বিশ্ব অর্থনীতিতে আরও শক্তি অর্জনের পথে চীন

Published : 31 Oct 2020, 04:43 PM
Updated : 31 Oct 2020, 04:43 PM

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের মহামারীতে প্রাণহানি আর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পাশ্চাত্যের অনেক দেশই বেহাল। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় প্রবাহে যদি আবার লকডাউনে যেতে হয় তাহলে অনেক দেশের অর্থনীতিতেই যে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি হবে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মজার বিষয় হলো, পাশ্চাত্যের অর্থনীতিতে যেখানে ধস নেমেছে সেখানে চীন কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের এই ঘুরে দাঁড়ানো থেকে বাকি বিশ্বও শিক্ষা নিতে পারে বৈকি।

প্রথমে দেখা যাক, ওদের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা কেমন। ২০২০ এর প্রথম তিনমাসে চীনের জিডিপি বার্ষিক হিসেবে দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরের চারভাগের প্রথম ভাগে (প্রথম তিনমাসে) জিডিপিতে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ সংকোচন দেখা গিয়েছিল। দ্বিতীয় অংশে সেটি ৩ দশমিক ২ শতাংশে মানে আগের অবস্থায় ফিরে আসে, আর তৃতীয় অংশে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে প্রসারিত হয়। এর মাধ্যমে বলা যায় চীনের অর্থনীতি আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ওরা কিভাবে অর্থনীতিকে চাঙা করছে আর আগামী দিনগুলোতেই বা তাদের পরিকল্পনা কী? চীনের আর্থ-সামাজিক যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পিছনে আছে তাদের কমিউনিস্ট পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টি যেভাবে পরিকল্পনা করে ঠিক সেভাবেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে অতি সম্প্রতি নতুন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি।

উচ্চমানের উন্মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাস্তবায়ন করা, 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিচালনা ব্যবস্থার সংস্কারে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে নতুন এই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়েছে চীন।

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম সম্মেলনের পঞ্চম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন ২৯ অক্টোবর রাজধানী বেইজিংয়ে সমাপ্ত হয়। সম্মেলনে চীনের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের চতুর্দশ পাঁচসালা পরিকল্পনা পর্যালোচনা করা হয়। সম্মেলনে বলা হয়, চীনে উচ্চমানের উন্নয়ন পর্যায়ের সূচনা হয়েছে এবং চীনের সার্বিক সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের মান সার্বিকভাবে উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনে সমাজতান্ত্রিক আধুনিকায়ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়।

সম্মেলনে পরবর্তী পাঁচ বছরে চীনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এসব লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে উচ্চমানের ভিত্তিতে অর্থনীতির টেকসই ও সুষ্ঠু উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা,  আধুনিকায়নে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা, উচ্চমানের বাজার অর্থনীতি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ  করা, পরিবেশ উন্নয়নে নতুন বিকাশ অর্জন ও জনজীবন নতুন পর্যায়ে উন্নীত করা।

সম্মেলনে প্রকাশিত ইস্তাহারে বলা হয়, চীন উচ্চমানের উন্মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, উন্মুক্তকরণের মান সার্বিকভাবে উন্নত করবে, অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাস্তবায়ন করবে, বাণিজ্যের নতুনধারা প্রবর্তন উন্নয়ন করবে, 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করবে এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিচালনা ব্যবস্থার সংস্কারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করব।

ইস্তাহারে  আরও বলা হয়, চীন উন্নয়ন ও নিরাপত্তা সমন্বয় করার পথে সামনে এগোবে। উন্নয়ন ও নিরাপত্তাকে জাতীয় উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও পুরো প্রক্রিয়ায় সমন্বয় করবে, আধুনিকায়নের বিভিন্ন ঝুঁকি প্রতিরোধ ও সমাধানের চেষ্টা করবে, জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সামর্থ্য জোরদার করবে এবং জাতীয় অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা  ‍ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

কিভাবে এই উন্নয়ন তারা ঘটাবে সেটার কিছু কৌশলও নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আগে রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মান উন্নয়ন।

চীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শক্তিশালী দেশ হিসেবে দাঁড়াতে চায়।  পাশাপাশি তারা প্রতিরক্ষা ও সশস্ত্রবাহিনীর আধুনিকায়ন দ্রুততর করে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে। তার মানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে তারা।

সম্মেলনে ২০৩৫ সালে চীনে সমাজতান্ত্রিক আধুনিকায়ন  বাস্তবায়নের লক্ষ্যের কথা বলা হয়। এতে বলা হয়: দেশের অর্থনৈতিক শক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিশক্তি এবং সার্বিক শক্তি উন্নত হবে, জিডিপি এবং শহর ও গ্রামের নাগরিকদের আয় নতুন পর্যায়ে উন্নীত করা হবে, নব্য প্রযুক্তি প্রবর্তনের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে, আধুনিক অর্থনীতি ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হবে, কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শীর্ষে পৌঁছার পর কমিয়ে আনা হবে উন্মুক্তকরণ কার্যক্রম নতুন র্পযায়ে উন্নীত হবে, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায়  অগ্রসর অবস্থায় থাকার চেষ্টা করা হবে, মাথাপছিু গড় জিডিপি মাঝারি উন্নত দেশের মানে উন্নীত করা হবে।

সম্মেলনের প্রস্তাবগুলো 'চর্তুদশ পাঁচসালা পরিকল্পনায়' পরিণত হবে এবং তা চীনের জাতীয় গণকংগ্রসে পর্যলোচনা করে চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করা হবে। এ পরিকল্পনা পরবর্তি পাঁচ বছরে চীনের উন্নয়ন দিক নির্দেশনা হিসেবে কাজে লাগবে।

ওদের এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশের জন্য নতুন কী পাওয়ার আছে বা জানার আছে সেটাই হলো আসল কথা। এখানে বলা হয়েছে 'এক অঞ্চল এক পথ উদ্যোগ'কে তারা আরও শক্তিশালী করবে। এক অঞ্চল এক পথ (ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড) হলো নতুন শতকে এশিয়ার আঞ্চলিক উন্নয়নে চীনের সবচেয়ে গতিশীল ও ব্যাপক উদ্যোগ। এর ভিতরে রয়েছে বাংলাদেশও। বাংলাদেশে চীনের যে উন্নয়ন অংশীদারিত্বের কাজগুলো চলছে তা এই এক অঞ্চল এক পথের সঙ্গে সংযুক্ত। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা চীনে লেখাপড়ার জন্য যে বিপুল সংখ্যক স্কলারশিপ পাচ্ছে সেটাও এই উদ্যোগের ফলেই। বাংলাদেশ যে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়েছে সেটাও এই উদ্যোগের জন্যই। ফলে এক অঞ্চল এক পথ উদ্যোগে চীন যত বেশি অর্থ ব্যয় করবে তা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে। বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ যদি বেশি হয় আমাদের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের জন্য তা অবশ্যই সুফল বয়ে আনবে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিচালনা ব্যবস্থার সংস্কারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ বাড়ানোর পরিকল্পনা প্রকাশ করে চীন এ কথাই বলেছে যে, এতে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তার প্রভাবও বৃদ্ধি পাবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব বাড়াতে ভারত ও জাপানের সঙ্গে মৈত্রী গড়ছে। নিঃসন্দেহে এটি 'চীন-ঠেকাও' পরিকল্পনা। সেক্ষেত্রে চীনের মনোযোগ বাংলাদেশের প্রতি এখন অবশ্যই বেশি। এই মনোযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের উন্নয়নে চীনের আরও বেশি অংশীদারিত্ব, বিনিয়োগ আদায় করে নিতে পারে বাংলাদেশ।

একথা ঠিক, চীন বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে গলার কাঁটা হলো মায়ানমার। কিন্তু বাংলাদেশ যদি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়াতে পারে তাহলে এই ইস্যুও সমাধান করে নিতে পারবে নিশ্চয়ই। অন্তত সেই আশ্বাসটুকু এর মধ্যেই বাংলাদেশ পেয়েছে।

চীন তার গ্রামগুলোর দারিদ্র্য দূর করছে সমবায়ভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ, কৃষির আধুনিকায়ন, পর্যটন বাড়নো এবং ব্যক্তিপর্যায়ে ব্যবসায়িক উদ্যোগ বাড়ানোর মাধ্যমে। পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন তো রয়েছেই। এই কৌশলগুলো বাংলাদেশও যদি গ্রহণ করতে পারে তাহলে আমাদের উন্নয়নের পথ আরও সুগম হবে আশাও করা যায় বৈকি।