Published : 04 Jun 2022, 04:39 PM
মুক্তিযুদ্ধের পর এ দেশের ইতিহাসে আরেকটি বড় অর্জনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং এ যাবতকালের বৃহৎ স্থাপনা, যা আবার নির্মিত হয়েছে সম্পূর্ণ নিজেদের অর্থে, তেমন একটি গৌরব তো উদযাপনের দিন। পুরো জাতি মিলে গৌরবে অভিষিক্ত হওয়ার ক্ষণ। কিন্তু অতীতের বহুকিছুর মতো এখানেও বিভক্ত জাতি। এই মাহেন্দ্রক্ষণে নানাপ্রকার বিতর্ক তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। কারা তৈরি করছে এমন বিতর্ক? কারা এবং কোন উদ্দেশ্যে এই গৌরবকে ম্লান করতে চায়?
উত্তরটি খুবই সোজা। যারা এ সেতু নির্মাণের বিরোধিতা করেছিল, সেতুটা যেন নির্মিত না হয় তার জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিল- তারাই। এরাই দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে উদ্বোধনের দিন হরতাল ডাকার একটি ছুতো খুঁজছে। তর্কে নামার লক্ষ্যে অনেকে বলবেন, বিতর্ক তো উসকে দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। কীভাবে? তা বোধহয় খুব বিস্তারিত বলার দরকার নেই। সামান্য উদ্ধৃতি দিচ্ছি তবুও।
গত ১৮ মে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কানফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে বক্তৃতার একপর্যায়ে বলেন, "খালেদা জিয়া বলেছিল, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে, ওখানে চড়া যাবে না, চড়লে ভেঙে পড়বে। পদ্মা সেতুতে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে (খালেদা জিয়াকে) টুস করে নদীতে ফেলে দেওয়া উচিত। আর যিনি আমাদের একটা এমডি পদের জন্য পদ্মা সেতুর মতো সেতুর টাকা বন্ধ করেছেন, তাকেও আবার পদ্মা নদীতে নিয়ে দুই চুবানি দিয়ে উঠিয়ে নেওয়া উচিত। মরে যাতে না যায়। একটু পদ্মা নদীতে দুইটা চুবানি দিয়ে সেতুতে তুলে দেওয়া উচিত। তাহলে যদি এদের শিক্ষা হয়।"
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে পত্রিকা, টিভি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর বাকবিতণ্ডা হচ্ছে। বিএনপি এবং তার সমমনা দলগুলো এই উক্তিকে খালেদা জিয়ার জীবননাশের হুমকি আখ্যা দিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে। গত তেরো বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ মিছিল করেছে, যদিও সে মিছিলে 'ছাত্রলীগের কর্মীরা আক্রমণ করেছে' বলে অভিযোগ করেছে তারা।
একইসঙ্গে বিএনপি এবং তার সমমনা দলগুলো পদ্মাসেতুর নির্মাণব্যয় ও বিএনপির শাসনামলে যমুনাসেতু, যা এখন বঙ্গবন্ধু সেতু হিসেবে পরিচিত তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালের প্রসঙ্গটি তুলছে। তাতে অবশ্য বিএনপি নিয়তটি পরিষ্কার হয়েছে। পদ্মাসেতু উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণার পরপর বিএনপির হঠাৎ সরব ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে মারমুখি হয়ে ওঠার পেছনে তাদের দুরভিসন্ধির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ যেকোনো ঘটনা ঘটিয়ে ২৫ জুন একটি হরতাল ডাকা যায় কিনা তার উছিলা খুঁজছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রসঙ্গে আসি। সেদিন প্রধানমন্ত্রী কি 'অপ্রধানমন্ত্রীসুলভ' কথা বলেছিলেন? সে ব্যাখ্যায় আসি। সেদিন অনুষ্ঠানটি ছিল দলীয় অনুষ্ঠান, কোনো সরকারি বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান নয়। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে সেদিন শেখ হাসিনা বক্তব্য দিচ্ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়। আর রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে তা অশোভনও নয়। তার ভাষণের এই অংশটি ছিল একটি পলিটিক্যাল স্যাটায়ার, যা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা করেন, আমাদের দেশে করেন, বিশ্বের প্রায় সবদেশেই করে থাকেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন প্রদেশ এমনকি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথিত রক্ষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাকযুদ্ধে এর চেয়েও কড়া, আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করতে বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি কিছু অভিন্ন ভাষায় আক্রমণ করে, যেমন 'আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল', 'আওয়ামী লীগ ইসলামবিদ্বেষী', 'বাকশালী' (দুঃখজনকভাবে এই বিপ্লবকে গালিতে পরিণত করা হয়েছে) ইত্যাদি।
বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া বলতেন, 'আওয়ামী লীগ জিতলে মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি শোনা যাবে', 'বাংলাদেশ ভারতের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হবে'। পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, 'এই চুক্তি সম্পাদিত হলে ফেনী পর্যন্ত ভারতের অংশ হয়ে যাবে'।
বলা যেতে পারে- এসব তো নির্বাচনী মাঠের বক্তৃতা কাজেই মাঠ গরম করার উপাদান তো কিছু থাকবেই!
কিন্তু ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, "শেখ হাসিনা তার ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন।" সেই গ্রেনেড হামলা এবং তৎপরবর্তী বিএনপি-জামায়াত সরকারের কার্যকলাপ বিশ্বের যেকোনো নিকৃষ্ট স্বৈরশাসকদেরও লজ্জায় ফেলে দেবে। বলা যেতে পারে এসব তো অতীতের কথা, অতীতের প্রসঙ্গ টেনে কেন বর্তমানকে অশান্ত করছি?
তাহলে বলি, গত কয়েকদিন আগে মির্জা ফখরুল বলেছেন, "আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী দল, সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া দলটি জন্মের পর থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে আসছে।"
গত মে মাসের শেষ শনিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় তিনি বলেন, 'জন্মের পর থেকেই আওয়ামী লীগ তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে একটি সন্ত্রাসী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।' মির্জা ফখরুলের এ ধরনের বক্তব্য নতুন নয়। কয়েকবছর ধরে তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে আওয়ামী লীগকে একটি সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ফখরুল সাহেবের কথামতো আওয়ামী লীগকে যদি 'সন্ত্রাসী দল' হিসেবে ধরে নিই তাহলে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ, ছাব্বিশে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, নয় মাসব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশের বর্তমান সংবিধান সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দ্বারা অর্জিত বলে বেআইনি বা অবৈধ হয়ে যাবে। বরং বিএনপির জন্মই হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে। একই কায়দায় পরে জাতীয় পার্টিরও জন্ম হয়েছিল। আইয়ুব খানের আমলে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে পাঁচপাত্তুরদের লেলিয়ে দেওয়া হতো। জিয়ার আমলে একই আদলে সেখানে নীরু-বাবুলদের সৃষ্টি করা হয়েছিল। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ও হাইকোর্টের সামনে ছাত্রদলের মিছিলে ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ও ছবি দিয়ে দুয়েকটি পত্রিকার কাভারেজ দেখে এই প্রজন্মের অনেকের মনে হতে পারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।
১৯৭২ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ছাত্রহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছিলেন বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র জাগপা প্রধান প্রয়াত শফিউল আলম প্রধান। (যদিও সে সময় তিনি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। এই ঘটনার পর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং বিচার হয়)। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই আসামিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান এবং রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
বরং আওয়ামী লীগের সৃষ্টি হয়েছিল এক ঐতিহাসিক কারণে। জন্মও এক ঐতিহাসিক ঘটনা। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়েছিলেন মাওলানা ভাসানী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পক্ষে আন্দোলন করতে গিয়ে যুবক মুজিব তখন কারাগারে, সে কারাগারে থাকা অবস্থাতেই তিনি দলের অর্থাৎ আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফখরুল সাহেবের কথামতো যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দ্বারা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে, তাহলে তার দায় তো ভাসানীকেও নিতে হবে।
আওয়ামী লীগকে 'আগাগোড়া সন্ত্রাসী দল' মনে করতো পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খানসহ পাকিস্তানি জান্তা এবং এদেশিয় রাজাকার-আলবদররা। আজ ফখরুল সাহেবের একই ভাষায় বক্তৃতা শুনে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, আওয়ামী লীগের প্রতি বিদ্বেষের কারণ কি একই বেদনাজাত অনুভূতি থেকে?
ফখরুল সাহেব এবং তার দল-মত অনুসারীরা প্রকাশ্যে স্লোগান দেন, 'পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার '। বিএনপি এবং তার সমমনা দলের অনেকে প্রায়ই প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগকে আরেকটি 'পঁচাত্তর' ঘটানোর হুমকি দিয়ে থাকেন। যদিও আরেকটি 'পঁচাত্তর' ঘটানোর চেষ্টা তারা ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউতে শেখ হাসিনার ওপর করে দেখিয়েছিলেন। তাদের দুর্ভাগ্য তারা সেদিন সফল হননি। যে দলের প্রতিষ্ঠাতা শেখ হাসিনার পিতার হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের একজন, যিনি হত্যাকারীদের পুরস্কৃতকারীদের একজন, যিনি তাদের বিচার না হওয়ার জন্য আইনপ্রণেতা, যিনি হত্যাকারীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনকারী, তার প্রতিষ্ঠিত দল এবং দলের নেতা তার স্ত্রী ও পুত্র শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেডহামলার ষড়যন্ত্রকারী, হত্যাকারীদের রক্ষাকারী, সে জিয়াউর রহমান, সে খালেদা জিয়া, সে তারেক রহমান এবং তাদের অনুগত দল ও জোটের সঙ্গে শেখ হাসিনা স্বাভাবিক, শোভন, আন্তরিক ব্যবহার করবেন কীভাবে? শেখ হাসিনা তো মানুষ। মানুষের পক্ষে তো সেটি সম্ভব নয়। আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশ্বের কোনো নেতার পক্ষে সম্ভব নয়। বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলোর কোনও নেতার পক্ষে সম্ভব নয়। দেশের কোনও পত্রিকাসম্পাদক, কোনও নোবেলবিজয়ী, কোনো সুজনের পক্ষে সম্ভব নয়। মাসখানেক আগে একটি টিভি চ্যানেলে সামান্য একটি বিষয় নিয়ে বদিউল আলম মজুমদার যেভাবে খেপে গেলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়ার ওপর তা দেখে ভাবছিলাম এরাই শেখ হাসিনাকে গণতান্ত্রিক ও সহনশীল আচরণের জন্য সবক দেন।
পিতৃহন্তাকারীকে ক্ষমা করা তো দূরের কথা ব্যাংকের এমডি হতে না পেরে পদ্মাসেতুতে অর্থায়ন না করতে বিশ্বব্যাংক ও হিলারিকে প্রভাবিত করেছিলেন নোবেল লরিয়েট। তো তাদের নিয়ে স্যাটায়ার করলে গণতন্ত্রের খুব বেশি ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না।
বিএনপি তো মুক্তিযুদ্ধকেই ধারণ করে না। খালেদা জিয়া বিশ্বাসই করেন না যুদ্ধে শহিদের সংখ্যা ত্রিশ লাখ। বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে মুসলিম লীগের কোনো তফাৎ নেই। বিএনপি চিন্তা-চেতনায় পাকিস্তানি। মুক্তিযুদ্ধের কোনো গৌরবকেই বিএনপি ধারণ করে না। করে না কারণ, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের কথা বলতে গেলে আওয়ামী লীগের কথা বলতে হবে। বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে হবে। বিএনপি সে সত্য বললে তার রাজনীতিই থাকে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক জ্বালা থেকে, অনেক খেদ থেকে সেদিন ওইরূপ মন্তব্য করেছিলেন। কারণ হিলারি ক্লিনটনের প্রভাবে বিশ্বব্যাংকের সে সময়ের কার্যকলাপ ছিল ন্যাক্কারজনক। তারা একজন ব্যক্তিকে তুষ্ট করতে গিয়ে একটি জাতিকে বিশ্বের দরবারে খাটো করেছিল। পরে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল বটে কিন্তু সে ঘা তো সহজে শুকাবার নয়।
এ প্রসঙ্গে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনের কথা বলতে হয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম, সুশীল সমাজের একটি অংশ রাতদিন আবুল হোসেনকে তুলোধুনো করেছেন। অনেকে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন। টেলিভিশনের টক শোতে অশালীন ভাষায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করতে বলেছেন। অনেকে এমনও বলেছেন, 'লোকটির সামান্য লজ্জা থাকলে পদত্যাগ করে বাংলাদেশের সম্মান বাঁচাতেন'। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি, এমনকি বাংলাদেশের কেউ পদ্মাসেতু সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে অসৎ উপায় অবলম্বন করেননি। এটা বাংলাদেশের কোনো আদালত নয়, কানাডার আদালতে প্রমাণিত সত্য। কিন্তু দুঃখজনক হলো এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও দেশের কোনো সংবাদমাধ্যম বা সুশীল সমাজের কেউ আবুল হোসেনের সম্মানহানির দায় নিয়ে তার কাছে ক্ষমা চাননি। এমনকি দুঃখও প্রকাশ করেননি। একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে যে দিনের পর দিন মিথ্যা অভিযোগে অপমানিত হতে হলো তার কোনো বিচার বাংলাদেশে হলো না। আবুল হোসেন ন্যায় বিচার পেলেন না। তিনি মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয়েছিলেন। এখন আবুল হোসেন যদি কোনো কঠিন কথা বলেন কিংবা সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা কিছু বলেন তাকে অশোভন বলে আখ্যা দেওয়া যাবে না।
পদ্মাসেতু আজ স্রেফ একটি সেতু নয়। এটি বাঙালি জাতির মর্যাদার প্রতীক। যে জাতিকে একদিন 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলে পরিহাস করা হয়েছিল, বহির্বিশ্বে যে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল দারিদ্র্য ও বন্যাপীড়িত দেশ বলে সে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ নিজেদের অর্থে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় স্থাপনা তৈরি করল তার গৌরব প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে উড়িয়ে দিলে চলবে না। শেখ হাসিনা বানিয়েছেন বলে সে গৌরবকে খাটো করে দেখার কিছু নেই। সফল নেতা তিনি যিনি জনগণকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন, আবার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন। জাতির পিতা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাও জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। এখানেই শেখ হাসিনার সঙ্গে অন্যান্যের পার্থক্য।
পদ্মা সেতু নিয়ে পাকিস্তানের বিশিষ্টজনের আগ্রহও কম নয়। পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ড. মালিকা-ই-আবিদা খাত্তাক সে দেশের বহুল প্রচারিত 'ডেইলি টাইমস' পত্রিকায় গত ২ জুন প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, "বাংলাদেশের বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু একটি স্বপ্নের প্রকল্প। এ মাসের ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল ১০টায় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সেতুটি উদ্বোধন করবেন।"
এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের পত্রিকা এবং সে দেশের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির লেখার উদ্ধৃতি কেন দিচ্ছি তা বোধহয় বিশদ বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশি নাগরিকরা নিজেদের মতামতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারেন।
তিনি আরও লিখেছেন, "দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার যাত্রীরা দেশের বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুটে ফেরি দিয়ে পদ্মা নদী পার হয়। দীর্ঘ যানজটে ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাত্রী ও চালকদের। চালু হলে, এটি হবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সেতু এবং সড়ক চলাচলের জন্য প্রথম নির্দিষ্ট নদী পারাপার। দ্বি-স্তরের ইস্পাত ট্রাস সেতুটির উপরের স্তরে একটি চার লেনের মহাসড়ক এবং নিচের স্তরে একটি একক-ট্র্যাক রেলপথ থাকবে। দক্ষিণাঞ্চলের লাখো মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু এ মাসে উদ্বোধন হলে মানুষের দুর্ভোগের অবসান হবে।"
তিনি এটাও লিখেছেন, "মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্ট এবং শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টের সাথে সংযোগকারী বাংলাদেশের একটি স্বপ্নের প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু, যা যাত্রী ও মালবাহী যানবাহনের জন্য যাত্রা সহজ করবে এবং ধীরে ধীরে দেশের জিডিপি ১.৩-২% বাড়িয়ে দিবে। পদ্মা সেতু যেটির নকশা করা হয়েছে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট স্টিল-ট্রাস কম্পোজিট কিপিং রোডের ওপরে এবং নিচে রেলপথটি বিশ্বের গভীরতম ভিত্তি সেতু। ২৫ জুন পূর্ব দিকে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদীর অপর পারে একটি বিশাল জনসভায় ভাষণ দিবেন। যা ২০১৮ সালের পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তার প্রথম জনসাধারণের সামনে উপস্থিতি।"
ড. মালিকা লিখেছেন, "দেশের উন্নয়নের মূর্তিমান প্রতীক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মতো বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আত্মবিশ্বাস ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশাল প্রতিবন্ধকতার পথে তাকে হাঁটতে হয়েছে কিন্তু তিনি তার গন্তব্যে ঠিকই পৌঁছেছেন। সেতুর নির্মাণের সময় যে ষডযন্ত্র ছড়িয়ে পড়েছিল তিনি তা দৃঢতার সাথে মোকাবেলা করে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন।"
তিনি বলেন, "পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের স্বাক্ষর বহন করে। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের সক্ষমতা আরও একবার জানার সুযোগ পেল বিশ্ব। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যারা বারবার তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে।"
পদ্মা সেতুর নাম উচ্চারণ করলে শেখ হাসিনার নাম উচ্চারণ করতে হবে উল্লেখ করে ওই নিবন্ধে আরও বলা হয়, "শেখ হাসিনা এবং পদ্মা সেতু একে অপরের পরিপূরক। তাদের আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। পদ্মা সেতুর নাম শেখ হাসিনার নামে না হলেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জানবে শেখ হাসিনার কারণেই এই সেতু সম্ভব হয়েছে।"
নিবন্ধের শেষে ড. মালিকা লিখেছেন, "পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা আগামী ২৫ জুন যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার মাধ্যমেই প্রমাণিত হবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে এবং জাতির আস্থাকেও ত্বরান্বিত করেছে।"
শেখ হাসিনার আরেকটি সাফল্য আছে। সেটি হলো রাজনৈতিক। কাউকে হত্যা না করে, কোনো জমায়েতে গ্রেনেড হামলা না করে শুধু রাজনীতি দিয়ে তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তিকে প্রায় শূন্য করে দিয়েছেন। ভবিষ্যতে এরও মূল্যায়ন হবে। গবেষণাও হবে।