প্রাণ লভুক সকল ভুবন, নয়ন লভুক অন্ধ

লাভা মাহমুদা
Published : 13 April 2021, 06:37 PM
Updated : 13 April 2021, 06:37 PM

দোরগোড়ায় কড়া নাড়তে নাড়তে বাঙালির অন্দরে ঢুকেই পড়লো বৈশাখ। প্রাণের অনুরণন জাগানিয়া উচ্ছ্বাসের বৈশাখ। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মওসুমী জলবায়ু বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এ দেশে বৈশাখ আসে ঠিক মোহনীয় আমেজে নয়, অনেকটা রুক্ষ উত্তাপে। মাঝেমধ্যে ঝড়বৃষ্টি, কখনো সখনো বা কালবৈশাখীর প্রলয় নৃত্যে মানুষকে জানান দেয় তার আগমনী বার্তা। নতুন ফুল-ফলের ঘ্রাণে ভরে ওঠে বাতাস। জীর্ণ পাতা ঝরে জায়গা করে নেয় নতুনেরা। এই বৈশাখের প্রথম দিনটিই ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন, নববর্ষ; যা বাঙালির সার্বজনীন আবেগের ঝর্ণাধারায় উৎসারিত একমাত্র চিরায়ত লোকজ উৎসব। এ বর্ষবরণ আমার কাছে যতো না উদযাপনের তার চেয়েও বেশি উপলব্ধির; হৃদয় মন ও মননে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যাওয়া অসাম্প্রদায়িক চেতনার আরেক নাম। লাল শাড়ি রেশমি চুড়ি পরে রমনার বটমূলে বা মঙ্গল শোভাযাত্রায় যাওয়াই শুধু নয়, আমার নাভীমূলে টান দিয়ে যাওয়া অনুভূতিরও অধিক ।

ষোল শতকের মাঝামাঝি মোঘল সম্রাট আকবর অনেকটা দায়ে পড়ে বাংলা নববর্ষের প্রবর্তন করেন। এই বাংলা ছিলো মোঘলদের গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী প্রদেশ বা সুবাহ। বিভিন্ন দৈব দূর্বিপাকে ফসলহানি ঘটলে দিল্লি পর্যন্ত খাজনা পৌঁছাতো না। এর প্রেক্ষিতে নতুন ফসল উঠলে প্রজাদের কাছ থেকে জমিদারদের খাজনা আদায়ের জন্য বৈশাখের প্রথম দিনটিকে নববর্ষ ঘোষণা দেওয়া হয়। ফসলের সাথে সম্পর্কিত বলে 'বঙ্গাব্দ' শব্দ ব্যবহারের আগে বাংলা সনকে 'ফসলি সন' বলা হতো । মোঘলেরা দায়ে পড়ে নববর্ষের প্রচলন করলেও সময়ের বাঁক পেরিয়ে বৈশাখের প্রথম দিনটিই আমাদের সার্বজনীন বৈষম্যহীন আনন্দ আয়োজনের সবচেয়ে বর্ণিল সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।

গত বছর নববর্ষের ঠিক আগে যে মহামারী ছোবল বসিয়েছিল, এবার সেই সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে, হয়েছে তীব্রতর। বিপর্যয় মানবের অস্তিত্ব, সভ্যতা ছিন্নভিন্ন। জীবনের জয়রথ থেমে গেছে। ভয়াবহ দুর্বিপাকে পড়েছে বিশ্ববাসী।  করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা চৌদ্দ কোটি  ছুঁইছুঁই। মৃতের সংখ্যাও প্রায় ত্রিশ লাখ। সব সূচকই বাড়ছে লাফিয়ে । আমাদের দেশেও ভয়াবহ অবস্থা। শুধু দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মৃত্যুর মিছিল দেখছি আর বিরহ গাঁথা শুনছি। কত পরিবার তছনছ হয়ে গেল, গুণে শেষ করা যাবে না। আতঙ্ক উদ্বেগ আর মৃত্যু ভয়ে বিপর্যস্ত মানুষের জীবন । প্রত্যেকের ছিল একেকটা জীবন, সংসার, স্বপ্ন, সাধ। কোভিড-১৯ সব স্বপ্ন-সাধ ছিন্নভিন্ন করে দিল। কে কবে ভেবেছিল, অমরত্ব লাভের প্রত্যাশায় নিরন্তর কাজ করে যাওয়া মানব সভ্যতার মৃত্যুর কাছে এমন অসহায় আত্মসমর্পণ। এখন আমরা নৈকট্যকে ভয় পাই, দূরত্বই সহায়।  আজ স্বপ্ন দেখার দিনে দেখছি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন, নতুন আলোয় দেখছি শুধুই অন্ধকার। তাই জীবনের আগে উৎসব নয়৷ এর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সব ধরনের স্বাভাবিক কার্যক্রমের মতো নিষিদ্ধ হয়েছে বৈশাখী সব আয়োজনও।

প্লেগ, কলেরা, গুটি বসন্ত, স্পেনিশ ফ্লুসহ অনেক মহামারী এসেছিলো আগেও। বিজ্ঞানের জয়রথ তাদের থামিয়ে দিয়েছে। এবার ইতিহাসের স্বল্পতম সময়ে এসেছে ভ্যাকসিন। এবারও আশাবাদী হতে চাই, আশায় বাঁচতে চাই। জীবনের জয়ধ্বনিকে কেউ থামাতে পারবে না। এ মহামারীর কবল থেকে রেহাই পাবে ধরিত্রী। করোনা নামক মৃত্যুদূত শুধুই একটি সাধারণ ভাইরাসের নাম হবে।  পরাজয়ের গ্লানি যেমন আছে, জয়ের আনন্দও আছে। সে আনন্দধ্বনিতে আমি না থাকলেও আমার প্রজন্ম নিশ্চয়ই শামিল হবে। তখন মানুষে মানুষে দূরত্ব নয় আরো মানবিক নৈকট্য আসবে। আর গাইতে চাই মনুষ্যত্বের জয়গান। সংকল্প করতে চাই অন্তত মানবিক মানুষ হওয়ার। অন্যায়, অশুভ আর অমঙ্গলের সাথে যেন কখনো না হয় মিতালি।

উজ্জ্বল হোক জ্ঞানসূর্য-উদয়সমারোহ…

প্রাণ লভুক সকল ভুবন, নয়ন লভুক অন্ধ।

শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,

করুণাঘন, ধরণীতল কর' কলঙ্কশূন্য।

অন্ধকার ভেদ করে আলো আসবেই। মানব সভ্যতার ধ্বংস নয়, বিকাশ অনিবার্য। করোনার বিনাশে শুভ হোক নতুন বছর। মমত্ববোধ তৈরি হোক বিচ্ছিন্নতায়। সকলের মঙ্গল হোক। শুভ নববর্ষ ১৪২৮।