পাকিস্তানকে রুখতে হবে

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 22 Sept 2021, 04:44 PM
Updated : 22 Sept 2021, 04:44 PM

গত ১৬ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে 'ঢাকায় পাকিস্তানি অপতৎপরতা' শিরোনামে যে সংবাদটি ছাপা হয়েছে, তা পড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল মানুষই আতঙ্কিত হতে বাধ্য। দীর্ঘ সে বিশেষ প্রতিবেদনটির প্রতিপাদ্য হলো- কয়েক বছর চুপ থাকার পর পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আবারও কোমরে কাছা বেঁধে নেমেছে বাংলাদেশকে অচল করে দিতে। লেখা হয়েছে, সে উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতাকে ব্যবহার করছে। বলা হয়েছে, পাকিস্তান হাইকমিশন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যমে কর্মরতদের নিয়ে একটি হোয়াটসআপ গ্রুপ খুলে ধর্মকে কেন্দ্র করে নানা রকমের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। পাশাপাশি স্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে ভুল তথ্যের পাশাপাশি বানোয়াট তথ্য প্রচার করছে। 

উল্লেখ্য যে অতীতেও ঢাকাস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তারা বাংলাদেশে জঙ্গি অর্থায়নের সময় হাতেনাতে ধরা পড়েছে। ২০০০ সালে পাকিস্তানি উপ-রাষ্ট্রদূত এরফান রেজা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশ্যে আপত্তিকর ভাষণ দেওয়ায় তাকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল, যেটি ছিল বাংলাদেশ থেকে কোন কূটনীতিককে বহিষ্কারের একমাত্র ঘটনা।

পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার অপতৎপরতা নিয়ে প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনটির  দাবি যে কত নির্ভুল তার প্রমাণ পাওয়া যাবে অবাধে চালিয়ে যাওয়া কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে, যেগুলোর বেশ কয়েকটি চালাচ্ছে পাকিস্তানিরা আর বাকি কয়েকটি বাঙালি নামক পাকিস্তানপ্রেমিরা। উভয়ের উদ্দেশ্যই এক, বাংলাদেশের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের সরকারকে অসাংবিধানিকভাবে উৎখাত করে, দেশটিকে পুনরায় পাকিস্তানে পরিণত করা। আর যতই নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসছে নিশ্চিতভাবে পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর অর্থায়নে এদের তৎপরতাও বেড়ে যাচ্ছে। তাদের দৃষ্টি পরের নির্বাচনের দিকে, যাতে আওয়ামী লীগ সরকারকে দূর করা যায়।

এরই মধ্যে পাকিস্তান আবার শুরু করেছে নতুন চাল, তারই অংশ হিসেবে তারা সম্প্রতি মারিয়া জাদুন নামক এক পাকিস্তানি নারীকে দিয়ে মিথ্যাচারে ভরপুর এক ভিডিও তৈরি করে তা নেট দুনিয়ায় ছেড়েছে। ভিডিওতে ওই নারী বিএনপি-জামাত নেতাদের সুরেই বললো, 'বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চ ভাষণের শেষে জয় বাংলা বলার পর জয় পাকিস্তানও বলেছেন'।  ওই নারী শুধু একথা বলেই ক্ষান্ত হয়নি, সে 'জয় পাকিস্তান' শব্দটি তার ভিডিওতে জোড়া লাগিয়েছে। এটি যে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর নয়, বরং অন্যের কণ্ঠ কৃত্রিমভাবে জোড়া দেয়া হয়েছে তা সহজেই বোঝা যায়, যা কোন শ্রোতারই বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। মারিয়া জাদুনের নগ্ন, নির্লজ্জ মিথ্যাচার সেখানেই শেষ হয়নি, সে এয়ার ভাইস মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) এ কে খন্দকারের লেখা বইয়ের উদ্ধৃতিও দিয়েছে। অথচ তার লেখা যে অসত্য ছিল পরবর্তীতে এ কে খন্দকার সে কথা নিজেই প্রকাশ্যে স্বীকার করে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর লেখার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। বয়সের চাপে স্মৃতি লোপ পাওয়া এ কে খন্দকার যে কিছু কুচক্রীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওই অসত্য কথাগুলো লিখেছেন, তাও তার পরবর্তী স্বীকারোক্তি থেকে পরিষ্কার হয়েছে। মারিয়া জাদুন তার মিথ্যাচারের পরিধি বাড়িয়ে এও বলেছে যে, 'বঙ্গবন্ধু নাকি পাকিস্তানি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে এটা জেনে রাগান্বিত হয়েছিলেন যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তিনি নাকি তখন বলেছিলেন, তিনি তো স্বাধীনতা চাননি, তিনি সংযুক্ত পাকিস্তান চেয়েছিলেন এবং তিনি নাকি তখনি পাকিস্তান রেডিওর মাধ্যমে সেকথা প্রচার করতে চেয়েছিলেন।' তার এ উলঙ্গ মিথ্যাচারও স্ব-প্রমাণিত। এটা যদি সত্যি হতো তাহলে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি লন্ডন পৌঁছেই সেকথা বলতেন, অথচ লন্ডন পৌঁছে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য শুধু উল্লাসই প্রকাশ করেননি, বরং পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ যে জেলখানার অভ্যন্তরে তার কবরও খুঁড়ে ছিল একথাও ব্যক্ত করেছিলেন। 

লন্ডনে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তানিদের বলেছিলেন তাকে ফাঁসি দেওয়া হলে তার মরদেহ যেন বাংলাদেশে পাঠানো হয়। মারিয়া জাদুনের কথা যে মিথ্যার বেসাতি দ্বারা তৈরি তার আরো প্রমাণ হলো ১৯৭১-এর অগাস্ট মাসেই বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য বিচার করার ইয়াহিয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা, যা বিশ্বময় গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যদি সংযুক্ত পাকিস্তান চাইতেন, তাহলে ইয়াহিয়া এ ধরনের ঘোষণা দিতো না, বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রশ্ন উঠতো না। লন্ডনে বঙ্গবন্ধু কান্নাজড়িত কণ্ঠে এও বলেছিলেন যে. পাকিস্তানিরা বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে, যে কথা অন্য বহু জনের মতো আমিও নিজ কানে শুনেছি সেদিন ক্লারিজেস হোটেলে উপস্থিত থেকে, যে কথা গণমাধ্যমের সহায়তায় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ শুনেছে। বঙ্গবন্ধু যদি পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরুদ্ধে থাকতেন তাহলে কেন তাকে ৯ মাস পাকিস্তানি কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল? বঙ্গবন্ধু ঢাকা পৌঁছেই একদিকে পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত গণধর্ষণের ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আবেগজড়িত কণ্ঠে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, অন্যদিকে আমাদের বিজয়ের জন্য উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন, ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। ঢাকার পথে দিল্লিতে যাত্রা বিরতির সময়ে দিল্লির বিশাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে তিনি বাংলাদেশের বিজয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন এবং ভারতের জনগণ, সেনাবাহিনী এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে কোলকাতায় স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সভায় ভাষণ দিয়েও তিনি একই কথা বলেছিলেন। দেশে ফিরেই তিনি পাকিস্তানি ক্রীড়ানকদের সাজা দেওয়ার জন্য দালাল আইন প্রণয়ন করে ৩০ হাজার বেশি পাকিস্তানি চরকে আটক করেছিলেন, তিনি বাংলাদেশে ফিরেই যে সংবিধান প্রণয়নে হাত দিয়েছিলেন তার অন্যতম বিধান ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করা। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের চরদের দ্বারা ঘটিত যুদ্ধাপরাধের অপরাধে যুদ্ধাপরাধিদের সাজা দেওয়ার জন্য সে বছরই যুদ্ধাপরাধ বিচারের আইন পাশ করেন। বঙ্গবন্ধু তখনই পাকিস্তানের কাছে দাবি করেছিলেন আমাদের পাওনা টাকা, সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার, যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সৈন্যদের বিচার করার। এটিও প্রমাণিত সত্য যে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বহন করা বিমানে দবির সিদ্দিকী নামে এক রন্ধ্রে রন্ধ্রে মুসলিম লীগার বাঙালিকে পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য। বঙ্গবন্ধু যদি সত্যিই সংযুক্ত পাকিস্তান চাইতেন তা হলে ভুট্টো কেন সেই দবির সিদ্দিকিকে পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য? সেই দবির সিদ্দিকিকে পরবর্তীতে কোলকাতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনার কথা ফাঁস হলে। ১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যায় পাকিস্তানের ভূমিকা ছিল অতি প্রচ্ছন্ন।

সম্প্রতিকালে ৭০ দশকের মার্কিন গোপন দলিল অবমুক্ত হলে জানা যায় ভুট্টো ১৯৭৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে বলেছিল খুব শিগগির বঙ্গবন্ধুকে অপসারণ করা হবে, বাংলাদেশে সামরিক শাসন জারি হবে আর সে সরকার হবে ভারতবিরোধী। ১৯৭৪-এর এপ্রিলে ভুট্টো পাকিস্তানের সামরিক একাডেমিতে বলেছিল খুব শিগগির উপমহাদেশে বড় পরিবর্তন হবে। ১৯৭৪-এর জুন মাসে ভুট্টো যে আসলে আইএসআইয়ের চৌকস কর্মকর্তাদের নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার নীল নকশা তৈরিতে, তাতেও কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। ভুট্টোর সফরসঙ্গী সাংবাদিকরা পাকিস্তানে ফিরে গিয়েই লিখেছিল বাংলাদেশে শিগগিরই সামরিক অভ্যুত্থান হবে।

এসব ঘটনা প্রমাণ করছে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের উদ্যোগেই সে-ই নারী জঘন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, যার জন্য তাকে বাংলাদেশে এনে বিচার করা দরকার। ওই নারীর ভিডিওটি অবিলম্বে বন্ধ করা এবং পাকিস্তানের কাছে এর জন্য ব্যাখ্যা চাওয়া প্রয়োজন। মারিয়া জাদুন ছাড়াও পাকিস্তান থেকে একটি ইউটিউব পরিচালনা করছে জোনায়েদ ইসলাম নামক এক পাকিস্তানি। তার প্রচারেও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মিথ্যাচার এবং ভারত বিরোধিতা। তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে তাদের অস্ত্র হিসেবে।

সেকালের অতি জনপ্রিয় ছায়াছবি 'হারানো সুরে' উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনকে বলেছিলেন, 'কৌতুহল থাকা ভালো, কিন্তু তার সীমারেখা থাকা উচিত।' সুচিত্রা কিন্তু কৌতুহলের সীমা অতিক্রম করেছিলেন যুক্তিসঙ্গত কারণে, অর্থাৎ কারণ ছাড়া অতি কৌতুহলী কেউ হয় না।

আমাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দ্বারা অর্জিত স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে যে দেশটি আমাদের ব্যাপারে সার্বক্ষণিক কৌতুহলের সীমারেখা লংঘন করছে তার নাম পাকিস্তান। আমাদের ব্যাপারে পাকিস্তান কেন এতো কৌতুহলী জানতে চাইলে অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বললেন, পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করা খুব কঠিন বৈকি? ইতিহাস বলছে, যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজা জয়পাল ছেলে আনন্দ পালের হাতে রাজ্য ছেড়ে দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মিসরের রাণী ক্লিউপেট্রাও তার নিজের পোষা সাপের কামড় খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই অর্থে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি ৯৩ হাজার সৈন্যের পরাজয় তো অতীতের যে কোন পরাজয়ের চেয়ে বেশি গ্লানিকর। এমনকি আত্মসমর্পণের দুইদিন আগেও বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল নিয়াজি প্রকাশ্যে উন্মাদের মতো হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। পাকিস্তান একাত্তর থেকেই তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে যে বদ্ধপরিকর, তার প্রমাণিত তথ্যের ঘাটতি নেই, আর তাদের প্রতিশোধের টার্গেট হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল আওয়ামী লীগ, কেননা এই দলের নেতাই পাকিস্তানকে বাধ্য করেছিলেন হাঁটুতে দাঁড়াতে। পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করতে না পেরে আজও লেগে আছে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানে পরিণত করে একাত্তর সালে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে, আর এজন্য বাংলাদেশে তাদের প্রেমিক দল বিএনপি ও জামায়াত তো, গ্রাম্য বাংলায় প্রচলিত কথা অনুসারে 'এক পায়ে খাড়া'। এছাড়াও রয়েছে বহু পাকি-প্রেমীজন যারা পাকিস্তান ভেঙ্গে ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের সৃষ্টি কখনো মেনে নিতে পারে নি। এর মধ্যে এক বিহারি পিতার পুত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডাকসুর এক সাবেক ভিপি, কুখ্যাত রাজাকার সবুর খানের ক্যামেরাম্যান ভাগিনা, আরো বহুজন। এদের সবার সঙ্গেই যে ঢাকাস্থ পাকিস্তানি দূতাবাসের যোগাযোগ রয়েছে, তার প্রমাণের অভাব নেই। 

এছাড়াও আছে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া কয়েক জন সাংবাদিক ও সেনা কর্মকর্তা যারা দেশে বিভিন্ন অপরাধের আসামী। আরো রয়েছে পাকিস্তানি অর্থপ্রাপ্ত চরেরা। পাকিস্তানের সে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য দেশটি অতীতে ভূমিকা নিয়েছিল বিএনপি, জামায়াতকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে ক্ষমতায় আনার। ২০০০ সালে পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী যে বিএনপি-জামায়াতকে প্রচুর পয়সা দিয়েছিল তাদের নির্বাচনে জয়ের জন্য, তা পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা প্রধান এক জেনারেল পাকিস্তানের আদালতে প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন। এরপর পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ঢাকাস্থ পাকিস্তানি দূতাবাস শুরু করে বাংলাদেশে কর্মরত জঙ্গিদের অর্থায়ন। হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল দুই জন পাকিস্তানি কূটনীতিক, ফারিন আরশাদ এবং মাজহার খান। ২০১৫ সালে তাদের দুজনকেই বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আরো পূর্বে পাকিস্তানি উপরাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভাষণের জন্য। 

২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে জাতির পিতার রক্তের ধারকদের শেষ করতে যে পাকিস্তান ২১ অগাস্ট গ্রেনেড আক্রমণে কুশিলবের ভূমিকায় ছিল, তার প্রমাণ অ-বিস্ফোরিত গ্রেনেডে পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির ছাপ এবং মাজেদ ভাট ও আব্দুল মালেক নামীয় দুজন পাকিস্তানির জড়িত থাকা, যাদের দুজনকেই বিচারিক আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। ২০১৩ সালে উত্তরা থেকে র‌্যাব যে কজন ষড়যন্ত্রকারীকে গ্রেপ্তার করেছিল, তাদের মধ্যে ছিল এক পাকিস্তানি, যে আইএসআই-এর চর হলেও পিআইএ-র ট্রাফিক অফিসারের ছদ্মবেশে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল।

এসব অপচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর পাকিস্তান এক নতুন কৌশল নিল, যা ছিল ছলে, কৌশলে চীনের সহায়তায় বাংলাদেশের বন্ধু সাজার। পাকিস্তান জানে বাংলার মানুষ পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্ব মেনে নেবে না যতদিন পাকিস্তান একাত্তরের গণহত্যা, গণধর্ষণের জন্য ক্ষমা না চাইবে, আমাদের পাওনা টাকা ও সম্পদ ফেরত না দিবে, যুদ্ধাপরাধে দায়ী পাকিস্তানি সৈন্যদের বিচার না করবে। কিন্তু পাকিস্তান সে দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এক ফন্দি বের করলো এই বলে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান চুক্তিতেই এসব বিষয় সমাধান হয়ে গেছে, যেটি সর্বৈব মিথ্যাচার। বাংলাদেশ কখনো এ ধরনের কথা দেয়নি, আর তা ছাড়া সেই ত্রিপক্ষীয় চুক্তি পার্লামেন্টে উপস্থাপিত না হওয়ায়, তা কখনো আইনি মর্যাদা পায়নি। একইসঙ্গে পাকিস্তান ড. আমেনা মাহমুদ, সাদাফ ফারুক এবং নাদিয়া আওয়ান নামের তিনজনকে 'বুদ্ধিজীবী' সাজিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় যে সব মিথ্যা কথা লেখালো, সংক্ষেপে তা হলো এই যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাস, কৃষ্টি, ধর্ম এক হওয়ায় তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হওয়া উচিত। লেখকত্রয় বড় বড় ডিগ্রির ধারক হলেও তারা মনে করতে পারলেন না যে বাঙালিদের ভাষা-কৃষ্টি-ঐতিহ্য পাকিস্তানিদের থেকে বহু গুণে আলাদা এবং সেই পার্থক্যের কারণেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার মানুষ ভেবেছিল, পাকিস্তানিরা আর আমরা এক নই, তাই এটি এক দেশ হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু সরাসরি বলতেন, "মাউড়াদের" সাথে আমরা এক থাকতে পারি না। বঙ্গবন্ধু সেই ১৯৫৫ সালেই পাকিস্তান পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে দাবি করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান নাম পরিবর্তন করে 'পূর্ব বাংলা' রাখা হোক। এমনকি পাকিস্তানের এবং বঙ্গীয় অঞ্চলের ইতিহাসেও রয়েছে বেজায় তফাৎ। প্রত্মতাত্ত্বিক দিক থেকে পাকিস্তানিরা ইরান, তুরস্কের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ, আর আমরা মাছ খাওয়া খাঁটি বাঙালি, যে কথা আইয়ুব খানও তার 'ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস' পুস্তকে লিখেছিলেন। সেই তিন লেখক বাংলার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানুষের মনে শুধু বিরূপ প্রতিক্রিয়াই জন্ম দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের মনে জন্মেছে ঘৃণা।

গত ২৬ মার্চ সবাই ভেবেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইবেন। ক্ষমাতো তিনি চানই নি, বরং বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের 'সাবেক রাষ্ট্রপতি' হিসেবে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করেছেন। বঙ্গবন্ধু আজ পৃথিবীর অনেক দেশেই 'বঙ্গবন্ধু' নামে পরিচিত, যেমন পরিচিত 'কামাল আতাতুর্ক', 'মহাত্মা গান্ধী'। ইমরান খান বঙ্গবন্ধু শব্দটিতো উচ্চারণ করেনই নি, এমন কি বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবেও উল্লেখ করেননি, যা প্রমাণ করছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের অনীহা এখনও বিরাজমান, কারণ তিনিই পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের সৃষ্টি করেন।

১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্টের প্রাক্কালে পাকিস্তান যে ধরনের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত বিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা করতো, আজও তারা তেমন প্রচারণায় নেমেছে। তাদের সে প্রচারণা বন্ধ করা এবং পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠতা বর্জন না করলে সমূহ বিপদ হতে পারে, যা কিনা পাকিস্তানের উদ্দেশ্য এবং এ ব্যাপারে চীনেরও হাত রয়েছে, রয়েছে পাকিস্তানপ্রেমি বহু বাঙালির।

এটা মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানে কখনো শাসক পরিবর্তন হয় না, শুধু ব্যক্তি পরিবর্তন হয়, কেননা, সে দেশের শাসক হচ্ছে তাদের সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা, আইএসআই, যারা তাদের ইচ্ছা মাফিক এক ব্যক্তির পরিবর্তে অন্য ব্যক্তিকে চেয়ারে বসায় মাত্র।

এটি আজ দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে আফগানিস্তানের তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ হাত ছিল। তালেবানিদের থাবা যেন বাংলাদেশে প্রসারিত হতে না পারে এবং বাংলাদেশের ধর্মান্ধরা যাতে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান গিয়ে তালেবানি প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র নিয়ে দেশে ফেরত এসে জঙ্গিবাদ ও উগ্র কর্মকাণ্ড শুরু করতে না পারে, সে জন্য পাকিস্তানের ব্যাপারে আমাদের সতর্কতার প্রয়োজন আরো বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে ঢাকাস্থ পাকিস্তানি দূতাবাসের ওপর কড়া নজরদারির প্রয়োজনীয়তা। সব ক্ষেত্রেই পাকিস্তান থেকে আমাদের যোজন যোজন দূরে থাকতে হবে।