ্রাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোজ্যতেল খাওয়ার পরিমাণ ১৯৯৫-৯৬ সালে ১০ গ্রাম থেকে দ্বিগুণেরও বেশী বৃদ্ধি পেয়ে ২০১০ সালে প্রায় ২১ গ্রামে পৌঁছেছে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি বছরে গড়পড়তা ২০টি ডিম খাওয়া পড়ত। আর বর্তমানে প্রায় ৫০টি। একই সময়ে আলু খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে জনপ্রতি দৈনিক ২০ গ্রাম। শুধু চিনি খাওয়ার পরিমাণ কমেছে ১ গ্রাম। আমরা প্রতিদিন যে খাদ্য উপকরণ বিশেষ করে মাছ শাকসব্জি, ফল কিনে থাকি সেগুলোর অধিকাংশ গ্রাম থেকে আসে। এমনকি বিদেশ থেকেও আমদানি করা হয়। এগুলো সাধাণত প্রাকৃতিকভাবে নয়, খামারে চাষ করে উৎপাদিত। দ্রুত বর্দ্ধনের লক্ষ্যে রাসায়নকি সার প্রয়োগ করা হয় এবং কীটনাশক ছিটিয়ে রোগব্যাধি ও কীটপতঙ্গ থেকে মুক্ত রাখা হয়। শহরে পৌঁছাতে বা বিদেশ থেকে আমদানিতে কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ লেগে যওয়ায় বাসী হয়ে যায়। বিক্রেতারা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে এগুলো ক্রেতাদের সামনে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরেন। ক্রেতারা আবার বাসায় নিয়ে এসে ফ্রিজার বা ডিপফ্রিজারে রেখে দেয়ায় আরো বাসী হয়ে পড়ে। খামারে উৎপাদিত ও বাসী উপকরণ দিয়ে তৈরি খাবার সুস্বাদু করতে অতিরিক্ত ভোজ্যতেল, মসলা এবং অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করা হয় যা স্বাস্থসম্মত নয়। এদিকে পশ্চিমাদের সান্নিধ্যে এসে আমাদের খাদ্য তালিকায় ঢুকেছে বার্গার, ফ্রায়েড পোটাটো ফিংগারস, পেটিস, কেক, মেয়োন্নেইস, সস, কোমল পানীয়, আরো কত কী। সেই সাথে আছে ফ্রায়েড রাইস ও চিকেনসহ তেলে ভাজা চাইনিজ খাবার। বিরিয়ানী, পোলাও, পরাটাতো আছেই। ঘরে তৈরি ঘির পরিবর্তে এগুলো তৈরিতে পরিশোধিত তেল ব্যবহার হচ্ছে। খাওয়াও পড়ছে ঘন ঘন। বিয়েশাদী, জন্মদিন, আত্মীয় স্বজনের নিমন্ত্রণ, অফিস পার্টি, পিকনিক, ভ্রমণ, পার্বণ, নিকটতম কারও সাফল্য ইত্যাদি উপলক্ষ্যে। সবকিছু মিলে আমাদের খাদ্যাখাদ্য উলটপালট বা গোলমেলে হয়ে গেছে। স্থানীয় উপকরণে তৈরি টাটকা খাদ্যের পরিবর্তনে জটিল রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে মহল্লায় বা গ্রামে ডিসপেনস্যারিতে ডাক্তার রুগীর জন্য অপেক্ষা করত। সেই আমলের তুলনায় বর্তমানে জনসংখ্যা দুই গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পাড়ায় পাড়ায় হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডয়াগনোষ্টিক সেন্টার হয়েছে। এখন যন্ত্রণাকাতর রুগীকে অপেক্ষা করতে হয় আদৌ ডাক্তার সাহেবের সাক্ষাৎ মিলবে কিনা। এর বড় একটা কারণ খাদ্যে পরিবর্তন। এক সময় মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যেত। কিন্তু এখন মানুষ খাদ্যের প্রাচুর্যের মধ্যে মারা যাচ্ছে অকালে, জটিল রোগে। এখনকার গোলমেলে খাদ্য মানুষের জন্য অনেকটা হুমকির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রসঙ্গ ক্রমে মার্কেসাস আইল্যান্ড বা 'দি ল্যান্ড অফ ম্যান' এর বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। তাহিতি থেকে প্রায় ১ হাজার ৪ শত কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এবং মেহিকোর পশ্চিম উপকূল থেকে ৪,৮০০ কিলোমিটার দূরে দুনিয়ার নিভৃত এক প্রান্তে কয়েকটি দ্বীপপুঞ্জ মিলে প্রায় ১হাজার ৫০ বর্গকিলেমিটার এলাকায় মার্কেসাসদের বসবাস। এই মার্কেসাস আইল্যান্ডস সর্বপ্রথম স্পানঞলদের নজরে পড়ে। এরপর ফ্রান্স ১৮৪২ সালে সামরিক অভিযান চালায় এবং ১৮৭০ সালে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। অষ্টাদশ শতাব্দিতে মার্কেসাসদের সংখ্যা ছিল ৭৮ হাজার। তারা ছিল সুস্বাস্থের অধিকারী। দাঁত ছিল চকচকে সাদা। মূলত উদ্ভিজ্জ জাত খাদ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। নানা উপাদেয় উদ্ভিজ্জ খাদ্য প্রাকৃতিক ভাবেই উৎপাদিত হত। শিশু জন্ম নেয়ার পর থেকে তিন থেকে চার বছর মায়ের দুধের উপর নির্ভরশীল থাকত। মুলত কচু, নারকেল ও ত্রিশ জাতের কলাই ছিল প্রধান খাদ্য। এছাড়া ছিল সামুদ্রিক মাছ। সমুদ্রে বা দূরবর্তী কোথাও গেলে সাথে থাকত কলা, শ্বেতসারযুক্ত এক রকম ফল (ব্রেডফ্রুট) সিদ্ধ বা নারকেল। কোন উৎসব হলে মাছ বা গোশত খাওয়া পড়ত। গাছের পাতায় মুড়িয়ে ভাপ দিয়ে খাবার তৈরি করা হত। নারকেল তেল দিয়ে একে অপরের শরীর মালিশ করে দেয়া ছিল মার্কেসাসদের সামাজিক রীতি। দুইতিন ঘন্টা ধরে এই মালিশ চলত। মালিশের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হত হৃদ্যতা। তেল দিয়ে মালিশের ফলে সূর্য়ের তেজ থেকে দেহের চামড়া রক্ষা পেত। বৃষ্টির পানি শরীরে পড়ে সহজে গড়িয়ে যেত। দ্বীপে কোন পীড়া বা ব্যাধি ছিল না। অকাল মৃত্যুর কোন কারণ ছিল না। শতবর্ষী পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষয় হয়ে গেলেও দাঁত ছিল। খুদা পেলেই তারা খেত। কোন সময় বাঁধা ছিল না। সাঁতারকাটা ছিল নিয়মিত অভ্যাস।

নারকেলের খোঁজে দ্বীপে বিদেশীদের আসা শুরু হলে মার্কেসাসদের জীবন যাপনে পরিবর্তন হতে থাকে। বিদেশী বণিকেরা চিনি, ময়দা, টিনজাত খাবার, মদ ও কাপড়ের বিনিময়ে নারকেল সংগ্রহ করতে থাকে। এই সাথে বিদেশীদের থেকে বসন্ত রোগ, যক্ষা, ডিপথেরিয়া, লেপরসি, সিফিলিস রোগ বিস্তার হতে থাকে। ইতোমধ্যে চীন থেকে বণিকরা এসে বন্দরে ভান্ডার বা দোকান স্থাপন করে লজেন্স, পাউরুটি, চিনি, টিনজাত খাবার, কলছাটাই মসৃন চাল বিক্রি শুরু করে। মার্কেসাসরা তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিত্যাগ করে চীনা বাজার থেকে খাবার কিনে খেতে শুরু করে। ইউরোপীয় খাবার খেলে মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এই ধরনের উপলদ্ধি সৃষ্টি হয় তাদের মধ্যে। কে কত পাউরুটি ও টিনজাত মটরশুঁটি কিনতে পারে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এরপর আগমন ঘটে ফরাসীদের। সামরিক শক্তি দিয়ে দ্বীপের অধিবাসীদের শাসন করতে। আগুন জ্বালিয়ে বিদ্রোহীদের গ্রাম ধ্বংস করা হতে থাকে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে ১৮৯৪ সালে। এক ক্যাপ্টেন নৌকাভর্তি বসন্তরোগে আক্রান্ত রোগীদের এই দ্বীপে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে যায়। একদিকে মার্কেসাসদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তার উপর বিদেশী খাবার খেয়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। বসন্ত রোগ বিস্তারের আগেই অর্ধেকের বেশী মার্কেসাসদের মৃত্যু ঘটে এবং ১৯২০ সালে ১ হাজার জনে এসে দাঁড়ায়। এই বিপর্যায়ের বড় একটা কারণ ছিল মার্কেসাসদের খাদ্যে হঠাৎ করে আমূল পরিবর্তন। এদিকে নারিকেল ক্রয় করতে বণিকেরা দ্বীপে আসা বন্ধ করে দেয়। জাহাজে নারিকেল তোলার মত সক্ষম কাউকে পাওয়া মুষ্কিল হয়ে পড়ে। খ্রীষ্টান যাযকেরা হতাশ হয়ে তাদের কার্যক্রম পরিত্যাগ করে। ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ কোনমতে একজন সরকার প্রধান ও কয়েকজন শান্তিরক্ষক নিযুক্ত করে দ্বীপ ত্যাগ করে। পরবর্তী তিন যুগ ধরে অবশিষ্ট মার্কেসাসরা বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে থাকে। চাইনিজ ভান্ডার থেকে খাবার কেনার মত সামর্থ্য বা অর্থ না থাকায় দ্বীপের প্রাকৃতিক আহার্য দ্রব্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তারা। তাদের পূর্বপুরুষেরা যা খেত সেই একই খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। প্রায় অর্ধ শতাব্দিকাল পরে প্রথমবারের মত মার্কেসাসদের মৃত্যু হারের তুলনায় জন্ম হার বৃদ্ধি পায়। বিদেশীর প্রতি তাদের অবিশ্বাস থাকলেও মার্জিত ব্যবহার বজায় রাখে। কিছু নৃতত্ত্ববিদ ১৯৫৮ সালে ভ্রমণ কালে দ্বীপবাসীদের বন্ধুসুলভ দেখতে পেলেও তাদের থেকে কোন সহায়তা পেতে ব্যর্থ হয়। তাদের ভাষা শিখতে চাইলে অসহযোগিতা করে। দ্বীপের জনসংখ্যা ১৯৬২ সালে লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৬৭ সালে ৫ হাজারে পৌঁছে। গত দশকের শেষ দিকে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৮ হাজারের উপরে চলে আসে। গভীর বিচ্ছিন্ন উপত্যকাগুলোতে নতুন গ্রাম বা বসতী হয়েছে। এমনই একটি গ্রামের নাম 'তায়োহা'। এর কর্তা হলেন ৯৫ বছর বয়স্ক একজন ব্যক্তি যিনি পুরনো দিনের সবকিছুই মনে রেখেছেন এবং নিজ গ্রামকে সেই আমলে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন যখন সবাই ব্রেডফ্রুট খেত, কচু উৎপাদন করত এবং স্থানীয় প্রণালীতে খাদ্য প্রস্তুত হত। তিনি খাদ্য উপকরণ ও খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত নিয়মাবলী কঠোরভাবে কার্যকরী করেন। শিশুপ্রসূতি মহিলাদের হাসপাতালে যেতে দেয়া হয় না। অভিজ্ঞ ধাত্রীর তত্বাবধানে ভূমিষ্ঠের ব্যবস্থা করা হয়। এই সমস্ত শিশুদের ওজন বেশী হয় কারণ তাদের মায়েরা স্থানীয় খাদ্য খায়। বাচ্চাদের শরীরের বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ভালো হয়। দ্রুত হাঁটতে সক্ষম হয়। রোগব্যাধিতে কম আক্রান্ত হয়। শিশুদের মায়ের দুধের সাথে সাথে অপরিপক্ক নারকেলের শাঁস ও স্থানীয় এ্যরারুট থেকে তৈরি শর্করা দিয়ে তৈরি খীর খেতে দেয়া হয়। নারিকেল গঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে কচি অবস্থায় খুব কম ক্যালরি থাকে। এতে প্রচুর ফসফরাস, লৌহ, থায়ামিন, রিবোফ্লবিন, নিয়াসীন, এ্যাসকরবিক এ্যাসিড ও ভিটামিন ই বিদ্যমান। এই সাধারণ খাবারেই গ্রামের শিশুদের জীবন শুরু হয়। মার্কেসাসদের প্রিয় মিষ্টান্ন হল বন থেকে সংগৃহীত মধু। গরম পানি ও লেবুর রসের সাথে মিশিয়ে এই মধু খায়। এছাড়া প্রায়শ মাঠ থেকে আখ কেটে নিয়ে এনে টুকরো করে চিবিয়ে খায়। শিশুরা কয়েক টুকরো স্কুলের টিফিনের সাথে নিয়ে যায়। এদের খাদ্য হল স্থানীয় পদ্ধতিতে রান্না করা মাছ, সব্জি, কচু জাতীয় খাবার সেই সাথে টাটকা ফল। কোন পাউরুটি, কলছাটাই মসৃন চাল, টিনজাত গোশত খেতে দেয়া হয়না। গ্রামে মার্কেসাসদের জীপন যাপন বিদেশীদের আগমনের পূর্বের তুলনায় আরও ভালো হয়েছে। গোষ্ঠীভিত্তিক বাগানে মিষ্টি আলু, তরমুজ, বাদাম, টমাটো, ভুট্টা, গাজর ও অন্যান্য সব্জি রাসায়নিক সার প্রয়োগ না করেই উৎপাদিত হয়। এই পুষ্টিকর খাদ্য হল দৈনন্দিন আহারের বড় অংশ। অনেক ত্যাগ ও তিক্ত অভিজ্ঞতার পর মার্কেসাসরা তাদের সেই সুখময় দ্বীপ ফিরে পেয়েছে। এখনকার খাদ্য এবং খাদ্যাভাসে আপনি থাকবেন কিনা আপনিই ভেবে দেখুন। কারণ জীবনটা আপনার, সিদ্ধান্ত্ও আপনাকেই নিতে হবে।


কিউ আর ইসলাম
: কৃষি, পানি ও পল্লীউন্নয়ন বিশ্লেষক।