Published : 13 May 2022, 03:11 PM
এ বছর নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে, বিশেষত সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতি বনাম হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি বিষয়ক একটি বিতর্ক কিংবা বলা যেতে পারে কুতর্ক, বেশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। এটি নিয়ে আগেও যে বিচ্ছিন্নভাবে নানা মহল থেকে নানা কথা বলা হয়নি তা নয়, তবে এবার মনে হলো একটি গোষ্ঠী খুব সংগঠিতভাবেই মাঠে নেমেছে বাঙালির বহু শতাব্দী ধরে চর্চিত লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলাম ধর্মের একটি কল্পিত বিরোধকে পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করার মতলব নিয়ে। বিতর্কটি মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত কয়েকটি নিরীহ প্রাণীর প্রতীকী চিত্র নিয়ে শুরু হলেও দ্রুতই সেটি বাঙালির চিরন্তন কিছু খাদ্যাভ্যাস, পোশাকপরিচ্ছদ, আচার-অনুষ্ঠান এমনকি চিরচেনা কিছু পুষ্প, বৃক্ষের শেকড় ধরেও টান মারে। অথচ পুরো বিতর্কের মূল ভিত্তিটিই নিতান্ত দুর্বল, কেননা এখানে সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের বিচার কিংবা তুলনা করা হচ্ছে, যে-দুটো পুরোপুরি দুই ভিন্ন গোত্র কিংবা বর্গের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাসের বিষয়, যা মূলত পরকালকেন্দ্রিক, আর সংস্কৃতি জীবনাচারের বিষয়, যার কার্যকর্ম ইহকালভিত্তিক। সংগঠিত ধর্মের উৎপত্তি কিংবা প্রচলন মানবেতিহাসের তুলনামূলকভাবে খুব নতুন একটি বিষয়, বড়জোর পাঁচ কি ছয় হাজার বছর আগের; যেখানে সংস্কৃতি খোদ মানবজাতির সমান বয়সী, লক্ষ কোটি-বছরের মাপে যার হিসাব চলে। ধর্ম পরিবর্তনশীল, সেই তুলনায় সংস্কৃতির মোটামুটি একটি স্থায়ী রূপ বিদ্যমান।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর কথাই ধরা যাক। তার বয়স সাকুল্যে হাজার বারোশ বছর; এর আগে সে ছিল মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও নিম্নবর্গের হিন্দুসমাজের অন্তর্ভুক্ত, তার আগে প্রধানত সনাতন ধর্মাবলম্বী, আর তারও আগে প্রাণী ও প্রকৃতিপূজারী। কিন্তু সংস্কৃতির কথা যদি বলি, তার মূল ভিত্তিভূমিটি কিন্তু আমাদের প্রকৃতিপূজারী পর্ব থেকে অদ্যাবধি প্রায় একইরকম রয়ে গেছে; হয়তো পারিপার্শ্বিক, আর্থ-সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাবে তাতে কিছু বাহ্যিক বদল কিংবা যোগবিয়োগ ঘটেছে, যার পেছনে ধর্মচর্চারও কিছুটা ভূমিকা নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু তাই বলে প্রতিবার ধর্মবদলের সঙ্গে সঙ্গে তার অনুসারীদের প্রাত্যহিক জীবনাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুই একেবারে আগাপাশতলা পালটে যায়নি বা যায় না। সে আগে যে ভাষায় কথা বলত, যে খাবার খেত, যে পোশাক পরিধান করত, যে গান গাইত, যে খেলা খেলত, যে উৎসব পালন করত, যেভাবে ঘর সাজাত, বাগান করত, প্রাণী পুষত, প্রতিবেশীর সঙ্গে মিলত, এক কথায় তার দৈনন্দিন জীবনযাপন করত, তার পুরোটাই প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। পালটায় মূলত নতুন ধর্মের রীতিনীতি অনুযায়ী তার প্রার্থনা, উপাসনার পদ্ধতি-প্রকরণ আর তার সঙ্গে সম্পৃক্ত অল্পস্বল্প খাদ্য, পরিধেয় সম্পর্কিত আচার-অভ্যাস। তা-ও সেসব কেবল ধর্মবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, অন্যদের ক্ষেত্রে অতটা নয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতির মধ্যে স্পষ্টতই একটি বিভাজন রয়েছে; ধর্ম নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে তার বিশ্বাস ও সেইসূত্রে পালনীয় আচার-অনুষ্ঠানের সীমিত পরিসরে, অন্যদিকে সংস্কৃতি তার জীবনের ব্যাপক ও বৃহত্তর পরিধিতে নিরন্তর ক্রিয়াশীল থাকে, থাকে তার নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের প্রধানতম স্মারক ও চালক হিসেবে।
সংস্কৃতির অধিকাংশ উপকরণ কিংবা কৃত্যই মূলত বাহ্যিক, এর সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসের তো কোনো বিরোধ নেই। বাঙালি মুসলমান তার মাতৃভাষা আবহমানকালের সেই বাংলা ভাষাতেই তার ধর্মীয় বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে, পারে যাবতীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের চর্চা করতে, এর জন্য তো তাকে তার মাতৃভাষা বাংলাকে বিসর্জন দেবার কোনো প্রয়োজন নেই। কেউ যদি উপরি হিসাবে আরবি ভাষাটাকে অর্থ বুঝে ভালোভাবে রপ্ত করে নিতে পারে, সেটা তার বাড়তি লাভ, কিন্তু তা তো আর সবার জন্যই বাধ্যতামূলক হতে পারে না! তেমনি বাঙালি কৃষক, শ্রমিক কিংবা নিতান্ত সাধারণজন তার নিত্যদিনের পরিধেয় লুঙ্গি কিংবা পাজামা পরেই এবাদত-বন্দেগি তথা ধর্মীয় কাজটুকু সারবে সেটাই তো স্বাভাবিক; এর জন্য তাকে কেন আরবদেশীয় চোগা-চাপকান কিংবা জোব্বা-পাগড়ি গায়ে চাপাতে হবে! বাঙালি মুসলমান নারী যদি তার বহু শতাব্দীর লালিত ঐতিহ্যের স্মারক একটি নিরীহ লাল কিংবা কালো টিপকে কপালে ধারণ করতে চায় তাতে তো তার জাত যাবার কোনো কারণ থাকতে পারে না, এমনকি এতে করে তার ধর্মচর্চারও কোনো বিঘ্ন হবার কথা নয়, কেননা এমন কিছুর উল্লেখ বস্তুত তার ধর্মগ্রন্থগুলোতেও নেই। একইভাবে বাঙালি মুসলমান তার বহু সহস্র বছরের পূর্বপূরুষের জীবনাচরণের ঐতিহ্য অনুযায়ী যদি গাছপালা, পশুপাখি, নদীনালা তথা প্রকৃতির প্রতি সহজাত অনুরাগটুকু বজায় রাখতে চায়, চায় তার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সম্পর্ক গড়ে তুলতে, আর এরই বহিঃপ্রকাশস্বরূপ সে যদি নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রায় দুচারটে পশুপাখির প্রতিকৃতি বহন করে আনন্দ পায়, তাতে তার মুসলমানিত্ব নিয়ে কেন টানাটানি পড়বে?
তার মানে এই যে, যে বা যারা এই বেহুদা বিতর্কটি তুলছেন তাদের একটি গভীর দুরভিসন্ধি ও অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। সেটি তাদের ধর্মচর্চা, ধর্মীয় মূল্যবোধ কিংবা ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় মোটেও। এর আদত উদ্দেশ্য মূলত দেশে বর্তমানে যেটুকু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অবশিষ্ট রয়েছে তাকেও ধ্বংস করে দেওয়া; সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধ, বিচ্ছিন্নতা ও বৈরিতার সম্পর্ক তৈরি করে, তাদের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট সৃষ্টি করা। এছাড়া সমাজে সংস্কৃতি-চর্চাকে বাধাগ্রস্ত ও তার সামগ্রিক পরিবেশটিকে বিনষ্ট করে দেওয়াটাও তাদের একটি বড় এজেন্ডা। কারণ এরা জানে, সমাজে শিক্ষা এবং সংস্কৃতির যথাযথ প্রসার ঘটলে সচেতন জনগোষ্ঠী তাদের পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণাকে প্রত্যাখ্যান করবে, তাদের ধর্মব্যবসা ও ধর্মরাজনীতির ফাঁদে সহজে ধরা দেবে না আর। এসবের বাইরে, তরুণ প্রজন্মের মনে বিজ্ঞান-বিরোধিতার বীজ রোপণ, দেশের সার্বিক সামাজিক বাতাবরণে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার প্রসার, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাচেতনার বিরোধিতার বিষয়গুলো তো রয়েছেই। এমতাবস্থায় আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশে উদার, সহিষ্ণু, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, অগ্রসর ও আধুনিক একটি সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখি, তাদের তবে করণীয় কী?
ব্যক্তির্পযায়ে, পারিবারিক পর্যায়ে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করণীয় তো আছে অনেককিছুই। তবে সবকিছুর আগে একটি কথা আমাদের সবাইকে, সর্বত্র ও সর্বক্ষণ সরবে বলে যেতে হবে যে, ধর্ম ও সংস্কৃতি দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস, কেউ যেন এই দুটোকে তার ব্যক্তিজীবনে গুলিয়ে না ফেলেন। ধর্ম সম্পূর্ণতই একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়, যা মূলত এক আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক জিজ্ঞাসার জন্ম দেয় বিশ্বাসীদের মনে। অন্যদিকে সংস্কৃতি হচ্ছে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে একটি নির্দিষ্ট নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবনাচরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত যাবতীয় কিছু, যার শেকড় প্রোথিত তার একেবারে আদি উত্থানের কালে, যখন হয়তো কোনো ধর্মের অস্তিত্বই ছিল না ধরণীতে। জীবনের এই বৃহত্তর সংস্কৃতিতে স্বধর্মী, বিধর্মী, বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী সবারই রয়েছে সমান অধিকার। এই কথাটি বাড়িতে যেমন বাবা-মা বলবেন তাদের সন্তানদের; তেমনি একেবারে প্রাথমিক শিক্ষার সময় থেকে শিক্ষকেরা বলবেন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের; প্রচারমাধ্যমে নিরন্তর প্রচার করতে হবে এই সত্যটুকু এবং এর বিরুদ্ধে স্বার্থান্বেষী মহলের সব অপপ্রচার খণ্ডনেও তৎপর থাকবে তারা; সাংবাদিকেরা লিখবেন এর পক্ষে তাদের পত্রপত্রিকায়; লেখক, চিন্তক, বুদ্ধিজীবীরা সবসময় তাদের লেখালেখির মাধ্যমে সমাজে এই চিন্তার প্রসার ঘটাবেন; শিল্পী ও সংস্কৃতিজনেরা তাদের শিল্পকর্ম ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সবরকম সংকীর্ণ চিন্তার বিপরীতে উদার মানবিকতা, সম্প্রীতি, সহিষ্ণুতা ভালবাসা ও মিলনের বার্তা ছড়িয়ে দেবেন সবার মাঝে। আর রাষ্ট্রকেও তার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে এর চর্চা করতে হবে; তার যাবতীয় আইন ও বিধিবিধানে এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে, এর বিরুদ্ধতাকারীদের ওপর নজরদারি ও প্রয়োজনে প্রতিবিধানমূলক ব্যবস্থাগ্রহণে তৎপর হতে হবে তাকে। এক কথায়, রাষ্ট্রকে কেবল সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীই নয়, সকল ধর্মের, বর্ণের, নৃগোষ্ঠীর মানুষই যেন নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে তার ধর্মপালন করতে পারে সেই ব্যবস্থা করার পাশাপাশি একটি একমুখী, অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন এবং সমাজে সর্বজনীন সংস্কৃতিচর্চার জন্য অনুকূল একটি পরিবেশ নির্মাণের লক্ষ্যে যা যা করণীয় তা করার বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। তা নইলে তার এতদিনের এত উন্নয়ন ও অগ্রগতির সবটুকু গুড় যে এই ধর্মান্ধ আর ধর্মবেনিয়া গোষ্ঠীর সংঘবদ্ধ পিঁপড়েরাই খেয়ে নেবে অচিরে, তাতে আর সন্দেহ কী!