দূর করো দুঃশাসন দুরাচার, জনতা জেগেছে যে দুর্বার

সঙ্গীতা ইমামসঙ্গীতা ইমাম
Published : 1 Feb 2012, 02:38 AM
Updated : 28 Oct 2020, 09:27 PM

১৯৬৮ সালের উত্তাল বাংলায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে জোরদার করতে ২৯ অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। যদিও এই প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হবে আরও আগে থেকেই। উদীচী তার প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই গণমানুষের ভাষ্য নির্মাণে ব্রতী রয়েছে। তাহলে কি উদীচী প্রতিষ্ঠার আগে গণমানুষের কোন ভাষ্য ছিল না? ছিল; তবে তা রাজনৈতিক ভাষ্য। আর সাংস্কৃতিক সংগঠন থাকলেও, গণমানুষের জন্য কোন সুসংহত সাংস্কৃতিক ভাষ্য নির্মাণের আন্দোলন তাদের ছিল না। উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তের হাত ধরে উদীচীর গঠন প্রক্রিয়ায় সেই সময় সম্পৃক্ত ছিলেন মঞ্জুরুল আহসান খান, গোলম মোহাম্মদ ইদু, কামরুল আহসান খান, জাহেদুর রহিম, একরাম হোসেন, মোনায়েম সরকার, তাজিম সুলতানা প্রমুখ। ঢাকা শহরের উত্তর শান্তিবাগ এলাকায় রহিমা চৌধুরানীর বাড়িতে শুরু হয় বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধ্রুবতারা— উদীচীর কার্যক্রম।

মুক্তিযুদ্ধের আগে প্রতিষ্ঠিত বলেই বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের যে মানচিত্র, তার সঙ্গে সংগঠনের আদর্শকে যুক্ত করেই একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে উদীচী। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন উদীচীর কর্মীরা। শোষণহীন, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে ঘোষণা উচ্চারিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে, সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই উদীচী তার সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইশতেহার রচনা করেছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নিয়োজিত থেকে কৃষক শ্রমিকের ন্যায্য পাওনার জন্য হাটে-মাঠে-ঘাটে, নানা শ্রমিক অঞ্চলে গান গেয়ে বেড়িয়েছে উদীচীর গানের দল। এই গান কেবল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ছিল না, এর সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়েছিল একটি শ্রমজীবী মানুষের রাজনীতি।

পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যখন বঙ্গবন্ধুর নাম নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি, যখন রাষ্ট্রীয় মদদে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার কাজ শুরু করে একাত্তরের পরাজিত শক্তি; তখন উদীচী বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ প্রচার করে ইতিহাস কথা কও গীতিনাট্যালেখ্যে। সে সময় উদীচীকে হতে হয়েছিল ঘরছাড়া। কার্যক্রম বন্ধের সরকারি হুমকি-ধামকি মাথায় নিয়েও প্রতিবাদ জারি রাখে সাহসী এ সংগঠনটি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে বাংলাদেশ। সংবিধান থেকে বাতিল করা হয় রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক স্তম্ভ 'সমাজতন্ত্র' ও 'ধর্মনিরপেক্ষতা'। একদিকে জাতির পিতার খুনীদের দায়মুক্তি দিয়ে জারি করা হয় কুখ্যাত ইনডেমেনিটি অধ্যাদেশ, অন্যদিকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে ধর্মভিত্তিক ও যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতির সুযোগ করে দেওয়া হয়। পঁচাত্তর পরবর্তী দীর্ঘ সময়ের সেনাশাসনে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে ছিন্নভিন্ন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নানা বিধান যুক্ত হতে থাকে সংবিধানে। রাষ্ট্রধর্ম ব্যবস্থা প্রণয়ন করে স্বৈরাচার এরশাদ বাংলাদেশের বহুত্ববাদী রাষ্ট্রচরিত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। স্বৈরাচারের পতনের পর তথাকথিত গণতন্ত্রের আমলে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে মৌলবাদীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। কিন্তু উদীচী বৈরি সময়েও তার লক্ষ্য থেকে একচুল নড়েনি। মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শকে সামনে রেখে উদীচী তার পথরেখা নির্মাণ করেছে, তার ওপর দাঁড়িয়েই সকল অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার থেকে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। এ কারণেই মৌলবাদী, উগ্র, ধর্মান্ধ জঙ্গীগোষ্ঠীর প্রধান টার্গেটে পরিণত হয় সংগঠনটি। এই স্বাধীন বাংলাদেশে দুইবার মৌলবাদী অপশক্তির হিংস্র বোমা হামলার নির্মম শিকার হয় উদীচী। বাংলাদেশে বোমা হামলার মতো ঘটনার শুরুই হয় ১৯৯৯ সালে যশোর টাউন হল মাঠে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে দুটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। সেই নারকীয় হামলায় দশজন শিল্পী-কর্মীকে হারায় উদীচী। অসংখ্য মানুষ আহত হন, পঙ্গুত্ব বরণ করেন অনেকেই। পরের বোমা হামলাটি হয় ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোণায় । সেখানেও উদীচী দুজন বলিষ্ঠ সংগঠক ও অভিনয়শিল্পীকে হারায়।

উদীচী অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। কুসংস্কার আর কূপমণ্ডুকতামুক্ত সমাজ বিনির্মাণই উদীচীর লক্ষ্য। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের যে বিধান বাহাত্তরের সংবিধানে আছে, উদীচী সেই সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে চলেছে। এ কারণেই বারবার ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাজনৈতিক দলসমূহের হিংস্র আক্রমণের শিকার হতে হয় উদীচীকে।

কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে পিছ পা হয়নি উদীচী। যতবার হামলা এসেছে, উদীচী বুক চিতিয়ে তা মোকাবেলা করেছে। আঘাতের পর দ্বিগুণ শক্তিতে জেগে উঠেছে উদীচী। যশোরে বোমা হামলার পর সাধারণ মানুষ আরও সম্পৃক্ত হয়ে জেলা উদীচীর কার্যক্রমকে বেগবান করেছেন। যেদিন যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়েছিল তার পরদিন যশোরের সকল ফুল বিক্রেতারা ফুল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছিলেন এর প্রতিবাদে। সুতরাং গণমানুষের সংগঠন উদীচী কখনোই কোন হুমকি বা ভয়ে আদর্শচ্যুত বা কর্তব্যচ্যুত হয়নি। আগামীতেও হবে না এই অঙ্গীকারেই আমরা কাজ করে চলেছি।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে ২০১৩ সালের শাহাবাগ আন্দোলনে উদীচী বলিষ্ঠ ও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছে। সারাদেশে উদীচীর সকল শাখা এই আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য সম্মিলিত শক্তি নিয়োগ করেছে। ঢাকায় শাহবাগে ২৪ ঘন্টা অবস্থান, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা আর স্লোগানের মাধ্যমে জনতার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার কাজ করেছে। আন্দোলনের নীতিনির্ধারণী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সারা বাংলাদেশে সংগঠনের প্রায় তিন শ শাখার মধ্যে অধিকাংশ জেলা শহরে কোন কোন ক্ষেত্রে উপজেলা বা থানা পর্যায়েও উদীচীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে।

আজকের প্রেক্ষাপটে যৌন নির্যাতকের অভয়ারণ্যে পরিণত হতে দেখছি বাংলাদেশকে। এই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া সেই 'সোনার বাংলা' নয়। নারী-পুরুষ শুধু নয়, সকল মানুষের সমতার বাংলাদেশ ছিল মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। সেই বাংলাদেশে প্রতিদিন ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন আমাদেরই মা বোন বন্ধু কিংবা সন্তান। শুধু যে নারীই ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, তা নয়; ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ছেলেরাও— বিশেষত মাদ্রাসার ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা। ধর্ষকরা বেশিরভাগই শাসকদলের ক্ষমতাশালী বা তাদের ছত্রছায়ার লোক অথবা মাদ্রাসার শিক্ষক। এছাড়াও ধর্ষকামী মানসিকতায় আক্রান্ত সকল পেশার মানুষ— তিনি পাদ্রীই হন, ডাক্তার, পুলিশ, শিক্ষক… যে কেউ বা যে কোন সম্পর্কের মানুষ। এই ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা রাখছে উদীচী।

উদীচী মনে করে নারী নিপীড়ন বন্ধে নারীর ক্ষমতায়ন একটি জরুরি বিষয়। একথা শুধু কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে চর্চায় রাখতে হবে বলে বিশ্বাস করে উদীচী। নারী নেতৃত্বের প্রশ্নে উদীচীর আপোষহীন একটি অবস্থান রয়েছে বলে আমি মনে করি। উদীচীর সাংগঠনিক কাঠামোতে এই চর্চা বিদ্যমান, ভবিষ্যতে তা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে বিশ্বাস রাখি।

আজ উদীচীর ৫২ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে উদীচীর বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, কর্মী, পথচলতি যে মানুষ একদিনও দাঁড়িয়ে উদীচীর গান শুনেছেন, গণচাঁদায় একটি টাকাও বাক্সে দান করেছেন, পৃথিবীর যে প্রান্তের যে মানুষ মানবমুক্তির সংগ্রামে নিয়োজিত আছেন— তাঁদের সকলকে জানাই বিপ্লবী অভিবাদন আর শুভকামনা। আগামীর সংগ্রামে আদর্শে অবিচল থাকার ব্রত নিয়ে সকলকে সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে পাওয়ার আশা রাখি।

জয় বাংলা

জয় উদীচী।