করোনাভাইরাস: অস্ট্রেলিয়া কি বর্ণবাদী আচরণ করছে?

শুভংকর বিশ্বাস
Published : 10 May 2021, 10:20 PM
Updated : 10 May 2021, 10:20 PM

আন্তর্জাতিক খবরাখবর যারা চোখ রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, ভারতের কোভিড রোগীর সংখ্যা এবং ভয়াবহতা তীব্র হওয়ার কারণে অস্ট্রেলিয়া সরকার গত ২৭ এপ্রিল থেকে দুই সপ্তাহের জন্য ভারতে অবস্থানরত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরে আসার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পাশাপাশি আইন করা হয়েছে যে, ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়ার কোনও নাগরিক সরাসরি অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসলে তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে ৬৬ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা করা হবে অথবা সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে, অথবা তিনি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত আনুমানিক নয় হাজার অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ভারতে আটকা পড়ে আছেন, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ভারতীয় বংশদ্ভুত।

দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, "ভারত থেকে আসা নাগরিকদের কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার হার বিপদজনকভাবে বেশি হওয়ার কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।"

প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন গণমাধ্যমে বলেছেন যে, তার সরকার দেশটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার উপদেশ অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পল কেলি প্রধানমন্ত্রী মরিসনের এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন- তিনি কেবল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন এর যথাযথ প্রক্রিয়া এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরিস্থিতি সরকারের কাছে তুলে ধরেছেন। কোভিড সংক্রমণ রোধে কোনও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে সরকারকে সুপারিশ করেননি।   

অস্ট্রেলিয়া সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে প্রথম সারির বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া থেকে শুরু করে সচেতন অস্ট্রেলিয় নাগরিকরা মরিসন সরকারের তীব্র সমালোচনা করছেন। গ্রে নিউম্যান নামক ৭৩ বছর বয়সী এক অস্ট্রেলিয় নাগরিক এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সরকারের বিরুদ্ধে ফেডারেল কোর্টে নাগরিক অধিকার আইনে মামলা ঠুকে দিয়েছেন, যিনি গত বছরের মার্চ মাস থেকে ভারতে আটকা পড়ে আছেন। নিউম্যান সাহেবের আইনজীবী ক্রিস ওয়ার্ড এ ঘটনাকে 'আইন বহির্ভূত ও সরকারের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শন' বলে অভিহিত করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার পাসপোর্টের প্রথম পৃষ্ঠায় স্পষ্টভাবে খোদাই করে লেখা আছে-

The Commonwealth of Australia requests all those whom it may concern to allow the bearer, an Australian citizen, to pass freely without let or hindrance and to afford him or her every assistance and protection of which he or she may stand in need.

অস্ট্রেলিয়া সরকারের এ হঠকারী সিদ্ধান্ত তাই নিউম্যান সাহেব ছাড়াও বঞ্চিত ও সচেতন নাগরিকদের প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করেছে। যদিও নিউম্যানের এ মামলাটি ধোপে টেকার সম্ভাবনা কম। কারণ, অস্ট্রেলিয়ার সংসদ গত বছরে কোভিড মহামারীর শুরুতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে জৈব নিরাপত্তা বলয়ের অধীনে যেকোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আদালতে গিয়ে আপত্তি জানানো, মিডিয়ার চাপ ইত্যাদি কারণে সরকার তার নিজ অবস্থান থেকে পিছু হটবে। তার কিছু নমুনাও ইতোমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। 

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনু্যায়ী, প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ভারতীয় বংশদ্ভুত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের টার্গেট করে ফেইসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন রাজনৈতিক ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে তিনি ইংরেজি ভাষায় একটি, হিন্দি ও পাঞ্জাবি ভাষায় সাব-টাইটেল দিয়ে অপর দুইটি- মোট তিনটি বিজ্ঞাপন তৈরি করে ফেইসবুকে প্রচার করেছেন। প্রায় নয় মিনিট দীর্ঘ এসব ভিডিওটিতে তিনি ভারতীয় জাতিকে একটি উদার ও দয়ালু জাতি হিসেবে অভিহিত করে ভারতে আটকে পড়া নাগরিকদের দ্রুত ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। 

উল্লেখ্য যে, অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় তিন শতাংশ ভারতীয় বংশদ্ভুত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক বাস করেন। ভোটের বিচারে এদেরকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কেননা, অস্ট্রেলিয়ায় মূল দুই রাজনৈতিক দল, লিবারেল ও লেবার পার্টি- কেউই খুব বড় ব্যবধানে জিততে পারে না।

তবে ভারতের সাথে ফ্লাইট বন্ধ ও দেশটি থেকে আগত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিদের জেল-জরিমানা করার ঘোষণা দেওয়ার ফলে মরিসন সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছে 'বর্ণবাদী' আচরণের অভিযোগ। আর এটি তাদের সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় ফেলেছে।  

কারণ এর আগে ভারতের মতো করোনাভাইরাসের কেন্দ্রস্থল হওয়ার পরও যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা কোনও ফ্লাইট বন্ধ রাখেনি অস্ট্রেলিয়া। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে যখন ইংল্যান্ডে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন পাওয়া গেল, তখন ইউরোপ, কানাডা ও এশিয়ার ৩০টিরও বেশি দেশ ইংল্যান্ডের সাথে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। অস্ট্রেলিয়াতেও যখন ইংল্যান্ডের সাথে ফ্লাইট বন্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রফেসর কেলি সাহেবই তখন বলেছিলেন, "বর্তমান ও অদূর ভবিষ্যতে ইংল্যান্ডের সাথে অস্ট্রেলিয়ার যোগাযোগ বন্ধ করার কোন পরিকল্পনা আমাদের নেই"। 

কারন হিসেবে তিনি বলেছিলেন, "আমাদের কোয়ারেন্টিন সিস্টেম খুবই নিরাপদ এবং কার্যকরী।"

স্বাস্থ্যমন্ত্রী গ্রেইগ হান্ট বলেছিলেন, "আমাদের কোয়ারেন্টাইন সিস্টেম বিশ্বের সেরাদের কাতারে, যা অস্ট্রেলিয়াকে নিরাপদ রাখবে।"

একই বক্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বেলাতেও। অথচ ভারতের বেলাতেই তাদের যত অস্বস্তি।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ওপর চালানো বেশকিছু জরিপ ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেও কেউ কেউ  অস্ট্রেলিয়া সরকারের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ তুলেছেন। 

গত ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস অঙ্গরাজ্য কোয়ারেন্টিনে থাকা যতজন মানুষের কোভিড-১৯পজিটিভ এসেছিল, তার মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ব্যক্তিই ছিলেন ৪১ শতাংশ। আর এ এপ্রিল মাসে যখন ভারতের করোনার প্রকোপ তীব্র, তখন একই অঙ্গরাজ্যে মোট আক্রান্তের মধ্যে ভারত থেকে আসা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা মোট রোগীর মাত্র ২১ শতাংশ। আবার নিজ নিজ দেশে করোনাভাইরাসের সর্বোচ্চ প্রকোপের সময় মাথাপিছু কোভিডে আক্রান্তের সংখ্যাও বলে দিচ্ছে- ভারত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অস্ট্রেলিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি এক ছিল না। করোনার সর্বোচ্চ পিকের সময় যথাক্রমে যুক্তরাজ্যে আক্রান্তের পরিমাণ ছিল প্রতি মিলিয়নে ১০০৪ জন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মিলিয়নে ৯০৭ জন, আর ভারতে প্রতি মিলিয়নে ২২৫ জন।

এত পরিসংখ্যান থাকা সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়ার অনেক বিশেষজ্ঞ গণমাধ্যমে বলছেন, ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার সরকারি উপাত্তের চেয়ে ঢের বেশি। সরকার সে আশংকাকে বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েই ভারতের ব্যাপারে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

অস্ট্রেলিয়ার এসব বিশেষজ্ঞদের কাছে ভারতের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটটা পুরোপুরি উপেক্ষিত থাকছে। যেমন- ভারতে এককভাবে একটা কক্ষে (আলাদা বাথরুমসহ) আইসোলেশনে থাকতে পারে এমন পরিবারের সংখ্যা অন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। ফলে এরকম ছোট পরিসরে বসবাসরগত কোনও পরিবারের একজন আক্রান্ত হলে ওই পরিবারের সবার সংক্রমিত হওয়ার কথা। আবার মৃত্যুর সংখ্যাও যদি ধরি, ভারতে কতজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সুচিকিৎসা পেয়ে মৃত্যুবরণ করছেন, যেটা নিশ্চিত করছে অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলো? সুতরাং অস্ট্রেলিয়া  সরকার কি পারে তাদের নিজেদের নাগরিকদের এমন একটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে?

আমি ভারতের গুণগান করার জন্য লিখতে বসিনি। নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও বাদ যায় না। মনে করার কোনও কারন নেই যে, ভারতের জায়গায় বাংলাদেশ বা চীন হলে অস্ট্রেলিয়ার আচরণের কোন পরিবর্তন হতো।

যাই হোক, তবে আশার কথা হলো, অস্ট্রেলিয়া সরকার এখন আর তার নিজের অবস্থানে নেই। অস্ট্রেলিয়ার এবিসি, এসবিএস, চ্যানেল ৯, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান ইত্যাদি বাঘা বাঘা সংবাদ মাধ্যম মরিসন সরকারের এ সিদ্ধান্তকে বর্ণবাদের সাথে তুলনা করায় সরকার এখন কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। সাথে লেবার পার্টি, গ্রিন পার্টিসহ সংসদের বিভিন্ন বিরোধী দলগুলোর তোপের মুখে লিবারেল সরকার ভারত থেকে নিজ দেশের নাগরিকদের যত দ্রুত সম্ভব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যে তারা ২০০০ শয্যার অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরির হাওয়ার্ড স্প্রিং কোয়ারেন্টাইন ফ্যাসিলিটিটি ঢেলে সাজাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, ১৫ মে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হলেই এই প্রত্যাবর্তনের কাজ শুরু হবে।

এক দশক ধরে অস্ট্রেলিয়ায় থাকায় আমার ব্যক্তিগত অভিমত, অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ রাজনীতিবিদ রাজনীতিকে শুধু একটি চাকরি হিসেবে বিবেচনা করে। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সবকিছুই নিয়মমাফিকভাবে চলায় সংসদ সদস্যদের খুব বেশি ক্যারিশমেটিক হওয়ার প্রয়োজন হয় না, রুটিন দায়িত্ব পালন করলেই চলে যায়। এছাড়া এখানকার রাজনীতিবিদদের 'বুশ ফায়ার' বা 'জঙ্গলে দাবানল' ছাড়া অন্য কোন দূর্যোগ মোকাবেলা করতে হয় না- বলে তারা নতুন সমস্যা সমাধানে অনভিজ্ঞ। 

তাছাড়া অনভিজ্ঞতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে রেজিস্টার্ড ১৪ হাজার অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার হিমসিম খাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো সুযোগ-সুবিধা থাকলে, বাংলাদেশের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাই এ জাতীয় সমস্যার সমাধান করে ফেলতেন, সংসদ পর্যন্ত যাওয়া লাগতো না বলেই আমার মনে হয়। 

আপাত দৃষ্টি মনে হচ্ছে, করোনাভাইরাস মোকাবেলা করতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সরকার আজ বড় ক্লান্ত। তাই আমি বর্ণবাদের অভিযোগ থেকে রাজনীতিবিদদের দায়মুক্তি দেওয়ার পক্ষে। যদিও সরকারকে নানা পরামর্শ দিয়ে বিভিন্ন সময়ে সাহায্য করা এদেশের বিভিন্ন সংস্থার প্রধান বা আমলাদের ব্যাপারে আমার এলার্জি রয়েই গেছে।