Published : 27 Mar 2021, 06:08 PM
(কথোপকথন ও শ্রুতিলিখন: অলাত এহ্সান, তরুণ গল্পকার-সমালোচক)
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি পালন করতে পারছি— এজন্য আমার একধরনের ভালো লাগা আছে। কিন্তু গৌরবের জন্য দেশের যেটুকু চেহারা বা চরিত্র হওয়া দরকার ছিল, সেটুকু হয়ে ওঠেনি বলে একধরনের বেদনাও আছে। কারণ ত্রিশ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছেন, দুই লক্ষ নারী ধর্ষিত হয়েছেন, এক কোটি লোক দেশান্তরিত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা লড়াই করেছেন, অকাতরে জীবন দিয়েছেন— দেশটা একটা ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, মানুষের সমঅধিকারের দেশ হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়ে উঠতে পারেনি। হ্যাঁ, উন্নয়ন হচ্ছে, বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রটা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। বাহাত্তরে সংবিধানে বঙ্গবন্ধু যে চরিত্রের কথা সুনির্দিষ্ট করেছিলেন রাষ্ট্রের জন্য— যে চার মূলনীতি— সেটা আর অনুষ্ঠিত হচ্ছে না রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। কাজেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এগুলোতে আমার খারাপ লাগা আছে।
তারপরও বলবো, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ আজকে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের দ্বিগুণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনগুণ এগিয়ে আছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র আমাদের খারাপ বলতো, আমাদের গরীব-মিসকিন বলতো, আমরা তাদের ছাড়িয়ে গেছি— সেটা আনন্দের ঘটনা তো বটেই। আমেরিকা পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন— 'বটম লেস বাসকেট' (তলাবিহীন ঝুড়ি); বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ তা নয়, বরং এখন একটা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। এগুলো গৌরবময় অর্জন, অবশ্যই আমাদের উদযাপন করা উচিত। পাশাপাশি আমাদের স্মরণে রাখা উচিত এদেশে পরাজিত শক্তি— রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস্, স্বাধীনতা-বিরোধীশক্তি, তাদের যে উত্তরসূরী— সারাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে তারা নানা রকম বিভেদ ও বিভাজন তৈরি করছে। এগুলোর প্রতি সরকারের অত্যন্ত কঠোর মনোভাব হওয়া উচিত ছিল, সেটা হচ্ছে না। সেটা প্রতিফলিত হওয়া উচিত, সেটা জরুরি। এই যে ধর্মের কথা বলে সাম্প্রদায়িকার বীজ ছড়াচ্ছে, এতে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সমাজে অনৈক্য তৈরি হচ্ছে। এগুলো তো মুক্তিযুদ্ধের কথা নয়।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর যখন উদযাপন করছি, তখন (সুনামগঞ্জের) শাল্লায় তারা এতগুলি বাড়িঘর— সরকারি হিসেবে আশিটার মতো, বেসরকারি হিসাবে আরো বেশি— লুটতরাজ করেছে, দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই যে লোকগুলো ঘটনা ঘটাচ্ছে, এগুলো স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরকে কালিমা লিপ্ত করছে। সেটি দেখে তো খারাপ লাখছে। আমি আশা করবো আমাদের উত্তরসুরী, আগামীর প্রজন্ম অবশ্যই এসব ঝেড়েমুছে পেছনে ফেলে সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, মুক্তিযুদ্ধের সোনার স্বপ্ন সোনার বাংলা— একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমঅধিকারের এবং সব জাতিসত্ত্বার সমঅধিকারের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে।
এই যে দেশের চলচ্চিত্র, আজকের দিনে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী বা আগের চেয়েও খারাপ অবস্থায় গেছে। তার কারণে হচ্ছে, প্রথম আমরা যাকে 'কমর্শিয়াল গ্রাউন্ড' বা 'বাজার' বলি, সেই বাজারটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। বাণিজ্যিক ছবিও কিন্তু ভাল হয়, একটা নিটোল গল্প বলে। সেই গল্প বলার মানুষগুলো কিন্তু আর আগ্রহী হলো না। কমার্শিয়াল ফিল্ম তামিল অনুসরণে, বম্বে, হলিউড ছবির 'ব্যাড কপি' করে, খারাপ দিকগুলো নিয়ে বানানো। সেসব ছবি নিশ্চতভাবে বক্সঅফিসে তো হিট করলোই না, জনগণও প্রত্যাখান করলো। ফলে ছবি আর সেভাবে হলো না। ভাল ছবি যেটা, আমরা বলি 'বিকল্প ছবি' বা 'শিল্পসম্মত ছবি'— সেটা আলমগীর কবির, শেখ নেয়ামত আলী, সালাউদ্দিন জাকি, বাদল রহমান— এই তো সত্তুর-আশির দশকের চারজনের নাম বললাম; তারপর আমাদের মোর্শেদুল ইসলাম, তারেক মাসুদ এরা এলো। তারপর একটা গ্রুপ আসছে। কিন্তু মুশকিল হলো সিনেমার যদি বাজার না থাকে, সিনেমা হল না থাকে, মানুষ যদি ছবি না দেখে তাহলে চলচ্চিত্রশিল্প তো বাঁচবে না। অর্থাৎ, চলচ্চিত্রের প্রযোজনা আছে, কৌশল আছে- সেগুলা করার মতো লোক থাকবে না, স্বশিক্ষিত বা সুশিক্ষিত লোক থাকবে না, তা তো হয় না। মুশকিল হচ্ছে আজকে, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে ছবি তৈরি যেখানে সহজ হয়ে গেছে, এই সহজের হাত ধরে তারা খুবই খারাপ ছবি, নোংরামির পর্যায় পরে, এমন ছবি বানাচ্ছে। আবার যারা ভাল ছবি তৈরি করছেন, তাদের ছবি দেখার লোক নাই। ব্যাড কমার্শিয়ালের লোক নাই, গুড সিনেমারও লোক নাই। কারোরই কিন্তু লোক নাই।
সত্তুর দশকে চলচ্চিত্রের এত সুন্দর একটা পরিবেশ, আমরা হারিয়ে ফেললাম। ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় বাংলা চলচ্চিত্রের যে উত্থান ঘটে ছিল— একদিকে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চলছে, আরেক দিকে বাংলা চলচ্চিত্রের উত্থান ঘটছে। চলচ্চিত্রে শুধু জনপ্রিয় বা প্রেমের গান না, গণসংগীতও একটা জায়গা করে নিয়েছিল। লালন এসে সম্পূর্ণ অধিকার করে ফেলেছে সত্তুর দশকের ছবিকে। চলচ্চিত্রের যে জোয়ার এসে ছিল, পঁচাত্তর পরবর্তী যে সেনাশাসন-স্বৈরশাসন এসেছিল, এটা তাদের ব্যর্থতা; তারা চলচ্চিত্রকে একটা শিল্পমাধ্যম হিসেবে বিচার করেন নাই। এটাকে তারা পাবলিসিটি হিসেবে গণ্য করেছেন। তারা চায়নি এর বিকাশ হোক। মৌলবাদীরা চায় না চলচ্চিত্র হোক, চিত্রাঙ্কণ হোক, গান হোক; টেলিভিশনে ভাল কাজ হোক— তারা তা চায় না। তারা তো মনে করে এটা ইসলাম সম্মত নয়। এই মৌলবাদী শক্তি, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর এখন নিজেদের অবস্থান শক্ত করে ফেলেছে। একটা বিপরীত স্রোত খুব তরঙ্গায়িত হয়েছে। আমাদের সঠিক স্রোত যেটা, মূল স্রোত যেটা, চলচ্চিত্রের শিল্প স্রোত যেটা, সেটি তার ভূমিকা হারিয়েছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা, পনেরশো সিনেমা হল ছিল সত্তুরের দশকে, এখন সিনেমা হল এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র দুশোর মধ্যে। এটা কেন ঘটলো? কেন মানুষ ছবি দেখতে চায় না? সামাজিক অবস্থা কি ছবি দেখার মতো আছে? সমাজ কি এনকারেজ করছে আমাদের মেয়েদের, আমাদের সন্তানদের ছবি দেখার জন্য? প্রতিদিন মসজিদে বলছে— ছবি দেখতে যাওয়া হারাম? তারা তো বলছে! তারা তো 'আমার সোনার বাংলা' জাতীয় সংগীত গায় না। তারা তো 'জয় বাংলা' বলে না। তারা তো বাংলা সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে না। তারা আরবি সংস্কৃতি চালু করতে চায়। ইসলামও নয়, আরবি সংস্কৃতি। সেটার সঙ্গে তো বাঙালির জীবন যায় না। সাংঘর্ষিক পরিস্থিতে আসলে শিল্পের বিকাশ হয় না। ধারাবাহিক বিকাশ হবে না। দু-একটা তারেক মাসুদের আবির্ভাব ঘটবে, কিন্তু তারপর আর ধারাবাহিকতা থাকবে না। সুতরাং আমার মনে হয় যে, রাজনৈতিকভাবে সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু সিনেমা হল বানালে হবে না, শুধু অনুদান দিলে হবে না।
আমি অনুদান কমিটিতে দীর্ঘদিন ছিলাম। আমি প্রশংসা করি সরকারের অনুদানের ব্যাপারটাকে, কিন্তু অনুদান দেওয়ার পাশাপাশি নিশ্চয়তা দিতে হবে যে— আজকে দর্শক তার কন্যাকে নিয়ে, বোনকে নিয়ে, তার নারী বন্ধুকে নিয়ে বা নারী, ছেলে বন্ধু বা স্বামীকে যদি নিয়ে সিনেমা হলে যায়, তাহলে একটা যানবাহন পাবে, একটা রিকশা পাবে, একটা বেবিট্যাক্সি পাবে বাড়ি ফিরার জন্য, নিরাপদ থাকবে তার রাস্তা। সমাজ তাকে বাধা দিবে না; তাদেরকে মুর্তাদ ঘোষণা করবে না সিনেমা দেখার জন্য, নাটক করার জন্য। এ রকম পরিস্থিতি তো করতে হবে। সমাজ তো ওই জায়গায় নাই। সত্তুরের সমাজ তো না এটা। পঁচাত্তরের পরে ক্রমশ এমন জায়গায় গেছে, এইখানে অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। একটা ধর্ম-রাষ্ট্রের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি। সেটা হচ্ছে ধর্মের নাম ব্যবহার করে একদল তস্কর দেশে এমন এক ধরনের সামাজিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে যেটা আগামীতে আমাদের স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। সাংস্কৃতিকভাবে একটা সংঘাতের কাল চলছে।
একইভাবে মঞ্চ নাটকেও ঘটছে। মঞ্চ নাটক তো এখন কম লোক দেখে। হবেই তো, স্বাভাবিক তো। কেন, ছেলেরা তাদের প্রোফেশন হিসেবে নাটককে নিতে পারে নাই? সরকারের যেটা করা উচিত সেটা তো করলো না। করা তো উচিত ছিল কালচারাল মিনিস্ট্রির। আমাদের কিছু অভিনেতাকে কিছু মাসোহারা দিয়ে রাখতে পারতো। এখন সে সারাদিন কাজ করবে একটা এনজিও অফিসে, একটা ব্যাংকে বা একটা স্কুলে এবং সন্ধ্যার সময় নাটক করবে! এবং সেটা কতদিন কন্টিনিউ করা যায়? তারপর রাস্তাঘাটের নিরাপত্তাহীনতা তো একটা আছেই। মেয়েদের এখন ছেলেরা দলে নিতে চায় না। ছেলেরাও এখানে আসতে চায় না, কারণ বম্বের বস্তা পঁচা সিরিয়ালগুলো তারা দেখছে। তাও হয়তো দেখছে না কেউ। এখন যে কি রকম সময় যাচ্ছে— এটা একটা অদ্ভুত রকম খারাপ সময়। দেশ এক জায়গায় উন্নতি করেছে, কিন্তু সংস্কৃতির জায়গায় কোনো উন্নতি করতে পারে নাই।
মেধার সংকট আমাদের আছে। তবে আমি ওই মেধার বিশ্বাস করি না। আমি বলি যে আমার একভাগ হচ্ছে মেধা বা প্রতিভা, আর নিরানব্বই ভাগ হচ্ছে আমার শ্রম। কিন্তু আমাকে পরিশ্রম করার মতো সেই স্পেস দিবেন তো। আজকে একটা আযান পড়লে নাটক বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক আছে। তারপর কি হচ্ছে? এখন শুরু হয়েছে, নামাজের জন্য বিশ মিনিটি নাটক বন্ধ রাখতে হবে। তাহলে দুবার এক নামাজে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আবার মাগরিবে নামাজের পরই এশার নামাজ হয়। চারবার যদি নামাজের জন্য নাটকে যতিচিহ্ন পরে, তাহলে নাটক করা যায় আর! তাহলে সে নাটক কেন লোকজন দেখবে, কেন আমি করবো?
প্রত্যেকটা থিয়েটার হলের পাশে মসজিদ বানিয়েছেন। যেখানে নাটক হবে, গান হবে তার পাশে মসজিদ দিয়েছেন। সেখানে আযান দিচ্ছেন, তাকে ডিসকারেজ করছেন। এটা হতে পারে না।
লেখালেখিতে সেনসর একটা বড় ঝামেলা। লেখালেখিতে একধরনের সেল্ফ সেনসর তৈরি হয়ে গেছে, সেটা এক ধরনের ক্ষতি করেছে— আমি কি লিখতে পারবো, কি লিখতে পারবো না। সেটা নিয়ে অনেক বিপদ হয়েছে সবারই। তারপরও বলবো, বর্তমান সরকারের সময় অতবড় সেনসর নাই। আর এটাও ঠিক, সেলিম আল দীনের মতো একজন নাট্যকারের অভাব আছে যে নতুন পথ দেখাবে। সেলিম তো নতুন একটা পথ দেখিয়েছিল— বাংলা নাটক, বাঙালির নাটক। স্বাধীনতার পর একটা জাতিসত্ত্বা বিদেশি নাটকের আঙ্গিক অনুসরণ না করে নিজস্ব আঙ্গিকে, হাজার বছরের আঙ্গিক আধুনিক নাটকে ব্যবহার করেছেন। সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বন্ধ হয়ে গেছে আজকাল। এখন সবই চাকরির জন্য করা হয়। থিয়েটার করে তো আর চাকরি রাখা যায় না। খুব বিপদ আসলে।
নাটকে তো সেনসর নাই, তবু নাটক তো হচ্ছে না। পালা গান তো হচ্ছে না। আপনি তো এনকারেজ করছেন না, সরকার তো এনকারেজ করছে না। উপজেলা চেয়ারম্যান আছেন, পৌর মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আছেন, বড় বড় ব্যবসায়িরা আছেন যারা কোটি কোটি টাকা বানাচ্ছেন— আমরা সবাই কোনো না-কোনোভাবে ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত— আমরা তো তাদের এনকারেজ করছি না। সংস্কৃতি রাষ্ট্র যেমন বাঁচাবে, সমাজের নেতৃস্থানীয় যারা আছেন— তাদেরও দায়িত্ব আছে তার সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার। সেটা তো হচ্ছে না। আপনি মাদরাসা করছেন, মসজিদ করছেন, কিন্তু আপনি তো কোনো থিয়েটার হল করছেন না, লাইব্রেরি করছেন না, আপনি তো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার উপযোগী কোনো স্পেস তৈরি করছেন না। তাহলে কি করে আশা করেন এখানে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে?