‘টাকাওয়ালার বিচার হবে না’!

রাশিদুল রাশেদ
Published : 7 May 2021, 11:36 AM
Updated : 7 May 2021, 11:36 AM

ইংরেজি Technocracy শব্দটির বাংলা পরিভাষা 'বিশেষজ্ঞতন্ত্র', যার মানে যারা যে বিষয়ে জানেন, যে বিষয়ে যাদের দক্ষতা রয়েছে, তারাই কেবল সে বিষয়ে কাজ করতে পারে। কেননা অন্যজন করতে গেলেই অনর্থ ঘটে। এ তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অর্থনীতিবিদ- থর্সটাইন ভেবলেন।

শব্দটির ব্যবহার অবশ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই করা হয়েছে। নিরঙ্কুশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রাষ্ট্রে এ বিশেষজ্ঞতন্ত্রের ব্যবহার রয়েছে। বর্তমানে যদিও পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতান্ত্রিক আদলে পরিচালিত, কিন্তু রাষ্ট্রের শাসনে যথেষ্ট বিরোধ, চরম মতদ্বৈততা, চরম বিষাদ, চরম অসন্তোষ, চরম অরাজকতা, সীমাহীন দুর্নীতি, অবাধ ঘুষ লেনদেন, লুটপাট, বহিঃদেশে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ পাচার, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কালোবাজারি হচ্ছে। এর কারণ রাষ্ট্র শাসনে যারা দক্ষ, যারা অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি, শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি ও আধুনিক যন্ত্রকৌশলে দক্ষ, সেসব বিশেষজ্ঞদের বদলে গলাবাজি, চাপাবাজী, তোষামোদী, তৈলমর্দনকারী, বক-রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্রশাসনকে একচেটিয়া করে দখলে নিয়েছে। কাজেই রাষ্ট্রে দুর্নীতি বেড়েছে, যা লাগামহীন-নির্লজ্জ। ফলে রাষ্ট্রে অরাজকতা, বিচারহীনতা, সুশাসন নিশ্চিত না হওয়ার অস্থিরতা বিরাজ করছে। যা সুশাসনের অঙ্গীকার নয় বরং নাগরিক অধিকার হরণ হয় এবং হয়রানির শিকার হয় প্রতিনিয়ত।

এমনটি আমার বঙ্গরাষ্ট্রেও যেন হুবহু মিলে যায়। কয়েকদিন আগে রাজধানীর গুলশানের বাসায় মোসারাত জাহান মুনিয়া নামের এক তরুণীর আত্মহত্যা অথবা হত্যা প্ররোচনার অভিযোগ কিংবা এফআইআর-এ বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে আসামি করা হয়েছে। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের বা অপরাধের বিচার হবে না বলে ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিড়িক পড়েছে। কেউ কেউ এথেন্সের মহামতি দার্শনিক সক্রেটিসের আইন সম্পর্কিত ডায়লগ উপস্থাপন করে যুক্তি উপস্থাপন করছেন। যেমন তিনি বলেছিলেন- "যার টাকা আছে তার কাছে আইন খোলা আকাশের মতো, যার টাকা নেই তার কাছে আইন মাকড়সার জালের মতো।" কথাটি প্রাচীন গ্রীসের নগর রাষ্ট্রের জন্য খুবই স্বাভাবিক হলেও বর্তমানের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেন অস্বাভাবিক। যদিও তখনকার নগররাষ্ট্রগুলো গণতান্ত্রিক ছিল এবং পাশাপাশি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রও ছিল। কিন্তু আধুনিককালের রাষ্ট্রে আইন টাকার জোরে হাঁটতে থাকবে! যা মোটেও কাম্য নয়। 

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলে যে বিষয়টি কাজ করে- তা হলো রাজনৈতিক শাসন। তথা রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার স্থানে যদি বিশেষজ্ঞদের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হতো, তাহলে রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা, নৈতিকতা, স্বাভাবিকতাসহ সহনশীলতা প্রত্যাবর্তন হতো। ফলে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হতো। কেননা দক্ষ ব্যক্তি সাধারণত ব্যক্তিজীবনে সৎ হন। অসততা কায়েমে বিশ্বাসী হন না দক্ষ রাজনীতিক। দক্ষতার এটাই যেন স্বাভাবিক গুণ বা বিষয়। সুতরাং রাষ্ট্রে ওই পর্যায়ের লোকজন দক্ষ ও সৎ হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হতো। সাধারণ মানুষও টাকাওয়ালার বিচার হবে না বলে অগ্রিম মন্তব্য করতো না। "টাকার জোরে আইন লড়ে"- এ কথাও উল্লেখ হতো না। ফলে আমরা যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মানুষের বিচারের প্রতি অনীহা বা বিচার না হওয়ার আশংকা নিয়ে যে হাজারো বক্তব্য দেখতে পেলাম- তা আমাদের দেখতে হতো না। 

মোসারাত জাহান মুনিয়ার মামলায় পুলিশ যথেষ্ট উদ্যোমী ভূমিকা এখন পর্যন্ত পালন করলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা রয়েছে। তাদের আশঙ্কা- এ হত্যার বিচার হবে না। যেহেতু রাষ্ট্রে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার তদন্ত ও রায় সুদীর্ঘকালেও হয়নি সেহেতু জনগণের এ আশঙ্কা একেবারে অমূলকও বলা যায় না। 

উদাহরণ হিসেবে টানা যেতে পারে- পুলিশের তদন্তাধীন বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যামামলা। তাই সাধারণ মানুষ পুলিশের তদন্ত অধীন মামলার বিচার হবে না বলে যুক্তি উপস্থাপন করেছে বিভিন্নভাবে।

মিডিয়া গণিত

দিন দিন সাধারণ বাঙালির লোভের মাত্রা অশ্লীলতাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। একটা বড় অংশের বাঙালির মধ্যে- 'সাদাকে সাদা, কালোকে কালো' বলতে না পারার ইচ্ছাটার পেছনেও লোভ কাজ করে। অবশ্য মানুষের চরিত্রে লোভ সক্রিয় থাকবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। 

যদি অতিরিক্ত লোভের বদলে যদি আমাদের মধ্যে সাধারণত মাত্রার লোভও কাজ করতো তাহলে আমরা কিছু যুক্তির ধার ধারতাম। কিন্তু অতিরিক্ত লোভ আমাদের নীতি-নৈতিকতাহীন নষ্ট সমাজের অংশীদারী বানিয়েছে। এর দায় অবশ্য স্বয়ং রাষ্ট্রের। তাই সাধারণ মানুষ আজ বলছে যে, আইন সবার জন্য সমান নয়, মিডিয়া সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত নয়, মিডিয়া সিন্ডিকেট সদস্যদের স্বার্থে উন্মুক্ত হতে পারে না, ব্যক্তি স্বার্থের জন্য মিডিয়া ব্যবসায়ী বনেছে অনেকে ইত্যাদি ইত্যাদি। 

এখানে যেন মালিকানা স্বত্ব অধিকার কিনেছে মিডিয়ার উন্মুক্ত স্বাধীনতার। ভাবতে খুব অবাক লাগে যে, এখানে মিডিয়ার মালিকানা অর্জন হলো মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ অটুট রাখার কৌশল। কী আশ্চর্য জাদুকরী নিয়ন্ত্রণ! মিডিয়ার আলাদা যেন কোনও রাষ্ট্রীয় আইন নেই! আলাদা স্বাধীনতা নেই! অবশ্য থাকলেও লাভ নেই। বঙ্গরাষ্ট্র এমন প্রথা তৈরি করে নিয়েছে বলেই টাকার মালিকরা মিডিয়া মালিক, মিডিয়া ব্যবসায়ী, মিডিয়া সিন্ডিকেট। নিজেরা মহা অন্যায়কারী, অপরাধী হলেও গণমাধ্যম সেসব ঘটনা ধামাচাপা দিতে চাইবে। সে সুযোগে অপরাধ সম্রাট বনে এরা। এ রাষ্ট্রে টাকা,ক্ষমতা, গণমাধ্যম এ তিনের যোগে তৈরি হয় 'গড ফাদার'। এ রাষ্ট্র এমন বহু 'গড ফাদার' জন্ম দিয়েছে। ফলে আইন বিকল হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। বিশেষত 'গড ফাদার'দের অপরাধের বা মহা অপরাধের বিষয়ে। তাই জনগণ আজ মনে করছে- ওদের অপরাধের বিচার হবে না। কেননা এ রাষ্ট্র অতীতে এমন বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বিচার করতে পারে নি। অর্থাৎ সে অভ্যস্ততায় রাষ্ট্র নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যথেষ্ট ব্যর্থ।

বাংলাদেশে বিচার নিয়ে প্রহসনের ব্যাপারটি আসলে ঐতিহ্যগত বলেই মাঝে মাঝে মনে হয়। এ রাষ্ট্র জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলদারদের অর্থাৎ স্বৈরশাসকদের বিচার তো করতেই পারেনি। সুতরাং বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রভাবে সাধারণ মানুষ ক্ষমতাধরদের, টাকাওয়ালাদের বিচার হবে না বলেই ধরে নিয়েছে।

অর্থনীতিবিদ থর্সটাইন ভেবলেনের বিশেষজ্ঞতন্ত্র পুঁজিবাদকে আরও বিকাশ করে বলে অনেকেই মত পোষণ করেন। কিন্তু আজ এ বঙ্গরাষ্ট্রে পুঁজিবাদ সবকিছুকে পণ্য বানিয়ে রেখেছে! যেমন- সাংবাদিকদের লেখনী কিভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে, তাও যেন পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রণ করে। একটু তেতো সত্য উপস্থাপিত হলেই বিজ্ঞাপন বন্ধ, বেতন বন্ধ, অনুদান বন্ধ, হেন বন্ধ, তেন বন্ধ ইত্যাদি পর্যায়ে চলে যায় পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য। তাইতো পুঁজিবাদের ভোগবাদী সমাজ বড়ই অস্থির। সে দৌরাত্ম্যই হয়তো গুলশানের তরুণীর লাশ সম্পর্কিত অপরাধীর ছবি ব্লার হয়!