ডেমোক্রেট-রিপাবলিকান দ্বৈরথ

দেলোয়ার হোসেন
Published : 7 May 2015, 03:24 PM
Updated : 6 Nov 2012, 09:42 PM

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে উত্তেজনা ও আগ্রহ লক্ষ্য করার মতো। বিশেষ করে ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর, বিশ্বায়নের প্রভাবে পুরো বিশ্ব একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। এরপর থেকে বিশ্বের দেশে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে উৎসাহ বেড়ে গেছে। উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত সব দেশের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।

পাশাপাশি, এ সময়ের মধ্যে গণমাধ্যমেরও বিরাট বিকাশ হয়েছে যার ফলে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ বিশ্বকে আলোড়িত করছে। আর তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহটাও নানাভাবে পল্লবিত হয়েছে।

আরও কিছু কিছু দিকও এ নির্বাচনকে বিশ্বজুড়ে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। যেমন, এ নির্বাচনের ধরন ও কৌশল। দু'দলের প্রার্থী-নির্বাচন নিয়ে আঠারো মাস ধরে চলেছে তুমুল আলোচনা। আবার দু'দল যখন প্রার্র্থী-নির্বাচন চূড়ান্ত করেছে তখন স্ব-স্ব দলের পক্ষে প্রচারণার ক্ষেত্রে তাদের কৌশল ও প্ল্যাটফর্ম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে দেয়। ওদিকে ১৯৬২ সাল থেকে মার্কিন নির্বাচনের দুই প্রেসিডেন্ট-প্রার্থী সরাসরি টেলিভিশন-বিতর্কে অংশ নেন। এটাও চারদিকে একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে।

তাছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি। এই দেশটি বিশ্বে একক আধিপত্য ধরে রেখেছে। তাই এ দেশের নির্বাচন নিয়ে সমগ্র বিশ্বেই মানুষ আগ্রহ অনুভব করে। এটা যেমন তৃতীয় বিশ্বের বেলায় সত্য, তেমনই ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর বেলায়ও। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল পদে একজন ডেমোক্রেট না একজন রিপাবলিকান বসবেন সেটার ওপর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আসবে।

সব মিলিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন এর বর্ণাঢ্যতা, আয়োজন, নির্বাচনী কৌশল এবং গণতান্ত্রিক মহিমা নিয়ে বিশিষ্ট।

এ নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী দুটি রাজনৈতিক দরের দুজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ডেমোক্রেটরা উদারপন্থী এবং রিপাবলিকানরা রক্ষণশীল বলেই পরিচিত। তবু অন্যান্য বিশ্বের ক্ষেত্রে নির্বাচনের লড়াইয়ে অবতীর্ণ দু'প্রার্থীর অনুসৃত নীতিমালায় খুব বেশি পার্থক্য থাকার কোনও সুযোগ নেই। কারণ একক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাইরের বিশ্বে আধিপত্য ও কর্তত্ব ধরে রাখতেই চাইবে। তাই কী ডেমোক্রেট কী রিপাবলিকান- পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে দু'দলের নীতিমালায় মৌলিক কোনও পার্থক্য থাকবে না।

পার্থক্য যেটি হবে তা হল কৌশলে বা আচরণে। দুটি দল কিছুটা ভিন্নভাবে তাদের বৈরী, মিত্র এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে আচরণ করে। এ ক্ষেত্রে দল দুটির দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা পার্থক্য অবশ্যই থাকে।

যেমন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র সবসময়ই। তবে এ দেশের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে রিপাবলিকান আর ডেমোক্রেটরা ভিন্নভাবে এগোয়। ইরানের পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠার বিষয়টি দুটি দলের জন্যই উদ্বেগের বিষয়। তবু ইরানের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিয়ে দু'দল কাজ করবে। ইরাক-আফগানিস্তান প্রসঙ্গেও দু'দলের কলাকৌশল আলাদা। আরব বিশ্বের বর্তমান পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্র কী ভূমিকা রাখবে এ নিয়ে দু'দলের কৌশলগত পার্থক্য রয়েছে।

একইভাবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিকেও মার্কিন প্রশাসন কম গুরুত্ব দেয় না। এ সব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও আধিপত্য অক্ষুন্ন রাখার পদ্ধতি নিয়ে দুটি প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হবে।

নয়-এগারোর পর বুশ-প্রশাসনের ঘোষিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যে লিগ্যাসি- এর ধারাবাহিকতায় গুয়ানতানামো বে'তে সন্দেহভাজনদের আটকে রাখা হত। এ সময় তাদের ওপর এত বেশি নিপীড়ন করা হত যে ওখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছিল বলে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ হয়েছে। ওবামা ক্ষমতায় এসে গুয়ানতানামো বে বন্ধ করে দিলেন। তার মানে কি এই যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ওবামা সেখান থেকে সরে এসেছেন? তা নয়।

তার মানে, ওবামা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কৌশলে পরিবর্তন এনেছেন বা আনবেন, যুদ্ধটি ত্যাগ করবেন না অবশ্যই। এমনতরো সব বিষয়েই রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটদের পার্থক্য।

মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন নিয়ে এ সব ব্যাপার তো রয়েছেই। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতিমালার পরিবর্তন নিয়েও বাইরের বিশ্বে কিছু কিছু উদ্বেগ লক্ষ্য করা যায়।

এমন নয় যে ওখানকার অভ্যন্তরিণ নীতিমালা সরাসরি আমাদের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অবস্থায় কোনও পরিবর্তন আনবে। তবে 'অভিবাসীদের দেশ' হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিমালা নিয়েই আমাদের বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর আগ্রহ বেশি। ঐতিহ্যগতভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নেয়া জনগোষ্ঠী ডেমোক্রেটদের বেশি সমর্থন করে। কারণ অভিবাসী প্রশ্নে ডেমোক্রেট সরকারগুলো তুলনামূলক উদার।

বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজেও একজন অভিবাসী পিতার সন্তান। ফলে তাঁর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দুর্বলতা রয়েছে। শুধু তাই নয়, বাইরের বিশ্বেও তিনি অনেক বেশি জনপ্রিয়। কয়েক মাস আগে মার্কিন নির্বাচনের দু'প্রার্থীর জনপ্রিয়তা যাচাই করতে বিশ্বের ২১ দেশে একটি জরিপ চালানো হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে, ওবামা বিশটি দেশেই রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনিকে বিরাট ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। ওবামার ব্যক্তিগত পরিচিতি ও ইমেজই এর কারণ। সমগ্র বিশ্বে মার্কিন-বিরোধিতা এমনিতে প্রবল হলেও ব্যক্তি ওবামা এ সব ছাপিয়ে উঠেছেন, জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন।

ওবামার আফ্রিকান অরিজিন, মুসলিম পিতার পরিচিতি, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে বেড়ে ওঠা, একটি ব্রোকেন ফ্যামিলি থেকে উঠে এসে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, পরবর্তীতে শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ হিসেবে বিরাট সাফল্য মানুষকে তাঁর সম্পর্কে সবসময়ই আকৃষ্ট করেছে।

এ প্রেক্ষিতেই নির্বাচনের ফলাফল প্রসঙ্গে আমার কিছু হিসেব-নিকেশের কথা বলব। বড় কোনও অঘটন না ঘটলে ওবামাই আবার নির্বাচিত হবেন এমন সম্ভাবনাই বেশি। তবে এখানে দুটো প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেই হবে। নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরুর আগে কিন্তু রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি ওবামার তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, ওবামার সঙ্গে ব্যবধানটা কমিয়ে এনেছেন। এর ফলে এবারের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরির ক্ষেত্রে অবশ্যই রমনির একটি অবদান রয়েছে।

এভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করে, নির্বাচনে নাটকীয়তা এনে রমনি যেভাবে এগিয়ে এসেছেন তাতে অবশ্যই তাঁরও একটি সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সে সম্ভাবনা কম দুটি কারণে। প্রথমত, ৪০ শতাংশ ভোট আগাম দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এই ভোটের ৫৪ শতাংশ পেয়ে ওবামা এগিয়ে রয়েছেন। ওদিকে মার্কিন নির্বাচনে 'দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য' হিসেবে পরিচিত ওহাইও এবং ফ্লোরিডায় ওবামা আগেরবারও অনেক বেশি ভোট পেয়েছেন। ওহাইও'র মোট ভোট ১৮ এবং ফ্লোরিডার ২৯। তাই মার্কিন নির্বাচনে এ দুটি অঙ্গরাজ্যের প্রভাব অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ সব রাজ্যে ওবামার জনপ্রিয়তা কমলেও তিনি হেরে যাবেন এমনটি কিন্তু নয়।

মনে রাখতে হবে, ২৭০ ইলেকটোরেল ভোট পেলেই একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন। সেখানে ওবামা ২০০৮ সালের নির্বাচনে পেয়েছেন ৩৬৫ ইলেকটোরেল ভোট। ফলে তাঁর ভোট কমলেও সেটা নির্বাচনে জেতার জন্য যথেষ্ট হবে বলেই বিশ্লে¬ষকদের মত। তবে নির্বাচনে রমনি জিতে গেলে সেটা বেশ নাটকীয় একটি ব্যাপারই হবে।

রক্ষণশীলরা নানা কারণেই ওবামার নীতিগুলোর প্রবল বিরোধী। গর্ভপাত প্রশ্নে ডেমোক্রেটরা উদার। রক্ষণশীলরা এ ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর। ওবামার স্বাস্থ্যনীতির কঠোর সমালোচক রক্ষণশীলরা। অথচ মজার ব্যাপার হল, গভর্নর থাকার সময় মিট রমনি নিজে ওবামার স্বাস্থ্যনীতির অনুরূপ নীতির কথা বলেছিলেন। এখন যেহেতু তিনি রিপাবলিকানদের প্রার্থী- তাই এ নিয়ে আর কথা বলছেন না।

ওবামার কিছু কিছু অর্থনৈতিক নীতিরও কড়া সমালোচক রক্ষণশীলরা। যুক্তরাষ্ট্রের এলিট কর্পোরেট শ্রেণিটি সবসময় রিপাবলিকানদের নীতির দ্বারা উপকৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশাল সামরিক শিল্পগুলো আছে এগুলোর প্রভাবশালী মালিকদের কর রেয়াত দেওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ করে দেন রিপাবলিকানরা।

এমনকী রিপাবলিকানদের আন্তর্জাতিক পলিসিও এ জন্যই যুদ্ধের পক্ষে যায়। রিপাবলিকানদের ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থেই এটা করতে হয়। তবে আসলে এর পেছনে কাজ করে কর্পোরেট স্বার্থ। ওয়াল স্ট্রিট ওই বিশাল কর্পোরেট শ্রেণিরই দখলে। ওবামা এর কঠোর সমালোচনা করেছেন অতীতে। এখনও করছেন। কিন্তু রিপাবলিকানরা তা কখনও-ই করবেন না।

জুনিয়র জর্জ বুশ যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তখন 'নিউ-কন' বলে একটি গ্রুপ গড়ে উঠেছে যারা অতি-রক্ষণশীল। সাবেক প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ ছাড়াও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কনডোলিৎসা রাইস এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড এ গ্রুপটির নেতৃত্ব¡ দিচ্ছেন। ওরা শুধু বুশের সময়ে নয়, ওবামার সময়েও মার্কিন রাজনীতিতে বিরাট প্রভাব রেখেছেন। তাই এ হিসেবগুলো একেবারে বাদ দেওয়া যাবে না।

আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই আমরা জানতে পারব কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তাহলেই বোঝা যাবে আগামী দিনগুলোতে একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোথায় কীভাবে ভূমিকা রাখবে।

দেলোয়ার হোসেন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক।