Published : 02 May 2022, 04:09 AM
'মহাতৃপ্তির মহাপ্রাপ্তির' বর্ণাঢ্য ৮৮ বছরের জীবনের যবনিকা টেনে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
রোববার সেহেরির জন্য যখন ঘুম থেকে উঠি তখনই তার মৃত্যুর খবর চোখে পড়ে। সব মৃত্যুই বেদনার। কিন্তু সকাল থেকে বিভিন্ন পত্রিকায়, ফেইসবুকে তাকে নিয়ে চেনাজানা বহুজনের স্মৃতিচারণমূলক পোস্টগুলো পড়ে বারবারই মনে হচ্ছিলো কাজ দিয়ে তিনি মৃত্যুকে ছাপিয়ে গেছেন। তিনি তার কাজের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে।
অর্থবিভাগে তার অধীনে বেশ কিছুদিন কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। ২০১১ সালে অর্থবিভাগে যোগ দেওয়ার পর থেকে তার মেধা আর স্মরণশক্তির গল্প শুনেছি সহকর্মীদের মুখে। আমার এক ব্যাচমেইট তার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি স্মৃতিচারণ করেছেন। ঘটনাটা অনেকটা এরকম যে,
একটা সারসংক্ষেপে তিনি জি-২০ ভুক্ত ১৯ দেশের নাম উল্লেখ করে মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছেন। তার ধারণা ছিল এটা কারো চোখে পড়বে না। যথারীতি সব কয়টা টেবিল পেরিয়ে ফাইলটা রাতে গেছে মন্ত্রীর বাসায়। সকালে ফেরত এসেছে যাতে আবুল মাল আবদুল মুহিত পেন্সিল দিয়ে ২০ তম দেশের নামটি লিখে দিয়েছেন।
মুহিত স্যার বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষাতেই দক্ষ ছিলেন। বেশ মজা করে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিতেন ফাইলে। একদিন আমার সঙ্গে একই কক্ষে বসা এক জুনিয়র সহকর্মী বললেন, মন্ত্রী মহোদয় সারসংক্ষেপে একটা সরকারি দপ্তর সম্পর্কে লিখেছেন 'আমি এই অপদার্থ ডিপার্টমেন্ট নিয়ে কী করি? একে প্রাইভেটাইজ করলেই ল্যাঠা চুকে যায়"। সহকর্মী বিপদে পড়েছেন নথিতে এ সিদ্ধান্ত কিভাবে উপস্থাপন করবেন তা নিয়ে।
আগেই বলেছি মুহিত স্যারের স্মরণশক্তি ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। আমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা তৈরি করা। একবার আমাদের দেওয়া একটা উপাত্ত তিনি লাল কালিতে কেটে দিলেন। আমি কিংবা অর্থবিভাগের সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগের সহকর্মীদের কেউই কী ভুল হয়েছে সেটি ধরতে পারছিলাম না। অগত্যা আমাকেই যেতে হলো মুহিত স্যারের কাছে। আমি তখন সিনিয়র সহকারী সচিব। সাহস করে স্যারের কক্ষে ঢুকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, "তোমাদেরই অন্য একটা ডকুমেন্টে ভিন্ন তথ্য আছে। ইকনোমিক রিভিউটা চেক করে দেখ।" আমি স্যারের স্মৃতি শক্তি দেখে রীতিমত অবাক হয়ে গেলাম।
মুহিত স্যার কাজকে সবার উপর প্রাধান্য দিতেন। আমি সিনিয়র সহকারী সচিব হয়ে তার কাছে যাচ্ছি সেজন্য তাকে কখনও বিরক্ত হতে দেখিনি। এমনকি কোনও বিষয় যুক্তিযুক্ত হলে ভিন্নমত প্রকাশের জন্য তিনি বকা দিতেন না। একবার বাজেট বক্তৃতার খসড়ায় তিনি নিজ হাতে ব্রডমানি সাপ্লাই ১৮ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা লিখে দিলেন। সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগে আমার সহকর্মীরা বললেন, এতে বাজারে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। কিন্তু মুহিত সাহেবের নিজ হাতে লেখা বিষয়ে দ্বিমত করা কিভাবে। কেউ সাহস করে যাচ্ছেন না। আর বক্তৃতা লেখার কাজটা যেহেতু আমার, আমিই গেলাম।। মন্ত্রী মহোদয়কে বলা মাত্রই মুচকি হেসে ১৪ কেটে ১৬ করে দিলেন আর লিখে দিলেন ক্রমান্বয়ে তা করা হবে। আমাকে বললেন, তিনি ওভাবে চিন্তা করেননি। যুক্তিসঙ্গত বিতর্কে তিনি বাধা দিতেন না। আমার মনে আছে, তারেক (সাবেক অর্থসচিব) স্যারের বিদায় অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, তারেক স্যারের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল যুক্তিসঙ্গত উপায়ে 'না' বলতে পারা। মুহিত স্যার ওইদিন বলেছিলেন, এটা একজন কর্মকর্তার অত্যাবশ্যক গুণ যা আজকাল আর দেখা যায়না। অথচ সরকারী কাজ সুসম্পন্ন করার জন্য এটা জরুরী।
আমি অর্থবিভাগে যোগ দেওয়ার পর অর্থসচিব ড. মোহাম্মদ তারেক আমাকে বাজেট বক্তৃতা সমন্বয় ও খসড়া তৈরির কাজে লাগিয়ে দিলেন। গোপনীয়তার কারণে বক্তৃতার খসড়া থেকে শুরু করে প্রেসে পাঠানো পর্যন্ত পুরো কাজটি হতো সচিব মহোদয়ের দপ্তরে। তারেক স্যার নিজেই পুরো কার্যক্রম মনিটর করতেন। এরপর অর্থসচিব হলেন ফজলে কবির স্যার। তখনও বাজেট বক্তৃতা প্রণয়নের কাজ হতো সচিব মহোদয়ের তত্ত্বাবধানে তার কক্ষে। মুহিত স্যার দেখতে আসতেন রাতে। কোন কোন দিন রাত ১২টা বা ১টায়। তারেক স্যার অবশ্য আমাকে আগেই বলে রেখেছিলেন, মন্ত্রীর (মুহিত) সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কঠিন। আমার আগে এ কাজটা করেছে আমার অনুজ সহকর্মী ফয়েজুল। সচিব স্যারের ধারণা, এ কাজের চাপেই তার ওপেন হার্ট সার্জারি করা লেগেছে। আমি বেঁচে গেলেও উচ্চ রক্তচাপ নামক রোগে চিরস্থায়ীভাবে আক্রান্ত হয়েছি। অথচ আমাদের প্রায় আড়াই গুণ বেশি বয়সী মুহিত স্যার অবলীলায় এ চাপ সহ্য করে গেছেন।
স্যারকে নিয়ে আরও অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। অনেক কথা ভুলেও গেছি। আজ আর লেখা বাড়াবো না। তার মহাপ্রয়াণের দিন থেকে কায়মনোবাক্যে কামনা করি সৃষ্টিকর্তা তার বিদেহী আত্মাকে চিরশান্তি দান করুন। আর তিনি বেঁচে থাকুন তার কর্মের মাঝে।