রক্তাক্ত জিতেন গুহ: সাম্প্রদায়িকতা না অন্য কোনও কারণ?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 2 May 2022, 00:19 AM
Updated : 2 May 2022, 00:19 AM

চট্টগ্রামের পটিয়ায় ইফতার মাহফিলে হামলা চালিয়ে হাইদগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জিতেন কান্তি গুহকে গাছে বেঁধে মারধর করার ঘটনা ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমের সূত্রে সবারই জানা রয়েছে।

যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি হাইদগাঁও উনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক বি এম জসিম। ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় তাকে দল থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়েছে সম্প্রতি।

হাইদগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এক ইফতার মাহফিলে জিতেন কান্তিকে লাঞ্ছিত ও মারধরের ঘটনা ঘটে। ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল স্থানীয় সাংসদ সামশুল হক চৌধুরীর। জিতেন কান্তি ছিলেন বিশেষ অতিথি । কিন্তু ব্যানারে ইউপি চেয়ারম্যান বি এম জসিমের নাম ছিল না। জিতেন গুহকে মারধরের পর ইফতার মাহফিল পণ্ড হয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমরা অনুষ্ঠান স্থলে কয়েকজন বসেছিলাম। তখনও ইফতারের অনেকটা দেরি। এ সময় চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে (বি এম জসিম) লোকজন এসে আমাদের ইউনিয়নের আহ্বায়ক মাহফুজুল হকের নাম ধরে অশ্রাব্য গালি দিতে থাকে। এরপর হঠাৎ তারা জিতেন গুহকে মারধর শুরু করে। তাকে গাছের সাথে বেঁধে মারধর করে রক্তাক্ত করে। গত ইউপি নির্বাচনে জিতেন গুহ ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল হাসানের নৌকা মার্কায় প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট। সেই আক্রোশ থেকে তাকে মারধর করা হয়েছে।"

জিতেন গুহকে পিছমোড়া করে হাত বাঁধা ও রক্তাক্ত অবস্থার গাছের সাথে বেঁধে রাখার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরেছিল। সেখানে তাকে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। মাথা আর গায়ের বিভিন্ন জায়গা ছিল রক্তাক্ত। গত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী বি এম জসিম জয়ী হন। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করায় জসিমকে বহিষ্কারের সুপারিশ কেন্দ্রে পাঠায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ।

এ জাতীয় ঘটনা ঘটলেই বাংলাদেশের মানুষ ইদানিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট-শেয়ার দিয়ে ভাসিয়ে ফেলে। একপক্ষের লক্ষ্য থাকে- মজা নেওয়া এবং অন্য পক্ষের লক্ষ্য থাকে বিষয়টি নজরে এনে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জায়গা তৈরি করা। পরের কারণটি দিনদিন আত্মরক্ষার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাজনীতি নেই, রাজনৈতিক দল নেই। কোথাও সেইভাবে কোনও বাদ-প্রতিবাদ নেই। একসময় যারা  প্রতিবাদের জন্য রাজপথে নামতেন, এখন সেই প্রতিবাদী 'নায়কে'রা মাইক্রোফোনমুখী। 

বিরোধী দলের রাজনীতি পথ হারিয়ে টিভি ক্যামেরা আর হলের ভিতর সীমাবদ্ধ। কাজেই মানুষের শেষ আশ্রয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আমি একথা অবশ্যই বলবো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শক্তি এখন প্রমাণিত; দেশের ভেতর ঘটে যাওয়া অনেক অনাচার-অন্যায়-দুর্নীতির ঘটনা শেষ পর্যন্ত কেবল ফেইসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসার পরই কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়েছে। 

আবার আজকাল কোনও ধরনের সমস্যা এমনকি মন্ত্রীদের বেশিরভাগই পারেন না সমাধান দিতে। গত কয়েকদিন আগে কলাবাগানের তেঁতুল তলা খেলার মাঠ নিয়ে যে ঘটনা, যত উত্তেজনা- সবকিছুর সমাধান হলো শেষ পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। সৈয়দা রত্নাসহ এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেককেই আমি চিনি। এ পুরো ঘটনায় একটাই প্রশ্ন এসেছে মনে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাসেও মানুষ আস্থা পাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী বলার পরই স্বস্তি পাচ্ছে। বারবার কেন তাকেই এসব সাধারণ বিষয় দেখভাল করা লাগছে!


চট্টগ্রামের ঘটনাটিতে ফিরে আসি। এটি আওয়ামী পরিবারের ভেতরের কোন্দল। আবার এ ঘটনাকে অন্য অনেকগুলো দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা যায়। জিতেন গুহকে প্রহার ও নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টক-শোতে যুক্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। ভদ্রলোক ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। এর আগেও আমি তার কথা শুনেছি। হৈচৈ না করে তিনি শান্তভাবে কথা বলেন। আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, "এটি একটি সাম্প্রদায়িক ঘটনা এবং জিতেন গুহ সাম্প্রদায়িকতার শিকার।" আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই এই কারণে যে তিনি প্রবণতাটি ধরতে পেরেছেন। সঠিক কথাটি বলেছেন। কিন্তু যে লোকটি জিতেন গুহকে প্রথম আঘাত করে তার নাম ইন্দ্রজিত বলে কোনও কোনও সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে। এই নামটি কোনও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের নাম নয়। ধরে নিচ্ছি এই লোকটিও হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাহলে এখানে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ আসে কিভাবে? আহমদ হোসেন হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন, হিন্দু নেতা বলেই এভাবে গাছের সাথে বেঁধে মারার সাহস হয়েছে। আর সংখ্যালঘুদের মারলে হৈ চৈ হয়, মানববন্ধন হয়- কিন্তু কারও শাস্তির ঘটনা কদাচিৎ। সেটা আমরা নারায়নগঞ্জের শিক্ষক শ্যামলকান্তির সময় থেকেই দেখে আসছি।  কোনও ওসমানেরই কোনও বিচার হয়নি। সাতবার জামিনের আবেদন খারিজ হবার পর ছাড়া পাওয়া ঝুমন দাসের বেলায়ও একই অবস্থা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কয়েকদিন পর পর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির সম্প্রদায়ের ওপর এমন আঘাতের উৎস কোথায়? এটা কি অন্তর্গত বিদ্বেষের বহির্প্রকাশ নাকি পুঞ্জিভুত পাপের ফলাফল? এর পেছনে কিসের উস্কানি কাজ করে? আমরা সবাই জানি আওয়ামী লীগ এদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। কিন্তু আওয়ামী লীগের কোন আমলেই সংখ্যালঘুরা যে পরিপূর্ণ নিরাপদ ছিল, তা কিন্তু নয়। তারা কোনও না কোনওভাবে আক্রান্ত হয়েছে, হচ্ছে। 

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এবং নীতিমালা অনুযায়ী, প্রশাসনের নানা পদে আসীনের সুযোগ পেলেও, বাস্তবে সংখ্যাগুরু ছাড়া বাকিদের হাতে কিছু নেই। প্রশাসনে থাকা সংখ্যালঘুরাও নিয়ম আর সমাজের প্রচলিত ধারার অনুগামী মাত্র। সেটা আমরা বিগত দুর্গাপূজার সময় দেখেছি। এমন সব জায়গায় তাণ্ডব ঘটানো হয়েছে, যেখানে পুলিশ কর্মকর্তারা ছিলেন হিন্দু। কিন্তু না তারা কিছু ঠেকাতে পেরেছিলেন, না পেরেছিলেন ব্যবস্থা নিতে। 

চট্টগ্রামের ঘটনাটি আরও কিছু কারণে তাৎপর্যপুর্ণ । জিতেন গুহ আওয়ামী নেতা। সাথে পূজা উদযাপন পরিষদেরও নেতা এবং যে অনুষ্ঠানে  তাকে মেরে রক্তাক্ত করে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল তিনি ছিলেন সেই আয়োজনের বিশেষ অতিথি। প্রথমত, দেশে রোজার মাস চলছে। এটি ছিল ইফতার মাহফিল। যার মানে সেখানে রোজাদার এবং সংযমীরাই থাকার কথা। অথচ সংযমের কোন চিহ্ন নেই কোথাও। একের পর এক ঘটনায় তার প্রমাণ দেখছি আমরা।  আপাতত শেষ ঘটনাটি দেখলাম পটিয়ায়। সংযমী মানুষেরা কিভাবে এমন মারামারিতে লিপ্ত হতে পারেন?

দ্বিতীয়ত আসে, সামাজিক আচার বা শিষ্টাচারের কথা। একটি অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি মানেই তো কোন বিশিষ্টজন। তাকে আপ্যায়ন করে আনা হয়। এমন অতিথিকে অতর্কিত আক্রমণ করা হলে প্রতিরোধ করা হলো না কেন? প্রতিরোধ করার মানুষ থাকলে নিশ্চয়ই তাকে মারধরের পর রক্তাক্ত করে গাছের সাথে বেঁধে রাখা যেত না। এসবই সম্ভব হয়েছে সেখানে ।

শেষকথা হচ্ছে, এজাতীয় ঘটনা এখন সংক্রামক। যে ভদ্রলোক আক্রান্ত হয়েছেন, তার নামেও নানা অভিযোগ রয়েছে বলে খবরে এসেছে। এখন দেশে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ভদ্রলোক ও নিরীহ মানুষ কয়জন? কাজেই জিতেন কান্তি গুহও যে ধোয়া তুলসি পাতা- সে কথা জোর গলায় বলতে পারছি কই! কিন্তু বিষয় সেটা নয়। একজন  মানুষের কৃত অপরাধ বা তার দোষের জন্য আইন আছে, বিচার আছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া বা এমন মারমুখী হওয়াটা আরও বড় অপরাধ।

এমন ঘটনার কারণের মধ্য অন্যতম- সুষ্ঠু বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা ও গলদ। আইনের শাসনে কি তবে আস্থাহীনতা রয়েছে বেশিরভাগ মানুষের? কেবল প্রধানমন্ত্রীর কাছে খবর গেলেই ঘটনার সুরাহা হচ্ছে। অথচ সবার জন্য তার কাছে কি পৌঁছানো সম্ভব কখনো?

ভেতরে ভেতরে পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়ানো সমাজে এটাই হয়। টাকা কামানো, টাকার পাহাড় গড়াই যেন বাংলাদেশের একটি বড় অংশের মানুষের একমাত্র কাজ হয়ে গেছে। অবশ্য মানুষ করবেই বা কী? প্রাইভেট হাসপাতালে দুই রাত থাকলেই একলাখ টাকার বিল গুণতে হচ্ছে। সাধারণ মানের রিসোর্টে সামান্য কয়েকদিন একটু অবসর কাটালেও খরচ হচ্ছে একই রকম। দূরপাল্লার বাসে চড়লেও হাজার টাকা গুণতে হয়। কাজেই মানুষ সবভুলে টাকার ধান্দায় ব্যস্ত। আর সমাজে জিতেন গুহের মার খাওয়াই হয়ে উঠছে নিয়তি। সামনে আর কী কী দেখতে হবে কে জানে?

সিডনি