এসডিজি-র পরিপ্রেক্ষিতে ব্র্যাকের কার্যক্রম

কে এ এম মোরশেদ
Published : 20 March 2022, 06:34 PM
Updated : 20 March 2022, 06:34 PM

সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদ শাল্লায় ১৯৭২ সালে যার শুরু, সেই ব্র্যাক আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দারিদ্র্যবিরোধী সংস্থা। এই ৫০ বছরে, ব্র্যাকের উদ্যোগগুলোতে সবসময়ই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে একেবারেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে। এসব কার্যক্রম বাংলাদেশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মতো জাতীয় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কাঠামো অনুসরণ করেই পরিচালিত হয়েছে।

 ব্র্যাকের কর্মসূচি এবং সামাজিক উদ্যোগগুলো এসডিজির ১৭টি  লক্ষ্যের মধ্যে ১১টিতেই ৫৫টি টার্গেট পূরণের নিমিত্তে ৭২টি সূচকে সরাসরি অবদান রাখে বিশেষত ব্র্যাক তার ৮টি বিষয়ভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে এসডিজির থেকে নং লক্ষ্যসহ , ১০, ১১, ১৩ এবং ১৬ নং লক্ষ্য অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্যগুলির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত পনেরটি উন্নয়ন কর্মসূচি এবং তিনটি সামাজিক বাণিজ্য উদ্যোগ কার্যক্রম এগিয়ে নিতে লাখ ২৪ হাজার ৪৪২ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন টাকা ( দশমিক ৮৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বিনিয়োগ করেছে।

এই সময়ের মধ্যে, ব্র্যাক এক বা একাধিক পরিষেবার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সম্পদসম্ভাবনা, সিদ্ধান্ত এবং কর্মে প্রবেশাধিকার এবং অধিকতর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে প্রায় ২০ মিলিয়ন (২কোটি) বাংলাদেশিদের কাছে পৌঁছেছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত দেখার জন্য ২০২১ সালে প্রকাশিত 'এসডিজি কন্ট্রিবিউশন ভলান্টারি রিপোর্ট ২০২০'- দেখা যেতে পারে। সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম বেসরকারি সংস্থা হিসেবে ব্র্যাক এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যাতে এসজিডির প্রথম পাঁচটি লক্ষ্যে ব্র্যাকের অবদানের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রতিবেদনর দ্বিতীয় কিস্তি খুব শিগগিরই প্রকাশ হবে।  

যদিও জাতীয় এসডিজি লক্ষ্যমাত্রায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্র্যাকের অবদান নিয়ে গর্ব করা যেতেই পারে, তবে তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ হলো অংশগ্রহণকারী চিহ্নিতকরণ কৌশল, সমন্নিত ছাঁদ, এবং অর্থায়নের নকশার মাধ্যমে ব্র্যাক যেভাবে এসডিজি-র মূলনীতিগুলোর প্রতিফলন ঘটিয়েছে সে ব্যাপারটি। আমার মনে হয়, 'কাউকে পেছনে ফেলে নয়' নীতির ক্ষেত্রে ব্র্যাকের অভিযোজন অবদান সম্ভবত সবচেয়ে আকর্ষণীয়। 

প্রথম থেকেই ব্র্যাকের নীতি হলো, যে সবার পেছনে, তাঁর কাছে আগে পৌছানো। সুতরাং, এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে ব্র্যাকের সবচেয়ে বড় কর্মসূচি হল আল্ট্রা-পুওর গ্রাজুয়েশন। প্রত্যন্ত এলাকার অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণের লক্ষ্যেই ডিজাইন করা হয়েছে। কর্মসূচিটি লাখ ১২ হাজার ৬৩৪ টি খানার ২০ লাখেরও  বেশি মানুষকে চরম দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের জন্য উৎপাদনশীল সম্পদ, দক্ষতা অর্জনে এবং সংগঠিত হতে সহায়তা করেছে। তেমনি, ব্র্যাকের শিক্ষা কার্যক্রম হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সাধারণ বিদ্যালয় নেটওয়ার্ক। এইসব প্রতিবন্ধী বান্ধব ও প্রবেশগম্য বিদ্যালয়গুলি যা মুলত ঝড়েপড়া ও প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য নিবেদিত। আবার, যাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশগম্যতা নেই বা সামর্থ্য নেই, ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসূচি তাদেরকেই অগ্রাধিকারভিত্তিতে সেবা দেয়। বিশ্বের বৃহত্তম মাইক্রোফাইনান্স অপারেশন হিসেবে, ব্র্যাক ক্ষুদ্র অর্থায়ন কার্যক্রম নিত্য নতুন ভাবে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যত উজ্জ্বলতর করার প্রয়াসে লিপ্ত।   

আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো– 'উন্নয়নের জন্য বেসরকারি খাতের অর্থায়ন' ধাঁধার ব্র্যাকীয় সমাধান। ব্র্যাকের সামাজিক বাণিজ্য উদ্যোগ এবং সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ বিনিয়োগ রীতিমত গবেষণার যোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, ব্র্যাকের লাইফস্টাইল আউটলেট আড়ংএর সবচেয়ে বেশি মার্কেট শেয়ার রয়েছে, এবং এটি ৬০ হাজারেরও বেশি কারিগরকে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে প্রবেশ করতে এবং উন্নয়ন কর্মসূচিতে অবদান রাখতে সহায়তা করে। ব্র্যাক ব্যাংক এসএমই সেক্টরে সবচেয়ে বড় ঋণদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। 

তৃতীয় দিকটি হলোকীভাবে ব্র্যাক জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্রে রেখে শান্তি, সমৃদ্ধি, এবং অংশীদারিত্ব সূত্রকে এক করতে মানুষের ক্ষমতায়নকে নিয়ে কাজ করছে। ব্র্যাকের কর্মসূচিগুলো বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য মত প্রকাশ, অধিকার, পারিবারিক অন্যান্য দ্বন্দ্ব নিরসন, স্থানীয় নেতৃত্বে জলবায়ু অভিযোজন সক্ষমতার মত বিভিন্ন বিষয় সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যাক্তিগত ক্ষমতায়নের দৃষ্টিতে দেখে। এই সামগ্রিক কর্মসূচিগুলোর প্রতিটিই প্রান্তিকতম ব্যক্তিদের চাহিদা পূরণ করে এবং মধ্যস্থতামূলক ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অভিন্ন ভবিষ্যতের জন্য সামাজিক চুক্তির বিকাশ প্রয়োগকে সমর্থন করে। 

সবশেষে উল্লেখ্য যে, ব্র্যাক দৃষ্টিতে, শুধু বৈশ্বিক চিন্তনই নয়, স্থানীয় মনন ও চিন্তার সঠিক প্রয়োগ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এসডিজির মতো একটি বৈশ্বিক লক্ষ্যকে অন্ধ অনুসরণ না করে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রতিটি জনগোষ্ঠির প্রয়োজন ও অগ্রাধিকারের আলোকে এই সব লক্ষ্য অর্জনে কাজ করাবার ব্যাপারটিই ব্র্যাককে অনন্য করেছে।