ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ ও টিকার হালাল হারাম

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 6 Jan 2021, 08:59 AM
Updated : 6 Jan 2021, 08:59 AM

"Nationalism: An infantile disease. It is the measles of mankind" আইনস্টাইনের এই উক্তি যেন বিধিলিপির মতো সেঁটে আছে মানবজাতির কপালে। একাডেমিক পরিসরে নানা ধরনের জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনা হলেও 'ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ' এখনো সেভাবে আলোচনায় আসেনি। 'ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ' প্রথম আলোচিত হয় ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়া যখন H1N1 এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করে। কয়েকটি ধনী দেশ আগাম চুক্তি (প্রি পারচেজ এগ্রিমেন্ট) করেছিল ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য। বৈষম্যমূলক এই চুক্তির বিপরীতে কোনো আন্তর্জাতিক লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কও নাই।

কোভ্যাক্স স্কিম নিয়ে আলোচনা চলছে যাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর GAVI (গ্লোবাল অ্যালায়েন্সে ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমুনাইজেশান) মিলে সল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য দুই বিলিয়ন টিকা সরবারহ করবে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার চূড়ান্ত ট্রায়ালের অনেক আগেই আমেরিকা, ব্রিটেন আর জার্মানির মতো সম্পদশালী দেশগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে আগাম চুক্তি করে রেখেছিল টিকা প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর সাথে। যখন কোনও দেশ শুধু সেই দেশের নাগরিকদের জন্য টিকার ডোজগুলি সংরক্ষণ করার চেষ্টা করে, তখন তাকে 'ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ' বলে। বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে 'ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ' এর লড়াই। এই নতুন দ্বন্দ্ব কোথায় গিয়ে শেষ হয় কে জানে? যদিও জার্মান প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ''কোভিড-১৯ থেকে কেউ নিরাপদ নয়, এটা থেকে আমরা সবাই নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত আসলে কেউই নিরাপদ নয়। যারা নিজেদের সীমান্তের ভেতরে ভাইরাসকে জয় করেছে, তারাও অন্যরা জয়ী না হওয়া পর্যন্ত নিজের সীমানার ভেতরে বন্দি"। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস বলেন, গরিব দেশগুলো ভ্যাকসিন পাবে-এটা নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল বিশ্ব থেকে করোনা দূর করানো যাবে। (ডয়চে ভেলে)

সার্স ইবোলা আমাদের জন্য ভৌগলিক কারণেই বাস্তবতা হয়ে দেখা দেয়নি। ২০২০ শুরু হয় নতুন ভাইরাসের শঙ্কা নিয়ে। জানুয়ারির শুরু থেকেই হাওয়া দিচ্ছিল আর এপ্রিলে তো থাবাই বসাল। ওলটপালট ঘটে যায় আমূল। কেঁপে উঠে মানব অস্তিত্বের ভিত। করোনাভাইরাসের করাল থাবায় পড়তে হয় এই জনপদকেও। ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় কম মরণঘাতী হলেও এর অর্থনৈতিক অভিঘাত এখনো বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি।

'ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ'-এর সাথে শুরু হয়েছে টিকার হালাল-হারাম বিতর্ক। টিকার হালাল-হারাম বিতর্ক বড় ভাবে শুরু হয় ইন্দোনেশিয়ায়। ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ জেলাটিন ব্যবহার করা হয় বলে ইন্দোনেশিয়ায় ২০১৮ সালে হাম ও রুবেলার টিকাকে হারাম ঘোষণা করে দেশটির সর্বোচ্চ ওলামা কাউন্সিল। এই ঘোষণার পর দেশটিতে সাধারণ নাগরিকগণের মধ্যে তাদের সন্তানকে টিকা না দেয়ারও প্রবণতা দেখা দেয়। যার ফলে হামের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় দেশটিতে। ইমুনাইজেজেশানের অভাবে হামে সংক্রমিত হওয়ার বিচারে ইন্দোনেশিয়া বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ দেশ। 'টিকা হালাল' ওলামা কাউন্সিল এই ফতোয়া দিলেও মুসলিম প্রধান দেশটির সাধারণ মানুষ আর টিকায় উৎসাহী হয়নি।

ব্রিটেনের মতো দেশেও হালাল-হারাম বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ব্রিটেনের কয়েকজন মুফতি একটি ফতোয়ায় সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বায়োএনটেকের টিকাকে 'হালাল' বলে ঘোষণাও দেন। কিন্তু তাতেও থামেনি বিতর্ক। আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বে প্রথম করোনাভাইরাসের টিকা দেয়া শুরু করে যুক্তরাজ্য। তখনই শুরু হয় এ বিতর্ক। ফাইজারের এই টিকায় যে কোলেস্টেরল ব্যবহার হয়েছে তা শূকরের কিনা এই সন্দেহে ব্রিটেনে মুসলিমদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দেয়। ইসলামসম্মত নয় এই কারণে 'টিকা হারাম' বলে বিতর্ক শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ বিতর্ক অবসানে ব্রিটিশ ইসলামিক মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন- বিআইএমএ বিবৃতি দেয়। বিআইএমএ এ বিষয়ে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং বায়োটেক বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ করে নিশ্চিত করে, টিকা তৈরিতে কোনো পশুজাত উপাদান ব্যবহার করা হয়নি। সংরক্ষণ ও সরবরাহ সুবিধার জন্য স্ট্যাবিলাইজার হিসেবে টিকাতে শূকরের চর্বিজাত জেলাটিন ব্যবহার করা হয়। হালাল হারাম বিবেচনায় অনেক মুসলিম প্রধান দেশ বিকল্প টিকার কথা ভাবছে। সৌদি আরব এবং মালয়েশিয়ার দুটি ফার্মা জায়ান্ট নিজেরাই হালাল টিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে।

নীতিকাঠামোর বৈষম্যের কারণে বিত্তের মেরুকরণ বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। পিছিয়ে পড়া ও ঝুঁকিপ্রবণ নিম্নমধ্যবিত্ত ও এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণিও প্রান্তবর্তী হয়ে পড়ছে। বরাবরের মতো সম্পদ কতিপয়ের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রবণতা জারি আছে। 'বাংলাদেশ প্যারাডক্স' মেনে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, মহামারীর মধ্যেও কোটিপতি বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২ জন। ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে শীর্ষে বাংলাদেশ। আর অন্য দিকে দারিদ্র্য হার ও বৈষম্য বাড়ছে। ১৯২৯-এর 'গ্রেট ডিপ্রেশন' বা মহামন্দার প্রতিধ্বনি শুনতে পান অনেক অর্থনীতিবিদ। সেই 'গ্রেট ডিপ্রেশন' এর সময় মার্কিন ব্যাংকার আর্থার ডব্লিউ লোয়াসবি বলেছিলেন, ''আমার কোনও ভয় নেই, কারণ এর (গ্রেট ডিপ্রেশন) সঙ্গে তুলনা করা চলে এমন কোনও পতন আর হবে না।'' এমন অভূতপূর্ব ২০২০ পার করে ২০২১-এ পড়ল বিশ্ব।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করার পথ খুঁজতে কোনো কোনো দেশ তথাকথিত 'ইমিউনিটি পাসপোর্ট' ইস্যুর চিন্তা করেছিল জুলাই মাসের দিকে। এর মানে দাঁড়ায় আপনার করোনাভাইরাস ছিল কিন্তু এখন আপনি তা বহন করছেন না। পাশাপাশি আপনি আর করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হবেন না। যার কাছে এই পাসপোর্ট থাকবে তার ভ্রমণের ক্ষেত্রেও কোনো বাঁধা নেই। 'ইমিউনিটি পাসপোর্ট' ধারণকারীরা এ প্রক্রিয়ায় একটি এলিট শ্রেণি তৈরি করবে কিনা, সে প্রশ্ন করেছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রফেসর রবার্ট ওয়েস্ট। তার মতে এ ধরনের সার্টিফিকেট সমাজে বৈষম্য তৈরি করতে পারে। ভয়াবহ এক বৈষম্যমূলক চিন্তা অবশ্য বেশি দূর এগোয়নি কিন্তু করোনাভাইরাসের টিকা এমন বিভাজন বৈষম্য তৈরি করবে না সেই সাথে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ বিরোধ তৈরি করবে না এমন নিশ্চয়তা কি দেয়া যায়?