স্বাধীনতার ৫০ বছর: মুন্না কি জন্মাবে আবার!

নাজমুল হক তপন
Published : 6 April 2021, 02:20 AM
Updated : 6 April 2021, 02:20 AM

"অটো ফিস্টার বলেছিলেন, মুন্না জার্মানিতে জন্মালে ফুটবল একজন বেকেনবাওয়ার পেত",  বাংলাদেশের বিশ্বখ্যাত জার্মান কোচ অটো ফিস্টারকে উদ্ধৃত করে এ কথাগুলো জানিয়েছিলেন ওই সময় দৈনিক আজকের কাগজ সম্পাদক ও আবাহনী লিমিটেডের অন্যতম শীর্ষ সংগঠক কাজী শাহেদ আহমেদ।

আমার সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারও শুরু হয়েছিল দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায়। সাংবাদিক তৈরির কারখানা বলে খ্যাত ছিল পত্রিকাটি। খেলাধুলার প্রতি ভীষণভাবে আসক্ত ছিলেন সম্পাদক শাহেদ আহমেদ। খেলা নিয়ে গল্প করতে পছন্দ করতেন। 'রক্ষণ রাজ' মোনেম মুন্নার প্রসঙ্গ তুলতেন মাঝে মধ্যেই।

মুন্না ভুল দেশে জন্ম নিয়েছিলেন এ নিয়ে একমত সবাই। এদিক থেকে চিন্তা করলে মুন্না একটি আক্ষেপের নামও। নিজের প্রতিভার প্রতি এই 'রক্ষণ রাজ'  সুবিচার করতে পেরেছিলেন কি-না, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। তবে দেশের সীমানার বাইরে নিজের নামটি ভালভাবেই চেনাতে পেরেছিলেন। ১৯৯৫ সালের সাফ গেমসের একটি সংবাদ শিরোনাম স্মরণের অলিন্দে ঢুঁ দিচ্ছে বেশ। ওই বছর সাফ গেমসের ভেন্যু ছিল মাদ্রাজ। যতদূর মনে পড়ে গেমস শুরুর দিন কলকাতার  প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজারের খেলার পাতার একটা সংবাদ শিরোনাম ছিল, "শাহবাজ, ঊষা ও মুন্নার গেমস আজ শুরু"!

১৯৯০-র দশকে পাকিস্তানের শাহবাজ আহমেদকে অনেকেই বলতেন 'হকির ম্যারাডোনা'। পিটি উষার কথাও নতুন করে বলার কিছুই নাই। এ ভারতীয় অ্যাথলিট তার সময়ে ছিলেন এশিয়া সেরা। গেমস শুরুর সময় এমন দুইজন খ্যাতিমান ক্রীড়াবিদের সমান মর্যাদায় উচ্চারিত হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের ছেলে মুন্নার নামও। ভাবতে অবাক লাগতে পারে, বিশেষ করে হালের ফুটবল দেখে কিন্তু এটাই সত্যি।

মুন্নাকে নিয়ে আলোচনা করার আগে একটা প্রসঙ্গ না তুললেই নয়। বাংলাদেশ ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার তিনি। তাকে বাদ দিয়ে দেশের ফুটবল ইতিহাস সম্পুর্ণ হবে না কোনওভাবেই। ১৯৯২ সালে মুন্নাকে দলে ভেরাতে ২০ লাখ টাকা ঢালতে হয়েছিল আবাহনীকে। যেটা ওই সময় উপমহাদেশ ফুটবলে একটা বিশেষ ঘটনাই বটে। মুন্নার ২০ লাখ টাকা পাওয়ার ঘটনা প্রবলভাবে আলোড়ন তুলেছিল দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে। 

বাংলাদেশের একজন ফুটবলার হিসাবে এগুলো সন্দেহাতীতভাবেই বড় অর্জন। অবশ্য শুধু এটুকুতেই মুন্নাকে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। একজন খেলোয়াড়, বিশেষত একজন ফুটবলারের জনপ্রিয়তা বিষয়টি আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে। জনপ্রিয়তার জায়গাটিতে মুন্নাকে নিয়ে একটা সুক্ষ বিতর্কও হতে পারে। মোনেম মুন্না কোন্ বাংলায় বেশি জনপ্রিয়? এপার না ওপার?

'পিএইচডির গল্প' নামে স্মৃতিকথামুলক বইয়ে একটি বিশেষ ঘটনার মধ্য দিয়ে মুন্নার কথা আলাদাভাবে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক, কলামনিস্ট ও লেখক আসিফ নজরুল। লেখক পিএইচডি করার সময় থাকতেন লন্ডন হাউজে। ওই সময়ের একটা ঘটনার উল্লেখ লেখক করেছেন এভাবে-

লন্ডন আসার আগে আমার আলাপচারিতা শুধু দেশের রাজনীতি, নির্মূল কমিটি আর বিচিত্রা নিয়ে। কখনো বাইমেলা বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। লন্ডন হাউজে তাই হ্যালো-হাই বলে পাশ কাটিয়ে যাই সবাইকে। লন্ডন হাউজের কাছাকাছি থাকে আরও তিন পিএইচডি প্রত্যাশী- রানা ভাই ( ড. কাজী বোরহানউদ্দীন আহমেদ), মুকুল ভাই (ড. রেজাউল করিম) ও নাইম ভাই ( ড. নাইম আহমেদ)। তাদের ডেকে নিয়ে আসি। মনের সুখে বাংলা বলি।

এই করিডোরেই ঘটে এক অচিন্তনীয় ঘটনা। আমার আর রানা ভাইয়ের পেছন থেকে বেজে ওঠে সুরেলা কন্ঠ, আপনারা কি বাঙালি? লন্ডন হাউজের ভেতরে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন! প্রায় চমকে উঠে পেছনে ফিরি। নার্ভাস হয়ে বিরল ভঙ্গিতে বলি, ইয়েস, উই আর।  মেয়েটি হাসে দীর্ঘ তরঙ্গের হাসি। তাহলে ইংরাজি বলচেন কেন? 'বলচেন কেন', বলে ততক্ষণে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, 'আমি মিমি। অঙ্গনা সেনগুপ্ত। ৫ মিনিটের মাথায় কলকাতার মিমির জন্ম-জন্মান্তরের দাদা হয়ে গেলাম । ১৫ মিনিটের মাথায় মিমি তার সেই দাদার বানানো খিঁচুড়ি ডিমভাজা খেতে থাকে এবং ঘণ্টাখানেকের মাথায় মিমি তার চার জন প্রায় প্রেমিকের বর্ণনা দেওয়া শেষ  করে।

 মিমি দেখতে সাধারণ। তার জন্য জ্বলে-পুড়ে মরছে চার ইংরেজ। একটু অবাক হই। এরপর থেকে মিমির প্রায় প্রতিদিনের সংলাপ, মনটা কেমন করছে আাসিফ ভাই। আপনারা কি মজা করে রেধেঁ খেতে পারচেন। আমাকে বলতেই হয়, চলে এসো। মিমি চলে আসে এবং চলেও যায়। আমি আবারও রান্না করতে হবে, এই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ি। মিমিকে আমি তবু ক্ষমা করে দিই একটা কারণে। তার রুমে প্রথম যাওয়া সেদিন। দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি রুগ্ন চেহারার ফ্যাকাশে এক যুবক কোলে টেলিভিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে। তার পেছনে বেডে বসে চা খাচ্ছে মিমি।  

এই ছেলে বোধ হয় মিমির চার যুবকের একজন। মিমি আমাকে দেখে হাসে। তার হাসি ফেরত দেয়ার আগে আমি হতভম্বের মত মিমির ঘরের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই দেয়ালের বড় একটা অংশ জুড়ে পোস্টার। সেখানে আমাদের সুদর্শন ফুটবলার মোনেম মুন্না। আবাহনীর মুন্না কিছুদিন আগে কলকাতার ইস্টবেঙ্গলে খেলে এসেছে। কাঁপিয়ে দিয়েছে সারা কলকাতা। কিন্তু তাই বলে মুন্নার ছবি লন্ডন হাউজে! মিমির দেয়াল জুড়ে মুন্না। চার সাদা যুবকের কেউ নয়। মুন্নার উদ্দাম তারুণ্যের ছবি দেখি বারবার। মনে মনে বলি, কনগ্রেটস মুন্না, সাবাস।

মুন্নার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু তার শৈশবের শহর নারায়ণগঞ্জে। ১৯৮১ সালে শুরু ঢাকা পর্ব। খেলেন পাইওনিয়র লিগের দল ঢাকা পোস্ট অফিসের হয়ে। পরের বছর যোগ দেন দ্বিতীয় বিভাগের দল শান্তিনগর ক্লাবে। ১৯৮৩ সালে ডাক পান প্রথম বিভাগের দল মুক্তিযোদ্ধা সংসদে। ১৯৮৬ সালে ডাক পান জাতীয় দলে। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর ছিলেন জাতীয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। লাল-সবুজের জার্সিতে তার প্রথম মিশন ছিল পাকিস্তানের কায়েদে আজম ট্রফি। ওই আসরে শক্তিশালী ইরানের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে গোলের আনন্দে ডানা মেলেন মুন্না।

কায়েদে আজম ট্রফির আগে দলবদল হয়। মুন্না যোগ দেন ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে। মোনেম মুন্নার  আবাহনীর ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। এরপর কলকাতা ইস্টবেঙ্গল বাদে আর কখনো ক্লাব পাল্টাননি এই কিং ব্যাক। প্রথমবার ১৯৯১ সালে খেলেন ইস্টবেঙ্গলের হয়ে। খেলেন টানা তিন মওসুম। এর মধ্যে দুবার লিগ শিরোপা জেতে কলকাতার দলটি। ঢাকা আবাহনীতে খেলেন ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। জাতীয় দলের নেতৃত্বের ভার ওঠে ১৯৯০ সালের সিউল এশিয়ান গেমসে। দেশের হয়ে সাফ গেমস স্বর্ণ পদক জিততে না পারার আফসোস  আক্ষেপ অবশ্য ঘোঁচাতে পারেননি। তবে দেশের বাইরে প্রথম তার নেতৃত্বেই কোন ট্রফি জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে (ওই সময় বার্মা) অনুষ্ঠিত চার জাতি ফুটবল টুর্নামেন্টে শিরোপা জেতে মুন্না ও তার সহযোদ্ধারা। 

টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের শুরুটা ছিল খুবই বাজে। স্বাগতিক মিয়ানমারের কাছে ০-৪ গোলে হেরে যায় দল। তবে দ্বিতীয় ম্যাচ থেকে ঘুরে দাঁড়ান মুন্নারা। সিংগাপুরের বিপক্ষে কষ্টের জয় আসে ১-০ গোলে। পরের ম্যাচেই একই ব্যবধানে শ্রীলঙ্কাকে হারায় বাংলাদেশ। ফাইনালে আবারও প্রতিপক্ষ স্বাগতিক মিয়ানমার। শিরোপার লড়াইয়ে ফেভারিট হিসেবেই মাঠে নামে স্বাগতিকরা। ওই ম্যাচে মুন্নার বীরত্ব এখনও অনেকের স্মৃতিতে টাটকা। মামুন জোয়ার্দারের গোলে লিড নেয় বাংলাদেশ। আক্রমণের ঝড় তুলে ম্যাচে সমতায় ফেরে স্বাগতিকরা। তবে নকিবের গোলে আবারও লিড নেয় বাংলাদেশ। ম্যাচে ফিরতে মরীয়া হয়ে ওঠে মিয়ানমার।  পুরো ম্যাচে সতীর্থদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাগতিকদের সামনে প্রতিরোধের শক্ত দেয়াল গড়ে তোলেন মুন্না। 

শেষপর্যন্ত ২-১ গোলে লিড ধরে রেখেই ফুটবলে বিদেশের মাটিতে প্রথম শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব দেখায় বাংলাদেশ। ওই সময় বাংলাদেশের কোচ ছিলেন যুব বিশ্বকাপে ঘানাকে শিরোপা জেতানো অটো ফিস্টার। শিরোপা জয়ের পর এই জার্মান কোচ বলেছিলেন, সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরই কেবল উৎসব করতে চান। এর কিছুদিন পরই অনুষ্ঠিত হয় মাদ্রাজ সাফ গেমস। ওই আসরে ফাইনালে স্বাগতিক ভারতের কাছে ০-১ গোলে হেরে রানার্সআপ ট্রফি নিয়ে সন্তুস্ট থাকতে হয় মুন্নাদের। 

ইস্টবেঙ্গলে তিন মওসুম খেলেন মুন্না। এর মধ্যে দুবার লিগ শিরোপা ছাড়াও জেতেন আইএফএ শিল্ড। ঘরোয়া ফুটবলে লেফট ব্যাক, রাইট ব্যাক, স্টপার- সব পজিশনেই খেলেছেন মুন্না। তবে ইস্টবেঙ্গলে খেলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। দুই পায়ে জোরালো শট, প্রতিপক্ষ স্ট্রাইকারদের গতিবিধি সহজেই আঁচ করতে পারা, সঙ্গে নিখুঁত কড়া ট্যাকলিং, ক্লান্তিহীনভাবে পুরো মাঠ চষে বেড়ানো, রক্ষণ ও  আক্রমণের সেতুবন্ধ হিসেবে নিজেকে মেলে ধরা, মাঝে মধ্যে গোল  করা- ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে তার সব গুণগুলোই যেন বিকশিত হয়েছিল সমানভাবে, শতদলে। 

"আবারও মুন্না, আবারও মুন্নার পায়ে বল", ওই সময়ে ইস্টবেঙ্গলের খেলা যারা রেডিওতে শুনেছেন,  ধারভাষ্যকারদের এমন উচ্ছ্বাসে শিহরিত হননি দুই বাংলাতে এমন ফুটবলপ্রেমী খুব কমই পাওয়া যাবে। ওই সময়টাতে কলকাতায়  ভারতীয় ক্রিকেটার মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের জয়জয়কার। আজহার ইডেন গার্ডেনে ব্যাট করতে নামলে হাজার হাজার রান করেন, প্রচলিত ছিল এমন একটা কথা। এ মাঠে ৭ টেস্টে পাঁচটি সেঞ্চুরি করেন আজহার। ১০৭.৫০ গড়ে মোট রান ৮৬০। 'কলকাতার রাজা' আজহারের জনপ্রিয়তায় ভাগ বসান মুন্না। আনন্দনগরীতে তার আর আজহারের সমান পোস্টার বিক্রির খবরও এসেছিল মিডিয়াতে।

ইস্টবেঙ্গলে মুন্নার সঙ্গে খেলেছেন ভারতের জাতীয় দলের সাবেক ডিফেন্ডার কৃষ্ণেন্দু রায়। পেনাল্টিতে গোল করতে ওস্তাদ এই ডিফেন্ডার খেলতেন রাইট ব্যাক পজিশনে। মুন্নাকে নিয়ে লেখার কথা শুনে দুই দফায় ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছেন এই কৃতি ফুটবলার। আবেগঘন ভাষায় বলেছেন, "মুন্নার সঙ্গে আমার একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যদিও মুন্না ইস্টবেঙ্গলে খেলতে আসার আগে আমি অনেকবারই বাংলাদেশে গিয়েছি। বলা যায়, আমার ক্যারিয়ারের শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। ঢাকায় ১৯৭৮ সালে এশিয়া যুব ফুটবলে অংশ নিয়েছিলাম। এরপর আরও ছয়/সাতবার বাংলাদেশে খেলতে গিয়েছি। তবে আসলাম (শেখ মোহাম্মদ), রুমি (রিজভি করিম) ও মুন্না এ তিনজন ইস্ট বেঙ্গলে আসার পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কটা আরও গভীর হয়। বাংলাদেশের অনেক ফুটবলারের সঙ্গেই আমার আলাপ আছে। তবে মুন্না ভাই আর আসলাম ভাইয়ের সঙ্গে অন্যরকম একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। মুন্নার  কথা বলি। যতবারই বাংলাদেশে গিয়েছি, ততবারই আমাকে গাড়িতে করে ঘুরিয়েছে। অনেক উপহার দিয়েছে। একবার একটা কার্পেট দিয়েছিল। সেটা আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।" 

ফুটবলার মুন্না সম্পর্কে কৃষ্ণেন্দু এক কথায় যেন বলে দিলেন সবটুকু, "মুন্না একজন বহুমুখী ফুটবল প্রতিভা। তাকে দু বাংলার কোন ফুটবলপ্রেমীই কখনই ভুলতে পারবে না।"

কলকাতায় মুন্নার জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রচলিত আছে নানা 'মিথ'। খ্যাতনামা ডিফেন্ডার কৃষ্ণেন্দু বললেন, "ইস্ট বেঙ্গলে ইংল্যান্ড, নাইজেরিয়া ছাড়াও আফ্রিকার অনেক দেশের ফুটবলার খেলেছে। ইরান, ইরাক থেকে ফুটবলার এসেছে এখানে। তবে জনপ্রিয়তায় সবার থেকে এগিয়ে ইরানের মজিদ বসকার। এরপর নাইজরিয়ার চিমা (চিমা ওকারি) এবং মুন্না।  মজিদ-চিমার মতই বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা মনে রেখেছে মুন্নাকেও।"

এপার বাংলার চেয়েও ওপার বাংলাতে তারা বেশি সম্মান পেয়েছেন এবং এখনো পাচ্ছেন এই অভিমত সাবেক স্ট্রাইকার শেখ মোহাম্মদ আসলামের। আবাহনী ও জাতীয় দল ছাড়াও মুন্নার সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলেও খেলেছেন আসলাম। কলাকাতায় মুন্নার খেলা প্রসঙ্গে সাবেক এ স্ট্রাইকার বলেন, "ঢাকায় যে ভাল ফুটবল চর্চা হয়, সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছিল মুন্না। ওখানে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসাবে মুন্না যে খেলাটা করেছিল, তার কোন তুলনা হয় না।" নিজেদের মধ্যে বোঝাপাড়া বিষয়ে আসলাম বলেন, "সুযোগ পেলেই মুন্না আক্রমণে উঠে আসত। দু পায়েই বলকে দারুণ সুইং করাতে পারত । এই ধরনের সুইং করানো বলে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডাররা বিভ্রান্তিতে পড়ে যেত। এমন বলে আমি গোলও করেছি।"

মুন্নাকে 'পরিপূর্ণ ফুটবলার' হিসেবে উল্লেখ করেছেন এক সময় জাতীয় দল ও মোহামেডানের রক্ষণভাগের বিশ্বস্ত কাণ্ডারী কায়সার হামিদ। বললেন, "আমি মোহামেডানের ডিফেন্স সামলাতাম। আর আবাহনীর ডিফেন্স আগলে রাখার দায়িত্ব ছিল মুন্নার উপর। একসঙ্গে আমরা জাতীয় দলে খেলেছি। প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারদের গতিবিধি খুব ভালভাবে বুঝতে পারত মুন্না। ওর সিক্সথ সেন্স খুব প্রখর ছিল। তবে মাঝে মধ্যেই মেজাজ হারাত। আমি কিন্তু সবসময়ই মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলতাম। আমি মনে করি, টেম্পারামেন্ট আরেকটু ভাল হলে মুন্না এশিয়ার সেরা ডিফেন্ডার হতে পারত।"

মুন্নাকে নিয়ে অটো ফিস্টারের মন্তব্যের সুত্র ধরে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার ও প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আবাহনী ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিস্ট তানভীর মাজহার তান্না বলেন, "মুন্না যদি ইউরোপে জন্মাত, তাহলে ইউরোপীয় মানের ফুটবলই খেলত।" 

কৃষ্ণেন্দুর চোখে  মুন্না একজন স্টাইলিশ ফুটবলারও- "মাঠে মুন্না ছিলেন স্টাইলিশ । সাড়া জাগানো ফুটবল খেলেছেন। তার খেলা যারা দেখেছেন , তাকে কেউ ভুলতে পারবে না। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তাকে মনে রেখেছে। ক্লাবে তার ছবি টাঙানো  আছে।" 

'মুন্নাকে মনে রাখার দিক' থেকে কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন ক্রীড়া সাংবাদিক কৃশানু মজুমদার। সাবেক এ আনন্দবাজারের রিপোর্টার এখন কাজ করছেন সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায়। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে কৃশানুর যথেষ্টই আগ্রহ আছে। কাজ করেছেন মুন্নাকে নিয়েও। মুন্নাকে ইস্টবেঙ্গল কতটুকু মনে রেখেছে এ প্রসঙ্গে কৃশানু বলেন, "ভক্তরা মুন্নাকে ভালবেসেই মনে রেখেছে। তবে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব কর্তৃপক্ষ মুন্নাকে কতটুকু মনে রেখেছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ক্লাবে প্রাক্তনদের সঙ্গে মুন্নার ছবি আছে, এটুকুই। আমি মনে করি ইস্ট বেঙ্গলের কাছ থেকে মুন্নার আরও বেশি সম্মান প্রাপ্য। যেমন আমরা উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি মজিদ বসকারের কথা। ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের শতবর্ষ উপলক্ষে আনা হয়েছিল মজিদ বসকারকে। কলকাতায় বিমানবন্দরে  যখন পা রাখলেন তখন মধ্যরাত। এত রাত তারপরও মজিদকে দেখতে বিমানবন্দরে ভিড় জমিয়েছিল ভক্তরা। মজিদ, মজিদ চিৎকারে ফেটে পড়ছিল বিমানবন্দর এলাকা। তিন দশকেরও বেশি সময় আগে কলকাতা ছাড়েন মজিদ। তারপরও ভক্তদের হৃদয়ে সেই আগের জায়গাতেই আছেন মজিদ। এত দিন পরেও ভক্তরা তাকে মনে রেখেছে, এতে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন মজিদ। সঙ্গে এসেছিলেন মজিদের ভাইপো। তার কাকাকে ঘিরে মানুষের এই ভালবাসা দেখে ভীষণ আপ্লুত হয়েছিলেন ভাইপো। মুন্নার বেলায়ও তো এমন কিছু করতে পারত ইস্টবেঙ্গল! মুন্না নাই তো কী হয়েছে? তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আসতে পারত। ভক্তরা কিভাবে মনে রেখেছে সেটা দেখতে পারত মুন্নার সন্তানরা।"

সবাই ভুলে গেলেও '১২' সংখ্যাটি কোনদিনই ভুলতে পারবে না মুন্নার পরিবার। ১৯৯৩ সালের ১২ ফেব্রুযারি ইয়াসমিন সুরভির সঙ্গে পরিণয়সুত্রে আবদ্ধ হন মুন্না। কাঁটায় কাঁটায় দুজনের ১২ বছরের সংসার। মাত্র ৩৭ বছরেই মুন্না পৃথিবীর মায়া কাটান ২০০৫ সালের ১২ ফ্রেব্রুয়ারি। তখন বড় মেয়ে ইউসরা মোনেম দানিয়ার বয়স মোটে ৮ বছর। বিয়ের পর সুরভি দেখেছেন প্রিয় সঙ্গীর জনপ্রিয়তা। তবে ঢাকার চেয়ে কলকাতাতেই মুন্নার জনপ্রিয়তা কিছুটা বেশি ছিল বলে মনে করেন সুরভি মোনেম।

তিনি বলেন "বাংলাদেশেও মুন্না ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। একবার বইমেলাতে গিয়েছিলাম মুন্নার সঙ্গে। চারিদিক থেকে ভক্তরা ঘিরে ধরেছিল। নিরাপত্তা কর্মীদের সহায়তায় বেরোতে পেরেছিলাম। তবে কলকাতাতে মুন্নার ক্রেইজ ছিল আরও বেশি। ওর সঙ্গে বেরোলেই প্রচণ্ড ভিড় জমে যেত। শো রুম, বিপণীকেন্দ্র উদ্বোধন, দাওয়াতের পর দাওয়াত লেগেই থাকত।" কথায় কথায় উঠল লন্ডন হাউজের অঙ্গনা মিমির কথাও। সুরভি মোনেম বললেন, "মুন্নার খুব ভাল বন্ধু ছিল মিমি । আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড বলতে পারেন। মিমির সঙ্গে আমার ছেলে-মেয়েদের সম্পর্কও খুব ভাল।" 

পরিবারের সেই স্বপ্নের মত দিনগুলো হারিয়ে গেছে। মুন্নাকে মনে রাখার দায় অনুভব করেনি কেউই। মাঝে-মধ্যে আবাহনী ক্লাবের উৎসব-পার্বণে একটু স্মরণ করা হয়। দু/এক প্যাকেট মিষ্টি পাঠানো হয়। মুন্নাকে মনে রাখার জন্য বলার মত কিছুই করা হয়নি। কোনও আর্কাইভ, স্টেডিয়াম বা ক্রীড়া স্থাপনায় একটু জায়গাও হয়নি মুন্নার! আক্ষেপেরই কথা। নারায়ণগঞ্জে ছোট পরিসরে স্থানীয়ভাবে  'মুন্না স্মৃতি সংসদ' আছে। শুধু এটুকুই। মুন্নার নামটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দৌড়ঝাঁপও অনেক করেছেন সুরভি মোনেম। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। সুরভি মোনেমের কথায়, "সবথেকে আফসোস লাগে, তাদের বাবার খেলা নিয়ে কোন স্মৃতি নাই আমাদের সন্তানদের। অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওর খেলার ভিডিও জোগাড় করতে। কিন্তু কোন আর্কাইভের সন্ধান পাইনি। মুন্না যে খেলত, তার কোন প্রমাণই নাই!"

দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরেন সুরভি। মেয়ে দানিয়া মাস্টার্স করেছেন ফলিত গণিত (অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স) বিষয়ে। এখন উচ্চশিক্ষার্থে আছেন নরওয়ে। ছেলে আজমান সালিদ পড়ছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা নিয়ে। পরিবারের হাল ধরে সন্তানদের সুশিক্ষিত করতে সমর্থ হয়েছেন একাই লড়ে যাওয়া সুরভি। কিন্তু মুন্নার নামটা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় সফল হতে পারেননি। এনিয়ে তার আক্ষেপের শেষ নেই, "আমি খেলার জগতের কিছুই জানিনা। কি করতে হবে, আমাকে নির্দেশনা দেওয়ারও কেউ নাই। মুন্নার নাম বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রধান ভুমিকা কিন্তু রাখতে হবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ও আবাহনী ক্লাবকে। ফুটবলকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মুন্নাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যেসব ক্রীড়াবিদ দেশের জন্য সুনাম-সম্মান বয়ে এনেছেন তাদের স্মৃতি ধরে রাখাটা কর্তব্য বলে আমি মনে করি।"

কর্তব্য পালনের দায়িত্ব যাদের কাঁধে, তারা শুনছেন কি সুরভির চাওয়াটা? মুন্না বা ফুটবলপ্রেমীদের চাওয়াটা?