খেলার আড়ালের রাজনীতি

হায়দার মোহাম্মদ জিতু
Published : 1 Dec 2021, 02:54 AM
Updated : 1 Dec 2021, 02:54 AM

ইদানিং এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে যেকোনও বিষয়েই দুইটি পক্ষ বনে যায়। যদিও এ বিষয়গুলোকে দায়িত্বশীল অংশেরই সামাল এবং উপস্থাপন করা জরুরী। এখনকার বিভাজিত হবার ইস্যু দেশের ক্রিকেট। সম্প্রতি বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচে দেশের স্টেডিয়ামে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন, পাকিস্তানি দলের প্রস্তুতিতে মাঠে পতাকা টানানো এবং সমর্থন মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে বিব্রত এবং বেদনাসিক্ত করেছে। কেউ কেউ এমনও বলে ফেলেছেন, যতদিন ক্রিকেটে পাকিস্তান আছে ততদিনই তারা তাদের সমর্থন করবেন !

বিষয়টিতে রাজনীতির কিছু নেই আবার অনেক কিছু আছে এমন একটা গুমোট বার্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু আদতে রাজনীতি নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন এবং মত প্রকাশ করেন, তারা জানান ভিন্ন কথা। এক্ষেত্রে রাজনীতি নিয়ে সর্বজন পাঠ্য অ্যারিস্টটলের মতে, মানুষের পুরো যাপনটাই রাজনীতি। অর্থাৎ জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু, এর পুরো পরতে পরতে রাজনীতি যুক্ত ও চালিত। সে হিসেবে দুই দেশের ক্রিকেট খেলাটাও কোন অংশে রাজনীতির বাইরে নয়। তবে এর জন্য আরো নিরীক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার প্রয়োজন আছে।

খেলার সাথে রাজনীতি না মেশানোর পেছনে বহু যুক্তি রইলেও কেউ এটা অস্বীকার করতে পারবেন না যে,  স্বাধীন না হলে- কখনওই পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালির মাটিতে বড় মাপের খেলা অনুষ্ঠিত হতে দিত না। স্টেডিয়াম নির্মাণ-বিনির্মাণ করতে দিত না। তাদের ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস তাই বলে। ক্রিকেট খেলাটির বড় আসরগুলো হতো পশ্চিম পাকিস্তানের কোন স্টেডিয়ামে। বাঙালিকে খেলা দেখতে হত নানা ফর্দের অনুমতি ও কালা-কানুন ডিঙ্গিয়ে। এতো গেল খেলা দেখার বিষয়।

খেলোয়াড় হিসেবে অংশগ্রহণের দিক বিবেচনা করলে বাঙালি সন্তানেরা জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাওয়া তো দূরের কথা, স্টেডিয়ামের ধারে-কাছেও ঘেঁষতে পারতেন না। এবিষয়ে প্রমাণ হলো, তৎকালীন সরকারি এবং সর্বোচ্চ বিষয়গুলোতে বাঙালিদের সুযোগ পাওয়ার পরিসংখ্যান। সেটা সেনাবাহিনী থেকে সরকারি কর্মচারী সবক্ষেত্রেই।

এ অঞ্চলে একটি কথা বহুল প্রচলিত। সেটা হল, এখানকার মানুষ সহজেই ভুলে যায়। ভুলে যাবার সংস্কৃতি এখানকার রন্ধ্রে-রক্তে। একারণে হয়ত এখানের কেউ কেউ এখনও পাকিস্তানি পতাকা হাতে গ্যালারিতে উঠেন ! অথচ ওরা আমাদের রক্তে বিষ ছড়িয়ে দেবার কৌশলে মা-বোনের সম্ভ্রম লুটেছিল। ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল। বৈশ্বিক পরিস্থিতি অংশগ্রহণমূলক। কাজেই এখানে প্রত্যেকের সাথে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিযোগিতামূলক এবং বাজার চাহিদাসূচক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে এবং সেটা বাংলাদেশও করে চলেছে। কিন্তু তাই বলে অযাচিত সম্পর্ক স্থাপন কখনই নয়।

তবে এরপরও কেউ কেউ যুক্তি দেন বা দেবেন- 'একাত্তর সালের বিষয়, অনেক দিন তো হল' কিংবা 'মুসলমান মুসলমান ভাই-ভাই'। তাদের উদ্দেশ্যে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবার সুযোগ আছে। একাত্তরে কি এখানকার মানুষ মুসলিম ছিলেন না ? তখন কোন যুক্তিতে এখানে নির্বিচারে হত্যা, লুট, ধ্বংস এবং ধর্ষণ করা হয়েছিল ? আর তাছাড়া রাজনীতির মানচিত্র ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুসরণে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশই মুসলিম প্রধান। কিন্তু তারপরও সেখানে ভিন্ন ভিন্ন দেশ ও সীমানা আছে। কাজেই খেলায় পাকিস্তানের  প্রতি নমনীয়তা বিষয়ক আলোচনায় ধর্মীয় বিষয়াদি টেনে আনা একটি উছিলা বা অজুহাত মাত্র।

সংস্কৃতিতে বাঙালি ভীষণ অতিথিপরায়ন এবং আবেগ সম্পন্ন। কাজেই বাঙালির আবেগকে সম্মান করে প্রতিযোগিতামূলক সকল বিষয়কে এগিয়ে নিতে হবে, এটাই মূল কথা। কিন্তু খেলার আড়ালে যে রাজনীতি এবং তত্ত্ব ছড়িয়ে দেবার কৌশল, সেসব এখানে চলবে না।

এর বাইরে মনে রাখতে হবে, ঋণের ফাঁদে জর্জরিত, বিধ্বস্ত ও পরাজিত পাকিস্তানের মনে আজও একাত্তরের পরাজয়ের জ্বালা আছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ বিশাল সেনাবাহিনী নিয়েও তারা বাঙালির আত্মবিশ্বাস ও সাহসের কাছে পরাজিত হয়েছে। কাজেই পুরনো ঘায়ের মলম হিসেবে এক খেলা দিয়েই যে এখানে বিভাজনের সংস্কৃতি এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা চলবে- এমনটা বললেও বোধ করি ভুল হবে না। কৌশলগত আচরণ ও আবহ এটাই ইঙ্গিত করে।

কাজেই ইতিহাসের অনুপ্রাণনে বর্তমান বাঙালির এই উন্নয়ন জয়যাত্রা যেন সমুন্নত এবং অটুট থাকে সেজন্যে প্রতি সুতোয় সুতোয় দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। জাগাতে হবে জাত্যাভিমান ও জাতির স্পর্ধা। আর এটা করতে পারলেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সকল পাকিস্তানি দালাল ও দুর্বৃত্তজনেরা।