কৌলিন্য রক্ষায় পলিটেকনিক শিক্ষা বন্ধ জরুরী!

এম আর খায়রুল উমামএম আর খায়রুল উমাম
Published : 15 Sept 2021, 11:48 AM
Updated : 15 Sept 2021, 11:48 AM

বাংলাদেশে ৪ বছর মেয়াদী পলিটেকনিক শিক্ষা কোর্সকে ৩ বছরে নিয়ে আসার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতীতে আমাদের দেশে শিক্ষাকোর্সে বা শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য এমন কমিটি গঠন করে তার সুপারিশে কাজ করা হয়েছে তা জানা যায় না। একটা সরকারি আদেশে ৩ বছরের বিএ পাশ কোর্স ২ বছরের হয়ে গিয়েছে। ৩ বছরের অনার্স ৪ বছরের হয়ে গিয়েছে। কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি মাস্টার্সের সমতুল্য হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষার ফলাফল গ্রেড সিস্টেমে হয়ে গিয়েছে। শুধু একটা সরকারি আদেশে রাতারাতি এসব পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু ৪ বছর মেয়াদী পলিটেকনিক শিক্ষাকোর্সকে ৩ বছরে রূপান্তর করার জন্য কমিটি কেন? এখানে সরকার অধ্যাদেশ জারি করে পরিবর্তন করল না কেন?

বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে এই শিক্ষার কোনোরকম প্রয়োজন নেই। মধ্যম স্তরের জনশক্তি দিয়ে কোনো কর্মকাণ্ড করানোকে আমাদের মর্যাদাবান শিক্ষিত সমাজ অসম্মানজনক বলে মনে করে। এমন জনশক্তির অস্তিত্ব দেশ ও জাতিকে স্বস্তি দিতে পারে না। এজন্য দেশ থেকে এলএমএফ ডাক্তারদের বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য সাধারণ রোগের চিকিৎসাকে সোনার হরিণ করে তোলা হয়েছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মূসা একদিন বলেছিলেন- 'দেশে এখন ডাক্তাররা রোগী দেখেন না, রোগীরা ডাক্তার দেখে ভিজিট দিয়ে আসেন।' দেশের চিকিৎসা এতটাই উন্নত হয়েছে যে বিত্তবান ও ক্ষমতাবানরা সর্দি-জ্বর হলেই আমেরিকা-ইংল্যান্ড দৌড়াচ্ছে আর বিত্তহীনরা জমিজমা বিক্রি করে ভারতে চিকিৎসার জন্য ছুটছে। গ্রামের মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য নানাবিধ আইন তৈরি হয়েছে, কিন্তু তাতে লাভ যা হয়েছে তা প্রায়ই জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকে প্রকাশিত হয়। দেশের সাধারণ মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার বাইরে চলে গেলে, কৌলিন্য ও আভিজাত্য রক্ষা করার আনন্দে উদ্বেলিত আমাদের মর্যাদাবানদের লাভ কী হবে? একই চিন্তা চেতনায় রাতারাতি মোক্তারদের অ্যাডভোকেট বানিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য আইনের আশ্রয় নেওয়া কঠিন করে দেওয়া হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় পলিটেকনিক শিক্ষা ব্যবস্থার পরিণতি একই পথে চললেই স্বাভাবিক ছিল।

আমাদের দেশে কৌলিন্য প্রথা ভাঙ্গার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা রক্ষা করা যায়নি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য তিন শ্রেণির চিকিৎসকের একটা টিমওয়ার্ক গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। জটিল ও কঠিন রোগের জন্য এমবিবিএস ও উপরের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, সাধারণ ও কম জটিল রোগের জন্য মিডলেভেল ডাক্তার ও প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য পল্লী চিকিৎসক প্রয়োজন বিবেচনায় পরিকল্পিতভাবে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি, চারবছর মেয়াদী মিডলেভেল ডাক্তার তৈরির জন্য ৮ জেলা শহরে মেডিকেল স্কুল শুরু এবং বেশ কিছু থানা হাসপাতাল সংলগ্ন ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করে ২ বছর মেয়াদী পল্লী চিকিৎসক তৈরির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কৌলীন্য ও আভিজাত্যবাদীদের চাপের মুখে প্রথমে মিড-লেভেল ডাক্তারদের ৪ বছরের কোর্স ৩ বছরে এবং ২ বছরের পল্লী চিকিৎসক কোর্স ১০ মাসে নামিয়ে আনা হয় এবং আরো চাপের মুখে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০০০ সালের মধ্যে 'সবার জন্য স্বাস্থ্য' মুখ থুবড়ে পড়ে। এতে কৌলীন্যবাদীদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা হলেও সাধারণ জনগণ আজও তার খেসারত দিয়ে চলেছে। তাই সার্বিক বিবেচনায় পলিটেকনিক শিক্ষা কোর্স একই পথে চললেই স্বাভাবিক ছিল।

বাংলাদেশের মানুষের বিদেশ প্রীতি সর্বজন স্বীকৃত। বিদেশিদের কাছ থেকে কিছু প্রাপ্তি যোগ হলে তার ভালো-মন্দ বিবেচনার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। এখনো দেশে এমন প্রকল্প আছে যার প্রয়োজনীয়তা সাধারণ মানুষ বুঝে উঠতে পারে না। ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের একান্ত ব্যক্তি-স্বার্থ পূরণের নিশ্চয়তা পেলে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করেন। দেশের পলিটেকনিক শিক্ষা এমনিই বিদেশিদের দান আর সেই দান এসেছে আমেরিকা থেকে। ফোর্ড ফাউন্ডেশন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট তৈরি করে। আমেরিকান টেকনিক্যাল শিক্ষা কোর্স অনুসরণ করে এখানে শিক্ষার শুরু হয়। সেসময়ে বেশকিছু আমেরিকান শিক্ষক এ শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিলেন। এতে করে একটা উন্নতমানের শিক্ষার মাধ্যমে সুশিক্ষিত মধ্যম স্তরের প্রকৌশলী গড়ার কার্যক্রম চালু হয়। কিন্তু এ গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষাই সময়ের আবর্তনে পলিটেকনিক শিক্ষার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পেশার কুলীনদের জন্য দেখা দিল বিশাল সমস্যা। আমাদের আভিজাত্যপূর্ণ সমাজে যে শিক্ষার কোনো গুরুত্বই নেই সেই শিক্ষা কিনা উন্নতমানের হয়ে গিয়েছে। অতএব সর্বশক্তি দিয়ে টেনে নামানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।

বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত যুক্তি হচ্ছে উন্নতমানের শিক্ষাকে আরো উন্নত করার জন্য প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নিয়ে চলা আর নিম্নমানের শিক্ষাকে উন্নত করা। কিন্তু আমাদের কুলীন সমাজ বিশ্বস্বীকৃত এহেন যুক্তি মানতে নারাজ। তাই তারা আমেরিকান শিক্ষা অনুসরণ করে নিজেদের শিক্ষাকে উন্নত করার কাজে উদ্যোগী না হয়ে পলিটেকনিক শিক্ষা কোর্সকে টেনে নিচে নামানোর ব্রত গ্রহণ করেন। পলিটেকনিক শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন করে, মেয়াদ কমিয়ে নিম্নমুখী করার চক্রান্ত শুরু হয়। যা আজও চলমান আছে। এ চক্রান্ত চলমান রাখার প্রধান কারণ কুলীন পেশাজীবীরা দেশ ও জাতির কল্যাণে যে দায়িত্ব পালনের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করেছেন সে দায়িত্ব পালনে তারা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থেকে তারা আজও নিম্নপদের কাজ করে থাকেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে কুলীন পেশাজীবীদের কর্তব্য পালনের পোশাকী ভূমিকা। সেই ভূমিকায় দেশের নির্মাণ ও উৎপাদনের পরিণতি কী হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী প্রতিটা শিক্ষার একটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকে। সর্বত্রই জনগণের করের টাকায় দেশের প্রয়োজন বিবেচনায় মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষা প্রদান করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষার কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয় না। একজন মানুষও জানে না দেশ ও জাতির কল্যাণে কোন পেশায় কতজন প্রয়োজন। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী আর শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় নেই। যার যা ইচ্ছা সে তাই করছে। শিক্ষানীতিতে আছে শিক্ষকতা ছাড়া স্মাতক সম্মান অন্য সব চাকরির জন্য সর্বোচ্চ ডিগ্রি বিবেচিত হবে। সরকার এই শিক্ষানীতি অনুমোদন করেছে। সরকার যদি এই নীতি মানে তবে সারা দেশে এত মাস্টার্স করার ব্যবস্থা কেন? দেশের অনক্ষর অনাহারি মানুষের করের অর্থ এই শিক্ষার পিছনে ব্যয় করার কারণ কী? শিক্ষানীতিতে যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য বর্ণিত আছে তার সাথেও কোনো শিক্ষার এবং সে শিক্ষার সাথে অর্জিত চাকুরির মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কারিগরি ও প্রকৌশল কর্মকাণ্ডেও এর কোনো ব্যতিক্রম দেখা যায় না। ব্যয়বহুল শিক্ষা হলে কি হবে এতে কারো কিছু যায় আসে না।

দেশে সব শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্পষ্ট করা প্রয়োজন। শিক্ষা অনুয়ায়ী চাকরি হলে মানসম্মত সেবা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। উচ্চ শিক্ষা নিয়ে উচ্চ পদে চাকরি করে নিম্ন পদের কাজ করলে দেশ ও জাতির ক্ষতি। অনেকে বলতে পারেন আমরা এখন উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার দৌড়ে। তাই টাকা সমস্যা নয়। কিন্তু টাকা থাকলেই তা অপব্যবহার করতে হবে? এটা বোধ করি কোনো সভ্যতার লক্ষণ নয়। কোনো সভ্য মানুষের পরিচায়কও নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে শিক্ষানীতি অনুযায়ী লক্ষ্য উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেই জনগণকে জনশক্তিতে রূপান্তরের কাজ করতে হবে। যার যা ইচ্ছা সে মতো শিক্ষা ব্যবস্থা চলতে পারে না। শিক্ষানীতি তৈরি করে গর্বিত হয়ে তা সযত্নে শিকেয় তুলে রাখলে জনকল্যাণ হবে কীভাবে? শিক্ষানীতি অনুসরণ করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে একটা যুগোপযোগী ও উন্নত পরিবেশ পাওয়া যাবে। স্বপ্নে পাওয়া ব্যবস্থাপনা দিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণ হতে পারে না। কৌলীন্য রক্ষার জন্য পলিটেকনিক শিক্ষার মেয়াদ কমানোর স্বপ্নে দেশের কোনো লাভ হবে না।

পলিটেকনিক শিক্ষা কোর্সের শিক্ষার্থী ও পাশ করা গ্রাজুয়েটরা দীর্ঘ আন্দোলন করে ৪ বছর মেয়াদী কোর্স চালু করেছিল। অতিরিক্ত এক বছর মেয়াদ বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকগণ। কারণ, এক বছর বেশি শিক্ষা গ্রহণের জন্য তারা একটা ছিদ্র পয়সাও অতিরিক্ত পায়নি। পদ-পদবি-বেতনে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে পলিটেকনিক শিক্ষা ৪ বছর মেয়াদী হওয়ার ফলে তা একটা আন্তর্জাতিক মান অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। এখন আবার চক্রান্ত শুরু হয়েছে পলিটেকনিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ৩ বছর মেয়াদী করে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে আনার। এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কৌলীন্য ও আভিজাত্য রক্ষা করতে গিয়ে তারা জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেবে কিনা? পলিটেকনিক শিক্ষা নিয়ে চোর-পুলিশ খেলার কোনো প্রয়োজন নেই। দেশ ও জাতির কল্যাণ বিবেচনায় পলিটেকনিক শিক্ষা যদি চলমান রাখতে হয় তাহলে এই শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি শিক্ষা অনুযায়ী কর্মের বিভাজন করতে হবে, শিক্ষার লক্ষ্য উদ্দেশ্য মোতাবেক কর্মের দায়িত্ব দিতে হবে। জাতীয় বিল্ডিং কোডের মতো একই কাজ একজন ১০ তলা পর্যন্ত করবে এবং অন্যজন তার ওপর থেকে তদারকি করবে– সাধারণ জনগণ স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে এমন ছেলেমানুষী পছন্দ করতে পারে না। তবে সরকার যদি মনে করে কুলীনদের দিয়ে পুরা কারিগরি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে তাহলে পলিটেকনিক শিক্ষা কোর্স বন্ধ করে দেয়াই কর্তব্য। জেলার পলিটেকনিকগুলোর অবকাঠামোকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর কঠিন হবে না। এখানে বেকার বাড়লেও সমাজে মাস্টার্স পাশ বেকারের চাইতে কুলীন বেকারের সংখ্যা বাড়বে। আর পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা নিজেদের মানসম্মত রাখার জীবনব্যাপী আন্দোলন সংগ্রাম থেকে রক্ষা পাবে।