স্বাধীনতার এক অগ্রনায়কের বিজয়ের পথে যাত্রা

সৈয়দা রাফিয়া নূর রুপা
Published : 16 April 2021, 02:48 PM
Updated : 16 April 2021, 02:48 PM

২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের এখন ভরা যৌবন, বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে এখন শুধু সামনের দিকে এগিয়ে চলা। জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ এখন আর শুধু কল্পনা নয়, এটি বাস্তবতা। সমগ্র বাঙালি জাতির সাথে আমিও তা নিয়ে আজ খুব গর্বিত।

আমার বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক জীবনের শুরু ছাত্র জীবন থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি একজন তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তুলেছিলেন। গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের সাথে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সংগ্রামে জাতীয় নেতা শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাথে গোড়া থেকেই গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ ভাবনা আমাকে ভীষণ রকম আপ্লুত করে।

বাবার জীবন ছিল অসম্ভব ব্যস্ত তাই বাবার আদর উপভোগ করার সৌভাগ্য খুব বেশি হয়নি আমার জীবনে। তারপর ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর রাতের অন্ধকারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যখন আমার বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তখন আমি নিতান্তই ছোট। কী হয়ে গেছে, কী হারিয়েছি- কিছুই বুঝতে পারিনি তখন। শুধু দিনের পর দিন দেখেছি আমার মায়ের অসহায় বোবা কান্না। আম্মার কান্না খুব কষ্ট দিত আমার ছোট্ট মনে, মনে হতো বাবা এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে আর তাই পথ চেয়ে অপেক্ষা করতাম বাবার ফিরে আসার। সময়ের সাথে ধীরে-ধীরে বুঝতে পারলাম সেদিন কী হারিয়ে ছিলাম এবং আমাদের জীবন কী করুণভাবে বদলে গিয়েছিল।

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর শুভক্ষণে বাবার কথা খুব বেশি মনে পড়েছে। মনে হয়েছে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে এ সময়ে আমার পিতা কি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভয়ংকর একটি অনিশ্চিত সময় পার করছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পরবর্তী দশ-বার দিন ভারত সীমান্ত অতিক্রম করা পর্যন্ত আব্বার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কি অসম্ভব শ্বাসরুদ্ধকর! সে কথাগুলো বারবার মনে হয়ে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আর চোখের পানিতে বুক ভাসছে। সে কথাগুলো মনে হয়ে কেমন যেন এক বেদনা মেশানো ভাললাগা আমার সত্তাকে ঘিরে ধরছে, বাংলার গ্রামগঞ্জের প্রকৃতিটাকে আরও যেন আপন মনে হচ্ছে। 

জীবন বাজি রেখে যারা আমার বাবাকে সে কঠিন সময়ে সহায়তা করেছিলেন তাঁদের কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ। সেসব উদ্যোগের ফলেই তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতির কাছে যে বিশাল দায়িত্বের ওয়াদা করেছিলেন তা নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পেরেছিলেন। 

সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের সেই ঐতিহাসিক শপথ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিশ্ব সেদিন জানলো যে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে একটি নতুন দেশের অভ্যুদ্বয় ঘটেছে। এ নির্বাচিত সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি তার পুরোটি জীবন লড়েছেন বাংলাদেশর ও বাঙালির অধিকার আদায়ের লক্ষে। লড়েছেন  স্বাধীনতা ফিরিয়ে এনে তার প্রিয় জন্মভূমির মাথা উঁচু করতে ও বাঙালির মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষে। হোক না তিনি তখন পাকিস্তানের কারাগারে আটক, তার প্রাণের সহযোদ্ধারা বাংলার মুক্তিকামী আপামর জনগণকে সাথে নিয়ে জাতির জনকের পরিকল্পিত লক্ষ্যে দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র সফল এক যুদ্ধ পরিচালনা করে ২১৪ বছর আগে পলাশীর আম্রকাননে হারিয়ে যাওয়া বাংলার স্বাধীনতাকে আবার ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলেন।

৭১ পূর্ববর্তী সময়ে আমার বাবার কাজ যেহেতু ময়মনসিংহে ছিল, পরিবার নিয়ে তার বসবাসও ছিল সেখানেই। কিন্তু পার্টির গুরুত্বপূর্ণ কাজে বেশি সময় তাকে ঢাকায় থাকতে হতো। ঢাকা শহরে আমাদের নিজেদের কোন বাসস্থান না থাকায় আমার বাবা সাধারণত মগবাজারে আমার মেঝ মামা মাসুদুজ্জামান সাহেবের বাসায় থাকতেন-সেটিই ছিল তার ঢাকার ঠিকানা। আমার এ মামা-মামী পরিবারের সবার অসম্ভব শ্রদ্ধাভাজন, শ্রদ্ধেয়। আব্বা সে সময় মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধুর বাসায়ও থাকতেন বলে শুনেছি। 

২৫ শে মার্চ রাতে আব্বা বঙ্গবন্ধু'র বাসা থেকে মিটিং সেরে মগবাজারে মামার বাসায় ফেরেন অত্যন্ত চিন্তিত মনে। ফিরেই তিনি আমার মামীকে বলেন "ভাবি, আমাদের আলাপ আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে, পাকিস্তানি সেনারা আমাদের উপর যেকোনও মুহূর্তে আক্রমণ করবে। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তিনি তার বাসাতেই অবস্থান করবেন।" আব্বা আরও বলেন যে, বঙ্গবন্ধু তাকে ও অন্যান্য সহযোগীদেরকে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বলেছেন। 

আব্বা সে পরিকল্পনার বিষয়ে মামীকে এর বেশি আর কিছু বলেননি। আব্বা আমার মামীকে আরও বলেন, "পাকিস্তানি সেনারা আমাদের উপর কঠিন বর্বরচিত আক্রমণ করবে"। 

আমার মামী ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, বিদূষী ও ধীর স্থির। কি ভয়ানক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে তিনি বুঝতে পারলেন ও সবকিছু বিবেচনা করে তিনি সে রাতেই আব্বাকে তার ছোট ভাই শহীদ বুদ্ধিজীবী চিকিৎসক আলিম চৌধুরীর পুরানা পল্টনের বাসায় পাঠিয়ে দেন। মামী সেদিন যথাযথ সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন, কারণ আব্বার সেই ঠিকানা অনেকেরই জানা এবং মগবাজারের গলির প্রথম বাড়িটিই ছিল কুখ্যাত গোলাম আযমের। সেখান থেকে আব্বাকে আটক ও হত্যা করা খুবই সহজ হতো পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে। পরবর্তী সময়ে আব্বাকে খুঁজতে আমার মামার মগবাজারের বাসায় হানাদার বাহিনী আক্রমণ করেছিল ও আমার মামাত ভাইদের প্রায় মেরেই ফেলেছিল! তবে আল্লাহর ইচ্ছায়, নিতান্ত ভাগ্যগুণে আর মামীর উপস্থিত বুদ্ধির জোরে তারা রক্ষা পান।

২৫ মার্চের সে কালো রাতে ঢাকা শহরে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রদের উপর বিভিষিকাময় আক্রমণ চালানো হয় অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র দিয়ে। মধ্যরাতের ঘুমন্ত মানুষের উপর বিভীষিকাময় সে আক্রমণ চলে ঢাকা শহরের আরো বিভিন্ন জায়গায়। আগুনের লেলিহান শিখায় মধ্য রাতের ঢাকার আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল আর নিচের মাটি ভাসছিল টগবগে তরুণ, বৃদ্ধ, শিশু, কিশোরের কাঁচা রক্তের বন্যায়। কিছু মুহূর্তের মধ্যে কত মায়ের অতি আদরের ধন, কলিজার টুকরার বুক ঝাঁজরা হয়ে গেল, শহীদ হলো হাজারো সম্ভাবনাময় তরুণ এবং আরো অনেকে। 

টুনু মামার (শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলিম চৌধুরী) পুরান পল্টনের বাসা থেকে আব্বা নিশ্চয়ই ভয়াবহ সেই গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে সে সময় তিনি কী চিন্তা করছিলেন, কী চলছিল তার মনে? অতি আদরের শিশু কন্যাসহ পুরো পরিবারকে তিনি ফেলে এসেছেন ময়মনসিংহে। সেখানে কী হচ্ছে, তারা কেমন আছে- তা হয়তো ভাববারও সময় হয়নি তার। আমি নিশ্চিত সব ভাবনা ছাপিয়ে তিনি তখন দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ। একটি চিন্তা-ই তার মনে-প্রাণে-ধ্যানে সে মুহূর্তে- বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুদৃঢ় নেতৃত্বে হাল ধরে এগিয়ে নিয়ে দেশকে স্বাধীন করার যে মহান দায়িত্ব জাতির জনক, তার নেতা শেখ মুজিব ও সমগ্র বাঙালি জাতি তার ও সাথীদের উপর অর্পণ করেছেন সে মহান ও বিশাল দায়িত্ব তিনি জীবন থাকতে নিষ্ঠার সাথে পালন করবেনই করবেন।

২৭ তারিখ সকালে কারফিউ কিছুটা শিথিল হলে, আমার মামাতো ভাই কর্নেল শফিকুজ্জামানের বন্ধু রাশেদ ভাই, তার বড় ভাইকে সাথে নিয়ে মগবাজারে আসেন আমার মামী ও তার পরিবারকে তাদের গ্রামের বাড়ি রূপগঞ্জে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ সেই জায়গা তখনো নিরাপদ। কিন্তু আমার দূরদর্শী মামী তাতে রাজি না হয়ে তাদের নির্দেশ দেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে তারা যেন নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। 

২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার পর থেকেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী মরিয়া হয়ে বাকি নেতাদের খুঁজছে। শহীদ ডা. আলিম চৌধুরীর বাসা আব্বার বেশি সময় থাকার জন্য নিরাপদ নয়, তাই সিদ্ধান্ত হলো তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী মামীর (শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলিম চৌধুরীর সহধর্মিনী) ছোট ভাই স্বপন মামা আব্বাকে সেখান থেকে বোরকা পরিয়ে রিকশায় করে আমার সেঝ মামার হোসনী দালানের বাসায় পৌঁছে দেন। আমার সেঝো মামি আগেই খবর পেয়ে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি তার বাসার একপ্রান্তে সবচেয়ে নিরাপদ ও নিরিবিলি ঘরটিতে আব্বার থাকবার ব্যবস্থা করে দেন, এমনভাবে যে বাইরের কেউ, এমনকি বাসার কাজের লোকরাও যেন না জানতে পারে সেখানে কেউ আছে। সে সময় আমার মামাত ভাই শাফায়েতুজ্জামান নমির উপর বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয় আব্বাকে দেখাশোনা  এবং সঙ্গ দেওয়ার জন্য। 

সৈয়দ নজরুল ইসলাম হোসনী দালানের বাসায় অতি গোপনে দুই রাত ছিলেন। আমার আম্মা ও পরিবারের আর কেউ জানতো না আব্বা কখন কোথায় আছেন।

এদিকে আব্বাকে খুঁজে না পেয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অস্থির। তারা তখন পরিবারকে আটক করে মানসিক চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে আব্বাকে বন্দি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তারা চারিদিকে ঘোষণা করে দিলো পরিবারকে খুঁজে পেতে সহায়তা করলে লক্ষাধিক টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। আম্মা চিন্তা করলেন আমাদের আটকাতে পারলে পাকিস্তানি সেনাদের জন্য শেখ মুজিবের পরেই নেক্সট ইন কমান্ড সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে বন্দি করা হয়তো অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে, আর তাতে বিঘ্ন ঘটবে স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগতিতে। কাজেই ময়মনসিংহের বাসা আর এক মুহূর্তও নিরাপদ নয়। তাই আব্বার খবর পাওয়া পর্যন্ত আর অপেক্ষা না করে আম্মা সিদ্ধান্ত নিলেন ছোট্ট আমি, আমার বোন, মেঝ ভাই, সেঝ ভাই, ছোট ভাই ও পরিবারের অন্যান্য যারা ছিলেন তাদের নিয়ে ছদ্মবেশে অনিশ্চিত দুর্গম এক যাত্রা পথে বেরিয়ে পড়ার। 

আমার বড়ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আশরাফ, আব্বাকে পাগলের মত চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তখন। আমার স্মৃতিতে না থাকলেও, আম্মা ও পরিবারের অন্যান্যদের মুখে হাজারো বার শুনেছি সেই সব কথা। প্রায় চার মাস ছোট ছোট শিশু কোলে করে পরিবার নিয়ে যুদ্ধাঞ্চলে মৃত্যুর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বেঁচে থাকা এবং অতি যত্নে পরিচয় গোপন করে হাজারো শরণার্থীর সাথে নিরন্তর ছুটে চলার দুঃসহ, ভয়ঙ্কর ও সত্যি এক ভ্রমণ কাহিনী। কোথাও নিরাপদ আশ্রয় মেলেনি খুব বেশি সময়ের জন্য। থাকতে হয়েছে কখনো বনে-জঙ্গলে, কখনো-বা ডোবা-নালায় ডুবে, কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো বা নৌকায় চলে, বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে বা অচেনা কারও বাড়িতে। কখনো হিন্দু পরিচয়ে, কখনো মুসলিম, কখনো বই বিক্রেতার পরিবার হয়ে, কখনো বা কারো বাড়ির কাজের লোক পরিচয়ে অবিরাম চলতে হয়েছে প্রায় চার মাস। যুদ্ধের ময়দানে এক মায়ের পরিবার বাঁচানোর যুদ্ধ সেটি। সে সময় এমন কাহিনী বাংলার ঘরে ঘরে আছে। এই সময়ে আব্বা জানতেও পারলেন না কোথায়, কিভাবে আছে তার নিজের পরিবার, কেউ কি বেঁচে আছে? নাকি সবাইকে শেষ করে দিয়েছে? 

সেঝ মামা, মামী খুব সতর্কতা ও অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে পরম যত্নে দুই রাত আব্বাকে তাদের কাছে রাখলেন। ২৯ মার্চ ভোরে মামাতো ভাই শফিকুজ্জামান, তার বন্ধু রাশেদ ভাই এবং তার বড় ভাই- এ তিনজন মিলে দুইটি বেবিট্যাক্সি নিয়ে উপস্থিত হন হোসনী দালানের বাসায়। আব্বাকে ধরতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে পাক বাহিনী এরই মধ্যে। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা যেন তাদের চোখের বাইরে ঢাকা থেকে কেউ বের হতে বা ঢুকতে না পারে। তাই সবাই মিলে আব্বাকে ঢাকা থেকে বের করার ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক থাকলেন। আমার আব্বা বেশ উঁচু, লম্বা, বড়সড় মানুষ ছিলেন। তাকে তো আর লুকিয়ে পার করা সম্ভব নয়, তাই আমার মামী ও তার ছোট ভাইয়ের নববধূ মিলে মেঝ মামীর (মগবাজারের মামী) পরিকল্পিত বুদ্ধিতে বিশাল সাইজের বোরকা আর পরচুলা জোগার করলেন। তারা দুইজন মিলে আব্বাকে মামীর শাড়ি, পরচুলা ও বিশাল আকারের বোরকাটি পরিয়ে দিলেন। এত বড়সড় আর সিরিয়াস হাই প্রোফাইল এক নেতাকে একজন মহিলার সাজে সাজানো নিশ্চয়ই খুব সহজ ব্যাপার ছিল না, কিন্তু তারা নিষ্ঠার সাথে সেই কাজটি সম্পন্ন করলেন। 

পরিস্থিতি কঠিন, কিন্তু সবাই মিলে এ নিয়ে হাসিঠাট্টাও না করে পারলেন না। ছদ্মবেশী স্বাধীনতার এক অগ্রনায়ক সৈয়দ নজরুল ইসলাম হয়ে উঠলেন বুয়েটের তরুণ ছাত্র মিনু ভাই, রাশেদ ভাইদের পর্দানশীল অসুস্থ বৃদ্ধা মা। আল্লাহর নাম নিয়ে তারা বেবিটেক্সি করে রওয়ানা দিলেন রূপগঞ্জের পথে। কী ভয়াবহ ছিল সে পরিস্থিতি! রাস্তায় কোনও এক ব্যারিকেডে পরিচয় ফাঁস হলে সবাইকে সেখানেই শেষ করে দেবে পাকিস্তানি বাহিনী।

যথারীতি প্রথম ব্যারিকেডে থামানো হলো বেবিট্যাক্সি, সবাইকে নামতে বলল তারা। কী শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি, তারা সবাই নামলেন শুধু আব্বা ছাড়া। বেবি ট্যাক্সির ভিতরে উঁকি দিয়ে পাক আর্মিরা জানতে চাইল উনি কে? খুব শান্তভাবে তারা উত্তর দিল, "আমাদের পর্দানশীল বৃদ্ধ অসুস্থ মা, উনি হাঁটতে চলতে পারেন না, তাই তাকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।" কথাটি টহলরত সেনারা বিশ্বাস করলো এবং বাকি সবাইকে খুব ভালভাবে তল্লাশি করে ছেড়ে দিল। পথে পথে সব কয়েকটি চেক পোস্টে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। নিয়তির পরিকল্পনা তো ছিল অন্য রকম, তাই সেদিন পথে পথে মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে কোনোক্রমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঢাকা থেকে ডেমরা হয়ে পৌঁছে গেলেন রূপগঞ্জের পুরিন্দা গ্রামে। রাশেদ ভাইদের পুরিন্দা গ্রাম থেকে আমার আরেক মামা (দারোগা মামা) যিনি একসময় রূপগঞ্জ থানার ওসি ছিলেন তালেবুজ্জামান সাহেব আব্বাকে উঠিয়ে নিলেন এবং বিভিন্ন দিক ঘুরে, যেমন নরসিংদী-শিবপুর-মনোহরদী-চালাকচর বাজার ও কটিয়াদী হয়ে নিয়ে আসেন আমার নানা বাড়ি বোয়ালিয়া গ্রামে। 

সে সময় যাতায়াত ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট আজকের মত এত উন্নত ছিল না। ঢাকা থেকে পুরোটা যাত্রা-ই মানসিক ও শারীরিকভাবে সহজ ছিল ছিলনা, পথে পথে অনেক কঠিন অবস্থার মোকাবেলা করে চলতে হয়েছে। কিন্তু দু দণ্ড থেমে একটু বিশ্রাম নেওয়ারও যে সময় নেই তখন। বোয়ালিয়ায় তিনি এক রাত থাকলেন। নিরাপত্তা বিবেচনার পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় পৌঁছানোর তাড়াও ছিল। এই চিন্তা করে পরের দিন খুব ভোরে আমার ৫ নম্বর মামা আসাদুজ্জামান সাহেবকে সাথে নিয়ে আব্বা রওয়ানা হলেন আমার আম্মার নানা বাড়ি দীঘিরপাড়। সেটি এক বনেদি জমিদার বাড়ি, 'দীঘিরপাড় মিঞা বাড়ি' বলে এলাকায় পরিচিত।

আমার মা সম্ভ্রান্ত এক জমিদার পরিবারের অতি আদরের সাত ভাইয়ের পর একমাত্র কন্যা। সবাই আদর করে তাকে ডাকতেন আবু বলে। পরিবারের সবার কাছে তিনি ছিলেন, যেমন আদরের তেমনি সম্মানের। সবার অতি আদরের আবুর জামাইকে মানে আব্বাকে হঠাৎ করে তাদের মাঝে পেয়ে দিঘিরপাড়ের সবাই খুব আনন্দিত। তাদের আদরের জামাই এবং এত বড় সংগ্রামী এক নেতা, তাকে পেয়ে সবার মাঝে এক উৎসব উৎসব ভাব চলে আসলো। আমার বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আশরাফ খুব মজা করে বলতেন সেই ঘটনা। দীঘিরপাড় গ্রামের মুরুব্বিরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন জামাই বরণ করতে। সবার উৎসাহ উদ্দীপনায় তৈরি হলো কয়েকটি তোরণ। শামিয়ানা টানিয়ে ভোজের ব্যবস্থাও করা হচ্ছিল। তারা হয়তো তখনো পরিস্থিতির ভয়াবহতটা পুরোপুরি বুঝতে পারেননি অথবা বুঝতে পেরেই হয়তো তারা জামাইকে আদর যত্ন করে সম্মান জানাতে চাইলেন। আব্বা কাউকেই কিছু না বলে নীরবে শুধু পায়চারী করেছেন আর অটল বিশ্বাসে অপেক্ষা করেছেন পরবর্তী পদক্ষেপের।

একই দিনে আমার বড় ভাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, যিনি সেই সময়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়োজিত ছিলেন জানতে পারেন যে- আব্বা আমাদের নানাবাড়ি বোয়ালিয়ায় আছেন। ২৫ মার্চ রাত থেকেই বড় ভাই পাগলের মত চারিদিকে আব্বাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। আব্বা কোথায় আছে- খবর পাওয়ার সাথে সাথে বড়ভাই একটি জিপ নিয়ে রওয়ানা হয়ে যান বোয়ালিয়ার দিকে। সে সময় তার সাথে ছিলেন আনন্দ মোহন কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন ভি পি হামিদ ভাই ও জিএস বুলবুল ভাই, এরা তিনজনই দুর্দান্ত সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা। 

বোয়ালিয়া পৌঁছেই বড় ভাই সৈয়দ আশরাফ জানলেন আব্বা ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন দীঘিরপাড়। সেই তরুণ বয়সেই দূরদর্শী বড় ভাই বুঝতে পারেন মুহূর্ত নষ্ট করার তখন সময় নেই, প্রতিটি সেকেন্ড অতি মূল্যবান। যেভাবেই হোক স্বাধীনতার এ অগ্রনায়ক, নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে পৌঁছে দিতে হবে নিরাপদ আশ্রয়ে এবং খুঁজে বের করতে হবে বাকি নেতৃবৃন্দকে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা শক্ত হাতে হাল ধরে এক সশস্ত্র সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে সক্ষম। তবেই তো বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রাম সফল হবে। স্বাধীন বাংলার আকাশে উঠবে টকটকে লাল স্বাধীন ভোরের সূর্য, উত্তোলিত হবে শোষিত নিপীড়িত বাঙালির স্বপ্নে লালিত লাল সবুজ পতাকা।

দীঘিরপাড় পৌঁছে বড় ভাই  সেখানকার আয়োজন দেখে একটু থমকে যান, কিন্তু কাউকে কিছু না বলে তিনি দ্রুত আব্বার কাছে চলে আসেন। আব্বাকে দেখে মনে হলো যেন তিনি জানতেন যে, সেই মুহূর্তে তারা আসবে। তিনি যেন প্রস্তুত হয়ে তাদেরই অপেক্ষায় ছিলেন। বড় ভাই আর তার সাথীরা সেই মুহূর্তেই কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আব্বাকে নিয়ে জিপে উঠে চলতে শুরু করেন আমাদের নানা বাড়ি বোয়ালিয়ার দিকে। সেখান থেকে তাদের আসল উদ্দেশ্য হালুয়াঘাট দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া।

হালুয়াঘাট সীমান্ত এলাকয় পৌঁছালে দেখা হয়ে যায় দলের আরো অনেক নেতা কর্মীর সাথে, যেমন সেখানে ইতিমধ্যে এসে পৌঁছে গেছেন মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, সামসুল হক প্রমুখ। সবারই উপর দিয়ে বিগত কয়েকদিন অমানবিক কষ্ট আর অনিশ্চয়তার ঝড় বয়ে গেছে, সকলেই বিধ্বস্ত। কেউই জানতো না কে কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন, নাকি ধরা পড়েছেন? তাই যে কয়েকজন সেখানে ছিলেন, একে অপরকে পেয়ে খুব আনন্দিত ও কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। সেখানকার প্রয়াত এমপি জনাব কুদরত উল্লাহ মণ্ডল সাহেব বিশেষভাবে তাদের সহযোগিতা করেন এবং থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

১১ এপ্রিল একটি ছোট্ট বিমানে করে তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম প্রমুখ হালুয়াঘাটের ঢালু পাহাড়ের নিচে সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে খুজেঁ পান এবং বিমানে তুলে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পাড়ি জমান এক স্বাধীনতার ইতিহাস রচনা করতে।

পরবর্তী ইতিহাস সবার জানা। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন আমার বাবা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির সুকঠিন দায়িত্বও তার উপর ন্যস্ত হয়েছিল। আমি সত্যিই গর্বিত এমন এক পিতার সন্তান হতে পেরে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় নির্দ্বিধায় তারা বিলিয়ে দিয়েছেন দেশের জন্য, অতি পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন বাঙ্গালি জাতি এবং স্বাধীনতার রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে।