একজন সেইফটি প্রফেশনালের দৃষ্টিতে সীতাকুণ্ডের বিপর্যয়

ইফতেখার মাহমুদ
Published : 7 June 2022, 04:00 AM
Updated : 7 June 2022, 04:00 AM

বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ঘটা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যক্তিগতভাবে আমি মর্মাহত। এই দুর্ঘটনাটি এমন একটা সময়ে ঘটেছে যখন রানা প্লাজা বিপর্যয়ের ইমেজকে কাটিয়ে বাংলাদেশের শিল্পখাত একটি উত্তরণের পথে হেঁটে যাচ্ছে। বাংলাদেশে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশান ও কমপ্লাইয়েন্সের নতুন একটি মাত্রা যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের অনেক সেক্টরেই এখন পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে। সেই সময়েই দেশিয় একটি কন্টেইনার ইয়ার্ডে এমন একটি ঘটনা ঘটলো।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণায় দেখা যায়, এখানকার বেশিরভাগ নিরাপত্তার বাধা বা সেইফটি হ্যাজার্ডগুলোই প্রতিরোধযোগ্য। যদি মালিকপক্ষ ও কর্মচারীরা কিছু সাধারণ নিরাপত্তাজনিত পদক্ষেপ নেয় তাহলে বড় ধরনের নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। এতে সরকার,মালিকপক্ষ ও কর্মচারীদের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সবার আগে একটি 'হেলথ অ্যান্ড সেইফটি পলিসি' ও লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। তারপর সেই লক্ষ্যার্জনে যার যার ভূমিকা বা কাজ নির্ধারণ করে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যেতে হবে।

একজন আইএসও অডিটর হিসেবে বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও সার্ভিস সেক্টরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে মান ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির নিরিখে অডিট বা নিরীক্ষণের সুযোগ আমার হয়েছে। এই তালিকার মধ্যে বাংলাদেশের কয়টি প্রধান ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো (আইসিডি) ও কন্টেইনার ফ্রেইট স্টেশন (সিএফএস)-ও আছে, যাদের আমি দীর্ঘদিন ধরে অডিট করে আসছি।

চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো অব্যবস্থাপনা প্রশমন ও সুশৃঙ্খলভাবে কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের উদ্দেশ্যে বন্দরের সীমিত কন্টেইনার ইয়ার্ডের বিকল্প হিসেবে এই ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোগুলো গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে এখন মোট ১৯টি ডিপো আছে যারা সমন্বিতভাবে ৭৮ হাজার টিইউ (টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভেলেন্ট ইউনিট)  পরিমাণ কার্গো সামাল দেয়ার ক্ষমতা রাখে। সম্মিলিতভাবে এই কন্টেইনার ইয়ার্ডগুলো দেশের ১০০ শতাংশ রপ্তানিমুখী কার্গো এবং ২৫ শতাংশ আমদানিমুখী কার্গো সামাল দেয়।

ডিপোগুলোতে একটি নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরিতে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশান ভীষণভাবে জরুরি। এই ডিপোগুলোর মধ্যে 'কেঅ্যান্ডটি লজিস্টিক্স' প্রথম ২০০৫ সালে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন শুরু করে আমার তত্ত্বাবধানে।একই বছর বাংলাদেশের প্রথম কন্টেইনার ইয়ার্ড অধুনালুপ্ত ইকবাল এন্টারপ্রাইজ ডিপো স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের পথে এগোয় এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য ডিপোগুলো স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন ও কমপ্লাইয়েন্স এর মান বাড়ানোর দিকে এগিয়ে আসে।

বাংলাদেশের সবচে বড় একটি কন্টেইনার ইয়ার্ড কিউএমএস, ইএমএস, ওএইচএস এবং আইএসএমএস- এই চারটি স্ট্যান্ডার্ড একসাথে ইমপ্লিমেন্ট করেছে যেখানে আমার অডিট করার সৌভাগ্য হয়েছে। তারা যে চারটি স্ট্যান্ডার্ড একসাথে ইমপ্লিমেন্ট করেছে এর মধ্যে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা (OHS) বিষয়ক স্ট্যান্ডার্ড আইএসও ৪৫০০১:২০১৮ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে একটা কন্টেইনার ডিপোর জন্য।

কন্টেইনার ইয়ার্ডগুলোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক স্ট্যান্ডার্ডআইএসও ৪৫০০১:২০১৮ আক্ষরিকভাবে প্রয়োগ করা অবশ্য কর্তব্য। অথচ, এই কন্টেইনার ডিপো বা ইয়ার্ডগুলোর মধ্যে আমার জানামতে মাত্র গুটিকয়েক  ডিপো আইএসও ৪৫০০১:২০১৮ সনদ পেয়েছে।

এই ডিপোগুলোয় শুধু স্ট্যান্ডার্ড প্রয়োগ করে সার্টিফিকেট অর্জন করে ক্ষান্ত হলেই চলবে না, এটির প্রয়োগও নিরবিচ্ছিন্নভাবে বজায় রাখতে হবে। বিএম ডিপোতে আইএসও ৪৫০০১:২০১৮

সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে এ ধরনের নিরাপত্তাজনিত ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির সম্ভাবনা বহুলাংশে কমে যেতো। আইএসও ৪৫০০১ এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, বছরব্যাপী নিয়মিত আভ্যন্তরীণ নিরীক্ষণে এই হেলথ অ্যান্ড সেইফটি হেলথ হ্যাজার্ড-গুলো আগে থেকেই চিহ্নিত করা যায় এবং এর বিপরীতে প্রয়োজনীয় সংশোধনমূলক এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এছাড়াও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে 'হ্যাজার্ড আইডেন্টিফিকেশান ও রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট' করতে হয়, সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিরূপণের জন্য।

যেমন ধরুন 'হ্যাজার্ড আইডেন্টিফিকেশান ও রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট' করে জানা গেল, একটি  প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগার রিস্ক আছে। তখন আগুন লাগার মূল কারণগুলো অনুসন্ধানের মাধ্যমে একটা ডিপোতে কতগুলো কারণে আগুন লাগতে পারে তার একটা তালিকা তৈরি করে, প্রতিটা কারণের বিপরীতে প্রিভেন্টিভ বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে এবং তা অরগানাইজেশানাল হেলথ অ্যান্ড সেইফটি প্ল্যানের অন্তর্ভুক্ত করতে হয়।

এখন পর্যন্ত যেটুকু জানা গেছে তাতে মনে হচ্ছে, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের বিস্ফোরণপ্রবণ একটি  রাসায়নিক পদার্থ আগুনের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরকে রূপ নিয়েছিল। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। বিশুদ্ধ অবস্থায় এটি বর্ণহীন তরল। পানির সাথে অক্সিজেনের অতিরিক্ত অণু যোগ করেই তৈরি করা হয় হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড। নানা ধরনের সংক্রমণ নাশক হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়, যা বৈজ্ঞানিকভাবে H2O2 নামে পরিচিত। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড শক্তিশালী অক্সিডাইজারের মতো দ্রব্যের সংস্পর্শে আসলে ভয়ংকর আগুন লাগতে পারে। নিরাপত্তাজনিত কারণে সব সময় হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের জলীয় দ্রবণ ব্যবহার করা হয়।

হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উত্তপ্ত হলে তাপীয় বিয়োজনে বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে। তাই এটাকে কম তাপে নিরাপদে স্থানান্তর করা হয়।

হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড  নিজ থেকে আগুন জ্বালাবে না, তবে অন্যান্য পদার্থের সঙ্গে মিলিত হলে আগুনের ঝুঁকি হতে পারে। বিশেষ করে, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড যদি বিশুদ্ধ বা মিশ্রিত আকারে হয় তাহলে বিভিন্ন ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে, প্রধানটি হলো এটি জৈব যৌগের সংস্পর্শে বিস্ফোরক মিশ্রণ তৈরি করে। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিজে আগুনের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে না, কিন্তু এটি আগুনকে তীব্র করে তুলতে পারে।

হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে সরাসরি বিস্ফোরক তালিকায় রাখা না হলেও ক্ষতি করার অসীম ক্ষমতা রয়েছে এর। মূলত ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে এর প্রতিক্রিয়া খুব ভিন্ন হতে পারে। উচ্চ ঘনত্বে, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের প্রকৃতপক্ষে বিস্ফোরক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কারণে লাগা আগুন পানি দিয়ে নেভানো যায় না। বরং এতে আগুনের মাত্রা আরও বাড়ে। রাসায়নিকের কারণে লাগা আগুন নেভাতে হয় ফগ সিস্টেমে। কিংবা ব্যবহার করা হয় ফোম কিংবা ড্রাই পাউডার জাতীয় অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র। এ কারণে পানির সাহায্যে এই আগুন নেভানো সম্ভব নয়।

আইএসও অডিটের সুবাদে এধরনের হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কয়েকটি বড় উৎপাদককে কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে তারা এই রাসায়নিক চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি করে। রপ্তানিকালে রপ্তানির উদ্দেশে আনা পণ্য কন্টেইনারে বোঝাই করা হয়। বাংলাদেশে সাধারণত ২০ ফিট, ৪০ ফিট এবং ৪৫ ফিটের কন্টেইনারে পণ্য বোঝাই করা হয় এবং এই বোঝাইকরণের কাজটি ডিপোতেও হতে পারে আবার ম্যানুফাকচারারের সাইটেও হতে পারে। রপ্তানিকারকদের উচিত, কেমিকেল বোঝাই ড্রামগুলোতে সঠিকভাবে টাগিং ও মারকিং করা এবং ড্রামগুলোতে পরিষ্কারভাবে রাসায়নিকগুলোর নাম লিপিবদ্ধ করা। দাহ্য ও করোসিভ বা ক্ষয়কারক হলে সেই বিষয়ক সাংকেতিক চিহ্ন দেয়া। এবং ড্রামগুলো ডিপোতে হস্তান্তরের সময় প্রতিটি রাসায়নিকের ম্যাটেরিয়াল সেইফটি ডেটা শিট ডিপোগুলোকে হস্তান্তর করা। ম্যাটেরিয়াল সেইফটি ডেটা শিটে প্রতিটি রাসায়নিকের ডিটেইল ইনফরমেশন থাকে।

যেসব ডিপো এরকম ঝুঁকিপূর্ণ, দাহ্য, দুর্ঘটনাপ্রবণ ও ক্ষয়কারক দ্রব্য স্টোর করে বা কন্টেইনার বোঝাই করে, তাদের উচিত এসব পণ্য 'HAZCHEM ZONE' আলাদা এলাকায় রাখা বা হান্ডেলিং করা। 'HAZCHEM ZONE'- এ সর্বোচ্চ ফায়ার সেইফটি নিশ্চিত করতে হবে।

এসব পদার্থে আগুন যেন না লাগে সেজন্য প্রিভেন্টিভ ফায়ার সেইফটি মেইজার নেওয়া উচিত। এধরনের আগুন নেভানোর জন্য আভ্যন্তরীণ ফায়ার সেইফটি টিমকে নিয়মিত পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এছাড়াও আগুন লেগে গেলে ফায়ার সার্ভিসকে প্রথমেই ওই কেমিক্যাল এর সেইফটি ডেটা শিট প্রোভাইড করতে হবে, যাতে তারা সতর্কভাবে সঠিক এক্সটিংগুইশার ও কেমিক্যাল ব্যবহার করে আগুন নেভাতে পারে।

আমার বাবা সিভিল ডিফেন্সের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষক ছিলেন। এ বিভাগটি পরে ফায়ার সার্ভিসের সাথে একত্রীভুত হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের বাসায় থাকা অবস্থায় বঙ্গবাজারের দুইটা বড় আগুন নির্বাপণের ব্যবস্থাপনা নিজের চোখের সামনে দেখেছি। একজন ফায়ারম্যান ঘণ্টা বাজা মাত্র যেখানে যে অবস্থায় থাকেন, ইউনিফর্ম হাতে ছুটে যান। তারপর গাড়িতে বসে পোশাক পরতে পরতে গন্তব্যে পৌঁছে বিপন্ন মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। বিএম ডিপোতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নয়জন ফায়ার ফাইটার মৃত্যুবরণ করেছেন। আহত হয়েছেন অনেকেই। অভিযোগ উঠেছে আগুনের ধরন সম্বন্ধে ফায়ার সার্ভিসকে সঠিক তথ্য দেওয়া হয়নি। সেকারণে, অনেক ফায়ার সার্ভিসের সেনারা অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। আবার ডিপোর পক্ষ থেকে তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে তারা ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে জানিয়েছে যে এটা রাসায়নিকজনিত আগুন। তবে, কোথাও না কোথাও যোগাযোগের ঘাটতি বা সমন্বয়ের সমস্যা ছিল।

যারা বা যেসব প্রতিষ্ঠান বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে কাজ করেন তাদের উচিত তাদের কাছে থাকা এই পদার্থের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে জনসংযোগ করা। এই ব্যাপারে তারা যেন সংশ্লিষ্ট সকল 'স্টেইকহোল্ডার'-কে সঠিকভাবে অবহিত করে। এই স্টেইকহোল্ডারদের মধ্যে আছে প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষের সবাই, কর্মচারী ও কর্মকর্তারা, তাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যরা, ভিজিটররা, সাপ্লাইয়াররা এবং নিকটবর্তী কমিউনিটির লোকজন। এই ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য  দেয়াল লিখন, লিফলেট বিতরণ, প্রশিক্ষণ,অফিস নোটিস জারি, সচিত্র পোস্টার দেয়ালে আঁটা, সেইফটি উইক পালন, শিক্ষামূলক নাটিকা প্রচার ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।

বর্তমান বিশ্বে মুনাফা অর্জনই মুখ্য বিষয় নয়। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণ হচ্ছে তার কর্মচারী ও কর্মকর্তারা। এই কর্মচারীরাই একটি প্রতিষ্ঠানকে চালু রেখে মালিকপক্ষের মুনাফা অর্জনের পথ করে দেয়। তাই যে কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাকে সবোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া উচিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের।