আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: কী আশায় বাঁধি খেলাঘর!

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 23 Feb 2021, 10:06 AM
Updated : 23 Feb 2021, 10:06 AM

'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়!' শুনে আমরা আবেগাক্রান্ত হই। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়নি। বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান, পশতুনসহ পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের ওপর যে রাষ্ট্রভাষাটি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই উর্দু পাকিস্তানের কোনো জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ছিল না। উর্দু ছিল মূলত উত্তর ভারত থেকে আমদানি করা একটি ভাষা এবং পাকিস্তানের জাতির পিতা জিন্নাহ নিজেই এ ভাষা ঠিকঠাকমতো বলতে পারতেন না।

সরকার মাত্রেই কেন একাধিক রাষ্ট্রভাষার দাবি মানতে রাজি হয় না? প্রথমত, একাধিক রাষ্টভাষা রাষ্ট্রের ঐক্য ও অখণ্ডতার পরিপন্থী হওয়া অসম্ভব নয়। যে কোনো সরকার নিয়ন্ত্রণ চায় এবং যে কোনো বৈচিত্র্যই নিয়ন্ত্রণের কাজটাকে কঠিন করে তোলে। দ্বিতীয়ত, একটির জায়গায় দুটি বা তিনটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলে রাষ্ট্রীয় খরচ বহুগুণ বেড়ে যায়। তৃতীয়ত, কোনো জনগোষ্ঠীর ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিলে তার এতটাই সমৃদ্ধি হতে পারে যে ভবিষ্যতে সেই জনগোষ্ঠী স্বায়ত্বশাসন দাবি করতে পারে। যেকোনো ধরনের স্বায়ত্বশাসন রাষ্ট্রের অখণ্ডতার জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ স্বায়ত্বশাসন স্বাধীনতায় রূপ নিতে দেরি হয় না।

সব জাতি মিলে একই জাতিরাষ্ট্র গঠন করতে হলে একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা অপরিহার্য বলে ভাবাটা সরকারের দিক থেকে দোষের কিছু হতে পারে না। পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সিদ্ধান্ত সঠিকই ছিল। কিন্তু যাহা তোমার জন্যে সঠিক, তাহা আমার জন্যে বেঠিক, হতে পারে আমার মৃত্যুর কারণ। বাংলা ভাষার মৃত্যু এবং পরিণামে বাঙালি জাতির মৃত্যু ঠেকাতে '৫২ সালের ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলার পরিবর্তে পাকিস্তান সরকার যদি বাঙালিদের ওপর একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাপিয়ে দিতে সক্ষম হতো, তবে বাঙালির কয়েক প্রজন্ম চাকরি-ব্যবসা-শিক্ষা সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে যেত। অস্বীকার করার উপায় নেই, ভাষা আন্দোলনের মূল কারণ আগাপাশতলা আর্থরাজনৈতিক। ভাষার আন্দোলন মাত্রেই রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন। পৃথিবীর কোথাও মাতৃভাষার জন্যে কোনো আন্দোলন কখনও হয়নি।

নাগরিকের জন্যে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্যে নাগরিক নয়। সমান সুযোগ-সুবিধা পেলে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক নিজেকে সমৃদ্ধ করে সমাজের, দেশের, পৃথিবীর সেবা করতে পারে। যে জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায় না, সেই জনগোষ্ঠী নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর তুলনায় কম সুযোগ-সুবিধা পায়। রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত কোনো একটি গোষ্ঠীর কোনো একটি ক্ষেত্রে কম সুযোগ-সুবিধা পাওয়াটা সংবিধান এবং মানবাধিকারের পরিপন্থী।

মাতৃভাষার মৃত্যু ঠেকানো এবং প্রতিটি মাতৃভাষার সমৃদ্ধি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল চেতনা। নিছক আবেগ, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে ভাষাকে বাঁচানো যায় না। কোনো ভাষাকে বাঁচাতে হলে সেই ভাষাটিকে কমবেশি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা দিতে হয়। সুলতানি ও ব্রিটিশ আমলে বাংলা ভাষার সামাজিক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর সাড়ে চার দশক অতিক্রান্ত হবার পরেও বাংলাভাষা এখনও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা পায়নি।

অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার অভাবে একটি ভাষার মৃত্যুঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। প্রমিত বাংলার মৃত্যুঝুঁকি আছে। 'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়!' বিখ্যাত গানের এই পংক্তিটি পুরোপুরি অসত্য নয় এ কারণে যে রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার মৃত্যুঝুঁকি শতগুণ বেড়ে যেত। চট্টগ্রামি, সিলেটি, নোয়াখাইল্যা, বরিশাইল্যা ইত্যাদি তথাকথিত উপভাষা কিংবা গারো বা মারমার মতো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কোনো প্রকার প্রতিষ্ঠা নেই বলে সেগুলোর মৃত্যুঝুঁকি বাংলার তুলনায় বহুগুণ বেশি।

কোনো ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কমবেশি স্বীকৃত হবার অর্থ হচ্ছে, ভাষাটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অনেক দেশেই একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে। কানাডায় যদি ফরাসি ও ইংরেজি – দুটি ভাষা এবং সুইজারল্যান্ডে ফরাসি, ইতালিয় এবং জার্মান – তিনটি ভাষা রাষ্ট্রভাষা হতে পারে, তবে বাংলাদেশে চট্টগ্রামি বা গারো কেন রাষ্ট্রের সামান্য মনোযোগও পাবে না? প্রমিত বাংলা আর চট্টগ্রামির গুরুত্ব সমান নয় – এমন অপেশাদার কুযুক্তি যারা দেবেন, তাদের বলব, প্রথমত, হাতির পা হাতির জন্যে যতটা অপরিহার্য, ইঁদুরের পা-ও আকারে ছোট হলেও, ইঁদুরের অস্তিত্বের জন্যে সমান অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, ভাষাব্যবহারকারীর সংখ্যার কথা যদি বলেন, তবে বলবো, চট্টগ্রামিভাষীর সংখ্যা চেক বা শ্লোভাকভাষীর তুলনায় বেশি।

আমার চোখের সামনে আমার মাতৃভাষা চট্টগ্রামি ধীরে ধীরে মরছে, কারণ চট্টগ্রামের বেশিরভাগ অভিভাবক 'ছোটলোক বা কাজের বুয়ার ভাষা'- এই অজুহাতে নিজেদের সন্তানদের এ ভাষা শিখতে উৎসাহ দেন না। আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব হওয়া উচিত, মাতৃভাষা নিয়ে এ ধরনের কুসংস্কার দূর করা। বাংলাদেশের যাবতীয় আঞ্চলিক ভাষা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা এবং পৃথিবীর প্রতিটি মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাবার পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করাও এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বাংলা একাডেমির দায়িত্ব হওয়া উচিত, প্রমিত বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা।

যাদুঘরে গজদন্ত প্রদর্শন করে হস্তী প্রজাতিকে বাঁচানো যাবে না। একইভাবে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে নিছক ভাষার নমুনা আর পোস্টার সংগ্রহের ছেলেখেলা করে বছরের পর বছর ধরে জনগণের অর্থের অপচয় করা যাবে, কাজের কাজ কিছুই হবে না। কোনো মুমূর্ষু ভাষার ব্যাকরণ বা শব্দকোষ তৈরি করেও সেই ভাষার মৃত্যু ঠেকানো যায় না। যে কোনো ভাষা আগে পরে মরবেই। তবে কোনো ভাষাকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা দিয়ে সেই ভাষার মৃত্যু যে বিলম্বিত করা যেতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেগুনবাগিচায় স্বেতহস্তী পালনে যতটা উৎসাহী, আসল কাজে ততটা তৎপর নয়।

কাগজে-কলমে রাষ্ট্রভাষা হলেও বাংলা কাজে-কর্মে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা নয়। বাংলা ভাষা সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম হয়ে ওঠেনি। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই বললেই চলে। আমলাতন্ত্র কিংবা সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীণ ভাষাও কি বাংলা? সব আঞ্চলিক ক্রিকেট টিমের নাম, বেশির ভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, 'টেলিটক', 'বিজিবি' ইত্যাদি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম ইংরেজিতে রাখা হয়েছে। সরকার নিজেই যে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করতে উৎসাহী নয়, তার প্রমাণ সরকারি বিদ্যালয়ে 'ইংলিশ ভার্সন' চালু হয়েছে দশক খানেক আগে।

'কী আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে!' একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার গর্বে ও আনন্দে আটখানা হয়ে আমরা একুশের মূল চেতনা 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' ইতোমধ্যে ভুলে বসেছি। বাঙালির সব অর্জনই আগেপরে ছিনতাই হয়ে যায়, কিছুটা কপালদোষে, অনেকটাই নিজের দোষে।