Published : 15 Jul 2021, 10:46 PM
টানা দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাউনের পর ১৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত সরকার লকডাউন শিথিল করেছে। বাস-ট্রেন-লঞ্চ-নৌযান চলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২১ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য কোরবানির ঈদে গ্রামমুখী মানুষ যেন নিরাপদে যেতে পারেন, ব্যবসা বাণিজ্য যাতে কিছুটা সচল হয়- সেজন্যই ঈদের আগের ছয়দিন দূরপাল্লার যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করছে সরকার। আবার ঈদ শেষে ঢাকামুখীদের জন্য আরও একদিন অর্থাৎ ২২ জুলাই হাতে রাখা হয়েছে। এ কয়দিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার অনুমতি রয়েছে। খুলে দেওয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত। তারপরে আবার ২৩ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত চলবে কঠোর লকডাউন ব্যবস্থা।
অংকটি অতি সরল অংক। কিন্তু ফলাফল অনেক জটিল। সরকারকে এমন সময়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হলো, যখন সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এর সংক্রমণ। দেশে দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। শুধু ছাড়িয়েই যায়নি, নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা এখন ১২/১৩ হাজারের মধ্যে ওঠানামা করছে, যা এর আগে ছিল না। এবং মৃত্যু! সে তো ২০০ নিচে নামতেই চাচ্ছেনা না।,
অনেক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সিদ্ধান্তের কারণে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ এতটাই বাড়তে পারে যে, হাসপাতালে রোগীদের স্থান সংকুলান হবে না। রীতিমতো বিনাচিকিৎসায় মানুষের মৃত্যু হতে পারে। কেউ বলেছেন ঈদে যেভাবে মানুষ ঢাকা ছাড়বে, কোরবানির পশুর হাটে ঘোরাঘুরি করবে, যেভাবে মেলামেশা করবে, শপিং করবে- তাতে সংক্রমণের গতিরোধ করা বহুগুণ কঠিন হয়ে পড়বে।
গত রোজার ঈদের সময় লকডাউন এর মধ্যেও গ্রামমুখী মানুষের স্রোত আমরা দেখেছি। মানুষ যেভাবে ঢাকা ছেড়েছে অনেক চেষ্টা করেও তা ঠেকানো যায়নি। সেটা ছিল মারাত্মক বিপজ্জনক অবস্থা। যার কারণেই করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর আজ এ চিত্র। আমরা লকডাউন দেই আর যাই করি- যেহেতু ঈদে বাড়িফেরা মানুষদের ঠেকানো যায়না, সেহেতু গাদাগাদি করে ফেরিতে পারাপার এবং ভেঙে ভেঙে ক্ষুদে যানবাহনে ঈদযাত্রার বদলে এবার দূরপাল্লার বাস ট্রেন-লঞ্চ-স্টিমার ইত্যাদি খুলে দেওয়া সম্ভবত সরকার মঙ্গলময়ই মনে করেছে। তবে এর পরিণতি হতে পারে অনেক ভয়াবহ।
গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করতে যতই বলা হোক, তা নিশ্চিত করা কি আদৌ সম্ভব? ঈদের পরে গণপরিবহন খোলা থাকছে মাত্র একদিন। ছয় বা সাতদিন ধরে যারা গ্রামে যাচ্ছেন, তারা যখন এ একদিনের মধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মস্থলে ফিরতে চেষ্টা করবেন তখন কি স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি অবান্তর হয়ে পড়বে না?
এভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যে বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে সে আশঙ্কায় বিশেষজ্ঞরা যেমন চিন্তিত, তেমনি সরকারও নিশ্চয়ই ভাবছে। আর সে কারণেই হবে হয়তো সম্ভাব্য সংক্রমণের চেইন ভাঙতে ঈদের পর আবার ১৪ দিনের লকডাউন দেওয়া হয়েছে । গেল লকডাউনে পুলিশ ও বিজিবিসহ সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়েও কঠোর লকডাউন কার্যকর করতে পারিনি আমরা। এ লকডাউনের ফলাফল দেখে আমরা কি নিশ্চিত হতে পারব যে আগামী লকডাউনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব?
বলতে দ্বিধা নেই, গত কঠোর লকডাউনটি যদি সত্যিই কঠোর লকডাউন হতো তাহলে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর এই অবস্থা হতো না। এ ব্যাপারে শুধু একটি উদাহরণই যথেষ্ট।
পার্শ্ববর্তীদেশ ভারতের দিল্লির কথা। সেখানে করোনায় মৃত্যুর মিছিল নেমেছিল। মৃত ব্যক্তিদের সৎকার করার স্থান হচ্ছিল না শ্মশানে, স্থান হচ্ছিল না কবরস্থানে। তখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী সাত দিনের লকডাউন দিয়েছিলেন এবং লকডাউনকে 'লকডাউন' হিসেবে পরিণত করেছিলেন। পুলিশের লাঠিপেটাতে মানুষ রাস্তায় নামতে পারেনি। প্রতিবাদ সেখানেও হয়েছিল, কিন্তু সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল থাকার কারণে এখন দিল্লিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও দৈনিক মৃত্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে এসেছে। শুধু দিল্লি নয় ভারতের অনেক প্রদেশেই করোনাভাইরাস এখন নিয়ন্ত্রণে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত এবং টিকা ব্যবস্থার কারণে করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।
পরিবার পিরজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের জন্য মানুষের দাবির প্রেক্ষিতেই হোক, দেশের অর্থনীতির কারণেই হোক অথবা আর অন্য কোনও কারণেই হোক সরকারকে ঈদের আগের লকডাউন উঠিয়ে নিতে হয়েছে এবং ঈদ পরবর্তী সময়ে করোনা যে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে সে বিবেচনায় আবার ১৪ দিনের লকডাউন ঘোষণা করতে হয়েছে। এ লকডাউন যদি ইতিপূর্বে লকডাউনগুলোর মত না হয় অর্থাৎ লকডাউনকে যদি 'লকডাউন' হিসেবেই পরিণত করা সম্ভব হয়, তবে হয়তো করোনাভাইরাসকে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে পৃথিবীর অনেক দেশ অনেক প্রদেশ। এক্ষেত্রে অবশ্যই দেশব্যাপী ব্যাপক টিকা দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। পত্রপত্রিকায় যা দেখছি তাতে টিকা সহজলভ্যতার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই লেখাটি যখন লিখছি সেসময় একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক সাহেব তার সম্পাদকীয়তে লিখেছেন আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে দেশে ১০কোটি ডোজেরও বেশি টিকা আসবে। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে, সে অবস্থায় কোন বিরতি ছাড়াই দৈনিক কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
অনেকেই হয়তো বলবেন, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষুধা পেটে নিয়ে ঘরে বসে মরতে পারবে না। ফলে এ লকডাউনও সফল হবে না। উন্নত বিশ্বে সফল হয়েছে, কারণ তারা দেশের জনসাধারণের খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। আমি তাদের সাথে দ্বিমত করছি না। তবে এটুকু বলতে চাই করোনাকালীন দেড় বছরে ১৭/১৮ কোটি মানুষের এই জনবহুল দেশে কতজন মানুষ না খেয়ে মরেছেন? হ্যাঁ একথা সত্য যে অনেক মানুষই ক্ষুধার কষ্টে জর্জরিত ছিলেন। সরকারকে অবশ্যই এ বিষয়টিও দেখতে হবে।
সরকার যে দেখছে না- তাও না। ২৩ জুলাই থেকে যে লকডাউন আসছে সেই ঘোষণার সাথে সাথেই তিন হাজার ২০০ কোটি টাকার পাঁচটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। যার ব্যাপ্তি রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত। এ প্যাকেজের আওতায় লকডাউন এর সময়ে নিম্নআয়ের ১৭ লাখের বেশি জনসাধারণ নগদ আড়াই হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা পাবেন, যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ দিনমজুর। শহর এলাকায় নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ৮১৩টি কেন্দ্রে বিশেষ ওএমএস কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এছাড়াও আরো অনেক পরিকল্পনাই এর আওতাধীন। হতদরিদ্র মানুষের অংশটুকুই আলোচনায় আনলাম মাত্র।
এই প্রণোদনার পরিকল্পনা সঠিকভাবে পরিপালন না হলে তা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে। আর যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, তবে লকডাউনের সময়ে অন্নাভাবে মানুষের ভোগান্তির যে আশঙ্কা রয়েছে তা থেকে অনেকাংশেই আমরা রক্ষা পাবো।
লকডাউন বাস্তবায়নে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সাথে সাংসদসহ সব জনপ্রতিনিধিরা যদি দায়িত্ব ও কর্তব্য সততার সঙ্গে পালন করেন তাহলেই ঝুঁকি অনেক কমে আসবে। তবে লুটপাটের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ঈদ পরবর্তী সময়ে দেশে করোনা সংক্রমণের মহাক্রান্তিকাল আসার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। এ সময় বাঁচতে হলে আমাদের প্রয়োজন প্রথমত জনসচেতনতা নিশ্চিত। তারপর সরকারি প্রতিনিধি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং দেশের বিত্তশালীদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য নিয়ে দরিদ্র মানুষের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসা। লুটপাটের কালচার অন্তত এবারের জন্য বন্ধ রাখা।
সব কথার এক কথা হলো, ঈদের পরে লকডাউনকে 'লকডাউন' এ পরিণত করা এবং সর্বোপরি টিকার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। আর তা না হলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে 'অপঘাতে' মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হতে হবে এ দেশের মানুষকে।