চীনের আগ্রাসন এখনই থামাতে হবে

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 23 May 2021, 03:19 PM
Updated : 23 May 2021, 03:19 PM

দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের রণপ্রস্তুতি যে বিশ্বময় এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে তা বলাই বাহুল্য। চীন আগে তার একটি শক্তিশালী তিন মুখ সম্পন্ন ডেকিং যুদ্ধ জাহাজ দক্ষিণ চীন সাগরে পাঠানোর পর আরো বহু যুদ্ধ প্রস্তুতিমূলক ঘটনা ঘটিয়েছে। বেশ কিছু যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়ে সব দেশের জাহাজের বিরুদ্ধে তাড়া করার চেষ্টা করছে, তাইওয়ানের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে এবং সর্বশেষে নবনির্মিত এক বিরাটাকার হেলিকপ্টারবাহী যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে ওই সাগরে। 

এর পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান প্রমুখ দেশও তাদের রণতরী পাঠিয়ে দক্ষিণ চীন সাগরকে সকল দেশের জন্য উন্মুক্ত রাখার প্রত্য়য় নিয়ে নেমে পড়েছে। বেশ কয়েকটি দেশ মিলিতভাবে 'ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্র্যাটেজি' নামেও সংঘবদ্ধ হয়েছে। 'ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্র্যাটেজি'তে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, জার্মানি ছাড়াও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আরও দেশ রয়েছে, যেমন- ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর।

উল্লেখিত দেশগুলোর ইন্দো-পেসোফিক স্ট্র্যাটেজিতে থাকা খুবই স্বাভাবিক কেননা, চীন পুরো দক্ষিণ সাগর তাদের নিজেদের রাজ্যের অংশ বলে দাবি করায় এবং সেখানে অন্য দেশের জাহাজের চলাচলকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এতে শুধু আঞ্চলিক দেশ সমূহেরই নয়, বরং বিশ্বের সমস্ত দেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেটি সবার জন্যই গভীর শঙ্কার জন্ম দিয়েছে- তা হলো চীনের এ আগ্রাসি ভূমিকা অবশেষে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তথা পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নেবে কিনা। চীন একটি পরমাণু শক্তিধর দেশ, যে প্রতিদিনই তার সমরসজ্জা বাড়িয়ে চলেছে। চীন সামরিক শক্তিতে বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ও রয়েছে গোটা বিশ্বকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চূড়ান্ত বিলুপ্তিতে আনার মতো ক্ষমতা। অতি স্বাভাবিকভাবে বহুদেশ চীনের অবস্থানের বিরোধিতা করতে বাধ্য হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন, তথা আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন কী বলে সেটি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক আইনের গতিপথ নির্ণয়ে সমুদ্র সংক্রান্ত আচার-আচরণ ও নিয়মাবলী বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। যে নিয়মটি শুরু থেকেই প্রচলিত তা হলো- সমুদ্রে নির্বিঘ্নে চলাচলের স্বাধীনতা বা সমুদ্রের স্বাধীনতা। আন্তর্জাতিক আইনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে হুগো গ্রোটিয়াস, যাকে আন্তর্জাতিক আইনের পুরোধা বলা হয়, তিনিও ১৭ শতকে সমুদ্রের অবাধ স্বাধীনতার দাবির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। সে সময়েই তিনি বিভিন্ন মতবাদের গুরুদের সমুদ্রের স্বাধীনতার তত্ত্বের পক্ষে একত্রিত করতে সক্ষম হন। এটি করে তিনি পর্তুগিজদের দাবিও নস্যাৎ করতে পেরেছিলেন, যে দাবির ভিত্তি ছিল তাদের বাণিজ্যিক মনোপোলি। 

গ্রোটিয়াসের তত্ত্বের স্বীকৃতির পর আন্তর্জাতিক আইনে সেটি প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এরপর সেই দিকেই বেড়ে উঠতে থাকে প্রচলিত বা কাস্টমারি আন্তর্জাতিক আইন। যে তত্ত্বটি নিয়ে আইনের অগ্রযাত্রা চলতে থাকে সেটি হলো, এই যে সমুদ্রে অবাধ চলাচল প্রতিটি দেশের নিরঙ্কুশ অধিকার।

প্রথাগত আইনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমুদ্র সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনকে সমৃদ্ধ করতে থাকে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য প্রচলিত আইন এবং চুক্তিভিত্তিক আইন অভিন্ন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী প্রথাগত আইন (কাস্টমারি ল) সকল দেশের জন্যই বাধ্যতামূলক। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক বিধান সমুহ শুধু চুক্তিভুক্ত দেশ সমূহের বেলায়ই প্রযোজ্য।

আন্তর্জাতিক আইনের উন্নয়নে সমুদ্র সংক্রান্ত আইন এক বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। ১৭ শতকের ডাচ আইন তত্ত্ববিদ হুগো গ্রোটিয়াস, যাকে আন্তর্জাতিক আইনের জনক বলা হয়, নিজেও তার আইনি গবেষণান্তে সমুদ্র আইনের উপরে অনেক মূল্যবান তথ্য দিয়ে গেছেন, যা এখনও আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের উপরে প্রথাগত বা কাস্টমারি আইন হিসেবে স্বীকৃত। তার সময়ে যারা সমুদ্র আইন নিয়ে বিভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন তাদের সবাইকে তিনি এ মর্মে সম্মত করতে পেরেছেন যে মহাসমুদ্র সব দেশের জন্যই উন্মুক্ত, অর্থাৎ কোনও বিশেষ রাষ্ট্র মহাসমুদ্রের একক মালিকানা বা অধিকার দাবি করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের ভাষায় 'মহাসমুদ্রের স্বাধীনতার তত্ত্ব' নামে পরিচিত। এ তত্ত্বের ফলে পর্তুগিজদের সাগরে একচ্ছত্র অধিকারের দাবি খণ্ডিত হয়ে যায়। তত্ত্বটি আন্তর্জাতিক আইনের অন্যান্য শাখার মতো এ মতবাদ নিয়ে এগিয়ে যায় যে, আন্তর্জাতিক আইন সব রাষ্ট্রের সম্মিলিত সম্মতির ভিত্তিতেই গড়ে উঠে। এর ফলে সমুদ্রকে সকল রাষ্ট্রের সমতার ভিত্তিতে ব্যবহারের তত্ত্ব গড়ে উঠে। প্রথাগত বা কাস্টমারি আন্তর্জাতিক আইনের বাইরেও বিগত দশকগুলোতে জন্ম নিয়েছে বহু আন্তর্জাতিক চুক্তিভিত্তিক আইন। বহু ক্ষেত্রে সেগুলো প্রথাগত আইন থেকে অভিন্ন নয়। তবে এসব কনভেনশনভিত্তিক আইনের ফলে সমুদ্র আইন এখন পূর্ণতা পেয়েছে। ১৯৫১ সালে অ্যাংলো-নরওয়েজিয়ান ফিসারিজ মামলার রায়ে আন্তর্জাতিক আদালত উল্লেখ করেছেন যে, আন্তর্জাতিক চুক্তি বা কনভেনশন ভিত্তিক আইনগুলো শুধুু চুক্তিভুক্ত দেশ সমূহের জন্য প্রযোজ্য হলে ও প্রথাগত বা কাস্টমারি আন্তর্জাতিক আইন সকল দেশের উপরই বাধ্যতামূলক। সমুদ্র আইনকে বহু দশক ধরেই বিধিবদ্ধ করার চেষ্টা করা হলেও তা কখনো সহজ ছিল না। 

১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের জন্মের পর পরই সদস্য রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক আইন কমিশন সৃষ্টি করে, আর সৃষ্টির পরেই উক্ত কমিশন উঠে পড়ে লোগ যায় সমুদ্র সংক্রান্ত আইনকে বিধির আওতাভুক্ত করতে। ১৯৫৬ সালে সেই কমিশন জাতিসংঘের সমুদ্র সংক্রান্ত সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সালে জেনিভায় জাতিসংঘের প্রথম সমুদ্র সংক্রান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যা UNCLOS-1 নামে পরিচিত। উক্ত সম্মেলনে যে চারটি কনভেনশনের জন্ম হয় সেগুলো হলো- 

১. টেরিটরিয়েল সি এবং কনটেজিয়াস জোন সংক্রান্ত 

২. মহাসাগর সংক্রান্ত 

৩. কন্টিনেন্টাল সেলফ সংক্রান্ত এবং 

৪. মৎস্য এবং সমুদ্র সম্পদ সংক্রান্ত। 

তবে ওই কনভেনশনে সমুদ্র সংক্রান্ত অধিকারের বিষয়ে সীমারেখা নির্ধারিত করা সম্ভব হয়নি বলে দ্বিতীয় জাতিসংঘ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সে সম্মেলনেও ঐক্যমতের অভাবে, অবশেষে তৃতীয় সম্মেলন বা UNCLOS-111 অনুষ্ঠিত হয়। এরই মধ্যে জাতিসংঘের সদস্য সংখ্য বহুগুণে বর্ধিত হয় এবং নুতন সদস্য রাষ্ট্র সমূহের থেকে দাবি উঠে পুরানো কনভেনশনগুলো ঢেলে সাজানোকে জন্য। তাছাড়া সমুদ্রগর্ভের সম্পদ উত্তোলনের জন্য কারিগরি ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়। বহু কথাবার্তা, তর্ক-বিতর্কের পর অবশেষে ১৯৮২ সালে একটি কনভেনশনের জন্ম দেয় ওই সম্মেলন, যা আজ অব্দি চীনসহ মোট ১৪৮টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর ফলে কনভেনশনটি  এখন পুরোপুরি কার্যকর। এ কনভেনশনের সৃষ্টি বহু বিধান এরই মধ্যে প্রথাগত বা কাস্টমারি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়েছে, যার জন্য সব রাষ্ট্রই সেগুলো মানতে বাধ্য। ১৯৮২ সালের কনভেনশন মহাসাগরকে সংজ্ঞায়িত করেছে, যে সংজ্ঞা অনুযায়ী মহাসমুদ্র হলো- টেরিটোরিয়েল সাগর এবং কোন দেশের আভ্যন্তরীণ জলরাশি ব্যতিরেকে গোটা সাগর। এ সংজ্ঞা মূলত প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রদত্ত সংজ্ঞারই প্রতিচ্ছবি। 

ওই কনভেনশন অনুযায়ী, টেরিটোরিয়াল জলসীমা ১২ মাইলের ঊর্ধ্বে হতে পারে না। কনভেনশনে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে টেরিটোরিয়াল জলসীমার বাইরে সমগ্র সাগর এলাকা সকল দেশের অবাধ ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

১৯৮২ সালের কনভেনশনে একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল  এর স্বীকৃতি রয়েছে, যার সীমারেখা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের উপকূল থেকে ২০০ মাইলের বেশি হতে পারে না। এ অঞ্চলে উপকূলীয় রাষ্ট্রের মাছ ধরার, সমুদ্রের তলদেশে এবং মাটির নিচের সম্পদ আহরণের একান্ত অধিকার রয়েছে। তবে উপকূলীয় রাষ্ট্রের উল্লেখিত একান্ত অধিকার থাকলেও সে রাষ্ট্র ওই একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে এমন কোন কিছু করতে পারবে না, যার ফলে অন্য রাষ্ট্রের সে অঞ্চলে যেন নৌচলাচল করতে এবং আকাশপথে বিমান চলাচল করতে পারে। এর সাথে সমুদ্রে তার ও পাইপ লাইন স্থাপনে বাধাপ্রাপ্ত না হয়। তাছাড়া উপকূলীয় রাষ্ট্র ওই অঞ্চলে কোন দ্বীপ বা অন্য কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কিছু স্থাপন করতে পারবে না। সোজা কথায় উল্লেখিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে উপকূলীয় রাষ্ট্রের কিছু একান্ত অধিকার থাকলেও, বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের অধিকার থাকবে উক্ত অঞ্চলে অবাধ নৌ-চলাচলের, আকাশে বিমান চলাচলের, তার এবং পাইপ লাইন বসানোর। এতে উপকূলীয় রাষ্ট্র বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না। ১৯৮২ সালের কনভেনশন পুরানো প্রথাগত আইনকেই এ মর্মে বিধিবদ্ধ করলো যে- কোনও দেশ সমুদ্রের একচ্ছত্র দাবিদার হতে পারে না। মহাসমুদ্রের স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা নিম্নরূপ :

১. অবাধ নৌচলাচলের স্বাধীনতা;

২. অবাধ মাছ ধরার স্বাধীনতার (২০০ মাইল একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরে);

৩. সমুদ্রের তলদেশে তার এবং পাইপ স্থাপনের স্বাধীনতা, এমনকি ২০০ মাইল একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যেও

৪. আকাশে উড়োজাহাজ চলাচলের স্বাধীনতা।

এছাড়া সমুদ্রের তলদেশে যে সম্পদ রয়েছে তাকে সমগ্র মানব জাতির ঐতিহ্য বলে ঘোষণা করে বলা হয়েছে সব দেশ সমুদ্র তলদেশের সম্পদের মালিক। এজন্য জাতিসংঘ একটি কমিটি গঠন করেছে, যাতে বাংলাদেশ ও রয়েছে। 

দুইটি দেশ যদি উপকূলীয় দেশ হয় তাহলে সমান দূরত্ব বা Equi-Distance তত্ত্ব বিরাজ করে, যেটি নিয়ে গ্রিস ও তুরস্কের বিবাদ।

উপরের বর্ণনা থেকে এটি অতি পরিষ্কার যে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাবি সম্পূর্ণরূপে আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থি। তাছাড়া চীন সে এলাকায় যে সমস্ত কার্যকলাপ দ্বারা অন্য দেশের নৌচলাচল, উড়োজাহাজ চলাচলসহ অন্যান্য অধিকারে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে তাও সম্পূর্ণ বেআইনি। চীনের এ ধরনের কার্যকলাপ বাংলাদেশসহ অন্য দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে, যার জন্য বাংলাদেশসহ সব রাষ্ট্রেরই চীনা দাবি ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া প্রত্যাশিত।

সম্প্রতি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় সবার স্বার্থরক্ষায় কাজ করতে আগ্রহী। এটি নিশ্চিতভাবে একটি স্বাগতিক বার্তা, যার দ্বারা দক্ষিণ চীন সাগরে বাংরাদেশের স্বার্থেও রক্ষিত হবে।