‘মামু’-র জোর কিংবা নিজের পায়ে দাঁড়ানো

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 29 April 2021, 09:21 AM
Updated : 29 April 2021, 09:21 AM

'বাঘ শিকার যাইমু/বন্দুক লইয়া রেডি হইলাম আমি আর মামু! মামু আমার বেজায় রসিক কেন করে খামু খামু'?

যদিও কয়েক দশক আগে এই গান জনপ্রিয় হয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ করে মানুষজন বলা শুরু করেছে যে 'মামা' শব্দটা সামান্য বদলে দেওয়ার পেছনে হেফাজতের জেলবন্দী নেতা 'মামু'নুল হকের খানিক অবদান আছে। ভদ্রলোক ২০২১ সালের এপ্রিলে (২০২১ এর ১৪ এপ্রিল বিশেষ কারণে বিখ্যাত হয়ে থাকবে। প্রথম রোজা, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন এবং করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ উপলক্ষে লকডাউনের প্রথম দিন ছিল ১৪ এপ্রিল) গ্রেপ্তার হন। এর আগে অবশ্য ভদ্রলোক প্রথম স্ত্রী, রিসোর্টে সাথে নেওয়া গার্লফ্রেন্ড বৈধ দ্বিতীয় স্ত্রী, কাবিন নামা, কাপাসিয়ার ভাবী, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য কিংবা গোপনীয়তায় রাষ্ট্র কিংবা ধর্মের হামলে পরার নিদর্শনসহ আরও অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। কেউ কেউ এ গানের প্যারোডি করেছেন এভাবে-

"রয়েল রিসোর্ট যামু/গার্লফ্রেন্ড লইয়া রেডি হইলাম আমি আর 'মামু'!" একালের  লোকজন সম্ভবত গানের কথাটা ভুলে গিয়েছিল। তারা এখন বলছে মামা শব্দটা নাকি তার নামের কারণেই 'মামু'তে রূপান্তরিত হয়েছে!

আমরা প্রথম প্রথম 'মামা'তেই থাকি। হিন্দু পুরাণের কারণে অন্তত 'দুজন মামা' বিখ্যাত হয়ে আছেন। প্রথমজন শকুনী মামা। বিখ্যাত গান্ধারীর ভাই শকুনী! গান্ধারী তার এক মাত্র বোন। শকুনীর আরও ছিল ৯৯ ভাই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বাধানোর পেছনে শকুনী মামার অবদান ছিল মারাত্মক। পিতার হাড় দিয়ে পাশার গুটি বানিয়েছিলেন, দারুণ ক্ষিপ্রতার সাথে পাশার চাল দিতে পারতেন,পাশা খেলায় হারিয়ে দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। শেষরক্ষা হয় নি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সহদেবের তলোয়ারের আঘাতে নিহত হয়েছিলেন শকুনী। কোন যোগসূত্র থাকুক আর না থাকুক আজও এ গান তুমুল জনপ্রিয়- 'আজ পাশা খেলবোরে শ্যাম…'

পাশা খেলুক আর নাই খেলুক পুরাণের আরেক বিখ্যাত মামার নাম 'কংস মামা'। ক্ষতিকারক আত্মীয় হিসেবেই কংসমামার নামটা উচ্চারিত হয়ে থাকে। দৈববাণী থেকে অত্যাচারী রাজা কংস জানতে পারেন তার চাচাতো বোন দেবকীর গর্ভজাত পুত্র কৃষ্ণের হাতেই তার মৃত্যু হবে। এ কারণে ছলে-বলে কৌশলে দেবকীর সন্তানদের হত্যা করতে উদ্যত ছিলেন কংসমামা। তাই কৃষ্ণের জন্মের পরে ভুল তথ্য জানানো হয় সবাইকে, আর কৃষ্ণকে পাঠানো হয় গোকূলে। কৃষ্ণ গোকূলেই বেড়ে ওঠেন। নিয়তির লিখন যেহেতু খণ্ডন করা যায় না, তাই একদিন কৃষ্ণের হাতেই নিহত হন তার কংস মামা। আমরা তাই কবিতায় গড়েছি- 'তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে'! 

আমরা অবশ্য উল্টোভাবে চিন্তা করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের চিরায়াত চেতনা নিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও 'মানবিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ' গড়তে যারা বাধা দেবে তাদের বধ করতে বাংলাদেশে বেড়ে উঠছে অগনিত মানুষ। মানুষ জাগবে ফের। দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে। প্রিয় পাঠক চলুন আপনাদেরও পৌঁছে দেই দু-একটা 'মামা'র রাজ্যে।

পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীন মামার বাড়ি বেড়াতে যেতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। মামা বাড়ির ফল-ফুলুরির মধুর রসে মুখ রাঙাতে বলেছিলেন। মন চাইলে আপনি বা আপনারা ঘৃুরতে যেতে পারেন 'মামা ভাগনের' পাহাড়ে। মামা ভাগনের পাহাড় আছে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের নাগপুরের কাছে। সেখানে আছে বিখ্যাত কালী মন্দির (পাহাড়েশ্বর মন্দির) ও মামা ভাগনের নামে তাল গাছ কিংবা পাথরের বেদী। জনশ্রুতি আছে এ কালী মন্দির নাকি একরাতের ভেতর নির্মাণ করা হয়েছিল। এখানে খাস নিয়তে কিছু চাইলে নাকি সেটা পাওয়া যায়। এ মন্দির কিংবা পাহাড় বীরভূমের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে মেলে না। আরও একটা প্রচলিত জনশ্রুতি এমন- 

রাম যখন সীতাকে উদ্ধারের জন্য লংকা যাত্রা করেছিলেন তখন সমুদ্র পাড়ি দেবার জন্য সেতু তৈরির প্রয়োজন হয়ে পরে। সেতু নির্মাণের পাথর নিয়ে যাবার সময়ে কিছু পাথর বীরভূমের নাগপুরের কাছে যে জায়গায় পরেছিল সেখানেই গড়ে ওঠে মামা-ভাগনের পাহাড়। শত শত বছর পরে মামা ভাগনের পাহাড়ে গ্রাফাইট শিলা পাথরের আধিক্য অনেককেই মুগ্ধ করে। কালী মন্দিরের সামনের একটা বেদিতে পনের ফুট এর মামা পাথর আর বার ফুট লম্বা ভাগনে পাথর কীভাবে একে অন্যকে ধরে আছে সেটা দেখলে অবাক হতে হয়! আছে মামা ভাগনে তাল গাছ, যদিও বাজ পরে মামা তাল গাছটা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। তবু মামা ভাগনে পাহাড় ঘুরে এলে নির্ঘাত ভালো লাগবে আপনার।

ভালো লাগতে পারে যদি যান বিজয় সিংহের সমাধি লাল শাপলার বিলে। সিলেটের জৈন্তাপুরের লাল শাপলার বিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধারণ করে আছে। মেঘালয়ের পাহাড়ঘেরা মুক্তিযুদ্ধের চার নম্বর সেক্টর মুক্তারপুরের খুব কাছেই এই লাল শাপলার বিল। লাল শাপলার বিলে ফুটে থাকা লাখ লাখ শাপলা ও  পদ্মের মাঝে আপনি নিমেষেই হারিয়ে যাবেন। জনশ্রুতি আছে জৈন্তারাজা রামসিংহের মামা বিজয়সিংহকে এই লাল শাপলার বিলে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল।তবু ব্রিটিশদের কাছে হার মানে নি জৈন্তারা। বিজয়সিংহের স্মরণে একটা মন্দিরও আছে সেখানে। শকুনী বা কংসমামার মতো নয় মামা বিজয় সিংহ।

বিজয় সিংহের মতো না হলেও একালের এক বিখ্যাত মামার নাম সোহেল তাজ! সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও তাজউদ্দীন আহমেদের পুত্র সোহেল তাজের এক ভাগ্নে অপহৃত হয়েছিলেন। খবর শুনে বিদেশ থেকে দেশে ফেরেন সোহেল তাজ এবং তার ভাগ্নেকে খুঁজে পাওয়া যায়। সবার নিশ্চয়ই সোহেল তাজের মতো মামা থাকে না। থাকলে অপহৃত বা গুম হওয়া অনেক মানুষকে নিশ্চয়ই ফিরে পাওয়া যেত।

যে মামারা থাকলে ভাগ্নেদের কোন আপদ থাকে না সেই মামাদের প্রয়োজনের সময় হয়তো খুঁজে পাওয়া যায় না। অপহৃত সব ভাগ্নেরা তাই ফিরে আসে না। চাঁদমামা প্রায় রাতে ফিরে আসে পৃথিবীর উপগ্রহ হয়ে। চাঁদমামাকেও মাঝে মাঝে দেখা যায় না। সোহেল তাজের মতো মামারা আলো ছড়াতে পারেন, চাঁদমামাদের নিজস্ব কোন আলো নেই। সূর্যের আলো না পেলে কিংবা আকাশে মেঘ থাকলে চাঁদমামাকে দেখা যায় না! চাঁদকে না দেখলে কবিদের হয়তো মন খারাপ হয়! গান লেখা হয় এভাবে- "মেঘ থাকিলে চান্দের কামাই প্রেমের কামাই নাই!"

দেশপ্রেমেও কোন কামাই কিংবা,জৈবিকতা নেই। শতকরা একশ ভাগ বিশ্বাস বা প্রেম না থাকলে দেশ কিংবা ঈশ্বর প্রেমের পরীক্ষায় পাশ করা যায় না। যে মামারা আলো ছড়াতে পারে না, যে কোন প্রেমের পরীক্ষায় ফেল মারে, ইদানিংকার ছেলে-মেয়েরা হয়তো তাদের আর মামা বলে না,বলে 'মামু'! তাই প্যারোডি ছড়ায় এমন- রয়েল রিসোর্ট যাইমু/গার্লফ্রেন্ড লইয়া রেডি হইলাম আমি আর 'মামু'! 

যদিও বাংলা সাহিত্য,নাটক,সিনেমাতে 'মামা'দের উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে।সেই তুলনায় মামীরা একটু অন্যরকম। তারা কংসমামা কিংবা শকুনী মামাদের পর্যায়ের। অথচ বাংলার জনপ্রিয়তম ছড়ার একটি ছিল এমন-

"তাই তাই তাই/মামা বাড়ি যাই/মামাবাড়ি ভারি মজা কিল চড় নাই! মামী দিল দুধভাত দুয়ারে বসে খাই।" 

হঠাৎ করে ছড়াটা বদলে গেল একসময়। হয়ে গেল- "তাই তাই তাই/মামাবাড়ি যাই। মামা দিল দুধভাত পেটভরে খাই। মামী এলো লাঠিহাতে পালাই পালাই।" 

মামাবাড়ির করুণতম গল্প হচ্ছে রবীঠাকুরের 'ছুটি'। দুরন্ত ফটিক তার মামা বা মামীর মানসিক পীড়ণ নিতে পারে নি। অসুখে ভুগে মৃত্যুর ঠিক আগে ফটিক বলেছিল- মা আমার ছুটি হয়েছে মা! আমি এখন বাড়ি যাচ্ছি!

মামাবাড়ি যাবার সেই আনন্দ বা উচ্ছলতা আগের মতো আছে কিনা সন্দেহ। ব্যান্ড গায়ক মাকসুদ তার এক গানে মামাবাড়ির ছড়াটা অন্যভাবে উপস্থাপন করেছিলেন-

"নাই নাই নাই/সেদিন আর নাই/ মামামামী সব আছে দুধভাত নাই।" 'ফিডব্যাক' ব্যান্ডের এক অ্যালবামে মাকসুদের গানের কথা ছিল এমন-

"শূন্য পৃথিবীতে নিজেকে অসহায় নিঃস্ব মনে হলো/আমি শূন্য হাতে শুধু ঘুরেছি পিছে পিছে পাই নি বাবার আদর/আমি স্বপ্ন ভরা চোখে ছুটেছি যন্ত্রণায় পাই নি মায়ের আদর/তবু তোমার নাম কোথাও ভাঙ্গাইনি রে মামা/আমি তো নিজের পায়ে নিজে দাঁড়িয়েছি রে মামা…"

মামার বাড়ি যাবার সেই আনন্দ কিংবা দুধভাত থাকুক আর নাই থাকুক 'মামার জোর' না থাকলে নাকি এদেশে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পরে। সহসা নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায় না। মামার জোর না থাকলে নাকি চাকরি মেলে না! এ বাস্তবতা যে দেশে সেইদেশে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানোর সাধনাটা ব্যতিক্রমী হলেও একান্ত কাম্য। কোথাও মামার নাম না ভাঙানোটাই যেন শিল্প।

লঞ্চ ডুবে গেলে যেমন 'উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম'কে কাম্য,অপহৃত ভাগ্নেদের জন্য যেমন সোহেল তাজদের মতো মামারা নমস্য,সেখানে কিংবা সেইদেশে 'মামু'নুলদের মতো মামুরা কাম্য নয়! সবচেয়ে বেশি কামনা  বা প্রার্থনা এটাই যে এদেশের সব ভাগ্নেরা যেন মামা আর মামুদের পার্থক্য বুঝতে পারে। তারা যেন মামুদের নাম না ভাঙিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখে।

নিজের পায়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে শিখলেই আঠারো কোটি বাঙালিরে কেউ দাবায়ে রাখবার পারবে না।