জঙ্গি হামলা: দুই বিচারকের আত্মদান হোক বিচারকদের নির্ভীক পথ চলার প্রেরণা

এম ইনায়েতুর রহিম
Published : 12 Nov 2020, 02:44 PM
Updated : 12 Nov 2020, 02:44 PM

২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর সকালে ঝালকাঠি জজশিপের দুইজন বিচারক, সিনিয়র সহকারী জজ জগন্নাথ পাঁড়ে এবং এস সোহেল আহমেদ যখন সরকারি বাসভবন হতে কর্মস্থলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আদালতের একটি মাইক্রোবাসে আরেকজন বিচারকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তখন তাদের উপর উগ্র-ধর্মান্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে বর্বোরোচিত ও পৈশাচিক বোমা হামলা চালায়। বোমা হামলায় ওই দুই সহকারী জজের দেহ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়, ঘটনাস্থলেই তাদের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয় মাইক্রোবাসটিও। হামলাকারীদের একজন, ইফতেখার হাসান-আল-মামুন ওরফে শিহাব-কে আহত অবস্থায় পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত লিফলেট থেকে এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ও জঙ্গি গোষ্ঠীর পরিচয় পাওয়া যায়। উদ্ধারকৃত লিফলেটে বক্তব্য ছিল 'মানব রচিত আইন মানি না। তাগুদি আইন মানি না। মানব রচিত আইন বাতিল কর।' সংগঠনের নাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ।

এ ঘটনার তিন মাস আগে ১৭ অগাস্ট দেশের ৬৪টি জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় একই সময় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণসহ দেশের বিভিন্ন আদালত এবং কালেক্টরেট ভবনসহ সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিস প্রাঙ্গণে। ওই ঘটনায় হতাহত বা সম্পত্তির ক্ষতি তেমন ছিল না। কিন্তু প্রতিটি বিস্ফোরণ স্থলে পাওয়া গিয়েছিল একই বক্তব্যের লিফলেট। লিফলেটে বোমা বিস্ফোরণকারীদের পরিচয় ও উদ্দেশ্য উল্লেখ ছিল। লিফলেটে দেশের সংবিধান, প্রচলিত আইন ও বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে উল্লেখ করা হয়েছিল- 'তাগুদি আইন মানি না, কোরআনের আইন চালু কর, মানব রচিত আইন বাতিল কর।' সংগঠনের পরিচয় দেওয়া হয়েছিল উপরোক্ত সংগঠনটির।

ঝালকাঠির ওই মর্মান্তিক ঘটনার সময় সদ্য প্রয়াত মাহবুব আলম এবং আমি যথাক্রমে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। এই ন্যাক্কার জনক ঘটনার প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির আহ্বানে ১৭ নভেম্বর সারাদেশে সকল পর্যায়ের আদালত বর্জন করা হয়। সমিতির পক্ষ হতে নিহত বিচারকদ্বয়ের প্রত্যেক পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। কিন্তু সে সময়ে সরকার নিহত বিচারকদের পরিবারের প্রতি তেমন কোন সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন মর্মে জানা নেই; বরং অভিযোগ ছিল জঙ্গি গোষ্ঠীর পেছনে তৎকালীন সরকারের পৃষ্টপোষকতার। সে সময়ের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, পরবর্তীতে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে যার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, গণমাধ্যমে বলেছিলেন- 'জঙ্গি মিডিয়ার সৃষ্টি, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি'।

ওই ঘটনার ৫/৬ দিন পরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষে আমরা ঝালকাঠি যাই। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পেয়েছিলাম বিধ্বস্ত মাইক্রোবাস এবং সংলগ্ন একটি গাছে ঝুলে থাকা মাংসপিণ্ড ও রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। বিভৎস করুণ দৃশ্য দেখে আমাদের সকলের শরীর ভয়ে শিহরিত হয়েছিল। পরে ঝালকাঠি আইনজীবী সমিতিতে গিয়ে আমরা প্রতিবাদ সভা করি। স্থানীয় আইনজীবীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান ও জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। বিচারকদের সাথেও মিলিত হয়ে তাদের মনোবল অটুট রাখা এবং ধৈর্য ধারণ করে কোন অপশক্তির হুমকিতে ভীত না হয়ে বিচারকার্য অব্যাহত রাখার তাদের দৃঢ় অঙ্গিকারের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করি।

আমরা ভোলায় সোহেল আহমেদের কবর জিয়ারত করি, তার পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করে দেশের আইনজীবী সমাজের সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাই। জগন্নাথ পাঁড়ের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটায় হলেও তাকে দাহ করা হয়েছিল বরিশাল শ্মশানঘাটে। আমরা সেখানেও গিয়েছিলাম। বরিশাল শহরে তার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রী ও স্বজনদের সমবেদনা জানাই। সে সময়ে তাদের একমাত্র সন্তানের বয়স ছিল ২/৩ বছর।

ঝালকাঠিতে বোমা হামলার মাত্র কয়েকদিন পর অর্থাৎ ২৯ নভেম্বর গাজীপুর আইনজীবী সমিতি-র একটি ভবনে আদালতের কার্যক্রম শুরুর পূর্ব মূহুর্তে জঙ্গিরা আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। একজন আত্মঘাতী আইনজীবীদের ব্যবহৃত কালো গাউন পরে ওই ঘটনাটি ঘটায়। ওই হামলায় চার জন আইনজীবী, তিন জন বিচারপ্রার্থীসহ আত্মঘাতী জঙ্গি নিহত হয়। ওইদিন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির উদ্যোগে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায়, আমি পয়লা ডিসেম্বর সারাদেশে হরতাল পালনের প্রস্তাব উপস্থাপন করলে সাধারণ আইনজীবীরা অকুণ্ঠভাবে ওই প্রস্তাবে সমর্থন জানায়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আহুত ওই হরতালে সমর্থন জানিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল-জোট ছাত্র-শ্রমিক-পেশাজীবী-সাংস্কৃতিক সংগঠন; এমনকি ওই রাজনৈতিক দল ও সংগঠন- যারা সে সময় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচীর বিরুদ্ধে ছিল। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির আহ্বানে 'দেশব্যাপী হরতালের' ব্যতিক্রম কর্মসূচিতে দেশের সকল স্তরের মানুষের ছিল স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। হরতালে পয়লা ডিসেম্বর ২০০৫ সারাদেশ স্থবির হয়ে যায়-পালিত হয় শান্তিপূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের সাথে রাস্তায় নেমে আসেন ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী-সহ সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষ। রাজপথে ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-জোট ও শ্রমিক সংগঠনও।

জঙ্গিদের প্রধান টার্গেট ছিল বিচার ব্যবস্থার উপর। দুইজন বিচারকের হত্যা মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ঝালকাঠির বিজ্ঞ অতিরিক্ত দায়রা জজ ২৯/০৫/২০০৬ইং তারিখের রায় ও আদেশে সাত জঙ্গিকে দণ্ডবিধির ১২০খ/৩০২/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে ফাঁসির সাজা দেন। বিচারের সময়ে আদালতে জঙ্গিদের বক্তব্যসমূহ হতে প্রমাণ পাওয়া যায় দেশের প্রচলিত আইন-আদালত ও বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের সশস্ত্র অবস্থানের কথা। মামলার অভিযোগ গঠনের সময় জঙ্গি নেতা আব্দুর রহমানকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পড়ে শোনানো হলে তার জবাব ছিল, 'যারা আল্লাহর আইনে বিচার করে না তাদের হত্যা করার জন্য আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম। আমার নির্দেশে বিচারক দুইজনকে হত্যা করা হয়। মানুষের আইনে আমি দোষী, আল্লাহর আইনে নির্দোষ। আমি কোন আইনজীবী নিয়োগ করিব না।'

সিদ্দিকুল ইসলাম প্রামানিক ওরফে 'বাংলা ভাই' আদালতে বলেছিল, 'যে মামলায় আমাকে অভিযুক্ত করা হইয়াছে তাহাতে আমি নির্দোষ। আল্লাহর আইনে বিচার চাই। মানুষের আইনে বিচার চাই নাই। কোন আইনজীবী নিয়োগ করিব না'। অন্যান্য অভিযুক্ত-আব্দুল আউয়াল, মামুন, আতাউর রহমান সানি, আমজাদ সকলেই একই ভাষায় আদালতকে জানিয়েছিল তারা মানুষের তৈরি আইনে বিচার চান না, আল্লাহর আইনে বিচার চান। তারাও নিজ নিজ পক্ষে আইনজীবী নিয়োগে অস্বীকৃতি জানান।

সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন শেষে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৩৪২ অনুসারে অভিযুক্তদের পরীক্ষা করার সময়ে আব্দুর রহমানের বক্তব্য ছিল, "…আমরা বাংলাদেশের প্রচলিত আইন মানি না। আমি আল্লাহর আইনে বিচার চাই। আমার মতে আমি নির্দোষ, আমরা এদেশের প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। আমরা এদেশের বিচারক, পুলিশ এদের হত্যার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়াছি। আমি আল্লাহর নির্দেশনা মতে দল গঠন করেছি ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছি।'

অভিযুক্ত মামুনের বক্তব্য ছিল- 'শায়খ আব্দুর রহমান-এর নির্দেশে ও খালেক সাইফুল্লাহ-এর নেতৃত্বে আমি দুইজন জজকে হত্যা করিয়াছি'। অপর অভিযুক্ত আমজাদের বক্তব্য ছিল- '… পরে আমরা সশস্ত্র জিহাদ এর পক্ষ অবলম্বন করেছি। শায়খ আব্দুর রহমান এর নির্দেশে আমি ঝালকাঠিতে বোমা হামলা সংঘটন ও দুইজন বিচারক হত্যা করতে পেরে আমি গর্বিত।' এ মামলায় অভিযুক্ত মামুন ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১৬৪ অনুসারে প্রদত্ত জবানবন্দিতে দুইজন বিচারককে হত্যার উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও আক্রমন সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করেছে।

হাইকোর্ট বিভাগ ডেথ রেফারেন্স নং-৪৭/২০০৬-এ বিচারিক আদালত কর্তৃক দণ্ডিত সকলের ফাঁসির সাজা অনুমোদন করে। দণ্ডিতরা হাইকোর্টে কোন আপিল করেনি। দণ্ডপ্রাপ্ত ইফতেখার মামুন আপিল বিভাগে জেল আপিল দায়ের করে, অন্যান্যরা আপিল বিভাগে কোন আপিল দায়ের করেনি। আপিল বিভাগে দণ্ডিত আব্দুর রহমান কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে একটি দরখাস্ত দাখিল করে, যেখানে তার বক্তব্য ছিল- '… এতএব যারা মানুষের তৈরী করা সংবিধান, বিধান বা আইনের কাছে বিচারপ্রার্থী হয় তারা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করলেও তারা ঈমানদার নয় বলে উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহতালা জানিয়ে দিয়েছেন। কাজেই যদি কেহ ঈমান বিধ্বংসী কাজ করে তবে মুসলিম দাবি করলেই তাকে রেহাই দেয়া যাবে না।'

দণ্ডিত 'বাংলা ভাই' আপিল বিভাগে দায়েরকৃত দরখাস্তে উল্লেখ করেছিল, '… তাই মুসলিম হিসেবে এ আইনে বিচার প্রার্থী হলে ঈমান থাকবেনা। আমি কোর্টে আপিল করিব না।'

অপর দণ্ডিত আব্দুল আউয়াল তার দায়েরকৃত দরখাস্তে উল্লেখ করে '… আমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিরুদ্ধে মহামান্য উচ্চ আদালতে লিভ টু আপিল করতে ইচ্ছুক। যদি আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয় এবং ইসলামী বিধান অনুযায়ী বিচার কার্য পরিচালনা করা হয়।…  অতএব আমার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে ইসলামী জুড়ি বোর্ড গঠন করে আল্লাহর আইনে পুনরায় বিচার করার আবেদন করছি, অন্যথায় সম্ভব না হলে আমার বিচার তাগুদি আইনে না করার আবেদন করছি।'

আপিল বিভাগ দণ্ডিতদের এ সকল দাবি ও বক্তব্যকে 'অলীক স্বপ্ন' (imaginary dream) মর্মে অভিহিত করে অভিমত দিয়েছে যে, আমাদের সংবিধানে এ ধরনের বিচার পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দেয় না। ইসলামি আইনে বিচারের দাবি 'আজগুবি ধারণা (utopian concept) এবং আমাদের বিচার ব্যবস্থায় এটি একটি অজানা বিষয়। [ডি এল আর-৫৯, পৃ: ৩৫ (এডি)]

আপিল বিভাগের রায়ে আরো অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, "ইসলাম শান্তির ধর্ম। দণ্ডিতিরা পবিত্র ইসলামের নাম ব্যবহার করে দেশের প্রচলিত আইন-বিচার ব্যবস্থাকে অচল করার 'হিংস্র পাগলামি তৎপরতায়' (wild mad struggle) লিপ্ত হয়ে দুইজন বিচারককে হত্যা করেছে। ইসলাম কি এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে? হতভাগ্য ওই দুইজন বিচারকের উপর কি ইসলামী আইন প্রণয়নের দায়িত্ব ছিল? ইসলাম কি ধর্ম পালনে জবরদস্তি বা শক্তি প্রয়োগ অনুমোদন করে? দণ্ডিতরা ইসলামের নামে গর্হিত পাশবিকতার যে পথ বেছে নিয়েছে তা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে'। রায়ে পবিত্র কোরআন শরীফের সূরা মায়িদার ৩২ নং আয়াত উদ্ধৃত করা হয়েছে; যেখানে উল্লেখ আছে- 'নরহত্যা অথবা দুনিয়ার ধ্বংসাত্মক কার্য করা হেতু ব্যতিত কোন ব্যক্তি যদি অপর কোন ব্যক্তিকে হত্যা করে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই (মানবজাতি) হত্যা করল। আর কেউ যদি কারো প্রাণ রক্ষা করে সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।' প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ওই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (ঝালকাঠির পাবলিক প্রসিকিউটর) মো. হায়দার হোসাইনকেও জঙ্গিরা পরবর্তীতে হত্যা করে।

শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম 'ইসলাম' কখনই গুপ্ত হত্যা কিংবা আত্মঘাতী হয়ে কাউকে হত্যা অনুমোদন করে না। রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ) বদরের যুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনও তার সহযোদ্ধা বা সাহাবাদের শত্রু পক্ষের কাউকে গুপ্ত হত্যা বা আত্মঘাতী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন এমন কোন নজির পাওয়া যায় না। রাসূল মুহাম্মদ (সা.) ঐতিহাসিক 'মদিনা সনদ' এর ভিত্তিতে মদিনা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন ধর্ম-গোত্রের মানুষকে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ করে একটি 'জাতি (কওম) রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার সূচনা করেছিলেন। 'মদিনা সনদে' চুক্তিভুক্ত মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টানসহ সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষকে একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতায় এনে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকারের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ও সম-অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছিল।

রাসূল (সা.) এর ওই 'মদিনা সনদ' বিশ্বে অনন্য নজির হয়ে আছে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আল-আমিন তার বিশ্বাসী বান্দাদেরকে চরম পন্থা পরিহার করে মধ্য পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহর ঐশী বাণী হচ্ছে- 'এভাবে আমি তোমাদেরকে এক-মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষী হতে পারো, আর রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হবেন (সূরা বাকারাঃ আয়াত-১৪৩)।'

সূরা বাকারার আয়াত ২৫৬-এ উল্লেখ করা হয়েছে, "ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই।' আর সূরা কাফিরুন -এর আয়াত-৬ এ উল্লেখ করা হয়েছে, 'তোমাদের ধর্ম তোমাদের। আমার ধর্ম আমার।' পরধর্মসহিষ্ণুতা বিষয়ে মহান আল্লাহ'র বাণী হলো, 'অবশ্য যারা ধর্ম সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোন কাজের দায়িত্ব তোমার নয়, তাদের বিষয় আল্লাহর এখতিয়ার। আল্লাহ্ তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে তাদেরকে জানিয়ে দেবেন (সূরা আন্ আম আয়াত-১৫৮)। 'তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে সকলকেই বিশ্বাস করতো। তাহলে কি তুমি বিশ্বাসী হওয়ার জন্য মানুষের উপর জবরদস্তি করবে?'

'আল্লাহর অনুমতি ছাড়া বিশ্বাস করা কারও সাধ্য নেই' (সূরা ইউনুস: আয়াত ৯৯-১০০)। 'কিন্তু তারা (মানুষ) নিজেদের ব্যাপারকে (ধর্মকে) বহুভাগে বিভক্ত করেছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে সন্তুষ্ট। তাই ওদেরকে কিছুকালের জন্য বিভ্রান্তিতে থাকতে দাও' (সূরা মুমিনুল: আয়াত ৫৩-৫৪)।

মহান আল্লাহর উপরোক্ত বাণীসমূহের আলোকে এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, ইসলাম ধর্ম নিয়ে উগ্রতা বা চরমপন্থা অবলম্বন সীমালংঘনের সামিল। 'আল্লাহ তো সীমা-অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না (সূরা বাকারা, আয়াত-১৯০)। বরং পবিত্র কোরআন শরীফে সীমালংঘনকারীদের বারবার সতর্ক করা হয়েছে।

জঙ্গিদের খোলামেলা বক্তব্য, অবস্থান ও কর্মতৎপরতা থেকে এটাই সুস্পষ্ট যে, তাদের অবস্থান বাংলাদেশের সংবিধান, আইন, বিচার ব্যবস্থা অর্থাৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। তাদের প্রধান টার্গেট ছিল বিচারক ও আইন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রাম ও যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে আবারো একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিপ্রায়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা বিভিন্ন নামে এবং অবয়বে এখনও তৎপর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে-উগ্রবাদী, জঙ্গি, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লালন-পালন পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধারাবাহিকভাবে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তি ক্ষমতায় থাকার কারণে আইন শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী জঙ্গি দমনে যথেষ্ট তৎপর ও সফলতা দেখিয়েছে এবং দেখাচ্ছে। জঙ্গি হামলায় নিহত দুই বিচারকের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাদের প্রতি অশেষ বিনম্র শ্রদ্ধা। তাদের আত্মদান হোক দেশের সকল বিচারকের নির্ভীক ও সাহসী পথ চলা এবং দেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনার প্রত্যয় ও প্রেরণা। আমরা যারা বেঁচে আছি তাদের ভুলে গেলে চলবে না- কবি জীবনান্দ দাশের 'মানুষের মৃত্যু হলে' কবিতার পংক্তিমালা-

"মানুষের মৃত্যু হ'লে তবুও মানব
থেকে যায়, অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
প্রথমত চেতনার পরিমান নিতে আসে।
. . . . . . . . . . . . . .
কতো দূর অগ্রসর হয়ে গেল জেনে নিতে আসে।"