বর্ণবাদমুক্ত পৃথিবীতে পরিচয় হোক ‘মানুষ’ হিসেবে!

রাফসান নিঝুম
Published : 31 Jan 2012, 01:05 PM
Updated : 19 Oct 2020, 07:41 AM

ঘটনা এক: ইতালির সিরি আ'তে খেলছিলেন মারিও বাল্লেতেলি। গায়ের রং কালো বলে গ্যালারী থেকে শুনলেন কটু কথা। রাগে, ক্ষোভে খেলা চলাকালেই বল হাতে নিয়ে লাথি দিয়ে ছুড়ে ফেললেন গ্যালারিতে। চোখে অশ্রু নিয়ে বের হয়ে যেতে চাইলেন মাঠ থেকে। সতীর্থরা থামালেন তাকে। তবে চোখের অশ্রু জানান দিচ্ছিলো হাজারো ক্ষোভ, অপমান ও কষ্ট! এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটে তার সাথে।

ঘটনা দুই: ভারতে আইপিএল খেলতে এসেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অধিনায়ক ড্যারেন সামি। তার দলেরই এক খেলোয়াড় হিন্দী ভাষায় তাকে ডেকেছিলেন 'কালু' বলে। এই ডাকের অর্থ বুঝতে পেরেছিলেন অনেক দিন পর। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়েছিলেন সেই ক্ষোভ।

ঘটনা তিন: রাজধানী ঢাকায় আমার এক পরিচিত ব্যক্তি হাসপাতালে এক গর্ভবতী নারীকে রক্ত দিতে গিয়েছিলেন। ফোনে রক্তদাতাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, "আপনার গায়ের রঙ কী?" সাধারণত এ ধরনের প্রশ্ন রক্তদাতাকে জিজ্ঞাসা করা হয় না, তাই খানিকট বিব্রত হয়েছিলেন সেই রক্তদাতা। আসল ঘটনা ঘটে হাসপাতালে উপস্থিত হবার পর।

সেই গর্ভবতী নারীর স্বামী কোনোমতেই শ্যামলা ত্বকের এই ব্যক্তির কাছ থেকে রক্ত নেবেন না। রক্ত নিলে বাচ্চা নাকি 'শ্যামলা বা কালো' হবে। তার চাই 'ফর্সা' রক্তদাতা! ফর্সা সন্তান!!

ঘটনা চার: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে, আমার এক বন্ধু আছেন যিনি নাইজেরিয়ায় থাকেন। আফ্রিকার অঞ্চলে জন্ম, তাই তার গায়ের রঙ কালো। একদিন তার এক পোস্টে তিনি জানালেন, বাংলাদেশের কয়েকজন তাকে 'কালো' বলে সম্মোধন করেছেন। ক্ষোভের সাথে আমাকেও এই কথা জানিয়েছিলেন সেই ভদ্রলোক। আমি নিজ দেশের মানুষের এমন কর্মকাণ্ডে যতটা না লজ্জিত হলাম, তার চেয়ে বেশি অপমানিত হলাম!

ঘটনা পাঁচ: কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে ফুটবল প্রিমিয়ার লিগ খেলতে এসেছিলেন নাইজেরিয়ান এক খেলোয়াড়। স্টেডিয়ামপাড়ায় আমার সামনেই এক লোক তাকে 'কালুর বাচ্চা' বলে গালি দিয়েছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে থাকায় সেই নাইজেরিয়ান খেলোয়াড় সেই ডাকের অর্থ বুঝে যান। চলে যাওয়ার সময় স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বলে গেলেন, "আমি মানুষ, প্লিজ এইভাবে বলো না"

ঘটনাগুলো পড়ে বুঝতেই পারছেন, কি বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি। চামড়া বা শরীরের রঙ ও বৈষম্য নিয়ে। এক কথায়, 'বর্ণবাদ' নিয়ে।

সৃষ্টিকর্তা আমাকে কিংবা আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আমাদের জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, ভাগ্য ছাড়াও শরীরের রঙও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সেই হিসাবে আমরা কেউ কালো, কেউ শ্যামলা, আবার কেউবা ফর্সা।

এলাকা বা অঞ্চল, জলবায়ু, দেশ ভেদেও অবশ্য চামড়ার রঙ কালো, সাদা হয়। যেমন, আমেরিকা, ইংল্যান্ডের মানুষ জন্মগত ভাবেই ফর্সা হয়। আবার নাইজেরিয়া, কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে অর্থাৎ আফ্রিকা মহাদেশের মানুষগুলো হয়ে থাকে জন্মগত কালো।

মানুষ চামড়ার রঙ দেখে বিচার করছে যে, কার সাথে কেমন আচরণ করবে। ধনী-গরিব বৈষম্যের মতো সাদা চামড়া-কালো চামড়া নিয়ে আমরা বিবাদে জড়াচ্ছি। একবারও ভেবে দেখছি না যে, কালো চামড়াধারী লোকটির আসল পরিচয়, সে একজন 'মানুষ'। আমাদের শরীরের ভেতর দিয়ে যে রক্তপ্রবাহ চলছে, তার রঙ কালচে লাল। সাদা চামড়া হোক বা কালো চামড়া, রক্তের রঙ লালই থাকছে।

বর্ণবাদ শুধু যে আমাদের দেশের সমস্যা, তা কিন্তু নয়। বর্ণবাদ পুরো বিশ্বের সমস্যা। দিন কে দিন আমরা মনুষ্যত্বকে বিক্রি করে, শুধু নিজেদের দাম্ভিকতাকে বজায় রাখার জন্য এই বৈষম্যর সৃষ্টি করে যাচ্ছি। কিন্তু দিনশেষে তা শুধু মানুষ জাতিরই ক্ষতি হচ্ছে এবং আমাদের মানসিকতার ভিন্ন এক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। বর্ণবাদের বিষয়টা হয়তো ছোটবেলা থেকে আমাদের ব্রেইনে ইন্সটল করে দেওয়া আছে। যা বড় হওয়ার সাথে সাথে শুধু আপডেটই হচ্ছে।

স্কুলে থাকাকালীন, আমার ক্লাসেরই এক শিক্ষার্থীকে সবাই 'কাইল্লা' বা 'কালু' বলে ডাকত। "ওই, কাইল্লা অমুক এইদিকে আয়!" সংগতকারণেই আমি তার নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। শুধু যে অন্যরা বলত এমনটা কিন্তু না। স্কুলের শিক্ষকেরাও তাকে এই একই নামে ডাকত। জেনে কিংবা না জেনেই আমি নিজেও তাকে এই নামেই ডেকেছি। খেয়াল করে দেখেছি, এত বড় হয়ে যাবার পরেও বন্ধুমহলে এখনো তাকে গায়ের সেই কালো রঙকে প্রাধান্য দিয়েই ডাকা হয়। আমি জানি না সেই বন্ধু কেমন অনুভব করে। তবে এটি যে তাকে বারবার বিব্রত ও অপমানিত করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

জনপ্রিয় ও কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলী এক রেস্তোরায় চাকরি পাননি কালো বলে। রেস্তোরা মালিক জানিয়ে দিয়েছিলেন এখানে শুধু সাদারা কাজ করে!

আমরা অনেকেই অনেক সময় বলি, কালো আমাদের প্রিয় রঙ। কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো জুতা, ঘড়ি। ওহ, ব্যাপারগুলোই খুব ক্লাসি ও স্টাইলিশ! কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ কালো হলেই যত সমস্যা!

আমার পরিচিত এক আপু কয়েক মাস আগে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানিয়েছিলন, পাত্রপক্ষ বলেছেন তিনি নাকি আরেকটু ফর্সা হলে ভাল হতো! আপু অবশ্য, এই কথার প্রতিবাদ না করে ফেইসবুকে জানিয়েছিলেন, কালো হওয়াতে তিনি লজ্জিত নন। বরং ফর্সা মানুষের অন্তরের কালো বর্ণ দেখতে পেয়ে তিনি আনন্দিত। কমেন্টে অনেক মানুষ তাকে সমর্থন করেছিলেন শুধু তার এই মনোভাবের জন্য।

কালো রঙ নিয়ে অবশ্য একটা কুসংস্কার আছে আমাদের এই সমাজে। তা হলো, গর্ভকালীন সময়ে কিছু খাদ্য সামগ্রী মাকে খাওয়ালে নাকি পেটের সন্তান ফর্সা হয়। অর্থাৎ জন্মের আগে থেকেই ফর্সা বানানোর প্রতিযোগিতা চলে। এই প্রতিযোগিতায় কিন্তু হেরে গেলে চলবে না। কালো সন্তানকে ফর্সা বানানোরও উপায় আছে।

গায়ের রঙ ফর্সা করা নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন বিজ্ঞাপণও দেখা যায় বিভিন্ন জায়গায়। এক সপ্তাহে ফর্সা করে দেওয়ার মতো জাদুকরি ক্রিম, পাউডার পাওয়া যায় এই গ্রহে।

১৯৯৯ সালের একটা পরিসংখ্যান মনে করিয়ে দিতে চাই। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের সেই প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন চারটি পত্রিকায় ছাপা বিয়ের বিজ্ঞাপন নিয়ে গবেষণা করেন। ৪৪৬টি বিজ্ঞাপনের মধ্যে ২২০টিতে সরাসরি উল্লেখ করা হয়, পাত্রীর গায়ের রং ফর্সা হওয়া নিয়ে! ২২২টি বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয়েছিল সুন্দরী, প্রকৃত সুন্দরী, অসামান্য রূপসী, রূপসী, অপূর্ব সুন্দরীর মতো শব্দ!

অর্থাৎ, কালো হলেই বিয়ের বাজারে আপনার গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে।

দেশের প্রথম অনলাইন ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেইসবুকের মতো বড় প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়েও বর্ণবাদের শিকার হতে হয় কৃষ্ণাঙ্গ, হিস্পানিক এবং নারী কর্মীদের।

সংবাদমাধ্যম বিবিসি'র একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র থেকে ১৯০৪ সালে অপহরণ করা হয় 'ওটা বেঙ্গা' নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে। ১৯০৬ সালে তাকে কয়েক সপ্তাহের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে বড় চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচায় আটকে রাখা হয়।

ইন্টারনেটে একটু রিসার্চ করলেই হয়তো এই রকম শতাধিক তথ্য পাওয়া যাবে। বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যমে যা নিয়ে হরহামেশাই সংবাদ তৈরি হচ্ছে।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। অথচ মানুষের কর্মকাণ্ডে তা কখনোই প্রকাশ পায় না। মাঝে মাঝে আমি ভাবি, এ কোথায় যাচ্ছি আমরা, আমাদের সমাজ, আমাদের পৃথিবী। 'মানুষ' হিসাবে পরিচয় না দিয়ে পরিচয় কি দেব "আমি শ্যামলা মানুষ" বা "আমি ফর্সা মানুষ"? গায়ের রঙই কি তাহলে আমাদের পরিচয়ের মানদণ্ড!

সমাজের আর দশটা সমস্যার মতো বর্ণবাদও একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। ভাবুন তো, যিনি আমাকে আপনাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি যদি কালো রঙ দিয়ে আমাদেরকে বানাতেন। এবং সেই রঙ এর জন্য যদি আপনার সহকর্মী, বন্ধু কিংবা প্রতিবেশীর কাছ থেকে কটুক্তি শুনতেন, তাহলে আপনার কেমন লাগত? নিজের উপরে কি জিদ আসত না? মানুষের ওপরে কি আপনার ক্ষোভ জন্মাতো না? কিংবা এক পর্যায়ে যেয়ে নিজেকে অসহায় মনে করতেন না? ভাবুন তো, আপনি যাকে কালো বলে অসম্মান করছেন, তার কেমন লাগে এই কথাগুলো শুনে!

আমার এই লেখা যে বিশ্ববাসীকে বর্ণবাদমুক্ত করে দিবে, তা আমি স্বপ্নেও কোনোদিনও ভাবি না। তবে এই লেখা পড়ে কোনো ব্যক্তি যদি নিজের অজান্তেই তার বর্ণবাদ বৈষম্যের ভয়াবহতা বুঝতে পারেন, তাইলেই এই লেখার সার্থকতা।

না হলে, হাজার হাজার লেখার মতো এই লেখার পেছনে সময় ও শ্রম দু'টাই ব্যর্থ।

লেখাটা শেষ করব দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও শান্তিতে নোবেল জয়ী নেলসেন ম্যান্ডেলার বর্ণবাদ সম্পর্কে একটি উক্তি দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, "আমি বর্ণবাদকে ঘৃণা করি, কারণ এটাকে আমি বর্বর জিনিস হিসেবে বিবেচনা করি। বর্ণবাদ – সে কালো বা সাদা যার কাছ থেকেই আসুক না কেন।"

(দ্রষ্টব্য: এই উক্তিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত)

তথ্যসূত্র: