অগ্রজপ্রতিম সহকর্মী খান সারওয়ার মুরশিদ

ড. আনিসুজ্জামান
Published : 13 Dec 2012, 04:03 PM
Updated : 13 Dec 2012, 04:03 PM

সম্প্রতি আমার শিক্ষক ও সহকর্মী খান সারওয়ার মুরশিদের মহাপ্রয়াণ হল। ওঁকে নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্মৃতি রয়েছে। এর খুব সামান্য অংশই হয়তো এখানে আমার পক্ষে তুলে ধরা সম্ভব।

১৯৫৪-৫৫ শিক্ষাবর্ষে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অল্প কিছুদিন ওঁর কাছে ইংরেজি সাবসিডিয়ারি পড়েছি। অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ নামে। তিনিও এটিতে ছিলেন। ১৯৫১ সালের দিকে এ সংগঠন গড়ে তোলা হয়। সওগাত অফিসে নিয়মিত আমাদের সাহিত্যসভা হত। আমরা দুজনেই সেখানে যেতাম। দেখা হত, কথা হত, সাহিত্য নিয়ে নানা আলোচনা হত। এভাবে খান সারওয়ার মুরশিদের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্র আমি ওঁর ছাত্র হওয়ার আগে থেকেই ছিল।

ওঁর বাবাকেও আমি চিনতাম। তিনি আলী আহমদ খান। ব্রিটিশ শাসনামলে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক ও পরে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হন। একসময় তিনি মুসলিম লীগ করতেন। পরে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। 'পূর্ব বাংলা' নামের যে পত্রিকাটি তিনি বের করতেন সেটি তখন থেকেই আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। তবে পত্রিকাটিতে কিছু সাহিত্যের লেখালেখিও ছাপা হত। আমার লেখা গল্প সেখানে প্রকাশিত হয়েছে। এভাবে খান সারওয়ার মুরশিদের পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল।

১৯৫৯ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করি। দশ বছর কাজ করার পর ১৯৬৯ সালে আমি চট্টগ্রামে চলে গেলে প্রথম দফায় সহকর্মী হিসেবে আমাদের কাজ করার ইতি ঘটে। তবে এরপর ১৯৮৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। এভাবে দু'দফায় মোট আটাশ বছর আমরা একসঙ্গে অধ্যাপনা করেছি।

বয়সে তিনি ছিলেন আমার বারো কি তেরো বছরের বড়। একসময় আমার এক আত্মীয়ার সঙ্গে ওঁর এক আত্মীয়ের বিয়ের সূত্রে আমাদের মধ্যে একটা আত্মীয়তাও তৈরি হয়েছিল। তবে ওঁর একজন ছাত্র ও অনুজতুল্য সহকর্মী হিসেবে সবসময় ওঁর স্নেহ পেয়েছি আমি।

ব্যক্তিগতভাবে খুব কাছ থেকে ওঁকে যেভাবে দেখেছি, তাতে মুগ্ধতা ছড়াতেন তিনি। দেখতে ছিলেন খুব সুন্দর। তেমনি ওঁর আচরণেও ছিল অসম্ভব শুচিতা। অর্থাৎ রুচি ও শুচির এক সুন্দর সমন্বয় ছিলেন তিনি। ব্যক্তি হিসেবে তাই তিনি ছিলেন অনন্য।

আমাদের সাহিত্যে ওঁর সবচেয়ে বড় অবদান হল, তিনি ছিলেন খুবই উচ্চাঙ্গের একজন সাহিত্য সমালোচক। অন্য অনেকের চেয়ে তিনি এগিয়ে ছিলেন আরেকটি কারণে। সমকালীন বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তো বটেই- ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কেও ওঁর গভীর প্রজ্ঞা ছিল। এ দুই ভাষার সাহিত্য সম্পর্কে ওঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয় আমরা নানাভাবে পেয়েছি। এ জ্ঞান ও বোধ তিনি আমাদের মধ্যে সঞ্চারের চেষ্টা করেছেন।

একটি ইংরেজি কাগজ সম্পাদনা করতেন তিনি। 'নিউ ভ্যালুজ' নামে। ১৯৪৯ সাল থেকে পত্রিকাটি সম্পাদনা শুরু করেছিলেন তিনি। ষাটের দশক পর্যন্ত পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। এটি ছিল খুবই উচ্চমানের একটি সাংস্কৃতিক পত্রিকা।

ব্যক্তি খান সারওয়ার মুরশিদের জীবন এভাবেই ছিল বৈচিত্রময় কর্মের এক বিশাল সম্ভার। দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। অন্যদিকে তিনি ছিলেন সমাজসচেতন। ফলে নিজ কর্মের পাশাপাশি এদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি ওঁর সহমর্মিতা ছিল। অনেক ক্ষেত্রে তিনি এসব আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে এদেশের যে-ক'জন শিক্ষক চিন্তা-ভাবনা করতেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা বলেছেন। স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করতেন বলেই এটা ওঁর মধ্যে এসেছিল।

আমরা ওঁকে দেখেছি ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় কিছু ভূমিকা পালনে আমাদের নেতৃত্ব দিতে। একাত্তরে তিনি ছিলেন অসাধারণ সক্রিয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিল গঠিত প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের বক্তব্যের খসড়া তৈরির জন্যও তিনি কাজ করেছিলেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তীতে তিনি যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে। সেখানে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমর্থক, আমাদের বিদেশি বন্ধু আন্দ্রে মার্লোকে নিয়ে আসেন। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ভিনদেশি সমর্থকদের সম্মাননা দেওয়ার রীতিটি বাংলাদেশে প্রথম তিনিই চালু করলেন তা বলা যায়।

তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যা-যা করতে চেয়েছিলেন- তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেকেরই তা অপছন্দ ছিল। মনক্ষুণ্ন হয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে উপাচার্যের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু তখন ওঁকে পোল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেন। রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনশেষে তিনি কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটে অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব নিয়ে লন্ডনে যান।

ফিরে এসে আবারও যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন। অবসরগ্রহণের পর তিনি ছিলেন সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক। একইসঙ্গে অধ্যাপনা করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা অনেক বেড়ে যায়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আমরা যে ৩১ জন নাগরিক সচেতন ভূমিকা পালন করেছি সেখানে তিনিও ছিলেন। বিশেষ করে আমাদের দেশে যে-সময়গুলোতে সামরিক শাসন ছিল, জনগণের কথা বলার সুযোগ থাকত না- সেসব সময়ে আমরা নানাভাবে একসঙ্গে কাজ করেছি।

ওঁর ইংরেজি ও বাংলা দুই-ই ছিল খুব পরিশীলিত। ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক সহকারী পরিচালক একবার আমাকে বলেছিলেন, 'বিবিসির বাইরে আমি এত ভালো ইংরেজি আর কাউকে বলতে শুনিনি।' তিনি লেখালেখিতেও খুব পরিশীলিত বাংলা ও ইংরেজি ব্যবহার করতেন। তাতে হয়তো সময় একটু বেশি লাগত কিন্তু তাড়াহুড়ো করে যেনতেনভাবে কিছু লিখবেন এটা ওঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। যেকোনো লেখাই খুব যত্ন করে লিখতেন। এজন্যই খুব সম্ভব তিনি খুব বেশি লিখেননি। ওঁর লেখা প্রবন্ধের বই মাত্র একটি। কবি শামসুর রাহমানের রচনাবলীর ভূমিকা লিখেছিলেন তিনি। আমার দৃষ্টিতে সেটা ছিল শামসুর রাহমানের ওপর খুব ভালো একটি মূল্যায়ন।

প্রসঙ্গক্রমে খান সারওয়ার মুরশিদের ব্যক্তিগত জীবনের কথাও উল্লেখ করছি। ওঁর স্ত্রী নূরজাহান মুরশিদও অত্যন্ত গুণী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান চালিয়েছেন। স্বাধীনতার পর প্রতিমন্ত্রীও হন। 'এদেশ একাল' নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি। নূরজাহান মুরশিদ ছিলেন খান সারওয়ার মুরশিদের যোগ্য সহধর্মিনী। তিনি আরো কয়েক বছর আগেই প্রয়াত হয়েছেন।

খান সারওয়ার মুরশিদের মৃত্যুতে আমাদের সাংস্কৃতিক জগতে ও নাগরিক সমাজে একটি শূণ্যতা তৈরি হল। তবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ওঁর অবদান জাতি বিস্মৃত হবে না এটাই আমি আশা করি।

ড. আনিসুজ্জামান : অধ্যাপক ও লেখক।