রাষ্ট্র যখন পুরুষতান্ত্রিক

Published : 15 June 2021, 03:25 PM
Updated : 15 June 2021, 03:25 PM

আজ কিছু গল্প বলবো। গল্প মানে অভিজ্ঞতা, সত্যিকারের অভিজ্ঞতা। 

কিছুটা শখ, কিছুটা প্রয়োজনে ড্রাইভিং শিখেছি। পরীক্ষায় পাশও করেছি। এবার লাইসেন্স নেওয়ার পালা।  বিআরটিএ-তে এক কম্পিউটার অপারেটরের কাছে কাগজপত্র নিয়ে যেতে হলো, যিনি কিনা সফটওয়ারে নাম ঠিকানা বিস্তারিত টুকে নিবেন। বাবা-মায়ের নাম লেখার পর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হাজবেন্ডের নাম কী? 

আমি আকাশ থেকে পড়ে বললাম, হাজবেন্ডের নাম দিয়ে কী হবে? 

বললেন, লাগবে। মহিলাদের লাইসেন্সে হাজবেন্ডের নাম লাগে। নিয়ম আছে। 

আমি বললাম, এইটা,কেমন নিয়ম? পুরুষদের লাইসেন্সে ওয়াইফের নাম দেন নাকি? কই, আমার হাজবেন্ডের ড্রাইভিং লাইসেন্সে তো আমার নাম নাই।

তরুণ বিআরটিএ কর্মচারী এবার পাল্টা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, আপনার নাম কেন থাকবে? 

– সেইটাইতো। তাইলে আমার লাইসেন্সে হাজবেন্ডের নাম কেন থাকবে? 

তিনি উত্তর দিলেন, সরকাররে জিগান। এইখানে নাম এন্ট্রি দেওয়ার ঘর আছে। ঘর ফাঁকা রাখা যাবে না।  

অগত্যা আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সে আমার হাজবেন্ডের নাম সরকারী নিয়মে বহাল হয়ে গেল। তাতে কোন দুঃখ থাকতো না যদি হাজবেন্ডের ড্রাইভিং লাইসেন্সে আমার নামটাও থাকতো। কিন্তু সরকার বাহাদুর আমার দুঃখ মোচনের কোন ব্যবস্থা রাখে নাই। 

সরকার সকল ভোটারকে পরিচয়পত্র দিয়েছেন। সেই পরিচয়পত্র কিন্তু পুরুষ ও নারী নাগরিকদের জন্য একরকম নয়। বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফরমে পিতা/ স্বামীর নাম লেখার অপশন আছে। এরপরই মায়ের নামের ঘর। এখন তাই অনেক নারীর জাতীয় পরিচয়পত্রটার চেহারাটাই একটা কৌতুকের মতো। সেখানে শুরুতে তার নিজের নাম, তারপর স্বামীর নাম, তারপর মায়ের নাম। মাঝখান থেকে অনেক নারীর বেচারা বাবার নামটাই হারিয়ে গেছে পরিচয়পত্র থেকে। যারা সচেতনভাবে পিতার নাম দিয়েছেন তাদেরটা বাদে।

গল্পটা এইখানে শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু এসব গল্প এতো সহজে কখনোই শেষ হয় না। 

নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটের সাধারণ জিজ্ঞাসা ট্যাবে যান। সেখানে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন আছে এরকম: 

– বিয়ের পর স্বামীর নাম সংযোজনের প্রক্রিয়া কি? 

–  বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। এখন ID card থেকে স্বামীর নাম কিভাবে বাদ দিতে হবে? 

– বিবাহ বিচ্ছেদের পর নতুন বিবাহ করেছি। এখন আগের স্বামীর নামের স্থলে বর্তমান স্বামীর নাম কিভাবে সংযুক্ত করতে পারি? 

নির্বাচন কমিশন যত্ন সহকারে স্যাম্পল উত্তরগুলো লিখেও রেখেছে। পরিচয়পত্রের ফরম এবং এই প্রশ্নগুলো যারা সাজিয়েছেন তারা স্বামীর পরিচয় ব্যতিত নারীর পরিচয় ভাবতেই অপারগ। 

এরকম নানারকম সরকারি/ বেসরকারি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে নারীকে প্রয়োজনে/ অপ্রয়োজনে পিতার নামের পাশাপাশি স্বামীর নাম লেখার অপশন জুড়ে দেওয়া থাকে সবসময়। ড্রাইভিং লাইসেন্সের বেলায় তো রাষ্ট্র আরেক কাঠি সরেস। সম্পূর্ণ বিনা অনুমতিতে, কোন মতামতের তোয়াক্কা না করে বাধ্যতামূলকভাবে নারীর ড্রাইভিং লাইসেন্সে হাজবেন্ডের নাম জুড়ে দেওয়া হয়।  

এসব তো আমাদের গা সওয়া হয়েই গেছে বহুদিন। অন্তত মায়ের নামটা যে আজকাল লেখা যায়, তাতেই আমরা অনেকে বর্তে গেছি! কিন্তু এইবার রাষ্ট্র তার পুরুষতান্ত্রিক চেহারাটা বড্ড কুৎসিতভাবে তুলে ধরেছে একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার আয়োজনে নারীর উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি তুলে। 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি হয়তো ভুলেই গেছেন যে, গার্ড অব অনার কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। এটা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তার সূর্য সন্তানদের শেষ যাত্রায় সম্মান জানানোর রাষ্ট্রীয় আয়োজন। সেটা তাদের পুরুষতান্ত্রিক মস্তিষ্ক প্রসূত মনোবাঞ্ছা পূরণ করার কোন উপলক্ষ নয়। 

এইতো, এবছরের শুরুতেই বিয়ে নিবন্ধনে নারীরা কাজী হতে পারবে না বলে সিদ্ধান্ত দিলেন আইন মন্ত্রণালয়। সেই সিদ্ধান্ত আবার মহামান্য হাই কোর্ট সমর্থনও করলেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল আমরা জানি না। 

গত দুইদিন ধরে চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমনিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম বেশ শোরগোল চলছে। তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। অভিযোগের আঙুল উঠেছে উত্তরা ক্লাবের সাবেক সভাপতি এবং ব্যবসায়ী নাসির মাহমুদের বিরুদ্ধে। পরীমনি অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিলেন বনানী থানায়, তারা সহযোগিতা করেন নাই। পাশে দাঁড়ান নাই চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিও। পরীমনির ভাষ্য অনুযায়ী, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানের কাছে বিষয়টি নিয়ে গেলে তিনি, 'দেখতেসি' 'দেখতেসি' বলে এড়িয়ে গেছেন। 

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। সেটা আমাদের গর্বের বিষয় নিঃসন্দেহে। 'দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, আর কী চান', বলে অনেকেই নারীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের এসব আপত্তিজনক আচরণগত সমস্যাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী হলেই সেই দেশের সংসদ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আইন আদালত, সবকিছু নারীবান্ধব হয়ে যায় না। বাংলাদেশের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অথরিটিতে বসে আছেন একেকজন পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্বের মানুষ। তারা কিছুদিন পরপরই নানারকম সিদ্ধান্ত দিয়ে, আচরণ দিয়ে, অসহযোগিতা করে, অসম্মানজনক মন্তব্য করে, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেন, বাংলাদেশের নারীরা, কেবলমাত্র নারী হওয়ার কারণে কতেটা পরিচয়হীন, কতোটা অযোগ্য, কতেটা অপাংক্তেয়।  

এমনিতেই প্রতিদিন একজন নারী হিসেবে ঘরে-বাইরে আমাদের শতরকম চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে চলতে হয়। সেখানে যদি গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো স্বয়ং রাষ্ট্র যখন পুরুষতান্ত্রিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন হতাশা রাখার জায়গা থাকে না। অথচ, এসব সংসদ সদস্যরা, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির মতো সংগঠনগুলোর নেতারা শুধু পুরুষদের ভোটে তো নির্বাচিত হন নাই। যে নারীরা তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলেন, তাদের প্রতি এই সাংসদদের, নেতাদের দায়বদ্ধতার জায়গাটা কোথায়?