শহীদ মা-ছেলের রক্তের ঋণ এভাবেই শোধ হবে!

নাজমুল হক তপন
Published : 25 March 2021, 03:00 AM
Updated : 25 March 2021, 03:00 AM

মুক্তিযুদ্ধে মানিকগঞ্জের শহীদ যোগমায়া চৌধুরী ও তার ছেলে তপন চৌধুরীর কাহিনী ট্র্যাজিক সিনেমাকেও হার মানায়। 

একাত্তরে সন্তান শহীদ হয়েছেন এবং সে দুঃসহ স্মৃতির ভার আজীবন বহন করতে হয়েছে জননীকে, মুক্তিযুদ্ধে এমন ঘটনা অসংখ্য। মানিকগঞ্জের চৌধুরী পরিবারে 'কালী পিসি'খ্যাত যোগমায়া চৌধুরীকে সে ভার বইতে হয়নি। ছেলে তপন চৌধুরী শহীদ হওয়ার আগেই মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে শহীদ হন তিনি। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আগে শহীদ হন কালী পিসির ছেলে তপন। 

গঙ্গাধরপট্টির চৌধুরী বাড়িকে বাদ দিলে মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এক কথায় অসম্পূর্ণ। এটুকু বললে কালী পিসিকে পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরা যাবে না। 

১৯৫২ পরবর্তী সময়ে সরকারি বিধি-নিষেধ আর নানাবিধ সামাজিক বাধা উপেক্ষা করে খালি পায়ে মেয়েদের নিয়ে ফুল দিয়েছেন শহীদ মিনারে। সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন নিবেদিত। 

১৯৬৭ সালে মানিকগঞ্জ মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠকালীন সেক্রেটারি ছিলেন যোগমায়া। ১৯৫০ ও ৬০ এর দশকের মহকুমা শহর মানিকগঞ্জের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সামাজিক উন্নয়নে তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল।

তিনি ছিলেন ক্রীড়ানুরাগী। তৈরি করেছিলেন 'ইয়ুথ ক্লাব'। এ ক্লাবের হয়ে খেলতেন দেশ সেরা অনেক তারকা ফুটবলাররাও।

ক্রীড়া-সংস্কৃতি ও রাজনীতি, সর্বোপরি স্বাধীন দেশের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একটি পরিবার কীভাবে একাত্ম হয়ে উঠতে পারে, তারই দৃষ্টান্ত 'কালী পিসি' এবং গঙ্গাধরপট্টির চৌধুরী বাড়ি। যোগমায়ার তিন ছেলে তপন, প্রকাশ ও বিকাশ সম্মুখ সমরের মুক্তিযোদ্ধা। তাদের মধ্যে তপন মুক্তিযুদ্ধে বহু বীরত্বগাঁথার জন্ম দিয়ে শহীদ হন।  

১৯৬০-এর দশকে ঢাকার মাঠের হাতে গোনা তারকা ফুটবলারদের একজন ছিলেন তপন চৌধুরী। যেহেতু চৌধুরী বাড়ির সন্তান, তাই রাজনীতি থেকে বাইরে থাকেন কীভাবে?  ১৯৬৭ সালে জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জিতেছিলেন ক্রীড়া সম্পাদক পদে।

 ১৯৬০-র দশকে বিজি প্রেস, ওয়ান্ডারার্স, ওয়ারীর মত প্রথম সারির ফুটবল ক্লাবে খেলেছেন তপন। সবশেষ খেলেছেন ওয়ারীতে। ওই সময় ওয়ারীতে খেলেছেন কাজি সালাউদ্দিন (বর্তমান বাফুফে সভাপতি), জাহাঙ্গীর শাহ বাদশার ( ১৯৭০ ও ৮০-র দশকে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা অলরাউন্ডার) মত খ্যাতিমানরা। 

১৯৬৮ সালে অংশ নেন আগা খান আন্তর্জাতিক গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টে; একই বছর লাহোরে অনুষ্ঠিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক দলের হয়ে খেলেন পাকিস্তানের জাতীয় ফুটবল টুর্নামেন্টে। 

শুধু ফুটবল নয়, অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, বর্শা নিক্ষেপ, ক্রিকেট- সব খেলাতেই তপন প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৬৭ সালে আন্তঃকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জগন্নাথ কলেজের হয়ে ৪০০ ও ৮০০ মিটার দৌড় ও বর্শা নিক্ষেপে চ্যাম্পিয়ন হন। 

এর আগে ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে রিলেতে পান রৌপ্য পদক। ঢাকা বিভাগ ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে মানিকগঞ্জের হয়ে এককে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখান। 

১৯৬৫ সালে আন্ত স্কুল সাঁতার প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে ১০০ ও ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে অধিকার করেন প্রথম স্থান। পাকিস্তান স্বাধীনতা দিবস দূরপাল্লার সাঁতারে একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হন। ওই সময় মানিকগঞ্জ ক্রিকেট লিগ ছিল বেশ জমজমাট। লিগে প্রায় নিয়মিত ছিলেন তপন। 

দেশের স্বাধীনতার ডাকে প্রিয় সেই খেলার ভুবন ছাড়তে তপন বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি; ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনে। 

১৯৬৭ সালে কলেজ সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকারের মদদপুষ্ট ছাত্র সংগঠন এনএসএফ এর রোষানলে পড়েন। এনএসএফ গুণ্ডাবাহিনীর আক্রমণে মারাত্মক আহত হয়ে মাসখানেক চিকিৎসা নিতে হয় তপনকে। 

সরকারি বাহিনীর ওই জুলুম তাকে দমাতে পারেনি, উল্টো দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে হয়ে ওঠেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। 

১৯৬৮ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। তপন ও তার বন্ধুরা মিলে কুকুরের গলায় আইয়ুব খানের ছবি আর লেজে পাকিস্তানের পতাকা বেঁধে ঘোরালেন পুরো মানিকগঞ্জ শহর। এর ফল হল রাষ্ট্রবিরোধী মামলা। তপনকে গ্রেপ্তার করা হল। 

কয়েক মাস কারা ভোগের পর মুক্তি পান তিনি। সেই তপনই ১৯৭১ সালে মার্চের মাঝামাঝি সময়ে মানিকগঞ্জে এসডিওর বাসভবন ও আদালতে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের নেতৃত্ব দেন।

 ১৯৫০ ও ৬০ এর দশকে মানিকগঞ্জ শহরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলার  প্রাণকেন্দ্র ছিল গঙ্গাধর পট্টির চৌধুরী বাড়ি। এরপর স্বাধীনতা সংগ্রাম যত দানা বেঁধেছে, ওই বাড়ি ততই স্থানীয় রাজনীতির কেন্দ্রে চলে এসেছে , স্বাধীনতাকামী মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। 

স্থানীয় নেতা কর্মীদের আনাগোনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চৌধুরী বাড়িতে চলতে থাকে গোপন বৈঠক, সেখান থেকে আসতে থাকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বাড়তে থাকে কালী পিসির  ব্যস্ততা। দশভূজার মত তিনি সব দিক সামলান।

 ২৫ মার্চ, কাল রাত। হায়েনার মত পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। চারিদিকি শুধু মৃত্য আর স্বজন হারানোর আহাজারি। 

সেই রাতের পরও হত্যাযজ্ঞ থামেনি। বিশেষ করে 'টার্গেট করে' হত্যা চলতে থাকে। ততদিনে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মানিকগঞ্জে যদি প্রথম কোনো বাড়ি আক্রান্ত হয়, সেটা হবে চৌধুরী বাড়ি। বাস্তবে হলোও তাই। 

এপ্রিলের মাঝমাঝি সময়ে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে দেয় গঙ্গাধর পট্টির চৌধুরী বাড়ি। সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন কালী পিসি ও তার পরিবার। আগেই পুরো পরিবার নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ভাই হরিপদ গোস্বামীর বাড়ি (সবার প্রিয় ভানু স্যার)। তবে ঘিওর থানার ভুলুণ্ডি গ্রামে গিয়েও রক্ষা হয়নি। 

মে মাসের ২৫ বা ২৬ তারিখ। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় যোগমায়ার অবস্থান জেনে যায় হানাদার বাহিনী। গভীর রাতে ভানু গোস্বামীর বাড়ি ঘেরাও করে তারা। পিঠ মোড়া করে বেঁধে ভানু স্যার ও কালী পিসিকে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্যাতন করা হয়। এরপর গুলি করে নিশ্চিত করা হয় মৃত্যু। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ফেলে রাখা হয় দুজনের মৃতদেহ।

এদিকে ২৬ মার্চের পর থেকেই সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় মানিকগঞ্জে। ক্যাপ্টেন হালিমের নেতৃত্বে মানিকগঞ্জের ট্রেজারি থেকে বেশ কিছু অস্ত্র লুট করা হয়। সেগুলো যাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়, তাদের একজন তপন চৌধুরী। 

প্রতিরোধের শুরুতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করার দায়িত্ব পান তিনি। তখন সঙ্গী-সাথীসহ নয়ার হাটের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু অস্ত্র-লোকবল কম থাকায় ধামরাইয়ের কাছাকাছি পুলিশের বাধার মুখে তার মিশন পুরোপুরি সফল হয়নি। 

যুদ্ধের মধ্যে তপন কোথায় কী করছেন সেই খবর অক্টোবর পর্যন্ত পাচ্ছিলেন ছোট ভাই বিকাশ চৌধুরী। সবশেষ যে তপনকে দোহার-নবাবগঞ্জে দেখা গেছে, সেকথাও জেনেছেন। 

তপনের শহীদ হওয়ার খবর বিকাশ পেয়েছিলেন দুদিন পর। একই ফ্রন্টে যাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তপন লড়াই করেছিলেন, তাদের কাছ থেকে খবরটা পেয়েছিলেন তিনি। 

বিকাশ বলেন, "শুরুতে আমি আর ভাই একই ক্যাম্পে ছিলাম। একবার ঘিওরে পাকিস্তানি সৈন্যরা একটা বাড়িতে দিনে-দুপুরে আগুন দিয়েছিল। আমি আর ভাই ঝুঁকি নিয়ে সেই আগুন নিভিয়েছিলাম। মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল আমার ভাই। একের পর এক দুঃসাহসিক মিশনে যাচ্ছিল। অক্টোবরে এক অপারেশনে শহীদ হল।"

বিকাশও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন শুরু থেকেই। তবে মুজিব বাহিনীতে যোগ দেন যুদ্ধের শেষ দিকে। মুজিব বাহিনীর হয়ে বিভিন্ন অপারেশনেও অংশ নেন।

মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীকে কীভাবে নাজেহাল করেছিলেন, সে কথাও বলেন বিকাশ, যার ডাক নাম বাচ্চু। 

ভাই তপন চৌধুরীর মতই ছিলেন অ্যাথলেট। ঢাকা মাঠের ফুটবলে ছিলেন পরিচিত মুখ। ঢাকার ফুটবলে তার আদুরে নাম ছিল 'গ্যাটিস'। সব পজিশনেই খেলতে পারতেন বলেই ওই নাম। ভাইয়ের মতই খেলেছেন ওয়ারী ক্লাবে। 

বাচ্চু বলেন, "মানিকগঞ্জ ইয়ুথ ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করি। এটি আমাদের পারিবারিক ক্লাব। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান পিডব্লুডি ক্লাবের হয়ে খেলার আমন্ত্রণ পাই। ওই বছর পাকিস্তান যুব দলের হয়ে খেলি। 

"দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবুল হাশেম। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ওয়ারী ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। হাশেম সাহেব আমাকে ওয়ারী ক্লাবে খেলার প্রস্তাব দেন। আমার ভাই তপন চৌধুরী খেলতেন বলে ওয়ারী ক্লাবের প্রতি আমার সব সময়ই বাড়তি আকর্ষণ ছিল। তাই ওয়ারীতে যোগ দিই। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ওয়ারীতেই খেলেছি।"

ঢাকা থেকে খেলার পর্ব চুকিয়ে মানিকগঞ্জ শহরে ফেরার পর বাচ্চু হাত দেন সাংগঠনিক কাজে। কিছুদিন মানিকগঞ্জ ফুটবল দলের কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শেখ রাসেল সাংস্কৃতিক ক্রীড়াচক্র। 

সেই বৈরী প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শেখ রাসেলের নামে সংগঠন দাঁড় করানো সহজ ছিল না। বাচ্চুর তত্ত্বাবধানে থাকা শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র স্থানীয় রনজিত স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখায়। সেই শিল্ড ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে দিয়ে আসেন বিকাশ চৌধুরী বাচ্চু।

এরপর ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেন। এখন একরকম স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছেন। মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাব থেকে স্থানীয় এক সাংবাদিকের সহায়তা নিয়ে তার নাগাল পাওয়া সম্ভব হয়।

এর আগে অনেকেই বলছিলেন, বাচ্চু চৌধুরী কাউকে ফোন করা তো দূরে থাক, ফোন ধরেনও না। এর সত্যতাও পাওয়া গেল। অনেক কষ্টে ফোন নম্বর পাওয়া গেলেও তাতে লাভ হল না। 

স্থানীয় ওই সাংবাদিক বললেন, 'ফোনে চেষ্টা করে উনাকে পাওয়া যাবে না। বরং উনার বাসায় যাই। উনি যে এলাকায় বাসা ভাড়া করে থাকেন জায়গাটা আমি চিনি।' 

লোকজনকে জিজ্ঞেস করে পৌঁছানো গেল বাচ্চু চৌধুরীর বাসায়। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বললেন, "আসলে এসব নিয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া আমি নিজেও খুব অসুস্থ। আর এসব শুনে কী করবেন? আর বলেই বা লাভ কি?" 

তখনও আমরা দরজার বাইরে দাঁড়ানো। একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। আমাদের হতাশ চেহারাটা দেখে উনি ভেতরে নিয়ে গেলেন। বললেন, "পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলব না। তপন চৌধুরীর কথা শুনতে এসেছেন তো?" 

পাঁচ মিনিট গড়লো ঘণ্টার কাটায়। মা যোগমায়া চৌধুরী, দাদা তপন চৌধুরীর প্রসঙ্গ উঠল। বললেন, "এসব শুনে কী করবেন? আর লিখেই বা কী হবে? এদেশে কি কোনো কিছুর মূল্যায়ন আছে?"

জানালেন, ঘরে ছবি-ডকুমেন্টেশন তেমন কিছুই নাই। পারিবারিক ছবিও নাই। 

বললেন, "কোনো কিছুই গুছিয়ে রাখিনি। এসব রেখে হবেটা কী? যে যা চেয়েছে, দিয়ে দিয়েছি। এখন এসব নিয়ে আর ভাবি না। স্ত্রী অসুস্থ। ওকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে যাবতীয় দেখভালের দায়িত্ব আমার। এদিকে আমার নিজের শরীরও ভালো যাচ্ছে না। কেউ আমাকে ডাকে না, আমিও কোথাও যাই না।"

কথা প্রসঙ্গে উঠল ঢাকার ফুটবলের কথা। তারুণ্যে খেলেছেন তারকা ফুটবলারদের সঙ্গে। এদের একটি অংশ ১৯৬০ এর দশকে খেলেছেন তাদের পারিবারিক ক্লাব মানিকগঞ্জের ইয়ুথ ক্লাবে। একটা পর্যায়ে এল সালাউদ্দিন, বাদশার নাম। 

১৯৬০ এর দশকে ফুটবল ও ক্রিকেট দুই খেলাতেই সমীহ জাগানো নাম জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রধান খেলা হিসেবে ক্রিকেটকেই বেছে নেন তিনি। হয়ে ওঠেন দেশ সেরা অলরাউন্ডার।

পরে ঢাকায় ফিরে তাকে ফোন করেছিলাম। তপন চৌধুরীর কথা তুলতেই বললেন, "ও তো জমিদার পরিবারের ছেলে। আমিও তো ওয়ারীতে ফুটবল খেলতাম। মানিকগঞ্জে অনেকবার গিয়েছি। তখন মানিকগঞ্জ যেতে ফেরি পার হতে হত। যতদূর মনে পড়ে, বেশ ভাল টাকা পেতাম। ওদের ( চৌধুরী পরিবার) পরিবার পৃষ্ঠপোষকতা করত।"

চৌধুরী পরিবারের উত্তরাধিকারী বিকাশ চৌধুরী বাচ্চু নিজের শহরেই থাকছেন ভাড়া বাসায়। সেখানেই কথা হল তার সাথে। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্ত্রী-সন্তান হারানোর  শোক বেশিদিন বইতে পারেননি বাবা যশোদা লাল চেীধুরী। দেশ স্বাধীন হওয়ার তিন বছরের মধ্যে সন্তান অরিন্দমকে নিয়ে কলাকাতায় চলে যান তপন চৌধুরীর স্ত্রী স্বপ্না চৌধুরী। ১৫ অগাস্ট ট্র্যাজেডির পর নতুন করে বিপদ নেমে আসে চৌধুরী পরিবারের ওপর। অর্পিত সম্পত্তি আইনের প্যাঁচে বাচ্চুরা বসতবাড়ি হারান। 

গঙ্গাধর পট্টির চৌধুরী বাড়িটি এখন সরকারি স্থাপনা। সরকারি মহিলা কলেজের হোস্টেল, ল্যাবরেটরি হয়েছে সেখানে। 

বাচ্চু চৌধুরী বলেন, " এটা আমাদের পারিবারিক বসত ভিটা। ষড়যন্ত্র করে দখল করা হয়েছে। মামলায় চারবার জিতেছি। কিন্তু সুরাহা হয়নি। আমাদের কোনো ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি।"

যোগমায়া চৌধুরীর নাতি বিকাশ চৌধুরীর ছেলে ক্রীড়া সাংবাদিক দেব চৌধুরী বলেন, "আমাদের পারবারিক সম্পত্তির উপর সরকারি স্থাপনা হয়েছে, এখন তো আর কিছুই করার নাই। তবে দেশের প্রচলিত আইনে আমাদের হক বুঝিয়ে দিতে সমস্যা কোথায়? মামলায় আমার বাবা বৈধ উত্তরাধিকারী হিসাবে বেশ কয়েকবারই জিতেছেন। কিন্তু একটা রিটের কারণে কয়েকবছর ধরে বিষয়টা আদালতে ঝুলে আছে।"

যশোদা চৌধুরী ও যোগামায়া চৌধুরীর দশ সন্তানের মধ্যে সাত ছেলে ও তিন মেয়ে। সবাই যার যার ক্ষেত্রে নিজ গুণে পেয়েছেন প্রতিষ্ঠা। কিন্ত যে বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জের মানুষের সুখ-দুঃখ আর সৃজনশীলতার তীর্থক্ষেত্র, সেই চৌধুরী বাড়িই এখন তাদের নেই। দেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যে পরিবারের ছিল আত্মিক যোগ, সেই পরিবারের সন্তান আজ নিভৃতচারী, বলা যায় 'স্বেচ্ছা নির্বাসনে'। 

মানিকগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সুদেব কুমার সাহা বললেন, "বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চৌধুরী পরিবারের অবদান অনেক। দেশের অন্যতম ক্রীড়া পরিবার তারা। তবে বাচ্চু চৌধুরী কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না।" 

ওই পরিবারের অর্জনকে সামনে নিয়ে আসার একটা দায়িত্বও তো মানিকগঞ্জবাসীর থাকা উচিৎ। এ প্রসঙ্গে সুদেব সাহার উত্তর, "আমরা আমাদের মত চেষ্টা করি। তবে পরিবারের লোকজনকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে।"

দেব চৌধুরী বললেন, "আমি ১১ বছর ধরে মূলধারার সাংবাদিকতা করছি। আমাদের পারিবারিক বিষয় নিয়ে কোনোদিন কারো সঙ্গে কথা বলিনি। আমি এটা বুঝি যে,  বাবার অভিমান অনুধাবন করার মত কেউ নাই। তবে এটুকু বলতে পারি, আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে যে ঝড় ঝাপটা বয়ে গেছে, তা খুব কম পরিবারের ক্ষেত্রেই ঘটেছে।"

বাচ্চু চৌধুরীর একটি কথায় স্পষ্ট হল হতাশা আর কষ্ট । 

শেষ পর্যায়ে এসে তিনি বললেন, "১৯৮১ সালে দেশের কয়টা লোক প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ করার সাহস দেখিয়েছে? আমি ওই সময় শেখ রাসেল ক্রীড়া সাংস্কৃতিক ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছি। ক্লাবটিকে স্থানীয় টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন করিয়েছি। ট্রফি দিয়ে এসেছি ৩২ নম্বরে, আপার (শেখ হাসিনা) হাতে।"  

বাস্তবতা হচ্ছে, শহীদ জননী যোগমায়া চৌধুরীর বংশধরেরা এখন বাস্তুচ্যুত।