ইতিহাসের অন্যতম সফল ঠাকুরদাদা: আমেরিকায় যৌন কারবারি কোটিপতি জার্মান নাপিত

মোস্তফা সারওয়ারমোস্তফা সারওয়ার
Published : 5 Dec 2021, 11:10 AM
Updated : 5 Dec 2021, 11:10 AM

মানব জাতির ইতিহাসে রয়েছে বিচিত্র কাহিনী। তা নিয়ে রয়েছে বিবিধ মতামত। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে নিয়ে কত লেখা শুধু সাধুবাদে ভরপুর! তার সংখ্যা নির্ধারণ কঠিন কাজ। আফগান তালেবানদের শক্তির কেন্দ্র কান্দাহার, মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া, মোগল সম্রাট আকবরের রাজধানী সেকেন্দ্রাবাদ, ইত্যাদি কত শহরের নামকরণ তাকে নিয়ে। এমনকি আমার মরহুম পিতার নাম ইস্কান্দার– আলেকজান্ডার শব্দের ফারসি রূপ। তথাপি আমার কাছে কখনও কখনও মনে হয় আলেকজান্ডার এক সুচতুর ভয়ংকর দস্যু। আমার অনুভূতিকে জানান দিতে আমার কবিতা 'Aphrodite Selling Nectar of Forbidden Fruit' এর কয়েকটি পংক্তি উল্লেখ করব। যুক্তরাষ্ট্রের সাদার্ন ইউনিভার্সিটি অব লুজিয়ানার সাহিত্য জার্নালে এ বছর ডিসেম্বরে কবিতাটি ছাপা হবে।

The fear of Gangaridai

Ancient kingdom of Bengal

Nearly incited mutiny

In Alexander's Macedonian Brigade

"Better run away, Alexander,"

Whispered Zeus

"Run, run, Alexander"

The marauder, plunderer

Never dared tread East of Beas

He ran, ran away

আলেকজান্ডার, কালিগুলা, নিরো, সাবারনারোলা অথবা মুসোলিনির এক দুর্বল ও বনসাই সংস্করণ হলো আমার প্রবন্ধের চরিত্র ফ্রিডরিক এর পৌত্র। ফ্রিডরিক একাধারে নাপিত, বিচারক, ইতিহাসের অন্যতম সফল ঠাকুরদাদা এবং ফ্যামিলি ম্যান; অন্যদিকে তিনি যৌনপল্লীর কারবারি, মিথ্যাবাদী, তোষামোদকারী এবং অন্যের জমি দখলকারী। নাপিত ফ্রিডরিকের জীবন কাহিনী অনেক সময় মনে হবে কল্পকাহিনী আবার কখনও কখনও মনে হবে ফ্রিডরিকের মতো তথাকথিত সফল লোকেরা আমাদের সামনেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।

স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে জার্মান নাপিতের অভিবাসন

১৮৮৫ সালের ১৯ অক্টোবর ঘর পালানো জার্মান নাপিত ফ্রিডরিক বারো দিনের সমুদ্র যাত্রা শেষে পৌঁছালেন অভিবাসীদের আগমন কেন্দ্র নিউ ইয়র্ক শহরের ক্যাসেল গার্ডেন ইমিগ্র্যান্ট ল্যান্ডিং ডিপোতে। স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে অনেক প্রতিকূলতা সহ্য করেছেন ফ্রিডরিক। সুদূর জার্মানির ব্রিমেন হতে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত বিশ ডলারে ক্রয় করা টিকেটে জাহাজের স্টিয়ারিজ ডেকে সমুদ্রযাত্রার কষ্ট ছিল অসহ্য। তিনি ব্রিমেন থেকে কেনা খাবার রান্না করে খাচ্ছিলেন অল্প পরিমাণে যাতে প্রতিদিনে অন্তত কিছু খেতে পারেন। আইডার নামক জাহাজে তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের খাবার কেনার ব্যবস্থা ছিল না। মলমূত্র ত্যাগের ব্যবস্থা ছিল অতি সামান্য।

স্নান করার প্রশ্নই আসে না দরিদ্র তৃতীয় শ্রেণির জন্য। যাঁদের পাঁচশত জনকে গাদাগাদি করে স্থান দিয়েছিল স্বল্প পরিসরে স্টিয়ারিজ ডেকে। নিউ ইয়র্ক বন্দরে তাকে স্বাগত জানান তার বড় বোন ক্যাথরিন ও দুলাভাই ফ্রেড শুস্টার। ফ্রেড শুস্টারও একই পল্লী শহর কালস্টাডের অধিবাসী ছিলেন। দুর্গন্ধময় জাহাজে শুকরের মতো ঘর্মাক্ত দেহের পরিবর্তে নিউ ইয়র্ক বন্দরের খোলা বাতাসে হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন ফ্রিডরিক। আশ্রয় পেলেন লোয়ার ম্যানহাটনের জার্মান বস্তিতে তার বড় বোনের ভাড়া করা ছোট একটি অ্যাপার্টমেন্টে। নিউ ইয়র্ক আগমনের পরদিনই ফ্রিডরিক নাপিত হিসেবে যোগদান করলেন অন্য এক জার্মান নাপিতের মালিকানাধীন চুল কাটার দোকানে।

সুদীর্ঘ ছয় বছর কঠোর পরিশ্রমী ফ্রিডরিক মানুষের দাড়ি, গোফ ও চুল কেটে এবং ছেঁটে দিতেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ফ্রিডরিক কড়ায়-গণ্ডায় জমাচ্ছিলেন ডলার এবং ছিলেন সুযোগের অপেক্ষায়। নিউ ইয়র্কে বাড়ি ভাড়া বেড়ে যাচ্ছিল হু হু করে। ভাড়া সংকুলানের জন্য কয়েকবার অ্যাপার্টমেন্ট পরিবর্তন করতে হয়েছিল এক বস্তি থেকে সস্তা অন্য এক বস্তিতে। লোয়ার ম্যানহাটনের জার্মান বস্তিগুলোর তৎকালীন অবস্থা ছিল করুণ। ইটের সরু রাস্তায় যানবাহনের জন্য ব্যবহৃত ঘোড়ার মলমূত্র অন্যান্য আবর্জনার সঙ্গে মিশে সে এক দুর্বিষহ পরিস্থিতি। এসব সহ্য করেই তিনি অধীর আগ্রহে সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন। ইতোমধ্যে তার কাছে জমেছে চার শত ডলার।

সিয়াটল অগ্নিকাণ্ড: কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ

১৮৮৯ সালের ৬ জন নিউ ইয়র্ক হতে দু হাজার আট শত বাহান্ন মাইল দূরে সিয়াটলে ঘটেছিল মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড। বাংলায় একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে, 'কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ'। ৬ জুন দিনের বেলায় প্রায় দুটা ত্রিশ মিনিটে এক মিস্ত্রি দোকানে দুর্ঘটনাক্রমে শিরীষের আটার একটি পাত্র উল্টে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। এক দিনেরও কম স্থায়ী আগুনে সিয়াটলের কেন্দ্রীয় বাণিজ্য জেলা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।

এর পরে শুরু হলো পুনর্নির্মাণের বিশাল যজ্ঞ। হাজার হাজার শ্রমিক ও মজুরদের আনা হলো নির্মাণ কাজে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ এই শ্রমিকদের দৈনিক চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজন হবে সরবরাহ। বাণিজ্য বুদ্ধি ও সূক্ষ্ম উদ্যোক্তার সহজাত প্রবৃত্তিতে ভরপুর ফ্রিডরিক তখনই বুঝে ফেললেন এবার মহাসম্ভাবনার স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সৌভাগ্যের রানী। তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

ইউরোপে সেকালে এক অদ্ভুত জঘন্য প্রথা প্রচলিত ছিল। নির্মাণ কাজে অন্য দেশ অথবা অঞ্চল থেকে দিনমজুর আনা হতো। এটা মনে করা হতো সবার জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু নৈতিকভাবে গর্হিত কাজ হলো শ্রমিকদের জন্য জৈবিক ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য আনা হতো বারবনিতাদের। এটা এমনকি বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। আমি গ্রীষ্মে কয়েকবার অস্ট্রিয়ার ইন্সব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছি। ২০১২ সালে ছিলাম অ্যাকাডেমিক ডিরেক্টর। আমেরিকা এবং ইউরোপের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষা সফরে যেতাম জার্মানির ব্যাভেরিয়ায় (ফ্রিডরিকের আদি নিবাস) অবস্থিত ওভারসালজবার্গে। ওখানে রয়েছে হিটলারের ঈগলস নেস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান আক্রমণে কিছুটা বিধ্বস্ত হয়েছিল। সিরামিক কাজে হিটলার এনেছিল ইতালীয় শ্রমিক, দক্ষতায় নামজাদা। তাদের জন্য সরকারি উদ্যোগে ব্যবস্থা করা হয়েছিল গণিকা পল্লী।

সৌভাগ্যের হাতছানিতে জার্মানির ব্যাভেরিয়ার আদিবাসী নিউ ইয়র্কের নাপিত ফ্রিডরিক কয়েক শত ডলার সাথে নিয়ে পাড়ি দিলেন প্রায় তিন হাজার মাইল দূরের এক অচিন শহর সিয়াটল। যুক্তরাষ্ট্রে তখন নব সংযোজিত ওয়াশিংটনের রাজধানী হলো সিয়াটল। ফ্রিডরিক তার জীবনের সকল সঞ্চয় উজাড় করে কিনে নিলেন গণিকা পল্লীর পুডল ডগ নামে একটি দোকান। নতুন নামকরণ করেছিলেন ডেয়ারি রেস্টুরেন্ট। সময়টা ছিল ১৮৯১ সালের শেষের দিক। ডনাল্ড ট্রাম্পের পারিবারিক জীবনীকার গোয়েন্ডা ব্লেয়ার ঐ এলাকা সম্পর্কে লিখেছেন, এটা হলো সেক্স, মদ ও ডলারের হটবেড। ঐ রেস্টুরেন্টর বিজ্ঞাপনে খাবার ও পানিয়ের সাথে জুড়ে দেয়া হতো "রুম ফর লেডিস" যার বাঁকা অর্থ হলো বেশ্যার ব্যবস্থা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ও মূলধারার রাজনীতিতে জাস্টিস অব পিস নির্বাচনে যৌন কারবারির ভূমিধ্বস বিজয়

এবারে আর ফ্রিডরিককে পায় কে? কাড়ি কাড়ি ডলার পকেটে আসছে। স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সৌভাগ্য রানীর চমৎকার আলিঙ্গনে ধূর্ত ফ্রিডরিক সিদ্ধান্ত নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিতে হবে। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়াল তার আগমনের বছরটি– যা ছিল ১৮৮৫ সাল। তিনি যদি আসতেন ১৮৮৩ সালে, তাহলে ১৮৯২ সালেই তিনি নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতেন। দু বছরের ব্যবধান। কিন্তু অনৈতিকতার কারবারির কাছে মিথ্যে বলাটা তেমন কোনও ব্যাপারই নয়। এমনকি সরকারি দলিলে মিথ্যা লেখার ঝুঁকি নিতে ফ্রিডরিকের রুগ্ন নৈতিকতায় বাঁধ সাধল না। পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত সাংবাদিক এবং লেখক ডেভিড কেএ জন্সটন তার লেখা 'দ্য মেইকিং অব ডনাল্ড ট্রাম্প' বইয়ে লিখেছেন ১৮৯২ সালে ফ্রিডরিক যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয়েছিলেন মিথ্যা বয়স উল্লেখ করে। যারপরনাই, তিনি নিউ ইয়র্কে আগমন দু'বছর এগিয়ে দিয়েছিলেন। দুই বন্ধু এসেছিলেন তার সৎ চরিত্রের সাক্ষী দিতে। একজন হলেন মজুর আর একজনের কাজ ছিল নিঃসঙ্গ মহিলাদের কিছুক্ষণের আবাসন। বাঁকা কথায় পিম্প অথবা বেশ্যার দালাল।

এবারে যুক্তরাষ্ট্রের নব্য নাগরিক তার জার্মান ভাষার ফ্রিডরিককে সূক্ষ্মভাবে পরিবর্তন করে ইংরেজি ভাষায় হয়ে গেলেন ফ্রেডারিক অথবা ফ্রেড। তিনি তার সিয়াটলের রেস্টুরেন্ট ১৮৯৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিক্রি করে মার্চ মাসে সিয়াটলের খানিকটা পূর্বদিকে মন্টি ক্রিস্টো শহরে আস্তানা গাড়লেন। এবারে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার আরও ঊর্ধ্বগতি। চারিদিকে খবর রটে গেছে, তেল খনিজ সম্পদের ধনকুবের ডেভিড রকফেলার মন্টি ক্রিস্টো এলাকায় প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। উদ্দেশ্য মাটির নিচে এবং নদীর কঙ্করে লুকায়িত স্বর্ণ ও রৌপ্য সন্ধান, আবিষ্কার, নিষ্কাশন ও বাজারজাত করে কাড়ি কাড়ি অর্থের পাহাড় গড়ে তোলা। দলে দলে সন্ধানকারীরা আমেরিকার কাউবয় টাইপ ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে ধেয়ে আসল ঐ অঞ্চলে। ফ্রিডরিক সবার চেয়ে ধূর্ত। তিনি সোনা সন্ধানকারী হলেন না। হলেন নিঃসঙ্গ সন্ধানকারীদের জৈবিক ক্ষুধা নিবৃত্তির কারবারি। এতে ডলার আসবে কাড়ি কাড়ি। নবনির্মিত রেলস্টেশনের কাছের জমির প্রতি তার নজর পড়ল। কিন্তু ঐ জমির স্বত্বাধিকারী হলেন নিকোলাস রুডবেক। ফ্রিডরিক দাবি করলেন তিনি স্বর্ণকনায় সমৃদ্ধ নদীবাহিত পাথরের টুকরো অথবা প্লেসার পেয়েছেন। ঐ দাবিটি ছিল সম্পূর্ণ ভুয়া। ঐ দাবিটির মূল উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত খনিজ সম্পদ অধিকার আইনের আওতায় ঐ জমিতে খনিজ আহরণের অধিকার লাভ করা। খনির সন্ধান কাজে দালানকোঠা ইত্যাদিও নির্মাণ করা যেত। সোনা সন্ধানের মিথ্যে কারণ দেখিয়ে ফ্রিডরিক সেখানে নির্মাণ করেছিলেন একটি দ্বিতল মোটেল ও রেস্টুরেন্ট। কুকাজে সিদ্ধহস্ত ফ্রিডরিক জমির মালিক রুডবেককে ভাড়া পর্যন্ত দিতেন না। পরিশেষে ১৮৯৪ সালে রুডবেক ঐ জমিটি ফ্রিডরিককে কম মূল্যে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ধূর্ত ফ্রিডরিকের চোখ ছিল রাজনৈতিক পদ লাভে যাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারায় শামিল হতে পারেন । ১৮৯৬ সালে মন্টি ক্রিস্টো উপশহরে তিনি জাস্টিস অব পিস নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করলেন।

ওই বছরেই সোনা এবং রুপার অপার সম্ভাবনার বেলুন ফেটে গেল। ফ্রিডরিক তার ব্যবসা গুটিয়ে ফিরে গেলেন সিয়াটলের যৌনপল্লীতে এবং আগের রেস্টুরেন্টের কাছে কিনে নিলেন আরেকটি রেস্টুরেন্ট। এবারে তার লাভ এতই বেড়েছিল যে মাত্র চার সপ্তাহের মধ্যে তিনি দোকান কেনার কর্জ শোধ করে দিয়েছিলেন।

কানাডার ক্লনডাইক গোল্ড রাশ: অজানার উদ্দেশ্যে দুঃসাহসী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী ফ্রিডরিক

১৮৯৬ সাল থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত কানাডার ইউকন টেরিটোরির ক্লনডাইকে ঘটেছিল এক বিস্ময়কর ঘটনা। ইতিহাসে যার নাম ক্লনডাইক গোল্ড রাশ। ১৮৯৭ সালের ১৫ জুলাই ক্লনডাইক থেকে ফেরত স্বর্ণ সন্ধানীরা দুটো জাহাজ এক্সেলসর এবং পোর্টল্যান্ড এ বহন করে এনেছিল ২০১০ সালের বাজারমূল্যে এক বিলিয়ন ডলারের স্বর্ণ।

দুঃসাহসী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী ফ্রিডরিক সিয়াটলের সব বেচে দিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। গন্তব্য ছিল কানাডার ইউকন টেরিটোরি। কুখ্যাত 'মৃত ঘোড়ার পথ' নামে পরিচিত এক দুর্গম গিরি পথ ধরে এগোতে হবে। মৃত্যু, বুভুক্ষা ও প্রতিকূল আবহাওয়ার এই রুক্ষ পথটি ছিল 'হোয়াইট পাস রুট'-এর অংশবিশেষ। ঐ দুর্গম বরফ ঢাকা গিরিপথে মালামাল পরিবাহী ঘোড়াগুলো শ্রান্ত হতে হতে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। স্বর্ণসন্ধানী কাফেলা ওই ঘোড়াগুলোকে বরফের উপর পরিত্যাগ করে এগিয়ে যেত ইউকনের লুকায়িত স্বর্ণের লোভে। ঐ মৃত ঘোড়াদের মাংস বিক্রির জন্য একটি তাবুর তৈরি রেস্টুরেন্ট খুলে দিলেন ফ্রিডরিক ও তার ব্যবসায়ের অংশীদার খনিজীবী আরনেস্ট লেভিন। লেখিকা গোয়েন্ডা ব্লেয়ারের ভাষায়, নিয়মিত খাবার ছিল সদ্য জবাই করা তড়িৎ হিমায়িত ঘোড়া।

হোয়াইট রুট পাস এর পথে বেনেট নামে একটি শহর ছিল। আজ মৃত, ম্লান, পরিত্যক্ত শহর। কিন্তু ১৮৯৭ থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত ক্লনডাইক গোল্ড রাশের সময় হাজার হাজার খনিজীবী ওখানে বাস করত। ওখান থেকেই ভেলা ভাড়া করে তারা পৌঁছে যেত স্বর্ণ সম্ভারে সমৃদ্ধ নদীবাহিত প্লেসার বালুকণার সন্ধানে। ১৮৯৮ সালের মে মাসে ফ্রিডরিক এবং আরনেস্ট লেভিন আস্তানা গাড়লেন বেনেট শহরে। স্বর্ণ সন্ধানের জন্য নয়। স্বর্ণ সন্ধানীদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর জৈবিক চাহিদার যোগান দিয়ে তাদের আরোহিত স্বর্ণে ভাগ বসাতে। দুজনে মিলে খুলেছিলেন 'আর্কটিক হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট'। ফ্রিডরিকের রেস্তোরাঁর চারিদিকে শত সহস্র তাবুতে থাকত স্বর্ণ সন্ধানীরা। নিঃসঙ্গ স্বর্ণ সন্ধানীদের খরচের হাত ছিল খোলা। সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের পর দিনান্তে সুস্বাদু খাবার, কড়া পানীয় এবং জৈবিক ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য খরচে ছিল না তাদের কোনো কার্পন্য। স্বর্ণ বিনিময় করে তারা দাম শোধ করত। খাবার ছিল খুবই উঁচু মানের। স্যামন মাছ, ভেড়ার মাংস, ঘোড়ার মাংস, ছাগলের মাংস, খরগোশ, পাlলকওয়ালা পা-বিশিষ্ট এক ধরনের বুনোহাঁস, রাস্পবেরি ইত্যাদি। কড়া পানীয়, মদ ও বিয়ারের ছিল ছড়াছড়ি। প্রাচীন ভারতের আর্যদের সোমরস এবং সূরা সংযোগে গোমাংস ভক্ষণের উৎসব ছিল না ভিন্নতর। স্বর্ণ সন্ধানীদের নিঃসঙ্গতার সাথে পারস্যের নিজ ভূমি ছেড়ে আর্যদের ভারতবাসী হওয়ার নিঃসঙ্গতার মিল আছে বলে সন্দেহ রয়েছে।

ডনাল্ড ট্রাম্পের পারিবারিক জীবনীকার গোয়েন্ডা ব্লেয়ার লিখেছেন, কড়া পানীয় এবং সেক্স বিক্রি করে আসত প্রচুর অর্থ। আর্কটিক রেস্টুরেন্ট খোলা থাকত প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা এবং মহিলাদের জন্য ছিল ব্যক্তিগত খুপরি যেখানে থাকত বিছানা এবং যৌন সেবার পাওনা মিটাতে স্বর্ণ মাপার দাঁড়িপাল্লা।

আন্দ্রেয়া বার্নস্টীনের পুস্তক 'আমেরিকান অলিগার্কস'-এর বর্ণনা অনুযায়ী কানাডার কর্তৃপক্ষ প্রথম প্রথম ওইসব বেআইনি কাজকর্মকে বন্ধ করা এড়িয়ে যেত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা কঠোর হওয়া শুরু করে। ইতোমধ্যে আরনেস্ট লেভিনের মাত্রাধিক মাদকাসক্তির জন্য ফ্রিডরিকের সাথে প্রায়ই ঝগড়া লেগে যেত। মাদকাসক্তির তোয়াক্কা করতেন না ফ্রিডরিক। বস্তুতঃ মদ বিক্রির লাভই ছিল তার উপার্জনের মূল অংশ। ফ্রিডরিকের মাথাব্যথার কারণ ছিল লেভিনের মাতলামির জন্য লাভের পরিমাণ কমে যাওয়ায়। উপরোক্ত কারণে ফ্রিডরিক তার মালিকানার অংশটুকু লেভিনকে বিক্রি করে দিয়ে ১৯০১ সালের সটকে পড়লেন। সেবার ফিরে গেলেন জার্মানির কালস্টাড– নিজের জন্মস্থানে। সাথে কাড়ি কাড়ি ডলার।

আইন অমান্যের অপরাধে জার্মান নাগরিকত্ব পুনর্বহালের দরখাস্ত নাকচ এবং বহিষ্কার

বত্রিশ বছর বয়স্ক ফ্রিডরিক তার ঘর পালানোর ১৬ বছর পর কালস্টাডে ফিরে এলেন বৃদ্ধ মায়ের কাছে। প্রতিবেশী এক গরিবের মেয়ে একুশ বছর বয়সের ভরা যৌবনা এলিজাবেথ ক্রিস্ট-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। নববধূকে নিয়ে ফ্রিডরিক ফিরে এলেন নিউ ইয়র্কে। শুরু করলেন পুনরায় নাপিতের কাজ। পরে হোটেল ও রেস্তোরাঁয় কর্মচারী হিসেবে। জন্ম হলো প্রথম সন্তানের, একটি কন্যা। বাড়ি কাতুরে এলিজাবেথকে নিয়ে ফিরলেন কালস্টাডে। ১৯০৪ সালের জুন মাসে। মন স্থির করলেন, আমেরিকা নয় জার্মানিই হবে তার ভবিষ্যৎ স্থায়ী নিবাস।

জার্মান নাগরিকত্ব ফিরে পেতে ফ্রিডরিক দরখাস্ত করলেন। করলেন প্রচুর তদবির। কিন্তু কর্তৃপক্ষ অনড়। সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদান এড়িয়ে জার্মানি থেকে পালানো ফ্রিডরিকের নাগরিকত্ব পুনর্বহালের দরখাস্ত শুধু নাকচ করাই নয়, ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফ্রিডরিককে আট সপ্তাহের মধ্যে জার্মানি ত্যাগের নির্দেশ জারি করল জার্মান কর্তৃপক্ষ। প্রিন্স বিসমার্কের প্রণীত 'সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদান' আইনের অমান্যকরণ আওতায় অপরাধী ফ্রিডরিক বাধ্য হয়েই জার্মানি ত্যাগ করে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে স্থায়ী বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

নিউ ইয়র্কে প্রত্যাবর্তন

সিয়াটল, মন্টি ক্রিস্টো এবং বেনেটে খাদ্য, কড়া পানীয়, যৌন সেবার মাধ্যমে উপার্জিত জমানো ডলারে আত্মবিশ্বাসী ফ্রিডরিক নিউ ইয়র্কে আবাসন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লেন। হোটেল ও রেস্তোরাঁতে বিনিয়োগ শুরু করলেন এবং পরিচালনার দায়িত্বেও অংশগ্রহণ করলেন। কিন্তু তার প্রথম কর্মঅভিজ্ঞতার স্মৃতি ভুলতে পারেননি। ম্যানহাটনের ৬০নং ওয়াল স্ট্রিটের ঠিকানায় খুলেছিলেন একটি নাপিতের দোকান। ওই রাস্তায় ৪০ নম্বরে তার পৌত্র (নাতি) ডনাল্ড ট্রাম্পের রয়েছে ট্রাম্প বিল্ডিং নামে এক বিশাল গগনচুম্বী অট্টালিকা। ওই রাস্তায় ওই অট্টালিকার প্রায় মুখোমুখি ৪৫ নম্বরে কয়েক বছর আগে আমার ছোট ছেলে আরাশ বাস করত। আমি অনেকবার ৪০ নম্বর এবং ৬০ নম্বর ওয়াল স্ট্রিটের মধ্যবর্তী ফুটপাথে হেঁটেছি। ফ্রেড ট্রাম্পের নাপিতের দোকানের স্মৃতিচিহ্ন নেই। সেখানে ৬০ নম্বরে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল গগনচুম্বী অট্টালিকা। প্রবহমান সময়ের তীরে পরিবর্তনের রীতিতে অনেক কিছুই হারিয়ে যায় স্থান কালের গহ্বরে।

স্প্যানিশ ফ্লু নামক প্যানডেমিকে ইতিহাসের অন্যতম সফল ঠাকুরদাদার ইন্তেকাল

ফ্রিডরিকের দিনকাল ভালই যাচ্ছিল। এক মেয়ে ও দুই ছেলের পিতা। কুইন্সের উড হ্যাভেনে সাত রুমের এক দ্বিতল দালানে সচ্ছলতায় দিন কাটছিল। কিন্তু সুখ বেশিদিন সইল না। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। যুদ্ধে জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রতিপক্ষে জড়িয়ে পড়ল। যুক্তরাষ্ট্রে জার্মান অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠল। এমনকি সহিংসতার উন্মেষ ঘটল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দেশপ্রেমের ব্যাপারে জার্মান অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অমূলক সন্দেহ জাগ্রত হলো অন্য দেশ থেকে আগত নাগরিকদের মনে। মুখে আলকাতরা মেখে এবং গলায় পাখির পালকের মালা পরিয়ে অনেককে অপমান করা হলো। এমনকি এক জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যাও করা হলো।

ফ্রিডরিক সাবধান লোক। তখন তিনি জীবন যাপন করছিলেন পরিমিতভাবে যাতে মানুষের চোখে না পড়েন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের অনেক কিছু শেখার ছিল তার পিতামহের পরিস্থিতি জেনে। জাতি অথবা বর্ণবিদ্বেষে উস্কানি দেওয়া কখনও মঙ্গলের হতে পারে না।

১৮১৮ সালের ২৯ মে বারো বছর বয়সী ছেলে ফ্রেড জুনিয়রকে নিয়ে ফ্রিডরিক জামাইকা অ্যাভিনিউতে হাঁটছিলেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পরদিন ৩০ মে ১৯১৮ সালে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে তিনি নিদারুণ অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। মৃত্যুর কারণ ছিল স্প্যানিশ ফ্লু নামে এক ভয়ঙ্কর প্যানডেমিক। স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে ওই সময়ে পৃথিবীর পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।

কী আশ্চর্য, ১০২ বছর পর কোভিড-১৯ প্যানডেমিক নিরসনে অব্যবস্থাপনা ছিল ফ্রিডরিক পৌত্র ডনাল্ড ট্রাম্পের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্টশিয়াল নির্বাচনে পরাজয়ের মূল কারণ। ডনাল্ড ট্রাম্প নিজেই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দ্বার থেকে কোনওক্রমে রেহাই পেয়েছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য বর্ণবিদ্বেষ এবং প্যানডেমিক সম্পর্কে ডনাল্ড ট্রাম্প কিছুই শিখেননি তার পিতামহ জার্মান নাপিত ফ্রিডরিক ট্রাম্পের অভিজ্ঞতা থেকে।